গুচ্ছ কবিতা – তিথি আফরোজ

By Published On: August 4, 2021Views: 320

নদী

নদীর কাছে দিগন্তে হেলান দিয়ে
আমারও কিছু বলার ছিলো
কেমন করে অনন্ত জীবন বয়ে চলে
অবসরের বেলা ভুলে ছুটে চলা
সাগর পানে!

সাগর তার ফেনিল বুকে- থেকে সুখে
গর্জন তুলে ডেকেই চলে স্রোতস্বিনী, পল্লবিনী
চন্দ্রমনি, হরঘরণী হাজার নামের তুফান তোলে
লবণাক্ত ঘূর্ণিমুখর প্রেমের লোভে যায় ছুটে যায়
তন্ত্রমেদুর দুপুর ভুলে বোকা সরল সকল নদী
নিরবধি আত্মভোলা চপলতার জলাঞ্জলি দিয়েই
সুখী! ও নদী, সুখ কারে কয়, বোঝ তুমি?
এমন নাচন, ধ্বংসকেতন তোলে যখন হায়দরী হাঁক
সে কি তখন তোমার আপন? ভেঙে নিলে চাষার কুলা
চলে গেলে দুধের গোলা, একটুও কি মন পোড়ে না
জান কাঁপে না! এমনই অন্ধ প্রেম কামনায় ছুটেই চলো
ঠিক হলো, ঠিক হলো না। ও নদী, এমন প্রেম আর করো না
আর করো না, থামতে শেখো, শিখে থামো…

 

সুখ ও স্বপ্নের সাম্পান

ইতিহাসের বুকে দাঁড়িয়ে এঁকে যাবো ইতিহাস
ওগো দরদী যমুনা প্রশস্ত করো বুক
উৎফুল্ল জলে ডুবিয়ে তোল স্নিগ্ধ বাতাস
বয়ে যাক এই লোকালয়ে সুখ ও স্বপ্নের সাম্পান।

এই করোনার করুণধ্বনি বাজে না যেন কারো মনে
অতলের গরল তলে সমাধি তাবিজ করে চলে যাওয়া
জীবন তরী চলে না;
ভূতলে বিঁধে রেখে বুক ওড়ে না চড়ুই, টিয়া
উন্মাদ সকল জাগো জাগো, তরবারি তসবির তালে
একটি নতুন মন্ত্রে অজ্ঞাত দাওয়াই স্ফুরিত করুক
উজ্জীবিত মূর্চ্ছনা
ও উন্মাদ, ও ইবনে সিনা দেখাও শ্রেষ্ঠ করতল!

 

পিপাসা

তোমার যাবতীয় পিপাসা আমিই মিটাবো;
জানো তো, এখানে কুসুম তিথিতে শেফালীর ডালে
ডুমুর ফুল ফোটে। লতানো রক্তজবার রেণু দুলে উঠলেই
লক্ষ্মীপ্যাঁচাটা স্থির তাকিয়ে থাকে মঙ্গলের আশায়।

আমি আকাশ থেকে মঙ্গল প্রদীপ নামাবো বলেই
খনার জিহ্বা গজিয়ে ফেলেছি পুনঃবার।
তোমার সকল সাধ অবলীলায় শুধু আমাকেই বলো;
আমি শখের তোলা আশির উর্ধ্বে ক্রয় করে রেখেছি পরম যত্নে।
এক জীবনের সকল অবগাহনে ফুরাবার নয় প্রলম্বিত সমুদ্র স্রোত।

অবগুণ্ঠন খুলে সূর্য উঠার আগেই জেগে আছে মহাপৃথিবীর স্বর্গ।
সুরার পেয়ালা তৈরি আছে ইস্কের ভাণ্ডারে:
সুবেহ-সাদিকের আগেই পান করে নাও,
মেটাও পিপাসা।

 

পারলেসিগারেটটাছেড়োনা

সূর্যাস্তের ঠিক আগে যে গোলাপি আভা
আমাকে বিমোহিত করে তাতে
গা এলিয়ে এক চুমুক ধূমায়িত কফির সাথে
তোমার ঠোঁট টেনে নেয়ার বাসনা করছি;
তখন সুখের সাথে একটু সিগারেটের ধোঁয়া মিশেল
থাকলে মোহ বাড়বে
পারলে সিগারেটটা ছেড়ো না…

(‘এবং খেজুর বৃক্ষ ও আঙ্গুর ফল থেকে
তোমরা মদ্য ও উত্তম খাদ্য তৈরী করে থাক,
এতে অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে
নিদর্শন রয়েছে। [ সুরা নাহল ১৬:৬৭’)
পারলে মদ্যটা মজাও
বোধশক্তি সম্পন্ন হও
কাছে আসতে পুলসিরাত লাগবে না
একটু সুক্ষ্ম কাতরতায় সুরা ঢালো দুটি সরু গ্লাসে
বুকে বুকে চিয়ার্সে রঙিন আলো জ্বালালে
মদ্যআর্দ্র ঠোঁট ঘষে নেবো অতীন্দ্রীয় অলি গলিতে
পারলে সিগারেটটা ছেড়ো না

আগুনে পোড়ানো ইসক– কামাতুর করে
ধোঁয়া আর সুরায় ডোবা ঠোঁট
নবরত্ন সভার মূর্চ্ছনা তোলে
গর্জনরত মেঘ নেমে এলে চন্দ্রগিরিতে
নিত্য আর কলা– অঙ্গ উন্মুক্ত করতে ব্যস্ত হয়
অতএব পারলে ছেড়ো না
ছেড়ো না জঙলি নদীর বাঁক
ছেড়ো না ধান শালিকের ঢাক
আর আমার তুলসীগঙ্গার মায়া

মারিজুয়ানা আর বুদ্ধের ধ্যানে
যখন পৈত্রিক ভিটা আলুথালু হয়
তখন একটা হাতের ওম লাগে হাতে;
একটু ছোঁয়ার তীব্রতার মোড়কে জড়িয়ে
একটা শীতঘুম দিতে চাই
পারলে মারিজুয়ানার একটা সুখটান রেখো
আমি অথবা লিওনার্দোর মোনালিসা
যে কেউ একটা সুখটান দিবে
দিবে ধোঁয়াসেচুমু তোমার তন্দ্রামগ্ন ঠোঁটে
পারলে সিগারেটটা ছেড়ো না

 

সূর্য

জেগে উঠে দেখি
সূর্য ডুবে গেছে বড় দিঘিটির পাড়ে।
এই তৃষ্ণার্ত চোখ কোথায় লুকায়!
আল্পসের মঁ ব্লঁ অথবা কারাকোরাম
বন্ধু তোরা-আরালে নিবি;
লুকিয়ে?

ডুববি-ই যদি ডাকলি কেন
দশ আঙুলে জাকুজ্জি অব ডিসেপেয়ার
রহস্যঘন রহস্যরসের ওপার থেকে!
যখন আবার উদিত হবি, সীমানার চরাচরে
তখন আবিষ্কারে নেশা হবে, নতুন একটা
গহীন গুহা, সুখ ছড়ানো, চোখ ধাঁধানো
মেলিসসানি অথবা ফিঙ্গেলসে, তলিয়ে নয়
ঠিক ঘুমিয়ে যাবো, দেখিস একটা∑
দীর্ঘ আয়ু পেয়েই যাবো…

 

মৃত্যু সংবাদ

সংবাদ লিখতে গিয়ে যারা
নিজেই সংবাদ হয়ে যায়
তাদের নামে কি নিষ্প্রাণ পৃষ্ঠা কাঁদে?

আউশের ধানের গন্ধে ক্ষেত
মাতাল হয় না, পেটমোটা চাল
দীর্ঘ সময় পেট পূর্ণ রাখার বিদ্যা
মুখস্থের কৌশল শেখায় গরীব পেটকে;
কিছু প্রশংসা বীজে বীজে বয়ে চলে।
লাঙ্গল নীরবে গেঁথে রাখে স্বাদ,
আহ্লাদে কর্ষণ করে যোনি ও জীবন
নিগূঢ় মন্থন এবং জল ছুঁয়ে মাটি
উর্বর উর্বশী করে চলে যায় গেরস্থ:
পড়ে থাকে জীবনহীন বিন্দাস জীবনে
শুস্ক প্রিয় সেই মাটির সামান্য প্রলেপে।
এটা কী প্রেম নয়!

বীজে ফুল হবে,
ফলের গর্বে ভরে যাবে মাটির গর্ভ
ভুলে যাবে যে লাঙ্গল কর্ষণের প্রেমে
উর্বর করে কঠিনকে ভেঙে জীবন্ত
করে দিয়েছিল জননীর স্বাদ, সে হারাক
পালাক, অল্প প্রেম মানেই অল্প নয় কিন্তু;
সুদূর সূর্যও জানিয়ে দেয় আমি আছি
রাত শেষে আমার নামেই আমার মতোই
অন্য একটি সকাল দূর থেকেই আমার প্রেম
দেখবে।

কোন কোন মৃত্যু খবর মানেই শুধু মৃত্যু নয়
আবার একটা জন্মের নাম, এঁকে যাওয়া পদচিহ্ন
বা একটি ক্ষেত্রের উর্বর জন্মের প্রতিটি ফলের নাম।

 

ঈদ

বাবা কবরে যাওয়ার সময়ও
রেখে গিয়েছিলেন আমার জন্য
বালিশের তলায় একগুচ্ছ ঈদ।
আমাদের উঠানের চিকচিকে রোদ্দুরে
উড়ে বেড়াতো আমার সোনালি সেসব ঈদ।
হারাতো না পালাতো না
আমার জন্য রেখে যাওয়া বাবার সেইসব ঈদ।

ভাইদের শুভ্র পাঞ্জাবিতে, মায়ের তসবিতে
সৌরভ মাখাতো ঈদের টালমাটাল সুগন্ধি।
আমি একবার:
আহ্লাদে আকাশে তুলি, মাথায় ফুলতাজ বানাই
গলায় গজমতি গাঁথি, হাতে আংটি কিংবা বাজু;
ফরফর করে পাখনা বানিয়ে উড়তে গিয়েই দোষ!

উড়ে গেলো; নিভে দিলো উঠানের রঙিন আলো,
ছোট ভাই রাগ করে কবরে যাওয়ার সময় ছিনিয়ে নিয়ে গেলো:
আমার বাবার দেয়া ঈদগুলো। সবাই মাটি দিয়ে ঢেকে দিলো
আমার ঈদসহ আস্ত ভাইকে।
সেই থেকে আমি ঈদহীন।

মা নাকি বুদ্ধি পর থেকেই ঈদ পায়নি,
নানা বিক্রি করে দিয়েছিলেন, জীবন্ত সব ঈদ
তাহলে-আর কে ফিরিয়ে দিবে আমার ঈদ!

 

ভ্রমের নদী

একগুচ্ছ ধোঁয়া, এক চুমুক পানীয়
যাপনের নিভৃত রথ তারকামণ্ডিত
জীবনানন্দ বাবু, উত্তম কুমার
টেবিলের ওপারে জ্যোৎস্নার বৃষ্টি
মার্কেজ, মায়াকোভস্কি;
এই জীবনের এই-ই যাপন।

লাশের কোলাহলে অথবা
ডুবিয়ে আলকোহলে
করছি তো, করতেই হবে
ধর্ষকের বিশ্রী প্রশ্বাসে
প্রেমিকের তীব্র প্রেমঘ্রাণ মাখিয়ে
ভ্রমের নদীতেও
সুখ নামের পাতাকা উত্তোলনে
যাপন; করছি তো।

বিদ-ঘুটে অন্ধকারেও; প্রাণোচ্ছাসে চাঁদে
সাম্পান ভাসিয়ে সুখমুখ জ্বালিয়ে যাপন।
কেবল আমিই নয়, কবি-ই কেবল পারে
পারছি তো?

 

প্রাণেশ্বরীমা

ক্যামন করে পারি দিবো
কংকর সাগর গহীন পাথার
উপায় বলো কান্ডারি গো
দুঃখীর দরদী আমার
প্রাণেশ্বরী মা

জীবন নদীর প্রতি ঘাটে
নানান জাতের হাঁট
সেই হাঁটের কেনা বেঁচায়
হরেক পদের ফাঁদ
আমি সুখের আশায়
ছাড়লাম তরী
সুখ হলো এক উড়াল পরী
দিবানিশি খুঁজে মরি,
আজব ভ্রমের দুনিয়ায়
কোথায় যাবো ক্যামনে পাবো
উপায় বলো মা, কান্ডারি গো
দুঃখীর দরদী আমার
প্রাণেশ্বরী মা

 

তিথিতীর্থমায়া

গুচ্ছ গুচ্ছ জীবন উছলে পড়লে জীবনের উপরে
সহস্র তপ্ত পথের কিনারে বর্ণিল ছায়া উড়ে আসে আকাশে;
এখানেই নক্ষত্ররাজি এখানেই আত্মার বিনিময়,
ঝড়ে পড়ে প্রশান্তির ঘ্রাণ। রাশি রাশি কল্লোলিত প্রাণ,
প্রণোদিত শীতলক্ষ্যার গান।

২.
উড়েছে রঙিন হাওয়া, তুলেছি পাললিক পাল;
ঠিকানায় ঘুমায় তরী, মাস্তুলে বয় সুখ।
মহুয়ার মনোহর নীড়ে সুবাসিত বেলী ও বকুল।

৩.
তৃষিত দৃষ্টি প্রস্ফুটিত সূর্যের আভায়
আবিষ্কার করে-
তৃপ্তির মঞ্জিলে নবরত্নের ব্রহ্মাণ্ড।

৪.
জীবনের জয়গানে প্রিয় হাসিমুখের সুখ
উজ্জীবিত প্রাণের গান শোনায়;
ছোঁয়াচে আত্নার আলো ভেসে ওঠে ঠোঁটে

৫.
ভোরের আভায় ভেসে
পাখির গানে এসে
ক্লান্তির নিগুঢ়ে বসো
চোখের পাতা ছুঁয়ে
ঠোঁটের জাদু মেখে
বিছিয়ে পরশপাটি
বুকে সাজিয়ে রাখো

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop