তৃতীয় বিবাহের প্রস্তুতি পর্ব

By Published On: August 23, 2025Views: 42
Image

তৃতীয় বিবাহের প্রস্তুতি পর্ব
ফরিদুর রহমান

অসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার কথাটা আমি প্রথমবারের মতো শুনেছিলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাক্তার মঞ্জুশ্রী বিশ্বাসের কাছে। নিজেকে আমার কখনোইমানসিক রোগী বলে মনে করিনি, ফলে স্বেচ্ছায় বা স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো সাইকোলজিস্টের কাছে যাবার প্রয়োজনও বোধ করিনি। শারীরিক কিছু সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই আমাকে স্বস্তি পেতে দিচ্ছে না, আর শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকার ফলে কোনো কাজই ঠিক মতো করতে পারছি না। সেই কারণে পুরোনো সহকর্মী এবং শুভাকাঙ্ক্ষী নাজমুন আপার পরামর্শ অনুসারে গিয়েছিলাম গাইনোকোলজির খ্যাতিমান চিকিৎসক আবিদা সুলতানার চেম্বারে। তিনিই আমাকে এক রকম জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন প্রফেসর বিশ্বাসের কাছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা নিরিক্ষার কোনো দীর্ঘ তালিকা হাতে না দিয়ে, বিনা প্রেসকিপশানে বিনা অষুধে- তবে বিনামূল্যে নয়-মনোরোগ বিশেষজ্ঞের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এইসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরস্পরের মধ্যে কোনো ধরনের যোগাযোগ বা রেসিপ্রোকাল এ্যালায়েন্স আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে স্ত্রী রোগ থেকে মনোরোগে স্থানান্তর কিছু দিনের মধ্যেই অসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বিষয়টি আমার জন্যে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল।

প্রফেসর মঞ্জুশ্রী বিশ্বাসের সাথে প্রথম সাক্ষাতের দুই সপ্তাহ পরে নির্ধারিত দিনে এবং নির্ধারিত সময়ে তাঁর চেম্বারে হাজির হলে প্রাথমিক কুশল জিজ্ঞাসার পরে তিনি আমাকে আমার শৈশব কৈশোর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। শুনতে চেয়েছিলেন দূর অতীতে আমার শিশু বয়সের উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা। শৈশবের অন্ধকার গলি পথে হেঁটে আমার কাছে প্রায় গুরুত্বহীন একটি দুটি স্মৃতির টুকরো জোড়া দিয়ে যে কাহিনি তুলে ধরেছিলাম প্রফেসর বিশ্বাস তা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। তারপরই তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এমন কোনো ঘটনা যা শিশু বয়সের আমার অপাপবিদ্ধ মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল, অথবা এমন কোনো অব্যক্ত কথা যা আমি দীর্ঘ দিন ধরে মনের মধ্যে ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি। তখনই অন্ধকার ঘরের জানালা খোলার মতো মনে চোরকুঠুরিতে এক ঝলক আলো এসে পড়ে। আমি প্রায় ত্রিশ বছর আগের একটি মফস্বল শহরের নির্মাণাধীন হাসপাতালের দৃশ্য দেখতে পাই। প্রামাণ্যচিত্রের ধারাবিবরণীর মতো সেদিনের দৃশ্যাবলী বর্ণনা করতে থাকি। হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে একটা দীর্ঘ বারান্দা মর্গের দিকে চলে গেছে। মর্গের পেছন দিকে হাসপাতালের পরিত্যক্ত কিংবা অব্যবহৃত জিনিসপত্র রাখার একটা বেড়ার ঘর। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী আমি ছোট বোন তুলতুলকে কোলে নিয়ে আধো অন্ধকার বারান্দা দিয়ে হাঁটছি। ওর বয়স তখন বছরখানেকের বেশি নয়। হাসপাতালের মর্গ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। মা শুধু বলেছিল, ওটা লাশকাটা ঘর… খবরদার ওদিকে যাবি না। সেদিন মগরিবের আজানের পরপর মা ওয়ার্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেলে আমার কৌতূহলের কারণে অথবা শুধুই মাকে অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে আমি তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকি। মা যেনো আমাকে দেখতে না পায় সে জন্য অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছিলাম, কিন্তু তুলতুল হঠাৎ জোরে কেঁদে ওঠায় মা এক ছুটে ফিরে এসে ওরা মুখ চেপে ধরে। হিস হিস করে বলে ওঠে, আর যেনো কোনো শব্দ না হয়। ওয়ার্ডে চলে যা, আমি আসছি।

অসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার কথাটা আমি প্রথমবারের মতো শুনেছিলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাক্তার মঞ্জুশ্রী বিশ্বাসের কাছে। নিজেকে আমার কখনোইমানসিক রোগী বলে মনে করিনি, ফলে স্বেচ্ছায় বা স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো সাইকোলজিস্টের কাছে যাবার প্রয়োজনও বোধ করিনি। শারীরিক কিছু সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই আমাকে স্বস্তি পেতে দিচ্ছে না, আর শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকার ফলে কোনো কাজই ঠিক মতো করতে পারছি না। সেই কারণে পুরোনো সহকর্মী এবং শুভাকাঙ্ক্ষী নাজমুন আপার পরামর্শ অনুসারে গিয়েছিলাম গাইনোকোলজির খ্যাতিমান চিকিৎসক আবিদা সুলতানার চেম্বারে। তিনিই আমাকে এক রকম জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন প্রফেসর বিশ্বাসের কাছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা নিরিক্ষার কোনো দীর্ঘ তালিকা হাতে না দিয়ে, বিনা প্রেসকিপশানে বিনা অষুধে-তবে বিনামূল্যে নয়-মনোরোগ বিশেষজ্ঞের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এইসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরস্পরের মধ্যে কোনো ধরনের যোগাযোগ বা রেসিপ্রোকাল এ্যালায়েন্স আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে স্ত্রী রোগ থেকে মনোরোগে স্থানান্তর কিছু দিনের মধ্যেই অসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বিষয়টি আমার জন্যে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল।

প্রফেসর মঞ্জুশ্রী বিশ্বাসের সাথে প্রথম সাক্ষাতের দুই সপ্তাহ পরে নির্ধারিত দিনে এবং নির্ধারিত সময়ে তাঁর চেম্বারে হাজির হলে প্রাথমিক কুশল জিজ্ঞাসার পরে তিনি আমাকে আমার শৈশব কৈশোর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। শুনতে চেয়েছিলেন দূর অতীতে আমার শিশু বয়সের উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা। শৈশবের অন্ধকার গলি পথে হেঁটে আমার কাছে প্রায় গুরুত্বহীন একটি দুটি স্মৃতির টুকরো জোড়া দিয়ে যে কাহিনি তুলে ধরেছিলাম প্রফেসর বিশ্বাস তা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। তারপরই তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এমন কোনো ঘটনা যা শিশু বয়সের আমার অপাপবিদ্ধ মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল, অথবা এমন কোনো অব্যক্ত কথা যা আমি দীর্ঘ দিন ধরে মনের মধ্যে ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি। তখনই অন্ধকার ঘরের জানালা খোলার মতো মনে চোরকুঠুরিতে এক ঝলক আলো এসে পড়ে। আমি প্রায় ত্রিশ বছর আগের একটি মফস্বল শহরের নির্মাণাধীন হাসপাতালের দৃশ্য দেখতে পাই। প্রামাণ্যচিত্রের ধারাবিবরণীর মতো সেদিনের দৃশ্যাবলী বর্ণনা করতে থাকি। হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে একটা দীর্ঘ বারান্দা মর্গের দিকে চলে গেছে। মর্গের পেছন দিকে হাসপাতালের পরিত্যক্ত কিংবা অব্যবহৃত জিনিসপত্র রাখার একটা বেড়ার ঘর। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী আমি ছোট বোন তুলতুলকে কোলে নিয়ে আধো অন্ধকার বারান্দা দিয়ে হাঁটছি। ওর বয়স তখন বছরখানেকের বেশি নয়। হাসপাতালের মর্গ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। মা শুধু বলেছিল, ওটা লাশকাটা ঘর… খবরদার ওদিকে যাবি না। সেদিন মগরিবের আজানের পরপর মা ওয়ার্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেলে আমার কৌতূহলের কারণে অথবা শুধুই মাকে অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে আমি তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকি। মা যেনো আমাকে দেখতে না পায় সে জন্য অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছিলাম, কিন্তু তুলতুল হঠাৎ জোরে কেঁদে ওঠায় মা এক ছুটে ফিরে এসে ওরা মুখ চেপে ধরে। হিস হিস করে বলে ওঠে, আর যেনো কোনো শব্দ না হয়। ওয়ার্ডে চলে যা, আমি আসছি।

লাশকাটা ঘর পার হয়ে যাবার পরে আমি আবার এক পা দু পা করে এগোতে থাকি। তুলতুল বোধহয় কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেড়ার ঘরটা পার হয়ে শেষপ্রান্তে আরও একটা ঘর। আবছা আলো ছায়ার মধ্যে দেখতে পাই হাসপাতালের বিছানায় দুজন নগ্ন নারী পুরুষ জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। ঘটনাটা কী ঘটছে আমি বুঝতে পারি না। খুব অল্প সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে পেছনে হাঁটতে থাকি, তারপরে বেড়ার ঘরটা পার হয়ে লম্বা বারান্দা ধরে এক ছুটে ওয়ার্ডে চলে আসি। সেই দিনটা থেকেই আমার সব ধরনের ভীতির সূত্রপাত। সারা জীবনে আমি আর কখনোই স্বাভাবিক হতে পারিনি। আমার অন্ধকার ভীতি, উচ্চতার ভীতি, যানবাহনের ভীতি আমাকে সার্বক্ষণিকভাবে তাড়া করে বেড়ায়।

আমার সাড়ে পাঁচ বছর বয়সের বুঝতে না পারা কাহিনি বাবার কাছে খুলে বলেছিলাম। তারপর থেকে আমি মার কাছে চির জীবনের শত্রু হয়ে গেছি। মা বিশ্বাস করে তার সাথে বাবার সম্পর্ক নষ্ট করার জন্যে আমিই দায়ী। অথচ মার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কাজিনকে বাবা আরো অনেকদিন আগেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কেন কী কারণে মিলু মামা হঠাৎ করে চলে গিয়েছিলেন এবং কেন আর কখনোই তাকে আমাদের বাড়িতে তাকে আর দেখা যায়নি সে কথা তখন বুঝতে না পারলেও একটু বড় হতেই বুঝে ফেলেছিলাম।

এ পর্যন্ত বলার পরে আমি সামান্য বিরতি দিতেই প্রফেসর বিশ্বাস তাঁর নিরাসক্ত মুখে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বিবাহিত জীবনের কথা কথা কিছু বলো। মধ্য পঞ্চাশেও মঞ্জুশ্রী বিশ্বাসের মুখশ্রী তিরিশের তরুণীদের মতো, শরীরের বাঁধন এতোটুকু শিথিল হয়নি। তিনি অবলীলায় আমাকে তুমি সম্বোধন করে কথা বলেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, আমার কোনো বিয়েই বেশি দিন টেকেনি। প্রথমটা বছর তিনেক এবং দ্বিতীয় বিয়ের বছর পাঁচেক পরেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সমস্যা কি তোমার দিক থেকে নাকি তোমার হাজবেন্ডের? আইমিন সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন বা তোমার অন্যান্য ভয় ভীতির মতো পুরুষ মানুষ সম্পর্কে কোনো ধরনের ভীতি কাজ করেছে? ঠিক তা নয়। প্রথমজনের সাথে বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। আমাদের বয়সের ব্যবধান, মন মানসিকতা, সামাজিক সাংস্কৃতিক দিক থেকে দূরত্ব সব মিলিয়ে দীর্ঘ দিন আমার পক্ষে তাকে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সেই বাবা মার অমতেই আমি তার সংসার ছেড়ে এসে স্বাবলম্বী হতে চেষ্টা করেছিলাম। তারপর? আমার দ্বিতীয় স্বামী জাকিরের সাথে পরিচয় ঘটেছিল একটা প্রশিক্ষণ কোর্সে। ওকে আমি ভালোবেসেই বিয়ে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু জাকিরের পরিবার কখনোই আমাকে মেনে নেয়নি। বিয়ের দু বছর পর থেকেই ওর সাথে আমার সম্পর্কে অবনতি ঘটতে থাকে। পরিবারে শ্বশুর শ্বাশুড়ি বা দেবর ননদের কথাবার্তার তিক্ততা মেনে নিতে পারলেও জাকিরের অবহেলা এবং অত্যাচার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। শেষ দিকে ওর অত্যাচার অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। তিন মাসের প্রেগনেন্সির সময় কথাকাটির একপর্যায়ে জাকির আমাকে লাথি মেরে ফেলে দিলে আমার মিসক্যারেজ হয়ে যায়। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওর সাথে আর নয়। জাকিরের সাথে ডিভোর্সের পর থেকে প্রায় পাঁচ বছর আমি একাই থাকছি, নিজের মতো করে বাঁচতে চেষ্টা করছি। এই দীর্ঘ পাঁচ বছরে তুমি কি কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো? এক্সট্রা মেরিটাল এ্যাফেয়ার, প্রেম ভালোবাসা অথবা শুধুই শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো সম্পর্ক?

প্রফেসর বিশ্বাসের প্রশ্নে আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। সত্যি কথা বললে তো অনেক কথা বলতে হয়। গত পাঁচ বছরে আমি অন্তত চারজন পুরুষকে বিছানায় ডেকে নিয়েছি। আমি কার কথা বলবো! আমার কবি বন্ধু আলমগীর, যে বিদেশে থেকে মাঝে মধ্যেই তার কষ্টার্জিত অর্থের একটা অংশ আমার এ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছে? সাংবাদিক তুর্য নিজাম, যে আমাকে বাড়িওয়ালার সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার পরে কিংবা পুলিশের হয়রানিসহ নানা ধরনের উটকো ঝামেলা থেকে রক্ষা করেছে! ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটের এম আর খান স্যার, যিনি আমার দুর্দিনে একটা পার্টটাইম কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন? আমার ফেসবুক বন্ধু মলয় রায়, আমার অসুস্থতার সময় কয়েকবারই যে হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করেছে? মলয়ের সাথে এখন সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও প্রয়োজনে কাজে লাগতে পারে ভেবে যোগাযোগটা বজায় রেখেছি। এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই এক বা একাধিকবার শারীরিক সম্পর্কে জড়িত হলেও কাউকেই আমি স্থায়ীভাবে গ্রহণ করিনি। এমনকি কোনো না কোনো অজুহাতে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিতাড়িত করেছি। আমাকে দীর্ঘ সময় নিরুত্তর দেখে মঞ্জুশ্রী বিশ্বাস নিজেই বলেন, সত্যি কথাটা আমার জানা দরকার। তোমার লজ্জা পাবার কোনো কারণ নেই। প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন সব অকথিত কথা থাকে যা সবার কাছে প্রকাশযোগ্য নয়। কিন্তু জানো তো, উকিলের কাছে তথ্য গোপন করলে মামলায় হেরে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একইভাবে ডাক্তারকে সঠিক তথ্য না দিলে অসুখ সারানো সম্ভব নয়। গত কয়েক বছরে একাধিক জনের সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে এবং এদের মধ্যে আমি বোধহয় দুই একজনের প্রেমেও পড়েছিলাম। তবে কারো সাথেই আমার সম্পর্ক বেশিদিন থাকেনি। শুরুতে যাকে ভালো লাগছিল, বলা যায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমি তার সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি এবং কীভাবে কতো দ্রুত তাকে আমার জীবন থেকে বিতাড়িত করা যায় সেই উপায় খুঁজতে হয়েছে। আর বর্তমানে…; বর্তমানে কী? তুমি আমার কাছে নির্দ্বিধায় সবকিছু খোলামেলা বলতে পারো। আমার দোদুল্যমানতা নিশ্চয়ই বিশিষ্ট মনোচিকিৎসকের দৃষ্টি এড়ায়নি। আমি আমার কণ্ঠে সবটুকু জোর একত্রিত করে বলে ফেলি, বর্তমানে আমি একজনের সাথে লিভটুগেদার করছি। প্রফেসর আবিদা সুলতানা তোমার শারীরিক সমস্যার জন্যে কোনো সাজেশান দেননি? আমাকে বিয়ে করে ফেলতে বলেছেন। তুমি তো একটা বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যেই আছো বলা যায়। শুধু অফিসিয়াল কাগজপত্রে বিষয়টার একটা বৈধতা দিলেই হয়। সমস্যা তো সেখানেই ম্যাডাম। আমি এই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছি। প্রফেসর বিশ্বাস কিছুক্ষণ নীরবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকেন, তারপরে গম্ভীর গলায় বলে ওঠেন, হুম! বুঝতে পারছি ওসিডি অর্থাৎ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার তোমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। প্রফেসর ডাক্তার মঞ্জুশ্রী বিশ্বাস কয়েকটা ট্র্ধসঢ়;াঙ্কুুলাইজার জাতীয় অষুধ এবং বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে একমাস পরে দেখা করতে বলেছিলেন। একমাস পরে একবার এবং তারপরের দু মাসে আরও দুবার কাউন্সিলিংএর পরে আমি বুঝে ফেলেছি প্রফেসর বিশ্বাসের কাছে আর যাবার প্রয়োজন নেই। শুধু মঞ্জুশ্রী বিশ্বাস নয়, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি আর কখনোই কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাব না। আসলে আমার নিজের যদি কোনো মানসিক সমস্যা থেকেই থাকে তাহলে তার নিরাময় আমার নিজের হাতেই।

মঞ্জুশ্রী বিশ্বাস শুধু কতোগুলো বিষয় পরিস্কারভাবে তুলে ধরেছেন। কয়েকমাস সাইকোলজিস্টের কাছে ঘোরাঘুরি করে ওসিডি, সাইকোসিস, বাইপোলার ডিসঅর্ডার এবং সিজোফ্রেনিয়া সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেছে। নিজেকে বিশ্লেষণ করে আমি নিজের সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন দাঁড় করিয়েছি। এই মূল্যায়ন শতভাগ সত্যি না হলেও আমাকে নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বেশি আর কেউ চেনে না। মানুষ হিসাবে আমি ভীষণ স্বার্থপর। নিজের কাছে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি কারো উপকারের কথা মনে রাখি না অথবা বলা যায় রাখতে চাই না। শুধু অকৃতজ্ঞ বললে কম বলা হবে, আমি রীতিমতো কৃতঘ্ন। অতীতের অনেক প্রিয় মানুষ, যাকে ভবিষ্যতে আমার আর কোনো প্রয়োজন নেই, তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে আমার এক মুহূর্ত সময় লাগে না। চরিত্রের এই নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আগে আমার কিছুটা অস্বস্তি ছিল। মঞ্জুশ্রী বিশ্বাস আমাকে সেই হীনমন্যতা থেকে উদ্ধার করেছেন। আমি এখন সবকিছুই আমার ওসিডি বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ধরে নিয়ে শান্তিতে আছি। যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো মানুষের মুখের উপর আমি দরজা বন্ধ করে দিতে পারি, পরিচিত অপরিচিত সবার ক্ষেত্রেই চোখ উল্টিয়ে ফেলতে আমি দ্বিতীয় বার ভাবি না। আমার আচরণ কারো মনোকষ্টের কারণ হলেও আমার কিছু আসে যায় না, তারপরেও সবকিছুর জন্যে মনোবৈকল্যকে দায়ী করে আমার ভেতরে কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না।

গত কয়েক বছরে শারীরিক অসুস্থতা, কাজের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, অর্থিক টানাপোড়েন এবং বারবার সঙ্গী বদলের ভেতর দিয়ে আমি একটা অস্থির সময় পার করেছি। এখন সত্যিই আবার থিতু হবার কথা ভাবছি। সম্প্রতি নতুন কর্মস্থলে আমি একজনকে টার্গেট করেছি। এরিয়া ম্যানেজার শোভন আমার কাছাকাছি বয়সের সচ্ছ্বল চাকরিজীবী, বিবাহিত এবং দুই সন্তানের পিতা, তবে স্ত্রীর সাথে বনিবনা নেই। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি তাকে আমার বিছানায় নিয়ে আসতে তিন মাসের বেশি সময় লাগবে না। তবে এবারে আমি আর কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে চাই না। একটি নিশ্চিন্ত নিরাপদ সম্পর্ক এবং দীর্ঘস্থায়ী বিবাহিত জীবনই এখন আমার একমাত্র চাওয়া। এক্ষেত্রে আমাকে দুটি সম্ভাব্য সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। প্রথমত বর্তমানে আমি যার সাথে দিনরাত্রি যাপন করছি সেই আবদুল গণির সাথে সম্পর্ক শেষ করে তাকে বিতাড়িত করা এবং দ্বিতীয়ত যে কোনো মূল্যে শোভনকে বিয়েতে রাজি করানো। আবদুল গণি মধ্যবিত্ত কেরানি মানসিকতার মানুষ। আয় রোজগার কম হলেও লোকটি মনের দিক থেকে ভালো। তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ নেই, কিন্তু যথেষ্ট কেয়ারিং। আমাকে বিয়ে করার জন্যে এক পায়ে খাড়া। কিন্তু আমি আর এইসব বিত্তহীন মানুষের সাথে ঘর করতে রাজি নই। ইদানীং গণিকে এড়িয়ে চলার কারণ হিসাবে বলেও দিয়েছি ওসিডির কারণে পুরুষ মানুষ সম্পর্কে আমার ভেতরে এক ধরণের ভীতি কাজ করছে। সেক্ষেত্রে আমি আপাতত তার কাছে থেকে দূরে থাকতে চাই। চিকিৎসা শেষে মানসিক সুস্থতা ফিরে পেলেই আবার তার সাথে যোগাযোগ করবো। আমার প্রতি ভীষণ সহানুভুতিশীল নির্বোধ লোকটি আমার ওসিডির অজুহাত মেনে নিয়েছে। এখন বাকি রইলো স্ত্রীর সাথে শোভনের ডিভোর্সের ব্যাপারটি চূড়ান্ত করা। তিন মাস পূর্ণ হবার আগেই আমি সোবহানবাগে আমার দুই রুমের এ্যাপার্টমেন্টে শোভনকে কফি খেতে ডেকেছিলাম। আবদুল গণিকে বিদায় দেবার পরে আমার ঘরদোরগুলো একটু গুছিয়ে নিয়েছি। কফি খেতে খেতেই আমার ছোট্ট সাজানো গোছানো ঘর দুয়ারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ শোভন আক্ষেপ করে বলে, আমি একটা অগোছালো বস্তিবাড়িতে থাকি। আমার বাসায় কখনো এলে আপনার মনে হবে হয়তো বাসা বদল করে এই মাত্র কোথাও থেকে এসেছি অথবা শিশগিরই মালপত্র নিয়ে কোথাও যাবার জন্যে বের হবো। কথা শেষ করে একটু হাসতে চেষ্টা করে শোভন। আমি তাকে একটু টোকা দিয়ে তার মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করে বলি, আমি একদিন এসে আপনার ঘর গুছিয়ে দিয়ে আসবো। একদিনের জন্য গোছাতে এসে তো কোনো লাভ হবে না। দুদিন পরেই আবার সব আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। তাহলে কি স্থায়ীভাবে চলে আসবো? আমি হাসির ছলে আমার মনের কথাটা প্রকাশ করে দিই। সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান তো সেটাই হতে পারে।

শোভন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে আমি তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি কথাটা সিরিয়ালি বলেছেন? আমি অনেকদিন আগেই কথাটা ভেবেছি, কিন্তু সাহস করে বলতে পারিনি। আমি শোভনের আরও কাছে এগিয়ে এসে তার কাঁধের একটা হাত রেখে বলি, আজ যখন সাহস করে বলেই ফেলেছেন, তখন আরেকটু সাহসী হতে নিশ্চয়ই আপত্তি থাকবে না। শোভন তার বাঁ হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আর ডান হাত পিঠে রেখে কাছে টেনে নেয়। দীর্ঘদেহী শোভনের ঠোঁট আমার ঠোঁটে নেমে এলে সে অস্ফূট কণ্ঠে বলে ওঠে, আমি তোমাকে ভালোবাসি সুমনা।

আমি বুঝতে পারি এরপরে কী ঘটতে যাচ্ছে। আমার তৃতীয় বিবাহের প্রস্তুতি সম্পন্ন। আশাকরি চূড়ান্ত পর্বের জন্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।

0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments