অনুসূয়া চলে যাবার পর

By Published On: May 14, 2025Views: 28

অনুসূয়া চ’লে যাবার পর
সৈয়দ মাহমুদ

অনুসূয়াকে কেন চ’লে যেতে হচ্ছে,তা ভাবার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলো অনুসূয়া চ’লে যাচ্ছে। সে কি সত্যিই চ’লে যাচ্ছে? অনুসূয়া দুরু দুরু বুকে অস্পষ্ট করে বললো, “তোমার সাথে বুঝি আর দেখা হবে না।” অদূরে কোথাও প্রচন্ড শব্দে একটা বাজ পড়ার সাথে সাথে অনেকগুলো জ্বলজ্বলে নক্ষত্র অকস্ম্যাৎ ডুবে গেল মিহিন অন্ধকারে। অনিক নির্বাক, নিস্তব্ধ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মনে মনে ভাবে সেও তো জানাতে এসেছিলো, তার প্রিয় এই শহর ছেড়ে চ’লে যাবে সে।

অনিকের তখন আপন সময়ের দুর্দান্ত কবিতা থেমে গেছে, কলমের ঠোঁটে যেন জমাট রক্তের দাগ। দিনমান আকাশের সবগুলো রং কেমন ফিকে ফিকে লাগে। বুকের ভেতর তোলপাড় তোলে দহনে দহনে পুড়ে যাওয়া কতগুলো মুহূর্ত। শুধু পূর্ণিমা রাতে জেগে থাকা স্বভাব হলেও এখন তার সবগুলো রাত অমাবশ্যার নিকষ কালো অন্ধকারে তলিয়ে যায়, নির্ঘুম জেগে থাকে সে। শিরায় শিরায় প্রতিবাদের মাদল বেজে ওঠে থেকে থেকে। সদ্য গলাকাটা হরিণের আর্তনাদ শোনে আপন কন্ঠস্বরে! কারা যেন তার গলায় ধাঁরালো ছুরির পোঁচ দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছে ভয়ার্ত জঙ্গলে। কেবল অনুসূয়া এবং ওদের বাগান বাড়ি তাকে বড্ড আপন করে নিয়েছিলো। শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে দুটো প্রকান্ড কৃষ্ণচূড়া গাছ, তার তলায় অনুসূয়ার সান্নিধ্যহয়ে উঠেছিল তার রক্তক্ষরণের প্রতিষেধক।

যে শহরের অলি-গলি রাজপথ, চায়ের দোকানে, পার্কে, ময়দানে, মিছিল-মিটিং-শ্লোগানে জীবন্ত ছিল অনিকের জীবন, সেই শহর আজ বড্ড অচেনা। তার দিকে অজস্র ভ্রুকুটি, অবহেলা-অবজ্ঞার সীমাহীন যাতনা তাকে কুরে কুরে খায়। কিন্তু অনুসূয়া তার একমাত্র পিছুটান। তবুও তাকে শহর ছেড়ে যেতে হবে। অনিকের বুকের ভেতরটা অনেক ভারী হয়ে ওঠে। ঘর থেকে বেরুলেই চারিদিকে শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকার, পথে পথে নপুংসক আর আপোষকামী নেতাদের মুখ। তাকে জানানো হলো তার দলীয় মেম্বারশীপ কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়েছে। অনিকের সামনাসামনি বসতে তাদের এত ভয় দেখে সে শুধু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে -ওদের নৈতিক পরাজয় ঘটে যায়। একজন নীচ ষড়যন্ত্রী-পদলোভীর কাছে নেতারা যে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে, তা দেখে নিজেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায় অনিক, কাদের নেতৃত্বকে শিরোধার্য করে চলেছে সে এতদিন! অনিকের সাথে আলোচনা করার মত কি কিছুই ছিলো না তাদের! একটিবার ডেকে অনানুষ্ঠানিক কথাও তো বলা যেত। এতটা অবহেলা কিংবা তাচ্ছিল্য অনিক আর মেনে নিতে পারছিল না।

অনুসূয়ার তিরতির করে কাঁপা শরীর আবার অনিককে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে, কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “আমি আজ নারী হতে চাই” । অনিকের কন্ঠে চাপা উত্তেজনা, “আমিও দুর্দান্ত পুরুষ হবো আজ” । তারপর নরম ঘাসের পালঙ্কে ওরা নারী আর পুরুষে রূপান্তরিত হয়।

দিনে দিনে অনিকের ভেতরের অস্থিরতা আর প্রসরমান যন্ত্রণার পাথর অনুসূয়াকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিলো। একদিন প্রশ্ন করে, “ওরা যে তোমার ভেতরের তুমিটাকে এভাবে মেরে ফেললো, তার বিচার কি হবে না? ”অনিক বলে, “প্রায় একটা বছর আমি তো প্রতীক্ষায় ছিলাম। সেই নপুংসকদের তো কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো না!তাদের দলপতিকে তো প্রশ্ন করা হলো না-কেন এই আক্রমণ? যাদেরকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল তারা আসলে কারা? আমাকেই বা কেন প্রশ্ন করা হলোনা, আমি যা করেছি তা কি অন্যায়- অগণতান্ত্রিক ছিলো? কেন আমাকে জীবন্মৃত করে ফেলা হলো?”

অনিকের আস্থা আর বিশ্বাসের জায়গা টলে গেছে। দেখা গেল সেই নপুংসক দলপতি ওপর মহলের অনেক নেতার সাথেই মিলেমিশে দিব্যি দিনাতিপাত করছে। নেশাগ্রস্থ বখাটেরা, সংখ্যা বাড়াতে যাদেরকে আমদানি করা হয়েছিল, তারা যে কখনোই কোনো আদর্শিক দলের বিশ্বস্ত এবং অনুগত হয়ে উঠতে পারেনা, অনিকের সে কথা সত্যি হলো। ওরা ফিরে গেল স্ব স্ব স্থানে। আরো অনেক পর দেখা যাবে ওদের কেউ কেউ মাদক বিক্রী করে বিপ্লব(!) করছে, কখনো সময় কাটছে জেলে, কেউবা মাতাল হয়ে চলছে রাস্তায়। দলপতির দখিন হস্ত ছিলো যে, সে আইনের পোশাকে অবৈধ উপার্জনের সমুদ্রে ডুবে যাবে। আর কিছুদিন পর একজনকে দেখা যাবে নেশার ঘোরে মৃত পড়ে রইল ডোবার জলে।

“তুমি কেন লঙ্কাকান্ড বাঁধালেনা” অনুসূয়ার প্রশ্নের উত্তরে অনিক বলেছিল “সবার উপরে দলের সুনাম আর শৃংখলা” শপথের সময় এটি তার কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলো। হয়ত ওদের কাছে তার এই সততা হাস্যকর মনে হবে, কারণ মুখে উচ্চারণ করা আর হৃদয়ে ধারণ করা যে এক নয়। মুখোমুখি বসে সমালোচনা এবং আত্মসমালোচনার পদ্ধতির প্রতি অবিচল আস্থায়তার তখনো চির ধরেনি। কিন্তু হায়, বৈঠকই যদি ডাকা না হয় তবে বিচার হবে কোন প্রক্রিয়ায়! কী এক রহস্যময় কারণে বৈঠক ডাকা হলো না আর। অনুসূয়া অবাক হয়ে যায় তাদের এই ভূমিকায়, অনিককে বলে,“সে-ও কি কখনো হয়! একটি নিয়মতান্ত্রিক দলের অভ্যন্তরে এতটুকু শৃংখলা থাকবে না!”

আসলে ভেতরে ভেতরে সবকিছুই তখন ভেঙে পড়েছে। আছে শুধু খোলস। অভ্যন্তরীণ শৃংখলা রক্ষার জন্যনৈতিক দৃঢ়তা দেখাতে না পারলে সেই দল দিয়ে সমাজের পরিবর্তন তো দূরের কথা দলকে টিকিয়ে রাখাই সম্ভব হবে না, তখন সেটাই অনিকের আত্মপোলব্ধি। হতে পারে সেটি ছিলো একটি ছোট ইউনিট মাত্র। কিন্তু ঘুণপোকা যদি নিম্নস্তরে বিরাজ করে সে একদিন ভেতর থেকে সব খেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠবেই।

প্রচন্ড অভিমানী অনিক অনুসূয়াদের বাগান বাড়িতে ছুটে যেত একটুখানি স্বস্তির শ্বাস নিতে। সেদিন সে গেল তার সিদ্ধান্তের কথা জানাতে,অনুসূয়াও তার প্রতীক্ষায় ছিলো কী যেন বলবে বলে। অনুসূযার মলিন মুখ অনিকের বুকের ভার আরও বাড়িয়ে দেয়। অবশেষে অনুসূয়ার কন্ঠে ধ্বনিত হলো, তোমার সাথে বুঝি আর দেখা হবে না।”

দু’জন বিধ্বস্ত তরুন-তরুনী পাশাপাশি বসে থাকে,বাকহীন কেটে যায় সুদীর্ঘ সময়। কেন যেনওরা কথা বলতেই ভুলে গেল, অথচ ওদের মনের গহীনে অযুত কথা কলকল রবেসাঁতার কাটছে। সন্ধ্যা উতরে যায়, অনুসূয়ার ভেতরে যাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে অনিক বলে, “রাতে দেখা হতে পারে একবার?” অনুসূয়া বলে, “আমিও এমনটাই ভাবছিলাম, তুমি এসোরাত বারোটার পর। “প্রতীক্ষায় থাকবো” বলে বিদায় নেয় অনিক।

অনিকের বোধের মধ্যে “তোমার সাথে আর দেখা হবে না” শব্দগুলো ভাংচুর চালাতে থাকে। এমন কেন হবে! তবে কি সত্যিই আর দেখা হবে না!তার জন্য কিএমন কঠিন দুর্বিপাক অপেক্ষা করছে! এই তো সেদিন অনুসূয়া দুষ্টুমীর হাসি ‍দিয়ে জানতে চাইলো, সমাজ পরিবর্তনকামীরাও কি ভালবাসে, তাদেরও কি ভালবাসতেই হয়! অনিক বলেছিল, কেন নয়!  হৃদয়ে ভালবাসা আছে বলেই তো ওরা বিপ্লবী। ওরা মানুষ ভালবাসে, ভালবাসে প্রকৃতি-এই আকাশ- বিশ্বব্রক্ষান্ড, ভালবাসে এই যে কৃষ্ণচূড়া, সবুজ বনানী, সাগর-নদী-জল আর ফসলের ক্ষেত। ঘরের ঘুলঘুলিতে যে চড়ুইছানা জন্মেছে তাকেও ভালবাসবে বিপ্লবীরা। অনুসূয়া ঈষৎ অভিমান ভরা কন্ঠে বলে, “আর নারী?” অনিক দু’হাত উঁচু করে হেসে বলেছিল, “সে তো সর্বাগ্রেই হে মানবী! আচ্ছা, অনুসূয়া কি সত্যিই চ’লে যেতে পারবে! অনুসূয়াদের বাড়িটা শহরের এক প্রান্তে। অনিকের শহরের ভেতরে আসতে ভাল লাগছিল না তাই উল্টো পথে গ্রামের রাস্তা ধরলো সে, যে পথে ওরা এক সাথে হেঁটেছে অনেক। কিছুদূর গিয়ে রাস্তা থেকে একটা মেঠোপথ নেমে গেছে অশোক বাগানের পাশ দিয়ে, শতবর্ষী পুরানো বাগান। সব ক’টা গাছের কান্ড থেকে বেরিয়ে এসেছে বাহারী বর্ণের অশোক ফুল। রাতের প্রথম প্রহরেই উজ্বল চাঁদের কিরণ মনে করিয়ে দেয়, হয়তবা আজ পূর্ণিমা। সেই সুবর্ণ বাগানের উপর জ্যোৎস্নার মোহিনী আলো অনিকের যাত্রা রহিত করে দেয়। সে একটা গাছের নিচে বসে ভাংচুরের শব্দ গুলোকে স্তিমিত করার চেষ্টা করে। এই অশোক বাগানে ওরা কত বার এসেছে!

সে যখন বাগান বাড়ির পুকুর ঘাটে ফিরেআসে তখন হাত ঘড়িতে রাত এগারটা পঞ্চাশ। অপেক্ষার প্রহর গুনছে অনিক। অবশেষে অনুসূয়া এসে বললো, “এখানে বেশীক্ষণ বসা ঠিক হবে না।”অনুসূয়াকে অনুসরণ করে অনিক এগিয়ে যায় বাগান ঘেঁষা পথ ধরে পিছন বাড়ির দিকে। পাচিলের কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়ায় ভিতরে প্রবেশ সহজ হয়েছে। এ যেন ভিন্ন একটা বাগান, যা ভেতর বাড়ির অংশ। তবে রঙ্গন ফুলে ঢাকা অন্য একটা পাঁচিলে আড়াল করা। দেখে মনে হয় যেন রঙ্গনেরই পাঁচিল। আগে কখনো অনিক এই জায়গাটা দেখেনি। একটা ছোট ফুল বাগান, তার পাশে কামিনী ঝোপ-তীব্র সুবাস ভেসে আসছে। অন্যদিকে উঁচু উঁচু দেবদারু, যত্রতত্র কিছু সুপুরি গাছ দাঁড়িয়ে। মাঝখানে খোলা জায়গায় নরম ঘাস বিছানো, পাশেই একটা কংক্রিটের বেঞ্চে ওরা বসে। তখন চাঁদের আলোয় হাবুডুবু খাচ্ছে নীলাভ-সাদাধরিত্রী।

অনুসূয়ার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠা নামা করতে থাকে, ভেতরে দ্রিমি দ্রিমি নিনাদের স্পষ্ট শব্দ। অধরের রঙ পাল্টে যায়, যেন তার অধরে গাঢ় গোলাপী রংয়ের সদ্য প্রলেপ টেনেছে কেউ।দ্রুত স্ফীত এবং সংকুচিতহয়নাসারন্ধ্র, চোখের গভীরে কামনারউথাল পাথাল তরঙ্গ। সহসা অনুসূয়া অনিককে আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয়। অনিকের শরীরে সাথে মিশে আছে অনুসূয়ার নরম শরীর, তার ওষ্ঠ আর অধরের মাঝে চলে গেল অনিকের তপ্ত ঠোঁট। তার পর অবিশ্রান্ত চুমোয় চুমোয় অনিককে উন্মাদ করে দেয় সে। অনিকও পাল্টা চুমুতে অনুসূয়াকে করে তোলে খরস্রোতা কল্লোলিনী।

যদিও অনিক জানেনা ডালিম ফুলের কোনো ঘ্রাণ আছে কিনা। কিন্তু সে সদ্যফোটা ডালিম ফুলের ম ম গন্ধে বিভোর! এই মৌতাত গন্ধে তার ভেতরে যেন এক ধরণের উত্তরণ ঘটে গেল। মনে হলো সে যেন পুরুষ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। অনুসূয়ার চোখের আবরণ অনিকের মতোই খসে গেল। চার চোখের দৃষ্টির ভেতর থেকে আব্রু নামের পাখিটি খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিলো মুক্ত আকাশে। অনুসূয়ার তিরতির করে কাঁপা শরীর আবার অনিককে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে, কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “আমি আজ নারী হতে চাই” ।অনিকের কন্ঠে চাপা উত্তেজনা, “আমিও দুর্দান্ত পুরুষ হবো আজ” । তারপর নরম ঘাসের পালঙ্কে ওরা নারী আর পুরুষে রূপান্তরিত হয়।

সদ্য নারী হয়ে ওঠা অনুসূয়া কী করে এতটা সাহসী হলো! অনিকের বুকের উপর আলুথালু বেশেতার শরীর কী নির্ভরতায় তলিয়ে আছে প্রশান্তির ঘুমে। তখন জ্যোৎস্না আলোক স্ফুলিঙ্গের মতো ঝরছেঅমৃতসুধা হয়ে।বোশেখী পূর্ণিমায় অনিকের দৃষ্টি চলে যায় দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছে, লাল লাল ফুলের উপর জ্যোৎস্নায় পাতা গালিচার দিকে। সে এক ঘোর লাগাবিমুগ্ধ আলো। উপরে দেবদারুর পাতায় লেগেছে হিল্লোল, যেন আনন্দ হুল্লোরে মেতেছে সদ্য উড়তে শেখা এক ঝাঁক সাদা বকের ছানা। বুকের মধ্যে শুভ্র পরীকে নিয়ে অনিক তার চোখের ভেতর এঁকে যাচ্ছে অপুর্ব একযাদু নিসর্গ। এই নিসর্গ অনুসূয়াকে দেখাবে বলে ওকে জাগিয়ে দেয় সে। অনিকের আদরে আদরে অনুসূয়া ঘুম ঢুলু ঢুলু চোখ খুলে মায়া রাজ্যের নিসর্গ দেখে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়!

অনুসূয়া বলে, “আমাদের পরিবর্তিত পৃথিবীটাকে আমরা এমন অনন্য আলোয়পরিপাট্য করে সাজিয়ে রাখবো।”

“কিন্তু তুমি যে বলছ, তুমি থাকবে না, তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না! সেই তুমিই যদি না থাকো- সেই পৃথিবী দিয়ে আমার কাজ কি?” অনিকের কন্ঠ বেশ ভারী শোনায়।

আলিঙ্গন আরো দৃঢ় করেঅনুসূয়া বলে, “কষ্ট পেয়ো না। আমার যাওয়াটা আসলে যাওয়া নয়, আমি এভাবেই তোমার কাছে আছি সর্বক্ষণ, শুধু সময়ের বাস্তবতা আমার শরীরটাকে নিয়ে যাচ্ছে দূরে, এর চেয়ে বেশী কিছু জানতে চেয়ো না। আমাদের দু’জনের এখন সেই সক্ষমতা নেই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াবার।”সে যেন সহসাই এক দায়িত্বশীলা অভিজ্ঞ রমনী হয়ে উঠলো।

অনিকের ভেতরে এক করুণ আর্তি গুমরে উঠছে। তবুও অনুসূয়ার ধীর-শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে সেই আর্তি ঝেড়ে ফেলে সে। তার মনে হয় চলমান তিমিরের বিরুদ্ধে পথ চলতে অনুসূয়ার হাতদুটো তাকে দ্বিগুণ শক্তি যোগাবে। অনিকের ভেতরে এক বিস্ময়ান্বিত বোধের জন্ম হয়- যেন একদিন সবকিছু পাল্টে যাবে!

ভোরের অনেক আগেই অনুসূয়া চলে গেল বিদায়ী চুমুতে অনিককে বিবশ করে দিয়ে। অনুসূয়ার অপসৃয়মান ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সবুজ বৃক্ষের পাতারা রুদ্র গ্রীষ্মেও যেনশীতের আগমনী বার্তা পেয়ে অকস্মাৎ ঝরে যেতে লাগলো! দানিউবেরসমূদয় স্রোত কয়েক মুহূর্তের জন্যআচমকা থমকে গেলে তার নৈঃশব্দের ক্ষীণ করুণ সুর ক্রমশঃ ভেসে আসতে থাকলো।গানের পাখিরা সববন থেকে কী করে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! একটি মাত্র পাখি শুধু বেঁচে রইল, যে কিনা গহীন অরণ্যে একাকী তার হারিয়ে যাওয়া সাথীকে নীরবে খুঁজে ফিরবে “পিউ-কাঁহা, পিউ-কাঁহা” বলে! মস্তিস্কের কোষে কোষে এতসব এলোমেলো সতেজ ভাবনা ঝড় তুলছে যখন, তখনই অনিক পাশ ফিরে বিস্ময়নেত্রে দেখে তার পাশেই শুয়ে জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখছেন:

ঝাউফলে ঘাস ভ’রে-এখানে ঝাউয়ের নিচে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে;
কাশ আর চোরকাঁটা ছেড়ে দিয়ে ফড়িং চলিয়া গেছে ঘরে।
সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন পথে ঘরে যাবো!
কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই, -চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে
শান্তি আমি পাবো?
রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন পথে যাবো?

বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা মানুষ অনিক, চিন্তা-স্বপ্ন ভুলে শান্তির প্রত্যাশা করে না সে। সেই কবে থেকে বৃত্তের বাইরে এসে হেঁটে চলেছে দুরন্ত এক স্বপ্নের পেছনে! কোথায় তার ঘর-জানা নেই! শুধু জানতে চায়কোন পথে এগুবে সে! রাতের নক্ষত্রকি তাকে বলে দেবে কোন পথে যাবে সে!

নক্ষত্ররাজিতাকে উত্তর দেয় না, ভোরের আগমনের সাথে সাথে ওরাও অনুসূয়ার মতো মিলিয়ে যেতে থাকে। তার প্রশ্ন মহাশূন্যে মৃদু প্রতিধ্বনি তুলে ধীরে ধীরে ভেসে যায় দূর থেকে দূরে।

কিয়ৎক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ তাকে প্রশ্ন করেন, “আচ্ছা, অনিক, তুমি তোমার অনুসূয়াকে চলে যেতে দিলে কেন?”

অনিকের বুকের উপর তখন চেপে বসে আছে মাউন্ট এভারেস্ট। তবুও তার চাপা কন্ঠস্বর শুনতে পান পাংশুমুখ কবি জীবনানন্দ, “তুমিও কি ধরে রাখতে পেরেছিলে কবি– তোমার শোভনাকে?”

0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments