গুচ্ছ কবিতা – শান্তা মারিয়া

By Published On: September 30, 2022

ছাব্বিশ বছরের পুরনো বিকেল

খুব পুরনো ক্ষয়ে যাওয়া মৃদু আলোর দিকে তাকালে
ছাব্বিশ বছরের পুরনো বিকেল ভেসে ওঠে।
তারা ভেসে যায় মন্দাকিনী স্রোতে
সেই বিকেলটিকে কোনো এক উচ্চাভিলাসিনী
গোড়ালি ধরে স্নান করিয়েছিল স্ট্রিক্সের অমৃতধারায়
ও তাই অমরত্ব পেয়ে গেছে।
যদিও দুর্বল কোনো মুহূর্তের ফাঁদে
সে হয়তো পা দিবে বিস্মৃতির অতলে।
ছাব্বিশ বছরের সেই বিকেল সামনে এসে দাঁড়ালো যখন
বড় সাধ হলো তার হাতে একবার
না হয় রাখা যাক দুটি অগ্নিদগ্ধ হাত
একবার ডাকা যাক প্রিয় সম্বোধনে।
সূর্যডোবা অন্ধকার, মোহিনী সন্ধ্যা, ভোরের মুগ্ধতা কোনো কিছু নেই।
কোনো কিছু নয়। আহা, সেই পুরনো বিকেল
একটিবার ছাতিমফুলের সৌরভ নিয়ে নাহয় বিছাক আসন।

তারাখসা রাতের সিম্ফনি

মোমের নরম আলো
দূরাগত নক্ষত্রের উষ্ণতায়
মৃত্যুকে আবৃত করে।
উন্মোচিত হয় জীবনের অনন্ত আকুতি।
সময়ের মৃদুল প্রবাহে ভেসে যায়
সেইসব তারাখসা রাত, ফাগুন পূর্ণিমা, দোলের আবীর।
যজ্ঞের আগুন ছেড়ে উঠে আসে স্বাহা
চোখ মেলে ভস্মীভূত প্রেম।
চন্দ্রজ সংগীত বাজে
দূর, বহু দূরবর্তি জীবনের প্রাচীন মন্দিরে।
তখন কেবল রাত, সুবর্ণ রোদ্দুর তখন কেবল স্মৃতি
হরিকেলে অচেনা বন্দরে তখনো নোঙর করে
দুধসাদা ডিঙা মধুকর।
পার্বতীর কেশ থেকে ঝরে পড়ে অনার্য কুসুম।
ধান, দুর্বা, সুপারিতে গৃহকোণে আলো দেয়
মহালক্ষ্মী, ঢাকেশ্বরী।
সেইসব নিবিড় নিশীথে
নিমগ্ন, নিভৃত নক্ষত্রের মরাল সংগীতে,
কাঁসার থালায়, মাটির প্রদীপে
রয়ে গেছে আমাদের যাবতীয় বিনিময়
শব্দহীন দৃষ্টির অক্ষরে।

না ভাসাইয়ো জলে

লখিন্দর দিয়েছিল প্রথম চুম্বন
আদিম কুমারী নাগিনীর ওষ্ঠপুটে।

কথা ছিল পাড়ি দিব দূর রেলপথ
পাহাড় চূড়ায় গড়ে নেবো নিজস্ব নগর
তাহিতির নীল জলে ঝিনুক প্রাসাদ
আফ্রিকার উপকূলে অরণ্য বসতি
কথা ছিল হাতের মুঠোয় পুরে নেবো
নৈনিতাল, বারানসী, আগ্রার মহল।

মৃত মাছ হয়ে ভেসে ওঠে সব গোপন বাসনা
বারো হাত কাকুঁড়ের জীবন খাঁচায়
শ্বাসরুদ্ধ আমাদের বিস্মৃত কামনা।

আগামি জন্মের জন্য তুলে রাখি এসো
যৌথ বৃষ্টি স্নান, কালো ড্রাগনের ঘর
মেঘমগ্ন নিবিড় দুপুর, সীতাহার,
আশ্বিনের ভোরবেলা, সেতার সংলাপ।
এক জীবনের যাবতীয় ঋণ শোধ করে
মৃত্যু অভিমুখে হেঁটে চলে নিষাদ কাফেলা।

মৃত্যু নয় চূড়ান্ত কখনো
মৃত্যু নয় বিচ্ছেদ নগর
দেখা হবে অন্য কোনো গ্রহে
অন্য কোনো সময়ের বাঁকে।
না হয় আরেক বার ধরা যাবে হাত
শোনা যাবে নাবিকের জাহাজী সংগীত
দেখা হবে রেশমপথের ধারে
দীপজ্বলা সরাইখানায়, ভক্তপুরে, সিয়ান নগরে।
এ জন্মের মতো শেষ হোক রাসলীলা
শেষ হোক পূর্ণিমার মোহন উৎসব
ক্লান্ত চোখে নেমে এসো ঘুম, এসো প্রেম,
এসো মৃত্যু, মৃন্ময় আবাস, আচ্ছাদন
সর্বশেষ আলিঙ্গনে বিদায় সুপ্রিয়।

হেমন্তের শেষ প্রেম রঙিন মৃত্যু

আজ এই হেমন্তের দিনে
রঙিন পত্র হয়ে ঝরে যাক শেষ প্রেম
তুষারের আগমন কান পেতে
শোনা যাক এসো
মাটির গভীর স্তরে
মৃতদের শবাধারে
ভালোবাসার নিগূঢ় আশ্বাস।
জীবনের চন্দ্রমায়
ঝুলে আছে মৃত্যুর চাদর
রাসলীলা শেষ হলে
শুরু হোক
চিতার আদর।

অনার্য কোজাগরী

বাংলার আকাশ জুড়ে বহমান কোজাগরী রাত
শিকড়ের গান গায় ভেজামাটি, বকের পালক
কুমারীর হাতে জ্বলে কবেকার লক্ষ্মীর প্রদীপ
স্তোত্রপাঠে মুখরিত আশ্বিনের প্রাচীন পূর্ণিমা।
রক্তের ভিতর ওড়ে দুধসাদা প্যাঁচার শাবক
ধূপের সুবাসে ভাসে শিশিরের নিভৃত আলাপ।
ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ অন্ধকারে ঘন হয় আরো
মাটির গভীর স্রোতে কানপেতে শোনা যাক এসো
জলের বাতাসী গান, ফসলের আদিম ইশারা ।
অপরূপ খোলাচুল, সাদাশাঁখা, রক্তিমসিঁদুর
প্রবারণা জেগে থাক প্রেমিকের উদাসীন চোখে
কোজাগরী, কোজাগরী, বরমাল্য কার হাতে বলো,
রূপালি ফানুস ওড়ে সুপ্রাচীন লক্ষ্মীর অন্তরে।
অনার্য আকাশে আজ নিজস্ব নক্ষত্র জ্বলে
কমলে কামিনী হাসে শঙ্খপাড় নদীর প্রবাহে
অন্ধকারে ভেসে যায় আকাঙ্খার মাটির প্রদীপ।

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop