নিরাপত্তাহীন কোন মানুষের জন্য ভালবাসাও বদল হয়ে যায় – ইসমত শিল্পী

By Published On: December 20, 2021

নিরাপত্তাহীন মানুষের জন্য ভালবাসাও বদল হয়ে যায়। এবং প্রতিশোধ নেয়ার চাইতে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারা অনেক বেশি সম্মানের। দুই ই শেখার।
বলছি কেনো ? কিছু মানুষ কোনো না কোনোভাবে নিজের কাছেই সর্বপ্রথমে নিরাপত্তাহীন। একে কী অসহায়ত্ব বলবো, নাকি ব্যক্তিত্বহীন ? তাও না। মানুষের উৎকৃষ্ট নির্ভরতার স্থানটি সর্বপ্রথম নিজেরে উপর। নিজের উপরে যাদের আস্থা অবিচল তারা কোনো কিছুতেই ভয় পায় না। সেই অবিচল আস্থা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, অপরের উপরেও আস্থাশীল ভাবনা তৈরি করে। সবরকম প্রতির্কূলতা ডিঙিয়ে লক্ষ্যে পৌছোনোর এক অদম্য স্পৃহাও মানুষ নিজের কাছ থেকেই পায়। নিরাপত্তাহীন মানুষ অন্যকে ভয় পায় মানে নিজের উপর আস্থা থাকে না। সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, দ্বিধান্বিত থাকে। সময়কে গোছাতে গোছাতে জীবনের অনেক পৃষ্ঠা না পড়া থেকে যায়। সবথেকে মর্মান্তিক কথা, এমন কাউকে ভালোবেসে ফেললে জীবন নাজেহাল হয়।

আস্থাশীল মানুষ অপরকেও ততখানিই আস্থাভাজন হিসেবে ভেবে নিতে অভ্যস্ত। কারণ দ্বিধা বলতে যা বুঝি তা যেমন নিজের উপর প্রভাব ফেলে না তেমনি অপরের বেলাতেও না। দ্বিধামুক্ত হতে পারলে কতকিছুই সহজ হয়ে যেতো আমাদের ! তাহলে কারোর মুখ থেকে এই বাক্য বেরুতো না- ‘তোমার জন্যে এতোকিছু করেছি- সব ভুলে গেলে !’ অথবা যে পীড়া আমাদের সবথেকে দহন করে বেশি, সেই কথাটি নিজেকে বলতে হতো না একবারও। ‘কেনো এতো ভালোবেসেছিলাম, কিচ্ছু বুঝলে না !’ বা ভালোবেসে দেবতাসম মানুষটাকে বলতে হতো না ‘স্বার্থপর’। নিজেকে অবহেলা করে কেনোই বা এতোকিছু ? ভুল সব ?

এই যে ‘ভুল সব’- এই যুগল শব্দ জীবনে একাধিকবারও আসে। ভুল একবার হলে আর হবে না, জীবনের অঙ্কে এমন হিসেব অবান্তর। কিছু ভুল শুধরে নিতে নিতেই অরেকটি ভুল অঙ্ক শুরু হয়ে যায়। পাতা ভরতে হবে এই অধ্যবসয় নিয়েই যেনো নেমে পড়া পথে। পাতায় পাতায় ভুল, তবুও পাতা ভরতে চাওয়া । আহ্ কী অসহনীয় যন্ত্রণা ! নিরাপত্তাহীনতার মাঝেই নিরাপত্তার খোঁজ করা। জীবনের সারমর্ম কী এখানেই। অথবা শেষই বা কোথায়; এই ভুলের মাঝেই ! একমাত্র জীবনের খাতায়ই শুণ্যস্থান বলে কিছু নেই। ভালোলাগা মন্দলাগা সুখ- দু:খ হাসি-কান্না প্রেম বিরহ ঝড় ঝাপটা, একাকিত্ব, পাওয়া না পাওয়া, কষ্ট বেদনা যন্ত্রণা আরো কতকিছু ! একটা না একটা তো থাকেই। কে বলেছে- জীবন শুণ্য ! আমি তো দেখি, জীবন কানায় কানায় পূর্ণ…

আরেকটু এগোলেই বিশ্বাস শব্দটি এসে হাজির হবে। যা সবথেকে আপেক্ষিক, সবথেকে মিথ্যে, সবথেকে অবান্তর, জবরদস্তিস্বরূপ। ইচ্ছের বিরুদ্ধেও বিশ্বাস বুকে বেঁধে বেঁচে থাকতে চায়, বিবেকের বিরুদ্ধে ভেতরে কষাঘাত করে। তাড়ানো যায় না। অথচ বিবেক ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে চাপ সৃষ্টি করার যে ক্ষমতা— এটাই বিশ্বাস। এই ক্ষমতা আমরা সৃষ্টি করে দিই। এটি কারও অর্থ সম্পদ কিংবা কারও অধিকার জবরদস্তি করায়ত্ত করে নেয়ার মতই। যে মানুষটি মনে প্রাণে স্বাধীন ছিল। আপনি জোর-জবরদস্তি করে তার স্বাধীনতা হরণ করেন। সুতরাং এ হচ্ছে দেবার অনুরূপ। যিনি বিশ্বাস করছেন তিনি দাতা, যার উপরে করছেন তিনি গ্রহীতা। তবে দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে কোনো চুক্তি ছাড়াই এই ডিড। চুক্তিবদ্ধতা থাকলে হিসেবটা ঠিক থাকতো, ভুল হতো না। জীবনের অঙ্ক হিসেব নিকেষ ছাড়া- তাই কোনো সূত্র ছাড়াই চলতে থাকে। এটাই বিপজ্জনক। এটাই ভাঙন। এটাই একসময় অসাস্থাহীনতা তৈরি করে, অবিশ্বাস জন্ম হয়। গণ্ডায় গণ্ডায় প্রশ্ন তৈরি হয়। নীতিনির্ধারকদের মতে প্রশ্নকারী সাজাপ্রাপ্ত হবেন, আসামী যেমন।

হায় ! কে সাজাপ্রাপ্ত হবার কথা আর কে সাজা পায় । এই বৈষম্য সৃষ্টির গোড়া থেকে। বর্তমানে দাঁড়িয়ে থেকে গোড়ার দিকে শুধরোতে যাবার বিন্দুমাত্র উপায় অবশিষ্ট নেই। কারণ ওটা পেছনের দিকে। বাস্তবতা কখনো থেমে যাবার পেছনে হাঁটতে পারে না, সামনে চলতেই হয়। অভ্যস্ত পদযুগল আস্থাশীল মনোভাবকে আশ্রয় করে পথ চলতে শুরু করে। থেমে যাবার জন্যে এই জীবনকে লালন পালন করবার দরকার কি ? তাই ছেড়ে দিতে শিখতে হয় বারবার, শতবার। ভুল হচ্ছে জেনেও ক্ষমা করে দিতে শিখে গেছে যে-সেইই মহান। কারণ প্রতিশোধ নেয়ার চাইতে কাউকে ক্ষমা করে দিতে পারা অনেক বেশি সম্মানের। এবং স্বস্তির। আরামের।

যার যতটুকু পাওয়ার যোগ্যতা আছে, তাকে তার বেশি দিতে নেই। এ কথা জেনেও ভুল করি বারবার; সবাই সবকিছু রাখতে পারে না, জেনেও আমরা ঢেলে দিই- উজাড় করে দিতে চাই। জীবনে এই একটিমাত্র ভুল বারবার হয়ে যায়।

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop