লুকোচুরির ছোঁয়াছুঁয়ির কাহিনী – ২য় পর্ব | সুরঞ্জন দত্ত চৌধুরী

By Published On: July 28, 2022

আমার ডেল্টা প্রেম
(রোগশয্যার পাঁচালি)

লুকোচুরির ছোঁয়াছুঁয়ির কাহিনী – ২য় পর্ব

জুনের ছয় তারিখে ভিকি হাজির দুপুরে ফেরত যাত্রার হুকুমনামা আর রথ নিয়ে। খাওয়া দাওয়া আর গুছোনোর জন্য দুঘন্টা সময় দিল। তাড়া দিল ওখানকার অভিভাবিকাদের সব দেখে শুনে দিতে। মাসখানেকতো বটেই নগরবাস! তাদের মুখের উপর যেন আচমকাই মেঘের ছায়ার আভাস। আবার শূণ্য বাড়ির পরিচর্যা? সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আরে আসছিই তো ফিরে শিগগির, ভাই থাকবে না আমি কি করব ওখানে, নগরজীবনের সুখভোগ সইবেনা একা একা।
খাওয়া দাওয়া হলো। সযত্নে আমার পুঁটুলি গুছিয়ে ল্যাপটপ ব্যাগ, ওষুধের বাক্স সব তুলে দিলো গাড়িতে ওরা। আমার ভিতরে স্নায়ুগুলি কেমন যেন টান টান হয়ে সপ্তম অক্টেভে সুর তুলেছে। যার অনুপস্থিত আশ্রয়ে এতদিন রইলাম, অথচ সকলসময় তার সাড়া পাই ঐ বাড়িতে, তাকে ছেড়ে যাচ্ছি। মন বলে,– চল, সেও তো তার আদরের ধনকে দেখতেই যাচ্ছে তোমার সাথে, টের পাওনা। বাঁ জানালা তার জন্য ছেড়ে দিয়ে ডানদিকে বসি। মেয়েরা বিদায় জানায়, দায় আছে ওদের। সব গুছিয়ে তবে তো বাড়ি যাবে ওরা। ভিকি হাত নেড়ে সচল হয়। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে হবে, পুত্রের আদেশ। এক্সপ্রেসওয়ে তে সন্ধ্যায় ট্রাকের বড্ড ভীড়। বিপদ আপদ নাকি লেগেই থাকে।
রাস্তায়।
বাড়িতে ঢুকতেই নাতির মানা, তার ঘরে ঢোকা চলবেনা। তার জ্বর জ্বর, কিন্তু কাজের কোন অসুবিধা নেই। দরজায় দাঁড়িয়ে হাসি আদর, খুণসুটি। ওর মা বাবাও কেমন যেন অস্বস্তিতে তাকাচ্ছে। ওদের শরীর কিছুটা উত্তপ্ত, ছেলের খুক খুক কাশি।
লিভিং রুমে বসেই চা বিস্কিট। দূরে দূরে বসে কথাবার্তা। বিকেলেই মেল এসেছে নাতির উপস্থিতি এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ, পরের সপ্তাহে যাবে। পরশু নয়।

এই কাশি আর গা গরম এলো কি করে? কর্মক্ষেত্রে যায়, হতেই পারে। দেশের বাড়ি থেকে ভ্রাতুষ্পুত্রের পুত্র, বংশের বড় নাতি, তার কোম্পানীতে যোগদান করল, এখানেই আছে, নীচে কয়েক দিন আগে থেকেই। অসুস্থতার লক্ষণ নিয়েই তরুণ তুর্কী নীচের ফ্ল্যাটে যন্ত্রপাতি সাজিয়েছে। সপরিবার কাশি জ্বরের আবেশ থেকেই সে এসেছে।

দেখেশুনে আমিই একটু আশংকিত হলাম৷ সমগ্র পরিবারের শারীরিক অস্বস্তি আমাকে বিষন্ন করে তুলল। আবার? প্রায় বছরখানেক নিশ্চিন্তে থাকার পর ডিসেম্বরে তাদের মায়ের আঁচলপাতা আশ্রয় থেকে ফিরে এল যখন অতিমারীর বিষ ফণা কিছুটা নামিয়ে নিস্তেজ হয়েছে লক্ষ মানুষের প্রাণবায়ু নিঃশেষ করে ! তখনই ই তো এরা সবাই এখানেই আক্রান্ত হলো, গৃহবন্দীত্বের চিকিৎসায় সুস্থও হয়ে উঠলো । পুত্রকে তো তিন দিন কাটাতেও হল নার্সিং হোমে। শক্তিহীন জীবানুকে পরাস্ত করে এরা জয়ী হলো। এখন এসব আর কেউ তেমন তোয়াক্কা করেনা। “এসো ভাই, বোসো ভাই,পানতামাক খাও, চোখের পাতা নামিয়ে বাড়ি যাও” গোছের মানসিকতায় নিয়েই ঘর করে৷ তিন চার দিন প্যারাসিটামল, চিকেন ডিম, হাই প্রোটিন ডায়েট। ফুঃ।
কিন্তু আমার শরীর তো বলতে গেলে এই দুর্মদের কাছে “ভার্জিন বডি”। হলোই বা বুষ্টার নেয়া কোভিশীল্ডের তৃতীয় ডোজে, লক লক তো করতেই পারে বীজানুর লালসার মারণ জিহ্বার।

শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই, আমার নিজের রুমের নির্দিষ্ট শয্যায় একাই দু’ রাত কাটালাম। কিন্তু পুত্র পুত্রবধু দুজনেই আমার বয়েস আর কিছু বয়েসজনিত দুর্বলতার কারণে কপালে ভাঁজ নিয়ে আমাকে লক্ষ্য রাখে।
ওদের শঙ্কা মুক্ত করতে তাদের সহমতেই আরো দিন দুয়েক নিশ্চিন্ত নির্ভয়ের আশ্রয়ে থেকে আসার জন্য ভিকিকে ডেকে ফিরে গেলাম আবার “অঞ্জনার আশ্রয়ে”। তিন চার দিন পরেই নাহয় ফিরে আসবো। ভাই এর ভুবনেশ্বর রওনার সময় উপস্থিত থাকাই তো আমার মনের সাধ। তো কি আছে, আসবো। অসুবিধার তো কিছু নেই, শুধু দূরে রাত কাটানো, এই যা।

যা বুঝিনি, টের পাইনি, তা হলো, দুবছরের পালিয়ে থাকা বর্ষীয়ান শ্রেয়সের বিরহে পাগলিনী-প্রায় প্রাণ-বিনোদিনী তার পায়ের নূপুর খুলে, ঘোমটা ঢেকে নিঃশব্দ চরনে কখন আমার নাসিকা গহ্বরে বাসর সাজিয়ে পুষ্পসজ্জায় অপেক্ষা করছে। গা ম্যাজ ম্যাজ, খুক খুক। ধুর, লাগাও প্যারাসিটামল। যার কেউ নেই তার এই প্যারা বন্ধু, শুনেছিলাম। দুদিন পর নগরে ফিরে এলাম। তেমন কিছু না, শুধু ঘুসঘুসে জ্বর। পূর্ব অভিজ্ঞতায় আত্মজ ও বৌমা প্রমাদ গুণে ডাক্তারের শরণাপন্ন। চারদিন এন্টিবায়োটিকসহ কাশির সিরাপ। চতুর্থ দিনে তরুণ ছটফটে স্মার্ট ডাক্তার আশিক ইকবাল গম্ভীর হয়ে কি সব অক্সিজেন হাইড্রোজেন নাইট্রোজেন এর কথা বলতে লাগল পুত্রের সাথে।
সন্ধ্যায় ভিকিকে ডেকে, ই এম বাইপাসের ধারে দশ তলা বিশালকায় হর্ম্যের গ্রাউন্ড ফ্লোরে, ইমার্জেন্সিতে হাজির।

দেরী করতে চায়নি পুত্র পুত্রবধু। পাঁচ বছর আগে তাদের মা’কে তারা হারিয়েছে, এবার আগেভাগেই লড়াইতে নেমে যেতে চায়।

Share:
5 1 vote
Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop