আল মাহমুদের উপমহাদেশ : যুদ্ধ ও প্রেমের সমন্বয়
এস ডি সুব্রত
আল মাহমুদ রচিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস উপমহাদেশ । মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জীবনচিত্রকে আশ্রয় করে লেখা উপন্যাসটিকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা না গেলেও যুদ্ধের ভয়াবহতা, হিংস্রতা, যুদ্ধের মাঝে প্রেম, দেশপ্রেম সব কিছুরই প্রতিচ্ছবি সত্যনিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন লেখক। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হিসেবেই বিবেচিত। এক টান দিয়ে শাড়িটা খুলে ফেলল। তারপর সেই শাড়ি দিয়ে আমাকে বেঁধে ফেলল। নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে দাঁত গুলো বের করে বলল, শাড়ি তুমি নিজেই খুলবে নাকি তোর বোনের মত করে খুলে নিতে হবে? নন্দিনী আপন হাতে শাড়িটা খুলে মাঝবয়স্ক রাজাকার কমান্ডারের হাতে তুলে দিল। নন্দিনীর শাড়ি দিয়ে নন্দিনী আর সীমা দিদিকে বেঁধে ফেলা হল। এরপর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল একটি গ্রামে। গ্রামটাকে দেখে মনে হল এখানে তেমন কেউ নেই। সম্ভবত ঐ গ্রামের কোনো এক সভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে আমাদেরকে নেওয়া হল। চোখ বেঁধে রাখায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না; সবই অনুমান। বাড়ির একটা ঘরে আমাকে বন্দি করে রাখা হল আর ঠিক পাশের ঘরেই নন্দিনী আর তার বোন সীমা দিকে বন্দি রাখা হল। সারাদিনের ক্লান্তি আর রাজাকারদের নির্যাতনের হঠাৎ করে মেঝেতে শোয়ার কারণে আমার শরীরে কাপন শুরু হল। ঠিক সেইসময় পাশের ঘর থেকে নন্দিনী আর সীমা দিদির চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। নন্দিনী চিৎকার করে বলছিল, ভগবানের দোহাই লাগে আমাদের ক্ষতি করো না । এতোটুকু শোনার পরই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফিরে তখন মেশিনগানের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আচমকা ঘরের দরজাটা খুলে গেল এবং অল্প বয়সী দুজন যুবক প্রবেশ করে আমার পানে চেয়ে বলে, কবি সাহেব! ভয় পাবেন না। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আনিস ভাইয়ের গ্রুপের লোক।’ উপরোল্লেখিত লাইনগুলো আল মাহমুদ এর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘উপমহাদেশ’-এর কাহিনির অংশ মাত্র। গল্পের নায়ক সৈয়দ হাদ মীর। পেশায় সরকারি চাকুরেজীবি এবং দেশের নামকরা কবি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কবি হাদী মীর আনিস নামক এক মুক্তিযোদ্ধার সাথে বর্ডার পাড়ি দেবার জন্য বের হন। তারা নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে দুজন মেয়ে খুবই অনুরোধ করে তাদের নৌকায় উঠে বসে। আর সেই দুই মেয়েই হল নন্দিনী ও সীমা।
এক সময় ঘটনাচক্রে কবি এবং মুক্তিযোদ্ধা আনিস বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর এই বিচ্ছিন্নতার কারণে রাস্তা ভুলে কবি হাদী মীর এবং নন্দিনীরা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে যায়। এবং পরবর্তিতে আনিস তার দলবল নিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে। অন্যদিকে কবি হাদী মীরের স্ত্রীও একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর বাংলাদেশ বর্ডার পাড়ি দেওয়ার সময় নানা ঘটনার সাথে সাথে নন্দিনী এবং কবির ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। পথিমধ্যে নন্দিনীর বোন হানাদারদের গুলিতে নিহত হলে নন্দিনী কবির উপর আরও বেশি নির্ভর হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে নন্দিনী এবং কবি উভয়ই দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলে। অন্যদিকে কবি হাদী মীর বুঝতে পারেন, তিনি এখনো তার স্ত্রীকে ভালোবাসেন। এক পর্যায়ে কবির মুক্তিযোদ্ধা স্ত্রী নন্দিনী এবং কবির মধ্যকার প্রননয়ের কথা জানতে পারেন।গল্পের নায়ক কবি হাদী মীর ঢাকায় পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের লাইব্রেরিয়ান তিনি। ঢাকা যখন পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেছে, চারিদিকে পাকিস্তানিদের অমানবিক অত্যাচার ও লুটপাটের কারণে লোকেরা ঢাকা ছেড়ে প্রথমে গ্রামে এবং গ্রামেও না টিকতে পেরে ভারতে পাড়ি দেন। সেই দলের একজন কবি হাদী মীর । তিনি তার স্ত্রীর থেকে বিছিন্ন হয়ে তার জন্য বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করে থেকে ভারতে যাবার সিদ্দান্ত নেন। কবির বোন ও ভগ্নিপতি একজন মুক্তি যোদ্ধাকে দিয়ে চিঠি লিখে দিয়ে কবিকে খুব শীঘ্র ভারতে চলে যেতে বলেন। তিনি অন্য এক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে জানতে পারেন যে কবির স্ত্রী হামিদা নিরাপদে কলকাতায় পৌঁছে গেছে। ভৈরব ও আশুগঞ্জে যখন পাক হানাদরেরা এসে অত্যচার শুরু করলে সেখানকার সকলে নবাবপুরে এসে পালিয়ে বাঁচে এবং সেখান থেকেই নৌকায় করে ভারতে যাবার জন্য রওয়া দেয়। এদেরই সাথে কবি আছেন। মুক্তিযোদ্ধা আনিস এদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। নৌকায় মোট ৩০জন লোক যেতে পারে কিন্তু সেখানে ৩২ জন্য ওঠার পরেও দুটি মেয়ে সীমা ও নন্দিনী এসে কান্না কাটি শুরু করে। সীমার স্বামী ঢাকায় গিয়ে আর ফিরতে পারে নি। সীমা একটা স্কুলের শিক্ষিকা। হিন্দুদের বাড়ীতে থাকাটা এখন খুব কঠিন হয়ে যাওয়াতে স্বামীর ফেরার অপেক্ষা না করে বোন নন্দিনীকে নিয়ে সে পথে বের হয়েছে। দুই বোন এসে অনেক কান্না কাটি করার পর কবি জোর করে আনিসকে বলে তাদেরও নৌকায় তুলে নেয়।
কিছু দূর যাবার পর গুলির শব্দ শুনে সবাই খুব ভয় পেয়ে যায়। পাকিস্তান টহলদারের তাদের নৌকাটা অন্ধকারে দেখতে না পারলেও অনুমান করতে পেরেছে। অনেক সাবধানে তারা একটা ঘাটে এসে নৌকা ভিড়িয়ে উপরে উঠলে চারিদিক থেকে কিছু লোক তাদের ঘিরে ধরে। সবার হাতে অস্ত্র থাকলেও তারা মুক্তি বাহিনীর লোক নয়। নকশাল বাহিনীর লোক। অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা সাথে আছে জানলে বিপদ হতে পারে ভেবে আনিস পানিতে ডুব দিয়ে পালিয়ে চলে যায়। নন্দিনীকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে এবং কাছাকাছি কোন গ্রামে কবির পরিচিত আত্মীয়ের কথা বলে তাদের হাত থেকে বেঁচে যায় তারা। অন্ধকারের মাঝে লাইন ধরে একজন আর একজনের কাপড় ধরে পথ চলতে চলতে সকলে একটা মাঠের কাছে এসে পৌঁছায়। কিন্তু এখানে এসে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে যায়। সাথে যে কয়জন মহিলা ছিল তার সবাই নিম্ন শ্রেণীর কৃষক পরিবারে। এর মাঝে সীমা ও নন্দিনী সম্ভ্রান্ত পরিবারের, তার উপর দেখতে সুন্দরী। রাজাকারদের সাথে কবির তর্কাতর্কির ফলে সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কবি, সীমা ও নন্দিনীকে আটকে রাখে। সীমা ও নন্দিনীর পরনের শাড়ী খুলে কবিকে খুব শক্ত করে বেঁধে নির্জন গ্রামের একটি বাড়ীর ঘরে আটকে রাখে তাদের। কবিকে অনেক শারীরিক অত্যচার সহ্য করতে হয় ফলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। হঠাৎ করে কবির কানে ভেসে আসে কোন নারীর আর্ত চিৎকার ও গোংরানি। লেখক ‘উপমহাদেশ’ উপন্যাসটিতে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি দেশের সংখ্যালঘু রাজনৈতিক দলের আর্দশ ও উদ্দেশ্যকে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। একই সাথে সেই সময় তাদের অবস্থা ও সরকার পক্ষের সাথে তাদের সম্পর্কটাও।আরও একটা একটা বিষয় লেখক তুলে ধরেছেন, সেই সময়ের ভারতীয় কবি সাহিত্যিকদের মানসিক অবস্থা ও আমাদের দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও সহযোগিতা।
হাদী মীর এমন একজন দুর্বল চরিত্রের মানুষ, বোন-দুলাভাইয়ের বাসায় একটা বিবাহিত মানুষ পরনারীকে নিয়ে তাদের সামনে শুয়ে থাকছে! আদব লেহাজ বলে যদি এদের কিছু থাকে! যুদ্ধের দোহাই দিয়ে কত কিছুই না দেখালেন এই বইতে । আর শেষটায় তো দুই নারীকে নিয়ে হাদী মীরের সংসারকেও জায়েজ করে দিলেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। হামিদা নারী মুক্তিযোদ্ধা বলে যতটা না সম্মান আদায় করে নিয়েছিল, শেষটায় এসে ওর এই ব্যাপারটা একদমই ভাল লাগল না। বইয়ের সমাপ্তির প্রয়োজনে কত কীই না করেছেন লেখক! ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে নীতিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু স্বতন্ত্র দলের অংশগ্রহণের কথা আমরা জানি। বামপন্থী এরকম একটি দলের (সম্ভবত কাল্পনিক) কার্যক্রমের কথা উঠে এসেছে এই বইতে। ভারতের নকশাল পন্থীদের সাথে যোগাযোগ থেকে শুরু করে তাদের কিছু অপারেশনেরও কথা বইতে এসেছে। বিষয়টি একেবারে অনৈতিহাসিক। বইয়ের শুরুতেই একটা জায়গায় দেখা যায় জিঘাংসা বশত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা একজন রাজাকারের কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করছে। এটা আসলে সম্ভব ছিল? অথবা এমন ঘটনার কল্পনা করে তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারদের একই সারীতে দাঁড় করালেন?
উপন্যাসের শেষের দিকে এসে— নন্দিনী যে ক্যাম্পে ট্রেইনিং নিতে যায় ওখানেও দেখা যায় ‘মেয়ে মুক্তিযোদ্ধা মানেই পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ দান করলেই কর্তব্য শেষ’ এইরকম একটা অনাচার। এই ব্যাপারগুলো কতটুকু সত্যি বলে বিশ্বাস করা যায়? তিনি মূলত একজন কবি। কবি হলেও কথাসাহিত্যে পারদর্শীতা কম নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। একটা যুদ্ধ ব্যক্তিগত জীবন ও সম্পর্কে কতখানি প্রভাব ফেলে তা বোঝাতে চেয়েছেন লেখক। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং তাদের সংঘাতের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তা বোধকরি খুব কম ঔপন্যাসিকই লিখেছেন। তবে যে জিনিসটা অন্য কোথাও পাইনি তা হ’ল মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক প্রতিশোধ স্বরূপ রাজাকার পরিবারের উপর পাশবিক অত্যাচার। এমন ঘটনা যুদ্ধের সময় ঘটেছিল কিনা জানা নেই। উপন্যাসটিতে একদিকে ছিল প্রেম, অন্যদিকে ছিল যুদ্ধের ময়দান। ছিল মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক কিছু চরম সত্য তথ্যের উপস্থাপন ।