জীবন ফিকশনের চেয়েও বড়
– এ এইচ এম জহিরুল ইসলাম
বাঘের ভয় আছে, তবু কপাল কপালকুণ্ডলা’র নবকুমার যায়- কাঠ আহরনে। পথ হারানো পথিক নবকুমার ‘ তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবোনা কেন?- মন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে বনে যায়। বনে সাক্ষাৎ হওয়া অধিকারী বলে- যাহাতে জগদীশ্বরের হাত, তাহা পন্ডিতে বলিতে পারেনা।
নবকুমারের সাথে কপালকুণ্ডলা, কাপালিকের দেখা হওয়া কি নিয়তি নির্ধারিত? এ প্রশ্নগুলো মনে আসছে, ‘ গোপন একটি নাম’ এর রাহাত বিন আমিনের গোপন মর্মকথা পড়ে। রাহাত বিন আমিনও ‘ তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবোনা কেন? – মুল্যবোধের বিশ্বাসী হয়ে মহাভারতের অভিমন্যুর মতো ঘটনার চক্রবূহ্যে ঢুকে পড়ে।
ইন্টার্ন ডাক্তার রাহাত, সঞ্জয়,সালেহ এবং মেডিকেল পড়ুয়া অনীমা কলেজ ক্যান্টিনে বসে ‘ শিক্ষার্থীরা কি হালের বলদ’ শিরোনামে সংবাদ পড়ে এবং শিক্ষার্থীর পিঠে লাল দাগ দেখে , শিক্ষা ব্যবস্থা এবং যে শিক্ষক নিয়ে আলাপ, আলোচনা করলো, তিনি সন্ধ্যায় রোগী হয়ে ভর্তি হলো হসপিটালে। শিক্ষক শাহানারা ঘুমের ঔষুধ খেয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর চেষ্টা করে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার বোন জাহানারা হসপিটালে নিয়ে আসে তাকে।
সেখানেই স্কুল শিক্ষক আমিন সাহেবের ছেলে ইন্টার্ন ডাক্তার রাহাত জাহানারের সাথে ‘ ডাক্তারি ব্যক্তিত্ব’র আবরন ভেঙে ফোন নাম্বার বিনিময় করে।
নিয়তি নির্ধারন না করলে কি রাহাত এ কাজটি যেচে করতো? করতোনা- কারন জীবন ফিকশনের চেয়েও বড়। এটাই আবার বুঝিয়ে দিয়েছেন লেখক এই উপন্যাসের কাহিনী পরম্পরায়। ঘটনার মিথস্ক্রিয়ায়।
সেই জীবনে রাহাতের সাথে শাহানারা,জাহানারা এবং আনিকা জড়িয়ে পড়ে।
আনিকা,’ রাহাতের বাবার ধনী বন্ধু জামাল উদ্দিনের কন্যা। এই জামাল উদ্দিনের ‘ আনিকা ভিলা’র চিলেকোঠায় বিনা ভাড়া থাকে রাহাত এই শর্তে- মাঝে মাঝে আনিকাকে পড়া দেখিয়ে দিবে। পড়া দেখাবে নাকি জামালউদ্দিনের চাওয়া নিশ্চিত ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার রাহাতের সাথে কন্যার বিয়ে দিবে?
ঘটনা পরম্পরায় আমরা তা সামান্য বুঝতে পারি। কিন্তুু আনিকার আছে বয়ফ্রেন্ড রবিন খান। রাহাত – তার কাছে উটকো ঝামেলা। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের রাহাত আনিকার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখে। রাহাত বরং তার চেয়ে বেশি বয়সী শাহানারার সাথে একটি অসম সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। শাহানারাকে মনোচিকিৎসক দেখায়,চাকুরি পাইয়ে দেয় আবার। শাহানারাও এগিয়ে আসে- তবে বুঝা যায়না এটা কি রাহাতের সাথে সৌজন্য সম্পর্ক না আরো বেশি কিছু? একদিন রাহাতের বন্ধুদের রান্না করে খাওয়ানোর জন্য আসে রাহাতের চিলেকোঠায়। রাহাত শারীরিক আবেগে শাহানারার প্রতি আকৃষ্ট হয়। শাহানারা নিষেধ না করলেও খুব গভীর আবেগ ছড়িয়ে পড়েনা দুজনের মাঝে।
এদিকে আনিকার সাথে সম্পর্কের ভাঙন হয় মাদকাসক্ত রবিনের। সাইবার বুলিং শিকার হওয়ার ভয়ে আনিকা সাহায্য চায় রাহাতের। রাহাত করেও।
এভাবেই বারবার রাহাতের সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া – নিয়তি নির্ধারিত বলেই লেখকের বয়ানে স্পষ্ট হয়।
আনিকাকে নিয়ে যেদিন সালেহ-বীথির বাসার অনুষ্ঠানে যায়- সেদিন দূর্ঘটনায় মৃত্যু হয় শাহানারার। এটা কি দূর্ঘটনা না শাহানারার সাবেক সহকর্মী ওমর ফারুক জীবনের কোন কারসাজির ফল- সমীকরণ মেলাতে চেষ্টা করে রাহাত। এই ওমর ফারুক জীবনের জন্যই শাহানারা তার শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাত করেছিল- এরকম একটা ব্যাখ্যা আমরা পাই।
আবার জীবনের সাথে শাহানার জড়িয়ে যাওয়া,তার মৃত্যু সন্দেহের উদ্রেক করে রাহাতের মনে।
রাহাত ঘটনার ঘনঘটায় ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিতে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাতে চাকরি পেয়ে চলে যায় টেকনাফ – রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দিতে। আনিকাও চাকরি পেয়ে একদিন হাজির হয় রাহাতের টেকনাফস্থ বাসায়।
রাহাত- আনিকার একটি পরিণত সম্পর্ক হবে আমরা পাঠকেরা তা বুঝতে পারি। কিন্তুু রাহাতের সাথে আকাশের ওপারে যাওয়া শাহানারার যোগাযোগ আছে- এটুকুই পাঠককে জানান লেখক। সেই যোগাযোগটা কি- তা আর জানেনা কেউ,আনিকাও না।
শাহানারা,এই গোপন একটি নাম- হৃদয়ের কোথাও ধারণ করে রাহাত হয়তো ছুটে চলে জীবনের লক্ষ্য পানে।
উপন্যাসটিতে রোহিঙ্গা সমস্যা, জঙ্গি ইস্যু, খবরের কাগজের ভাষার বিষয়ও প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে।
উপন্যাসে উঠে আসা রোহিঙ্গা সমস্যা, জঙ্গি ইস্যু নিয়ে আলোচনার সাথে একমত হলেও সংবাদ পত্রের ভাষা নিয়ে ভিন্নমত আছে। ভিন্নমতটা এই – সংবাদ ভাষ্যের কারনেই ঘটনার শিকার শাহানারা সম্পর্কে আমাদের মনে ভুল ধারণা জন্মায়- যেখানে আগে শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাত করলে খবরের কাগজ লিখতো-‘ শিক্ষার্থীতে বেত্রাঘাত’ এখন লেখা হয়- ‘ শিক্ষার্থী কি হালের বলদ?
এই ধরনের শিরোনামকে হালনাগাদ বলা হয়েছে উপন্যাসে- কিন্তু এই শিরোনাম- ই তো শাহানারাকে খল বানায় পাঠকের সামনে।
লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাসের ভাষা সরল,টানটান। এতই যাদু মাখা, এক প্যারা পড়লে পরবর্তী প্যারা পড়ার আগ্রহ জাগায়। তবে পাঠককে এত আরাম দিলে জনপ্রিয় ‘ হাল্কা’ শব্দটি জুড়ে দিতে পারে কেউ কেউ।
‘গোপন একটি নাম’ উপন্যাসের নামকরণের যথার্থতা পাই বলেই আরেকধাপ ভালোলাগা তৈরি হয় বইটি পড়তে গিয়ে। মাসুক হেলাল এর সুন্দর প্রচ্ছদ মোড়ানো এই উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে প্রথমা। জীবনকে আরেকবার ভাবতে বাধ্য করবে পাঠককে। একথা নিশ্চয়ই বলা যায়।