মৃণালিনী দেবীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি

By Published On: June 29, 2021

রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৮ সালে জুন মাসে এমনি এক বর্ষার দিনে মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লিখেছিলেন। যেখানে তাঁর দাম্পত্য দর্শনের পাশাপাশি, সংসার ও জীবন দর্শনের রূপও খানিকটা প্রতিভাত। আজ এমনদিনে সে-ই চিঠির কিছু অংশ তোমাদের জন্য নৈবেদ্য!

 

ভাই ছুটি,
আজ ঢাকা থেকে ফিরে এসে তোমার চিঠি পেলুম। আমি তাহলে একবার শীঘ্র কালিগ্রামের কাজ সেরে কলকাতায় গিয়ে যথোচিত বন্দোবস্ত করে আসব। কিন্তু ভাই, তুমি অনর্থক মনকে পীড়িত কোরো না। শান্ত স্থির সন্তুষ্ট চিত্তে সমস্ত ঘটনাকে রণ করে নেয়ার চেষ্টা কর। এই একমাত্র চেষ্টা আমি সর্ব্বদাই মনে বহন করি এবং জীবনে পরিণত করাবার সাধনা করি। সব সময় সিদ্ধিলাভ করতে পারিনে– কিন্তু তোমরাও যদি মনের এই শান্তিটি রক্ষা করতে পারতে তাহলে বোধ হয় পরস্পরের চেষ্টায় সবল হয়ে আমিও সন্তোষের শান্তি লাভ করতে পারতুম। অবশ্য তোমার বয়স আমার চেয়ে অনেক অল্প, জীবনের সর্ব্বপ্রকার অভিজ্ঞতা অনেকটা সীমাবদ্ধ এবং তোমার বাস্তব স্বভাব এক হিসাবে আমার চেয়ে সহজেই শান্ত সংযত এবং ধৈর্য্যশীল। সেইজন্যে সর্ব্বপ্রকার ক্ষোভ হইতে মনকে একান্ত যত্নে রক্ষা করবার প্রয়োজন তোমার অনেক কম। কিন্তু সকলেরই জীবনে বড় বড় সংকটের সময় কোন না কোন কালে আসেই– ধৈর্য্যের সাধনা, সন্তোষের অব্যাস কাজে লাগেই। তখন মনে হয় প্রতিদিনের যে সকল ছোট খাট ক্ষতি ও বিঘ্ন, সামান্য আঘাত ও বেদনা নিয়ে আমরা মনকে নিয়তই ক্ষুণ্ণ ও বিচলিত করে রেখেছি সে সব কিছুুই নয়। ভালবাসব এবং ভাল করব– এবং পরস্পরের প্রতি কত্তর্ব্য সুমিষ্ট প্রসন্নভাবে সাধন করব–এর উপরে যখন যা ঘটে ঘটুক । জীবনও বেশি দিনের নয় এবং সুখদুঃখও নিত্য পরিবর্ত্তনশীল। স্বার্থহানি, ক্ষতি, বঞ্চনা– এসব জিনিষকে লঘুভাবে নেয়া শক্ত, কিন্তু না নিলে জীবনের ভার ক্রমেই অসহ্য হতে থাকে এবং মনের উন্নত আদর্শকে অটল রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে । তাই যদি না হয়, যদি দিনের পর দিন অসন্তোষে অশান্তিতে, অবস্থার ছোট ছোট প্রতিকূলতার সঙ্গে অহরহ সংঘর্ষেই জীবন কাটিয়ে দিই– তা হলে জীবন একেবারেই ব্যর্থ। বৃহৎ শান্তি, উদার বৈরাগ্য, নিঃস্বার্থ প্রীতি, নিষ্কাম কর্ম– এই হল জীবনের সফলতা। যদি তুমি আপনাত আপনি শান্তি পাও এবং চারিদিকে সান্ত্বনা দান করতে পার, তাহলে তোমার জীবন সম্রাজ্ঞীর চেয়ে সার্থক। ভাই ছুটি– মনকে যথেচ্ছা খুঁৎখুঁৎ করতে দিলেই সে আপনাকে আপনি ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। আমাদের অধিকাংশ দুঃখই স্বেচ্ছাকৃত। আমি তোমাকে বড় বড় কথায় বক্তৃতা দিতে বসেছি বলে তুমি আমার উপর রাগ কোরো না। তুমি জান না অন্তরের কি সুতীব্র আকাঙ্খার সঙ্গে আমি এ কথাগুলি বল্চি। তোমার সঙ্গে আমার প্রীতি, শ্রদ্ধা এবং সহজ সহায়তার একটি সুদৃঢ় বন্ধন অত্যন্ত নিবিড় হয়ে আসে, যতে সেই নির্ম্মল শান্তি এবং সুখই সংসারের আর সকলের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, যাতে তার কাছে প্রতিদিনের সমস্ত দুঃক নৈরাশ্য ক্ষুদ্র হয়ে যায়– আজ কাল এই আমার চোখের কাছে একটা প্রলোভনের মত জাগ্রত হয়ে আছে। স্ত্রীপুরুষের অল্প বয়সের প্রণয়মোহে একটা উচ্ছ্বসিত মত্ততা আছে কিন্তু এ বোধ হয় তুমি তোমার নিজের জীবনের থেকেও অনুভব করতে পারচ– বেশি বয়সেই বিচিত্র্র বৃহৎ সংসারের তরঙ্গদোলার মধ্যেই স্ত্রীপুরুষের যথার্থ স্থায়ী গভীর সংযত নিঃশব্দ প্রীতিরি লীলা আরম্ভ হয়– নিজের সংসার বৃদ্ধির সঙ্গে বাইরের জগৎ ক্রমেই বেশি বাইরে চলে যায়– সেইজন্যেই সংসার বৃদ্ধি হলে এক হিসাবে সংসারের নির্জ্জনতা বেড়ে ওঠে এবং ঘনিষ্ঠতার বন্ধনগুলি চারদিক থেকে দুজনকে জড়িয়ে আনে। মানুষের আত্মার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই, যখনি তাকে খুব কাছে নিয়ে এসে দেখা যায়, যখনি তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ মুখোমুখি পরিচয় হয় তখনি যথার্থ ভালবাসার প্রথম সূত্রপাত হয়। তখন কোনো মোহ থাকে না, কেউ কাউকে দেবতা বলে মনে করবার কোনো দরকার হয় না, মিলনে ও বিচ্ছেদে মত্ততার ঝড় বয়ে যায় না– কিন্তু দূরে নিকটে সম্পদে বিপদে অভাবে এবং ঐশ্বর্য্যে একটি নিঃসংশয় নির্ভয়ের একটি সহজ আন্দন্দের নির্ম্মল আলোক পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকে। আমি জানি তুমি আমার জন্য অনেক দুঃখ পেয়েছ, এও নিশ্চয়ই জানি যে আমারই জন্যে দুঃখ পেয়েছ বলে হয়ত একদিন তার থেকে তুমি একটি উদার আনন্দ পাবে। ভালবাসায় মার্জ্জনা এবং দুঃখ স্বীকারে যে সুখ, ইচ্ছাপূরণ ও আত্মপরিতৃপ্তিতে সে সুখ নেই । আজকাল আমার মনের একমাত্র আকাঙ্খা এই , আমার জীবন সহজ ও সরল হোক্, আমাদের চতুর্দ্দিক প্রশান্ত এবং প্রসন্ন হোক্, আমাদের সংসারযাত্রা আড়ম্বরশূণ্য এবং কল্যানপূর্ণ হোক্, আমাদের অভাব অল্প উদ্দেশ্য উচ্চ চেষ্টা নিঃস্বার্থ এবং দেশের কার্য্য আপনাদের কাছের চেয়ে প্রধান হোক্,–এবং যদি বা ছেলেমেয়েরাও আমাদের এই আদর্শ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে ক্রমে দুরে চলে যায় আমরা দুজন শেষ পর্যন্ত পরস্পরের মনুষ্যত্বের সহায় এবং সংসারক্লান্ত হৃদয়ের একান্ত নির্ভরস্থল হয়ে জীবনকে সুন্দরভাবে অবসান করতে পারি। সেইজন্যেই আমি কলকাতার স্বার্থদেবতার পাষাণ মন্দির থেকে তোমাদের দূরে নিভৃৃত পল্লীগ্রামের মধ্যে নিয়ে আসতে এত উৎসুক হয়েছি– সেখানে কোনমতেই লাভক্ষতি আত্মপরকে ভোলবার যো নেই– সেখানে ছোটখাট বিষয়ের দ্বারা সর্ব্বদা ক্ষুব্দ হয়ে শেষ কালে জীবনের উদার উদ্দেশ্যকে সহস্রভাগে খন্ডীকৃত করতেই হবে। এখানে অল্পকেই যথেষ্ট মনে হয় এবং মিথ্যাকে সত্য বলে ভ্রম হয় না। এখানে এই প্রতিজ্ঞা সর্ব্বদা স্মরণ রাখা তত শক্ত নয়, যে—
সুখং বা যদিবা দুঃখং প্রিয়ং বা যদিবাপ্রিয়ং
প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীতে হৃদয়েনাপরিজিতা ।

তোমার রবি

 

 

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop