(প্রবন্ধ)
গুরু
অনীত রায়
জীবনের পথে হাজার বছর পথ হাঁটি নি। হেঁটেছি মাত্র ক’টি বছর। শিক্ষক পেয়েছি অনেক। শিখতে পারি নি কিছুই। সেটা অবশ্য আমারই অক্ষমতা। কিন্তু অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চয় হয়েছে বুঝি অনেক কিছুই। তার মধ্যে সবটাই বোধ হয় কাঁকড়-পাথর। এক-আধটা আলোর কণা থাকলেও থাকতে পারে।
শুনেছি, সমাজে শিক্ষক বা গুরু না কি রয়েছেন প্রধানত তিন রকমের। এক রকম গুরু আছেন, যিনি সব সময় তাঁর শিষ্যকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন। আর এক রকম আছেন, যিনি শিষ্যকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত; পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে যেতে মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যান, প্রয়োজনমত আবার আসেন। আর এক রকম গুরু না কি আছেন, যিনি শিষ্যকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়ে শিষ্যর সামনে থেকে ভেগে পড়েন।
সৈয়দ মুজতবা আলী, আদর্শ নিবেদিতপ্রাণ প্রথম রকম গুরুকেই বললেন অধম। বেচারা অধম গুরু! শিষ্যর জন্য জীবন নিবেদন করেও উপযুক্ত মান পেলেন না ।
দ্বিতীয় রকম গুরুকে একটু করুণা করলেন। শিষ্যকে শিক্ষা দেবার পর তাঁর মাঝে মাঝে উধাও হয়ে পড়াটা বোধ হয় আলী সাহেবের পছন্দের নয়। কিন্তু প্রয়োজনমত যে আবার আসেন, সেই জন্য কিছুটা করুণা করেই তাঁকে মধ্যম গুরুর সম্মানটা দিলেন। বেচারা!
কিন্তু সবচেয়ে ফাঁকি দিলেন যে গুরু, শিষ্যকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়ে ভেগে পড়লেন, তাঁকেই দিলেন উত্তম গুরুর সম্মান।
মুজতবা আলী সাহেবের এ কেমন বিচার! বিচার ! না কি অবিচার ! ঠিক বুঝতে পারি নি।
আজ বুঝতে পেরেছি, বলব না, তবে বোধ হয় তাঁর ভাবনা কিছুটা অন্তত অনুভব করতে পারি।
আসলে, প্রত্যেকটি মানুষের বাঁচাটা তো নিজেকেই বাঁচতে হয়! আমার বাঁচাটা অন্য কেউ বাঁচিয়ে দ্যায় না! তাই, গুরুর কাজ, কেমন করে বাঁচতে হবে, এই শিক্ষার ভিতটা গড়ে দেওয়া ! সেই শিক্ষার ভিতটা যখন গড়ে উঠবে, শিক্ষার্থী নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি যখন আয়ত্ত করে ফেলবে, তখন গুরু অকারণে কেন শিক্ষার্থীর বোঝাস্বরূপ তার সাথে লেপ্টে থাকবেন!
প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব চোখ আছে। শিক্ষার্থী নিজের চোখে দ্যাখবার শিক্ষাটা যখন পেয়ে যাবে, তখন কেন সে গুরুর চোখ ধার করে বিশ্বটাকে দেখবে!
আমাদের ভারতীয় আদর্শে গুরুকে ব্রহ্মা বলেছি, বিষ্ণু বলেছি, মহেশ্বর বলেছি। তাঁকেই আবার ব্রহ্মও বলেছি। ওই একই জন সৃষ্টি করছেন, সংরক্ষণ করছেন, আবার ধ্বংসও করছেন। কী উদ্ভূতুড়ে কাণ্ড রে বাবা ! সৃষ্টিই যদি করলেন, পালনই যদি করলেন, কেন তবে ধ্বংস করা ! আরও অদ্ভুত কাণ্ড, তিনিই না কি পরম ব্রহ্ম, অর্থাৎ জ্ঞানের জীবন্ত প্রতিমূর্তি !
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল এই রকম, যে, সৃষ্টি একটা হল; তাকে উপযুক্ত লালন-পালন করে পুষ্ট করাও হল; কিন্তু সেই সৃষ্টিও তো প্রাকৃতিক নিয়মেই জরা-ব্যাধি, ক্ষয়-ক্ষতি, সময়, বার্ধক্যের শিকার! আর তাই, নতুন সৃষ্টিকে জায়গা করে দেবার জন্য, পুরোনো যা কিছু ক্ষয়ে যাওয়া জঞ্জাল, তাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা হবে কী করে! তাই নতুন সৃষ্টির জন্যই ধ্বংসও প্রয়োজন। ভাঙাও প্রয়োজন। তবে এও জানবার কথা—
ভাঙারও নিজস্ব এক ছন্দ আছে ;
রীতি-প্রথা আছে,
এবড়ো-খেবড়ো ভাবে ভাঙলে, ভাঙার বিজ্ঞান থুতু দেবে
গায়ে, আর লোকে বলবে,
একেই তছনছ করা বলে।
অশিক্ষাও বলে কেউ, বলে, মূর্খ ভাঙা শিখতে হয়-
অপরূপভাবে ভাঙা গড়ার চেয়েও মূল্যবান
কখনো-সখনো।
এই ভাঙবার শিক্ষাটাও গুরুর কাছে থেকেই পাওয়া। সেই জন্যই গুরু একই সঙ্গে সৃষ্টি, ধারণ, এবং ধ্বংসের প্রতীক।
এভাবেই অনাদি কালের থেকে সৃষ্টির প্রক্রিয়া বহমান। এই প্রক্রিয়াকে আমরা বোঝবার চেষ্টা করি না। এ আমাদেরই অপস্মার। যে চলমান ‘আমি’ বিশ্বজগতে বাস করি, সেই ‘আমি’ নিজেকে কতটুকু জানি? আর বিশ্বজগৎকেইবা কতটুকু জানি? আমাকে নিজের দিকে তাকাতে শেখান তো গুরু। আবার নিজেজে চেনবার আলোকে বিশ্বকেও চিনতে শেখান তিনিই।আবার উল্টো দিক থেকে, বিশ্বকে চিনতে শেখাতে গিয়ে নিজেকে চিনতে শেখান গুরু। নিজেকে চিনতে গিয়ে গুরুকেও চিনতে শিখি। পারস্পরিক এই জানবার প্রক্রিয়া চলতে থাকে সব সময়।
গুরুর আসনে বসেন তো অনেকেই, কিন্তু প্রকৃত গুরু কে ?
যিনি দেবতাকে স্তব করতে,তার স্বরূপকে বুঝতে সাহায্য করেন, তিনিই তো আসলে গুরু!
‘দেবতা’ মানে কি অলৌকিক ক্ষমতাধর কোন অপ্রাকৃত শক্তি ?
অভিধান বলে, দেবতা সকল জায়গায় ক্রীড়াশীল। তাহলে বিশ্বের যা কিছু – ধুলোর কণা থেকে সূর্য, সূর্যালোক, সব কিছুই তো যে যার নিজের মত খেলা করে বেড়াচ্ছে। তার মানে, বিশ্বের সমস্ত বিষয়ই দেবতা। বেদ-এ অগ্নি, সবিতা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, যম, মৃত্যু, বায়ু, বরুণ, কাল বা সময় এমন আরও অসংখ্য বিষয়কে দেবতা বলা হয়েছে। এই সমস্ত কিছুকে যিনি আমার অন্তরের মধ্যে থেকে উদ্ভাসিত করেন, আমার চোখের সামনে মেলে ধরেন, সেই দীপ্তি – তিনিও দেবতা। দীপ্তির আভায় আমি যা জানতে পারছি, তার তো মৃত্যু নেই। তাই তা অমর। তাহলে আমার অর্জিত যে প্রকৃত জ্ঞান, সেই জ্ঞান বা ব্রহ্মও অমর। সেইজন্য ব্রহ্মজ্ঞানও দেবতা ।
অভিধান এও বলে, গুরু শিষ্যের মঙ্গলের জন্য স্তব করেন। অর্থাৎ শিষ্যর সব রকম উন্নতি বা বিকাশের জন্য স্তব করেন। তা, স্তব তো করেন! কিন্তু কার স্তব? দেবতার? আমরা জেনেছি, বিশ্বের সমস্ত বিষয়ই দেবতা। তাহলে সমস্ত বিষয়-এরই স্তব! আমরা জেনেছি, স্তব শব্দের এক অর্থ গুণকীর্তন। আর এও আমরা জানি, গুণ অর্থ বৈশিষ্ট্য। তাই, ‘দেবতার স্তব’ আর কিছু নয়, সমস্ত বিষয়-এর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ। আসলে গুরু শিষ্যকে সমস্ত বিষয় চেনান। শিষ্যকে চেনাতে গিয়ে নিজেও চিনতে চিনতে এগোন। বিশ্বের যা কিছু বিষয়, সে সবের একটা রূপ দেখতে পান। নিজেকে এবং শিষ্যকে একই সঙ্গে সম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে নিয়ে যান। বাইরের এবং অন্তরের সমস্ত অন্ধকার দূর করে আলোর প্রেক্ষায় নিয়ে আসেন। সম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলার জন্য তাঁর সর্বাত্মক আকাঙ্ক্ষা আমাকে আলোর পথে নিয়ে চলো! মানুষ হয়ে ওঠার পথে জীবন-সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়ান। আর, এই সমুদ্র পাড়ির জন্য পারানির কড়ি সঞ্চয় করেন। শিষ্যর জন্য। নিজের জন্যও। সত্যকামকে গুরু গৌতম সমিধ আহরণ করতে বলেছিলেন। তাকে উপনীত করবেন। কোথায় উপনীত করবেন? জ্ঞান-সমুদ্রের তীরে? তা ছাড়া আর কোথায়? কী আশ্চর্য গুরুর কর্মযোগের অন্তর্দৃষ্টি! কর্মযোগে ব্রতী করানোর কী গভীর বাস্তবসম্মত উপায় নেওয়া ! সত্যকামকে ক্ষীণ ও দুর্বল চারশো গো-ধন দিলেন। দিলেন আনন্দময় স্বর্গভূমি, মাটি, জল, সূর্য, চাঁদ, কিরণ, তির, গরু, বৃষ, পশু, মা, গায়ত্রী, বাকশক্তি, দশ দিক, ইন্দ্রিয়, কর্মযজ্ঞ, দৃষ্টিশক্তি, চোখ, সর্বোপরি এগিয়ে চলবার মন। আসলে এই গো-ধন তো গরুমাত্র নয়, বিশ্বজ্ঞান-পিপাসা। শুন্য, প্রায়-শুন্য বা অসম্পূর্ণ সেই জ্ঞানকে সম্পূর্ণতার পথে নিয়ে যাবার সাধনাই তো ক্ষীণ ও দুর্বল চারশো গো-ধনকে সহস্র করবার সাধনা।
বিশ্বের প্রকৃত গুরু যাঁরা, এই সাধনাই করে গিয়েছেন। বৃহস্পতি, শুক্রাচার্য, দ্রোণাচার্য, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, রামেন্দ্রসুন্দর, রেজাউল করিম, সক্রেটিস, টলেমি, নিউটন, আইনস্টাইন, মার্কস্ – এমন অসংখ্য গুরু।
গুরু আসলে আমাদের মানুষ হবার সঠিক পথ দ্যাখান। জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছনোর পথ দ্যাখান।
আমার গুরু যেমন আমার শিক্ষাদাতা, আমার গুরু তেমনি আমি নিজেও। সেই যে, মুজতবা আলী সাহেব যাঁকে উত্তম গুরু বলেছিলেন, যিনি শিষ্যকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়ে শিষ্যর সামনে থেকে ভেগে পড়েন, সেই গুরুই তো আমাকে শিখিয়ে দিয়ে গ্যাছেন, নিজেকে কেমন করে জানতে হবে, নিজেকে কেমন করে প্রকাশ করতে হবে, অন্যকে কেমন করে বুঝতে হবে, বিশ্বসংসারে কেমনভাবে পা ফেলতে হবে, কোন্ বাঁচাটা প্রকৃত বাঁচা, কেমন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার করতে হবে, কোন্ সংস্কৃতির চর্চা করব, কেমন করে নিজেকে সংস্কৃত করব – জীবনের এই সমস্ত শিক্ষা ।
জগৎ শব্দটির অর্থ যে চলমান সেই জ্ঞানটাই কীভাবে পাব সেটা বোধ হয় গুরুর সবচেয়ে বড় শিক্ষা। পরিবর্তনশীল জগতে আমি যে মানুষ সমাজের একক, সেই একক মানুষটাকে কেমন করে সুস্থ সমাজের একজন হিশেবে গড়ে তুলব, সেটা তো প্রতি মুহূর্তে আমাকে নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে। কোন জ্যান্ত গুরুকে তো আমি প্রতি মুহূর্তে জিজ্ঞাসা করে নিতে পার না – ওগো গুরু,বলে দাও, এবার আমি কী করব?
আমার চলার পথে প্রতি মুহূর্তেই আমার নিজের অন্তরের মাঝে যে গুরু আছেন, তিনিই আমাকে পথের দিশা দেবেন। গুরু আমার জমি তৈরি করে দিয়ে গ্যাছেন। কর্ষণ আমাকে নিজেকেই করতে হবে। সেই কর্ষণে ‘সীতা’কে পাবই। শস্যময় হবে আমাদের চেতনার ভূমি ।
(কবিতা)
তোমার দুডানা
জ্যোৎস্নার শাদা দুধে পৃথিবীর স্নান
তোমার মুখের ছবি মনে পড়ে না তো
রজনীগন্ধার বাসে ভেজা সাঁঝ
তোমার রেণুকা আমি উড়তে দেখি না
কোকিলের পঞ্চমে বসন্তরাঙা
তোমার সুরভিস্বর শ্রবণে আসে না
বিরহী যক্ষের রামগিরি আসে মধ্যরাতে
ব্যাঙ ও ঝিঁঝির ডাকে তোমায় দেখি না
শিরদাঁড়া বেয়ে নামে নীল কালকূট
চেতনায় সর্ষের হলুদ প্রেম
স’রে স’রে যায় শুধু অগণন তারা
সমুদ্র সাঁতার দিই ধুলোর ঢেউয়ে
তোমার দুডানা এসে আমাকে জড়ায়
আকাশের বুকে মধু আমাতে অমৃত।
রক্তক্ষরণ যখন
নন্দনে ঊর্বশী নীল ছোপে জিহ্বা রাঙে
বেহালার ছড় চলে বুকের শিরায়
সুস্মিতাও মোনালিসা হাসে
যখন তোমার ঘৃণাপল
ধুলোয় আমার বিশ্ব নামে
হাত মেলাবার আয়োজন