কাজী মোতাহার হোসেন এর কাছে লিখা কাজী নজরুল ইসলাম এর একটি চিঠি
১৫, জুলিয়াটোলা স্ট্রীট
কলিকাতা
০৮-০৩-২৮, সন্ধ্যা
প্রিয় মতিহার
পরশু বিকালে এসেছি কলকাতা। ওপরের ঠিকানায় আছি। ওর আগেই আসবার কথা ছিল , অসুখ বেড়ে উঠায় আসতে পারিনি। ২/৪ দিন এখানেই আছি। মনটা কেবলই পালাই পালাই করছে। কোথায় যাই ঠিক করতে পারছিনে। হঠাৎ কোনদিন এক জায়গায় চলে যাবো, অবশ্য দু – দশ দিনের জন্য। যেখানেই যাই, আর কেউ না পাক, তুমি খবর পাবে।
বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের মতিহার, বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে , সেদিন অন্ততঃ তোমার বুক বেঁধে উঠবে। তোমার ঐ ছোট্ট ঘরটিতে শুয়ে , যে ঘরে তুমি আমায় প্রিয়ার মত জড়িয়ে শুয়েছিল, অন্ততঃ এইটুকু স্বান্তনা নিয়ে যেতে পারবো , এই কি কম সৌভাগ্য আমার !!!
কেন এই কথা বলছি শুনবে ? বন্ধু আমি পেয়েছি যার সাক্ষাত আমি নিজেই করতে পারবো না । এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু , গানের বন্ধু, ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে উঠেনি কেউ। আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ পাতাটির লেখা তোমার কাছে লিখে গেলাম। আকাশের সবচেয়ে দূরের যে তারাটির দিপ্তী চোখের জলকনার মত ঝিলমিল করবে, মনে কর, সেই তারাটি আমি । আমার নামেই তার নামকরণ কর, কেমন ?
মৃত্যু এত করে মনে করছি কেন ? জানো, ওকে আজ আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হচ্ছে বলে ! মনে হচ্ছে, জীবনে যে আমায় ফিরিয়ে দিলে, মরলে সে আমায় বরন করে নিবে। সমস্ত বুকটা ব্যাথায় দিন রাত টন টন করছে। মনে হচ্ছে সমস্ত বুকটা যেন ঐখানে এসে জমাট বেঁধে যাচ্ছে। ওর যেন মুক্তি হয়, বেঁচে যাবো। কিন্তু কী হবে কে জানে !! তোমার চিঠি পেয়ে অবধি কেবল ভাবছি আর ভাবছি। কত কথা, কত কী !!! তার কি কূল কিনারা আছে !!! ভাবছি আমার ব্যাথার রক্ত কে রঙীন খেলা বলে উপহাস যে করেন, তিনি হয়তো দেবতা, আমার ব্যাথার অশ্রুর বহু উর্ধ্বে। কিন্তু আমি মাটির নজরুল হলেও সে দেবতার কাছে অশ্রুর অঞ্জলি আর নিয়ে যাবো না। ফুল ধূলায় ঝরে পড়ে , পায়ে পিষ্ট হয়, তাই বলে কি ফুল এত অনাদরের ? ভুল করে সে ফুল যদি কারোর কবরীতেই ঝরে পড়ে এবং তিনি যদি সেটাকে উপদ্রব বলে মনে করেন , তাহলে ফুলের পক্ষে প্রায়শ্চিত হচ্ছে এক্ষুনি কারো পায়ের তলায় পড়ে আত্মহত্যা করা।
সুন্দরের অবহেলা আমি সইতে পারিনে বন্ধু, তাই এত জ্বালা। ভিক্ষা যদি কেউ তোমার কাছে চাইতেই আসে , অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় তাহলে তাকে ভিক্ষা নাই ই দাও , কুকুর লেলিয়ে দিওনা। আঘাত করার একটা সীমা আছে, সেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে আসে আর তক্ষুনি তার নাম হয় অবমাননা। ছেলেবেলা থেকেই পথে পথে মানুষ আমি। যে স্নেহে , যে প্রেমে বুক ভরে উঠে কাঁনায় কাঁনায়, তা কখনো কোথাও পাইনি।
এবার চিঠির উত্তর দিতে বড্ড দেরী হয়ে গেল। না জানি কত উদ্বিগ্ন হয়েছ !!! কি করি বন্ধু , শরীর টা এত বেশী বেয়াড়া আর হয়নি কখনো। ওষুধ খেতে প্রবৃত্তি হয়না।
আমায় সবচেয়ে অবাক করে নিশুতি রাতের তারা। তুমি হয়তো অবাক হবে, আমি আকাশের প্রায় সব তারাগুলোকেই চিনি। তাদের সত্যিকারের নাম জানিনে কিন্তু তাদের প্রত্যেকের নামকরন করেছি আমার ইচ্ছে মত। সেই কত রকম মিষ্টি মিষ্টি নাম , শুনলে তুমি হাসবে। কোন তারা কোন ঋতুতে কোন দিকে উদয় হয়, সব বলে দিতে পারি। জেলের ভিতর যখন সলিটারি সেলে যখন বন্দি ছিলাম, তখন গরমে ঘুম হত না। সারারাত জেগে কেবল তারার উদয় অস্ত দেখতাম। তাদের গতিপথে আমার চোখের জল বুলিয়ে দিয়ে বলতাম , বন্ধু, ওগো আমার নাম না জানা বন্ধু, আমার এই চোখের জলের পিচ্ছিল পথটি ধরে তুমি চলে যাও অস্ত পাড়ের পানে। আমি শুধু চুপটি করে দেখি। হাতে থাকতো হাতকড়া, দেয়ালের সঙ্গে বাঁধা চোখের জলের রেখা আঁকাই থাকতো মুখে, বুকে। আচ্ছা বন্ধু , ক’ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়, তোমাদের বিজ্ঞানে বলতে পারে ? এখন শুধু কেবলই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে যার উত্তর নেই, মিমাংসা নেই – সেই সব জিজ্ঞাসা।
যেদিন আমি ঐ দূরের তারার দেশে চলে যাবো, সেদিন তাকে বলো, এই চিঠি রেখে সে যেন দু’ফোঁটা অশ্রুর দর্পন দেয়, শুধু আমার নামে। হয়তো আমি সেদিন খুশীতে উল্কা ফুল হয়ে তাঁর নোটন খোপায় ঝরে পড়বো। তাঁকে বলো বন্ধু, তাঁর কাছে আমার আর চাওয়ার কিছুই নেই। আমি পেয়েছি, তাঁকে পেয়েছি। আমার বুকের রক্তে, চোঁখের জলে আমি তাঁর উদ্দেশ্যে আমার শান্ত , স্নিগ্ধ অন্তরের পরিপূর্ন চিত্তের একটি সশ্রদ্ধ নমষ্কার রেখে গেলাম। আমি যেন শুনতে পাই, সে আমারে সর্বান্তকরনে ক্ষমা করেছে। ফুলের কাঁটা ভুলে গিয়ে তার উর্ধ্বে ফুলের কথাই যেন সে মনে রাখে।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে আবার লিখছি। কিন্তু আর লিখতে পারছিনে ভাই। চোখের জল , কলমের কালি দুইই শুকিয়ে গেল। তোমরা কেমন আছো, জানিয়ো। তাঁর কিছু খবর দাওনা কেন ? না কী সে এটুকুও মানা করেছে ? ঠিক সময় মতো সে ওষুধ খায়তো ?
কেবলি কীটস্ কে স্বপ্নে দেখছি। তার পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যানিব্রাউন পাথরের মত।
ভালোবাসা নাও
ইতি
তোমার নজরুল।
(ফজিলাতুন্নেসা কে না পাওয়ার ব্যাথায় বেদনা ভেঁজা বহিঃপ্রকাশ কাজী মোতাহার হোসেন এর কাছে লিখা কাজী নজরুল ইসলাম এর একটি চিঠি)