জনৈক লেখকের সঙ্গে এক সন্ধ্যা – ওলগা তোকারচুক | অনুবাদ: ফজল হাসান

By Published On: September 7, 2022

নোবেল বিজয়ীর গল্প
জনৈক লেখকের সঙ্গে এক সন্ধ্যা
মূল: ওলগা তোকারচুক/Olga Tokarczuk
অনুবাদ: ফজল হাসান

মহিলার কাছে সর্বোত্তম ধারণাগুলো সব সময় রাতেই আসত। কেননা তিনি দিনের চেয়ে রাতে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ থাকতেন। ভদ্রলোক হয়তো বলবেন, তা গতানুগতিক ও নীরস এবং হয়তো বিষয়টি পরিবর্তন করে আমি দিয়ে একটি নতুন বাক্য শুরু করবেন। সম্ভবত বলবেন, আমি দিনের মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছ চিন্তা করতে পারি সকালে, আমার প্রথম কফি পান করার ঠিক পরে, অর্থাৎ দিনের প্রথম অর্ধেকে।

অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে (হে ঈশ্বর, দুর্ঘটনা কী!) মহিলা সংবাদপত্রে পড়েছেন যে, ভদ্রলোক প্রুশিয়ার অ্যালেনস্টেইন ভ্রমণ করবেন। ভদ্রলোক তার এত কাছাকাছি আসছেন যে, সেই উত্তেজনায় তিনি কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলেন না। সেসময় তার মনের গভীরে সমস্ত স্মৃতি ফিরে আসে। অথবা বলা যায়, স্মৃতিরা ফিরে আসেনি। তার কারণ স্মৃতিগুলো সব সময় সেখানেই ছিল এবং কখনই সেখান থেকে অন্য কোথাও যায়নি। মহিলা চিৎ হয়ে শুয়েছিলেন এবং সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে ভাবছিলেন, যা তার লক্ষ্যকে সফল করতে পারে। তিনি এক অচেনা শহরের ট্রেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আছেন। ভদ্রলোক তার বিপরীত দিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এবং তাকে লক্ষ্য করেন। তার চোখেমুখে আচমকা ধাক্কা খাওয়ার মতো বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। তিনি থমকে দাঁড়ান এবং চোখ তুলে তাকান । মহিলার টুপি উপরের দিকে তোলা ছিল। ভদ্রলোকের তাকানোর ভাবসাব এবং দৃষ্টির উজ্জ্বলতা দেখে মহিলা উত্তেজনায় একবার কেঁপে ওঠেন। তবে তার শরীর দেখে নয়, বরং শুধু তার সেই চাহনি দেখে। অথবা ভদ্রলোক হয়তো বাজারের রৌদ্রস্নাত কোনো এক রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছেন (অ্যালেনস্টেইনের বাজারটি দেখতে কেমন হতে পারে?) এবং তিনি আবার বিপরীত দিক থেকে আসার সময় একজন পুরুষ ও একজন মহিলাকে অনুসরণ করছেন। মহিলা দেখতে পান যে, ভদ্রলোক তাকে চিনতে পেরেছেন। কারণ তার মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যায়, যখন তিনি বিচলিত গলায় অন্য লোকজনদের বলছিলেন, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন …’। কম্পিত হাতে তিনি তার মাথার উপর থেকে উজ্জ্বল রঙের টুপি খুলে ফেলেন (তার মাথায় চুল কী পাতলা হয়ে গেছে, নাকি ইতোমধ্যে টুপি খোলার সময় হয়েছে)। মহিলা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন এবং তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কেননা তিনি ভদ্রলোকের সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বাজারের চারপাশে ঘোরাঘুরি করেছেন । অ্যালেনস্টেইন কী বড় শহর? হয়তো খুব বড় শহর, হয়তো মে মাসের ভিড়ের মধ্যে তারা একে অপরকে পাশ কেটে চলে গেছেন, হয়তো তারা তাকে একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে ট্রেন স্টেশন থেকে সরাসরি হোটেলে নিয়ে গেছেন, হয়তো দেখা যাবে সেখানে কোনো বাজারই নেই, হয়তো বৃষ্টি হচ্ছিল, হয়তো তিনি আসেননি, হয়তো স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য তিনি শেষ মুহূর্তে যাত্রা স্থগিত করেছেন। হয়তো তিনি প্রকাশনার কাজে জার্মানিতে আটকে আছেন। তার উপর তিনি এমন একজন স্বনামধন্য লেখক, যাকে হয়তো শিক্ষিত সব মানুষ চেনে কিংবা হয়তো চেনে না, হয়তো তিনিই একমাত্র লোক যে, তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা হলে বা তার সম্পর্কে খবরের কাগজে অতি ক্ষুদ্র সংবাদ প্রকাশ পেলেও মহিলা তাকে অনুসরণ করেন। হয়তো মহিলা নিজেই নিশ্চিত করেন, লেখকের দুই খণ্ডের উপন্যাসটি বইয়ের দোকানে থাকা উচিত এবং কেবলমাত্র তিনি তার নিজের হাত দিয়ে অদৃশ্যভাবে বইয়ের মলাট পরিস্কার করছেন। কিন্তু গ্লাভসের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি দোকানীকে সম্পূর্ণ অন্য কথা জিজ্ঞেস করেন।   

সকালে মহিলার কাছে মনে হয়েছে ধারণাটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। নাস্তা করতে যাওয়ার সময় জোহান তার কোমর জড়িয়ে ধরে এবং মুখে চুম্বন করে। বাচ্চাদের সঙ্গীত শেখাতে শিক্ষক এক ঘন্টার মধ্যে আসবে। যখন সে তার নরম-সেদ্ধ ডিমের খোসা আলাদা করছিল, তখন তার নিজের আঙ্গুলের দিকে চোখ পড়ে। আঙ্গুলগুলো পাতলা এবং শুকনো, যেন সেগুলো কখনো তার হাতের আঙ্গুল ছিল না। এক মুহূর্তের জন্য তার মধ্যে অনুশোচনার সূঁচালো অনুভূতি জেগে ওঠে। তারপর কোনো আশা না করে বললেন, তিনি কয়েক দিনের জন্য ড্যানজিগে বাবার কাছে যেতে চান । তার স্বামী রুমাল দিয়ে ঠোঁট মোছে । তাকে দেখে মনেই হচ্ছিল না যে, তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি সহজেই চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করেন। তারপর তিনি চাকরকে জানালা খুলে দিতে বলেন। রাস্তা থেকে ঘোড়ার গাড়ি এবং ঘোড়ায় টানা ট্রামের শব্দ খাবার ঘরে ঢুকে পড়ে। আর তার একটু পরেই বাড়ির সামনে প্রস্ফুটিত লাইলাক ফুলের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। 

টুপির বাক্সে বেতের তৈরি একটা চওড়া টুপি, গাঢ় রঙের জর্জেট কাপড়ের খাটো জামা, বুক বরাবর ঝালর দেওয়া সাদা ব্লাউজ এবং রোদ থেকে গা বাঁচানোর জন্য ফিতা লাগানো ছোট ছাতা। এছাড়া আরও আছে হাতে বহন করার মতো ব্যাগ এবং চামড়ার তৈরি একটা বড় স্যুটকেস। বোতাম দিয়ে বুট জুতা বাঁধা হয়েছে। মখমলের নরম অন্তর্বাসের মধ্যে সুগন্ধির একটা ছোট্ট শিশি । কয়েক জোড়া দস্তানা। ভ্রমণের লটবহর। ড্যানজিগ স্টেশন থেকে অ্যালেনস্টেইনের টিকিট কিনে তিনি তিন ঘন্টা ক্যাফেতে বসে অপেক্ষা করেন। রেস্টরুমে তিনি আয়নায় তার প্রতিফলন দেখে ভড়কে যান। কেননা তিনি ভেবেছিলেন যে, তার বয়স অনেক কম । কম্পার্টমেন্টে ফিরে এসে তিনি নইয়া ডয়চে কুনশাউ পত্রিকার একটি পুরনো সংখ্যা পড়ার চেষ্টা করেন। সেখানে লেখকের একটা গল্প ছিল। তিনি পত্রিকাটি হাতের ব্যাগ থেকে বের করেন। একসময় পুরো গল্পটি তার মুখস্ত ছিল। অথচ এখন বুঝতে পারলেন যে, তিনি গল্পের পুরো কাহিনী ভুলে গেছেন।  

ছোট্ট একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে: অ্যালেনস্টেইন এবং ভেনিস একে অপরের পরিপূরক। দশ বছর পর শহর দুটি যেন হঠাৎ করে লাগাতার সময়ের শুরু এবং শেষ প্রান্তে আবির্ভূত হলো, যা তার জীবনের অনেকটুকু অংশ জুড়ে রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ। দুপুর ও মধ্যরাত। অত্যন্ত শুস্ক এবং ভেজা। অতীত এবং সময়ের অনুপস্থিততা। পেছন ফিরে দেখা এবং সামনের দিকে তাকানো। অসঙ্গতির মিলনমেলা।

মহিলা তাকে প্রথম দেখেছেন সাগর তীরে। তার পরনে ছিল ঝলমলে উজ্জ্বল পোশাক এবং মাথায় ছিল চকমকে টুপি। মহিলা তাকে মনে রেখেছেন, যদিও তিনি কাউকে কেবল একবার দেখলেই প্রায় সময়ই তাদের মনে রাখতে পারেন। সেই সাগর তীরে তিনি ছিলেন অসতর্ক এবং তারুণ্যে উজ্জীবিত। তারপর যখন তারা পরিচিত হয়, তখন মহিলার কাছে তাকে মুখোশ পরা একজন পুরুষের মতো মনে হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘আমি একজন লেখক।’ কিন্তু তার পরিচয় মহিলার কাছে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তিনি কিঞ্চিৎ হতভম্ব হলেন। তিনি সরাসরি মহিলার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না। তাদের উভয়ের পরিচিত একজন চট জলদি চেয়ার থেকে উঠে বলল, সে একটা গাধা। সবকিছুর পরে যখন মহিলা প্রথমবারের মতো হোটেলে তার বাথরুমটি দেখেছেন, তখন তার মনে হয়েছে যে, কেবল তখনই তিনি তাকে চিনতে পেরেছেন। এমনকি অন্তরঙ্গভাবে কাটানো সন্ধ্যা নয়, যখন ভদ্রলোকের শরীরকে জানার জন্য তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার অনুমতি তাকে দিয়েছিল, বরং ভদ্রলোককে চেনার কারণ ছিল হোটেলের বাথরুম। ভদ্রলোকের তোয়ালে বাথটাবের ওপর পড়েছিল। বাথরুমে আরও ছিল তার দাড়ি কামানোর ব্রাশ ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, পানির কারণে ক্ষয় হয়ে যাওয়া দাঁত মাজার ব্রাশ এবং সাবান রাখার কাঠের বাক্স। সেসব প্রাণহীন জিনিসপত্রের উপস্থিতি মানব দেহের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। মহিলা আলতো হাতে সেগুলো স্পর্শ করেন। তখনও ভদ্রলোক ছিলেন অথবা সম্ভবত তিনি ইতোমধ্যে জেগে উঠেছেন এবং তার জন্য অপেক্ষা করছেন। উচ্ছ্বল প্রেমে নিমগ্ন হয়ে সন্ধ্যা কাটানোর পরে সকালের নির্জনতা তার কাছে কিছুটা বিব্রত পরিস্থিতি বলে মনে হয় । হঠাৎ করে মহিলা নড়েচড়ে উঠেন এবং অনুভব করেন যে, তিনি শীতল আয়নায় মাথা রেখে কিছুক্ষণ অশ্রুপাত করবেন।

সবসময় সেই মুহূর্তটি মহিলার মনে পড়ত—সম্ভবত তাই ছিল তার ভালবাসার আরম্ভ। কাউকে চিনতে পারা কী আসলেই ভালবাসা নয়? একারণেই কী মানুষ একে অপরের দেহ কামনা করে, যা শুধু আনন্দের জন্য নয়, বরং নিকটতম দূরত্বের কাছাকাছি আসার জন্য? দেহের অভ্যন্তরে কি রয়েছে, তার সন্ধান করার জন্য শরীরের এই বিশেষ প্রবেশদ্বারের প্রতিটি সীমানা অতিক্রম করে।

মহিলা যেমন ভেবেছিলেন, অ্যালেনস্টাইনের স্টেশনটি তার চেয়ে ছোট। কিছুক্ষণের জন্য তিনি আতঙ্কের স্রোতে ভেসে গেলেন—অবলীলায় তার হাত ট্রেনের সিঁড়ির শীতল হাতল জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ট্যাক্সি যখন তাকে শহরের অন্যতম সেরা হোটেলে নিয়ে যায়, তখন আচমকা তার মনে হয় তিনি যেন বিশ্বের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারিনী। তার কাছে মনে হচ্ছিল চারপাশের মানুষজন, যারা কিছুই জানে না, কিছুই অনুভব করে না এবং একরকম মিইয়ে যাওয়া ও দ্বিমাত্রিক, যেন অসহায় যান্ত্রিক পুতুল। তাদের মলিন চেহারার ছোট ছোট দোকানপাট, কিছুই না-জানা তাদের মুখ, যে মুখটি ঠিক সেই মুহূর্তে ভরা কফি কাপের মসৃণ পৃষ্ঠের ওপর ঠোঁট রেখেছিল, তাদের আত্মকেন্দ্রিক শরীর, তাদের হাস্যকর আচার-অনুষ্ঠান, যেমন তাদের টুপি মাথার পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে আনা, তাদের বেতের লাঠি এবং ছাতা যতটা সম্ভব শক্তভাবে ধরে রাখা, তাদের অপ্রয়োজনীয় জীর্ণ-শীর্ণ ডিভান দিয়ে সাজানো-গুছানো বাড়িতে বিরক্তিকর সন্ধ্যা, তাদের সীমিত কারণ, পরবর্তী বাক্যটি বলার আগে প্রসারিত করার জন্য অনুপযুক্ত। প্রতিটি মিনিট যেন পাপেট পুতুলের মতো। যদিও তিনি ট্যাক্সির সীটে পুরুষের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল, তবে তার মনে হয়েছিল তিনি তাদের ভালবাসেন। তিনি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, কিন্তু তাতে করুণা ছিল না। আসলে তা ছিল ভালবাসা, যেমন শিশুরা পিতামাতার উদ্দেশ্য না জেনেই তাদের পড়ালেখার পরিকল্পনা মেনে নেয়। আর তিনি ট্যাক্সির উঁচুতে বসে আরও কিছু দেখলেন। তিনি কিছু নিয়ম নির্ধারণ করেছেন। তিনি মিনিটের পর মিনিটে, অঙ্গভঙ্গির পর অঙ্গভঙ্গি এবং ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে তৈরি করেছেন সেসব নিয়ম।

হোটেলের অতিথি তালিকার খাতায় নিবন্ধ করতে তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করেন এবং নামটি লেখার সময় অসাবধানতাবশত অভ্যর্থনাকারী লোকটিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ঘটনা কী সত্যি যে, বিখ্যাত লেখক টি. আজ রাতে এই হোটেলে অবস্থান করছেন?’

অভ্যর্থনাকারী লোকটি দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকাল এবং চশমার নোংরা কাঁচের উল্টোদিকের তার চোখ দুটি বিকৃত দেখাল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে, অত্যন্ত কষ্ট করে তিনি তার উত্তেজনা এবং গর্বকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

‘হ্যাঁ, সত্যি। আগামীকাল সঙ্গীত এবং সাহিত্য সম্পর্কে তার রচনা থেকে পাঠ করার কথা রয়েছে। আগামীকাল বিকেলে,’ লোকটি বলল এবং বলেই পরক্ষণে সে হঠাৎ কন্ঠস্বর ভারী করে বলল, ‘আপনাকে অনুরোধ করছি, কথাটা অন্য কাউকে বলবেন না যে, তিনি আমাদের এই হোটেলেই অবস্থান করছেন। এখানে অন্য কোনো ভাল হোটেল নেই। আমাদের হোটেলটি সেরা হোটেল। আমরা তার জন্য একটা আরামদায়ক কক্ষ সংরক্ষণ করে রেখেছি। বেশ কয়েক দিন ধরে কক্ষটি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।

অভ্যর্থনাকারী লোকটি রোমান সংখ্যা ১-এর নীচে ঝুলন্ত একটি চাবির দিকে ইঙ্গিত করে । ‘আমরা আশঙ্কা করছি যে, তার ভক্ত পাঠকরা তাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না ।’

‘তিনি কী সত্যিই এত জনপ্রিয়,’ মহিলা জিজ্ঞেস করেন।

‘আমার স্ত্রী তার সমস্ত লেখা পড়েছেন,’ অভ্যর্থনাকারী লোকটি বলল, যেন কথাটি সবকিছু ব্যাখ্যা করে।

‘বার্লিন থেকে ট্রেন কখন এসে পৌঁছুবে?’ মহিলা জিজ্ঞেস করেন। ‘আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি।’

অভ্যর্থনাকারী লোকটি সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকাল, কিন্তু ট্রেন আসার সময়টা সে ঠিকই বলল।

কক্ষের অবস্থা শোচনীয়। দুটি উঁচু কাচের দরজা, যা প্রধান রাস্তার দিকে মুখ করা। দরজার চৌকাঠে কয়েকটি কবুতর।

মহিলা মুখ ধুয়ে খসখসে একটি তোয়ালে দিয়ে ভেজা মুখ মোছেন। তারপর তিনি পোশাক পাল্টিয়ে চুল পরিপাটি করেন এবং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাবধানে পিন লাগান। আয়না খানকিটা উঁচুতে ঝুলানো ছিল এবং তিনি কেবল তার চোখ ও কপাল দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি আঙ্গুল দিয়ে গায়ে সুগন্ধি মাখেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, তার হাতে বেশ কিছুক্ষণ বাড়তি সময় রয়েছে এবং সেই ফাঁকে তিনি বাইরে গিয়ে ঘোরাঘুরি করে আসতে পারবেন। কিছু কেনাকাটা করতে পারেন। দোকানের জানালার কাচে তার প্রতিবিম্ব রেখে আসতে পারেন, এমনকি দোকানপাটের অনিশ্চিত বিশালতা দেখতে পারেন। তিনি ছাতার নিচে বসে লেমোনেড পান করতে পারেন। তিনি মাথায় টুপি পড়েন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ দরজা থেকে ফিরে আসেন এবং সবকিছু নিয়ে তিনি চিৎ হয়ে সটান বিছানায় শুয়ে পড়েন। সিলিংয়ের সূক্ষ্ম ফাটল তাকে কতগুলো রহস্যময় বর্ণমালার মাধ্যমে কিছু একটা ইঙ্গিত করে । 

তারা সমস্ত দিন শহরময় ঘুরে বেড়ায়। ভেনিসে প্রচন্ড গরম এবং ঘামে শরীর ভিজে যাচ্ছে। খালগুলো দূর্গন্ধে ভরা। তারা সবসময় দ্রুত গতিতে হাঁটছিলেন—দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন কোথাও যাচ্ছেন। ‘উফ, আমরা যেন সবসময় এত তাড়াহুড়ো করি,’ তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এবং হাসাহাসি করেন। আসলে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, হাঁটার সময় যেন একজনের হাত অন্যজনের হাতের সঙ্গে ঘষা লাগে, কাঁধের সঙ্গে কাঁধ স্পর্শ করে এবং হঠাৎ করে বাতাসে ভেসে আসে একে অপরের কাছে পরস্পরের শরীরের ঘ্রাণ। যদিও তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটছেন, কিন্তু কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছিলেন না। তবে তারা একজন আরেকজনের দিকে নজর রাখছিলেন। এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি মহিলাকে তার পরিবারের কথা নিরন্তর বলে যাচ্ছিলেন। তার কথা শুনে মহিলা অবাক হন । কেননা এ বিষয়ে তার বলার মত কোনো কিছুই ছিল না। কিন্তু তিনি অবিরাম কথা বলেই চলেছেন, যেন মহিলাকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, তার অস্তিত্ব রয়েছে এবং তিনি তার রক্তের মধ্যে হ্যানসেটিক বণিকদের জিন বহন করেন। তিনি সন্তান প্রসব করতে করতে ক্লান্ত স্ত্রী, তাদের সন্তান এবং সেই অশুভ গোঁফওয়ালা পর্তুগীজ বা ডাচদের বংশধারা বহন করছেন। তিনি তাদেরকে সময়ের মানুষ আখ্যায়িত করেন। সম্ভবত এ কারণেই তিনি একজন লেখক হতে পেরেছেন। তিনি তাদের নাম এবং মজাদার কথা মনে রেখেছেন, এমনকি তাদের ভুল পদক্ষেপ এবং অদ্ভুত অভ্যাসও তার মনে আছে। তিনি উদারভাবে প্রত্যেককে একটি করে বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দিচ্ছিলেন। মহিলা তাকে বিশ্বাস করেন না—সবাই কৌতুহলী হবে, তা সম্ভব নয় এবং অযৌক্তিক। মহিলা মনে করেন যে, পৃথিবী একটি জনাকীর্ণ জায়গা, যা অল্প সংখ্যক একক ব্যক্তি এবং ছোট সংখ্যা নিয়ে গঠিত। তার কাছে মানুষ একটি তরঙ্গের মতো এবং কোনো পার্থক্য করা যায় না। তবে তিনি যাদের ভালবাসেন, তাদের ছাড়া। সবাইকে ভালবাসা সম্ভব নয়।

শুধু যখন তারা কিছুক্ষণের জন্য কোথাও বসে থাকেন, কোনো এক ক্যাফের চেয়ারে, জনমানবহীন সমুদ্র সৈকতে কিংবা কাঠের জেটির মেঝেতে, কেবল তখনই তাদের দৃষ্টি বিনিময় হয়। তখন কোনো কিছু বলা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে । মহিলা তার দিকে ঝুঁকতে চান। প্রতিবার যখন তিনি তার দিকে তাকান, তখন তিনি তার ত্বকের মধ্যে তা অনুভব করেন। সেই পরিস্কার এবং উজ্জ্বল নীল দৃষ্টি নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছে।

সন্ধ্যায় তারা অন্য লোকজনের সঙ্গে বারান্দায় বসে, যেখান থেকে অগভীর লেক দেখা যায়। বাতির আলো পড়ে গাছের পাতাগুলোয় হলুদ রঙ ধরে একধরনের অপ্রত্যাশিত স্থানীয় প্রান্তরের বিভ্রম সৃষ্টি করেছে। সেসব বন্ধুরা একজন আরেকজনের পরিচিত। তারা হাসি-খুশি এবং গল্পগুজবে মশগুল ছোট্ট একটা দল। এসব বন্ধুরা এমন একটি দ্বীপ, যেখানে আমরা সবাই এক মুহূর্তের জন্য নোঙর করতে পারি, এমনকি আমাদের পায়ের নীচে জমি অনুভব করতে পারি। যদিও কেবল ভেসে যাওয়া আমাদের আগ্রহের বিষয়।

বাড়িটা লুকিয়ে আছে চোরকাঁটা গাছের আড়ালে এবং উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা । মহিলা চুপিচুপি সেখানে যান এবং জানেন যে, তিনি সেখানে আছেন। তিনি শুধু একবার তাকে দেখার জন্য গিয়েছেন। হঠাৎ তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি দিগম্বর এবং সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তা থেকে লাফ দিয়ে চোরকাঁটার ঝোপের মধ্যে নিজেকে আড়াল করেন । তারপর তিনি পেছন দিক থেকে চোরকাঁটার মধ্য দিয়ে বাগানের দিকে এগিয়ে যান । এখন তিনি ঘরের আলোকিত জানালা দেখতে পাচ্ছেন । কোনো ধরনের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান চলছিল । লোকজন হাতে মদিরার গ্লাস নিয়ে জানালার শার্সির পেছনে পায়চারী করছে। কাচের পেছনে তাদের ঠোঁট শব্দহীন নড়াচড়া করছে। নীল রঙের ড্রেস পড়া সুন্দরী মহিলা তার স্ত্রী। তিনি সবার উদ্দেশ্যে হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি কত সুন্দরভাবে সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন! গাছের কাঁটার খোঁচা লাগে তার গায়ে। তিনি ঘরের ভেতর নেই। তিনি সেখানে নেই।

হঠাৎ মহিলা জেগে উঠেন। টুপিটি তার গলায় খোঁচা দিচ্ছিল। তিনি উঠে আয়নার দিকে তাকালেন—তার চোখ সামান্য ফুলে গেছে এবং অশ্রুসিক্ত । এখন সময় হয়েছে ।

অ্যালেনস্টেইনে একটা ক্রস আকৃতির দুটি রাস্তা আছে এবং রাস্তা দুটির পাশে একটি দুর্গ, একটি টাউন হল এবং গত বছরের ফ্যাশন শো চলছে। এখানে বসবাস করা সম্ভব নয়, তবে বেড়ানোর জন্য আসা যায়। এখানে রয়েছে প্রুশিয়ান অর্ডার এবং এশিয়াটিক মেলানকোলি। এছাড়া রয়েছে পানির হালকা গন্ধ । ঘড়ির কাঁটা তিনটা স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কফির অর্ডার দিলেন । এখন হয়তো বাচ্চারা ঘুমিয়ে রয়েছে। হঠাৎ তিনি বাচ্চাদের ঘ্রাণ পেতে আকুল হয়ে উঠলেন—বাচ্চাদের চুলে সব সময় কেন বাতাসের গন্ধ পাওয়া যায়? ওয়েটার টাকা নিয়ে চলে যায় এবং যাওয়ার সময় কৌতুহল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। তিনি মন্থর পায়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে যান। আচমকা তার শান্ত ভাব বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যায়। তার হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি বাড়তে শুরু করে। তিনি রীতিমত দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন, যেন সেই মুহূর্তের বাইরে তার কোনও অস্তিত্ব নেই, যেন তার কোনও ভবিষ্যত বা অতীত নেই । একজন মহিলা স্টেশনের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। আর কোনো কিছু নয়।

প্ল্যাটফর্ম প্রায় জনশূন্য ছিল—হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে একজন যুবক, দুই বাচ্চার সঙ্গে একজন মহিলা এবং বেঞ্চে বসা সেই ধরনের একজন ভ্রমণকারী, যারা সব সময় স্টেশনে দেরী করে পৌছে এবং যাকে রেখে ট্রেন সব সময় চলে যায়। স্টেশনে তার পৌঁছানোর একটু পরেই একদল লোক আসে। তাদের মধ্যে দুজন গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ, তবে তারা সামান্য মোটা। একজনের চোখে তারের ফ্রেমের চশমা এবং অন্যজনের পড়নে ভদ্রোচিত কালো স্যুট ও এক চোখে চশমা (ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল তিনি যেন কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বাড়ি থেকে এসেছেন)। তৃতীয় ও চতুর্থজনের কোনো ব্যক্তিত্ব ছিল না। অবশ্যই তারা হবে সেই দল। অ্যালেনস্টাইনের উচ্চ সংস্কৃতি জগতের সমস্ত প্রতিনিধিরা লেখকের আগমনের অপেক্ষায় রয়েছেন । একসময় ছাত্রদের একটি বড় দল সেখানে প্রবেশ করে। হঠাৎ জায়গাটির দৃশ্যপট বদলে যায়, ঘরের আবহাওয়া গতিশীলতা লাভ করে এবং হৈ-চৈ শব্দে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এটা কী কোনো ফিল্ডট্রিপ, পিকনিক, প্রুশিয়ান স্কুলগুলোকে কী আজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে? বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য নিরর্থক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

কি অদ্ভুত ব্যাপার—ভেনিসে যখন তারা আলাদা হয়ে যায়, তখন ভদ্রলোক কান্না করেন। তিনি মহিলাকে জড়িয়ে ধরেন এবং তার শীতল, নীল চোখ অশ্রুতে ছলছল করে। তিনি বললেন, ‘আমি কি বোকা! কাঁদছি, আমাদের আবার দেখা হবে । মহিলা মনে করেন যে, ভদ্রলোকের উচিত তাকে প্রস্তাব করা; এসব বিষয়ে তিনি প্রথা মেনে চলেন। ‘কি আহাম্মক, প্রস্তাব করা, যাই হোক না কেন, আমরা একসঙ্গে থাকব,’ তিনি আরও ভাবলেন। তার এই ভাবনার কথাটি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে । সেই সময় অন্য কোনো সম্ভাবনা একেবারেই অকল্পনীয় ।

তারপর মহিলা বুঝতে পারেন যে, লেখক নিজের জন্যই কাঁদছিলেন। ‘আমি আপনাকে চারটি চিঠি লিখেছি,’ তিনি পঞ্চম চিঠিতে স্মরণ করে বললেন, ‘কিন্তু আমি সেগুলো পাঠাইনি। চিঠিগুলো একটা ক্ষতকে জ্বালাতন করেছিল, যা ইতোমধ্যে নিরাময় হওয়া উচিত ছিল। আপনি এত সুন্দর, এত সজীব, যেন পৃথিবী আপনাকে আদৌ স্পর্শ করেনি। একজন দেবদূতের মতো আপনি অন্য কোনো ভুবন থেকে এসেছেন। যতই আপনাকে আমি কাছে পাইনি, ততই আপনাকে কামনা করেছি।’ মহিলার কাছে চিঠিটা বিরক্তিকর বলে মনে হয়েছে, যদিও তার কারণ তিনি জানেন না । চিঠিটা যেন অন্য কারো কাছ থেকে এসেছে।

তার মনকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করে রাখা কিছু মানুষের জটলা সামান্য ঝাঁকুনি দিল। ফুলের তোড়া নিয়ে যুবকটি বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল। কালো পোশাক পরা ভদ্রলোক অস্থিরভাবে রুমাল দিয়ে এক চোখের চশমার কাঁচ পরিস্কার করলেন। বয়স্ক শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের দুই সারিতে সংগঠিত করার নিরর্থক চেষ্টা চালিয়ে যান। তখন মহিলা বুঝতে পারলেন যে, এসব লোকজন ভদ্রলোকের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই টি. এখনও তার কেউ নন, তবে তিনি অন্যদের জন্য ছিলেন। সেসব বাচ্চারা, স্যুটেড বুটেড লোকজন এবং ফুলের তোড়া নিয়ে যুবক, অভ্যর্থনাকারী লোকটি এবং তার বই পড়ুয়া স্ত্রী, সবাই তাকে নিজেদের আওতায় রেখেছিল।

কিন্তু লোকজন আসলে তার সম্পর্কে কতটুকু জানে? তারা কী তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস কিংবা তিনি যে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ছোটগল্প প্রকাশ করেছেন, তা থেকে তার সম্পর্কে জানতে পেরেছে? তাহলে তারা কাকে জেনেছে?  তিনি যা লিখেছেন, তাতে নিজের কথা খুব কমই স্থান পেয়েছে, বলা যায় সামান্য ছিটেফোঁটা। তার নিখুঁত, স্পষ্ট এবং বিশ্বাসযোগ্য বাক্যগুলোর মাঝে কী তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়? তারপর ভেনিসে সীমাহীন হাঁটার সময় তিনি সবসময় সংক্ষিপ্ত ও নার্ভাস গলায় কথা বলছিলেন। মহিলা সবসময় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন যে, তার কথার মাঝে কোনও বিরতি কিংবা কমার ইঙ্গিত ছিল কিনা । তিনি কী তার লেখার বর্ণনায় কিংবা উপাখ্যানে উপস্থিত ছিলেন? এমনকি তিনি রসিকতাও করতে পারছিলেন না। কীভাবে তিনি নিজের জন্য সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে ভুল ভাবে গ্রহণ করার জন্য পাঠকদের বোকা বানিয়েছেন? কাজটা তার জন্য খুবই সহজ ছিল। অথবা হয়তো তা ছিল না। সম্ভবত মহিলাকে বোকা বানানোর জন্যই তা হয়েছিল। তিনি প্রেম ও আকাঙ্ক্ষায় মোহাবিষ্ট হয়ে সবকিছু মিলিয়ে অন্য কাউকে দেখেছিলেন। না, লেখকের লেখার কোনও বাক্যে তিনি তাকে চিনতে পারেননি । লেখক তার লেখায় ছিলেন না। তিনি কাহিনীর নিরপেক্ষ বর্ণনাকারীর মধ্যেও ছিলেন না, এমনকি সেখানে তিনি জীবন্ত কারোর কথাও বলেননি। এটা সত্যি এমন ব্যাপার, যা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, একটি জীবন্ত সত্তার মাঝে কাউকে অনুসন্ধান করা, যিনি বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। বিশ্বজগতের শাসনকর্তা। যখন তিনি ঘুমিয়ে থাকেন, কিছুই জানেন না, মহিলার পেছন দিকে হেলান দেন, তখন তার নিঃশ্বাস খুঁজে বেড়ায় তার দৃষ্টির সীমানার বাইরে ও তার চোখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জিনিসপাতি; তার আইসক্রীম খাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করা—তিনি কী অন্য লোকেদের মতো বিষয়টি পছন্দ করেছিলেন, অন্য মানুষের স্নায়ুর মতো তার স্নায়ু কী তার মস্তিষ্কে সংকেত বহন করেছিল? অবশ্যই কিছু পার্থক্য থাকতে হবে। হঠাৎ মহিলার মনে পড়ল যে, তিনি ভেনিসে গোঁফ দীর্ঘ করেছেন। অবলীলায় তার হাত চলে যেত ওপরের ঠোঁটে। সেখানে কালো রুক্ষ গোঁফে তিনি আঙুলের ডগা স্পর্শ করে পুলকিত হতেন।   

ট্রেন আসছিল। লোকোমোটিভের ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া এসে তাদের মাথার ওপর অনেকটা বাস্তব আকৃতি সৃষ্টি করে। মহিলার হৃদপিন্ডে ধুকপুকানি শুরু হয় এবং ঠোঁট শুকিয়ে যায়। তিনি স্টেশনের রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডের আড়ালে গিয়ে তার অবগুন্ঠন সরালেন। কিছুক্ষণের জন্য ট্রেনটি থামে এবং সেখানে যেন কিছুই ঘটেনি। অল্প সময়ের জন্য স্টেশনটি স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চার জন উৎসুক লোকের দৃষ্টি ট্রেনের এক কামড়া থেকে অন্য কামড়ায় চলে যায়। তারপর তিনি লক্ষ্য করেন যে, দলটি হঠাৎ ডানদিকে ঘুরে ট্রেনের ইঞ্জিনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। অলক্ষ্যে থাকা মহিলাও তার দুই সন্তানকে নিয়ে সেদিকেই চলে যায়। ফুলের তোড়া হাতে যুবকটি সবার আগে রীতিমত দৌঁড়াচ্ছিল।

মহিলা কেবল তখনই লেখককে দেখলেন, যখন তিনি স্টেশনের দরজা পেরিয়ে বাইরে বের হয়ে যাচ্ছিলেন । কয়েকজন তাকে ঘিরে রেখেছিল। মহিলা অবাক হয়ে দেখলেন যে, তিনি এখন আরও স্থূলকায় হয়েছেন এবং আক্ষরিকভাবে বলতে হয় তার দেহের গড়ন বেঢপ হয়েছে । তবে সেই একই মুখ, যা তিনি খুব ভাল করে জানতেন। কিন্তু এখন ভিন্নরকম দেখাচ্ছে, যেন বাস্তবতার সঙ্গে আরও দৃঢ়ভাবে সম্পৃত্ত। তারপর তিনি অস্পষ্ট হয়ে যান। স্বাক্ষর করার জন্য যুবকটি তার দিকে অটোগ্রাফ অ্যালবাম এগিয়ে ধরে এবং এক চোখে চশমা পড়া লোকটি নিজের শরীর দিয়ে তাকে আড়াল করে রাখে। আর তিনি ছিলেন তুফানের চোখের মত—ধূসর, শান্ত, যেন কিছুই তাকে আর হতবাক করতে পারে না।

সুতরাং এখন নয়। হয়তো পরে হবে। মহিলার বুকের ধুকপুকানির শব্দ শ্লথ হতে থাকে। তিনি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তাদের অনুসরণ করেন। তিনি তাদের ট্যাক্সিতে উঠতে দেখলেন।

লেখকের সঙ্গে নির্ধারিত সন্ধ্যাটি শহরের থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানের প্রচার করার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। ‘বিখ্যাত লেখক টি. নিজের লেখা পড়ে শোনাবেন …’ অনুষ্ঠানে যারা প্রথম উপস্থিত হয়েছিলেন, মহিলা ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। শ্রোতারা ধীরে ধীরে অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে। মহিলারা তাদের সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পড়ে এসেছেন এবং তাদের শরীর থেকে শহুরে ঘ্রাণ বের হচ্ছিল। তাদের ভূঁড়িওয়ালা স্বামীরা খাটো কোটের সঙ্গে ঘড়ির চেইন লাগিয়েছে এবং তারা সময়ের সঙ্গে অস্বাভাবিকতায় নিমজ্জিত ছিল। অ্যালেনস্টাইনের বুর্জোয়া। এছাড়া ভদ্রোচিত পোশাক পড়ে আরও কয়েকজন এসেছেন—সম্ভবত তারা শিক্ষক এবং আত্মসচেতন স্থানীয় বুদ্ধিজীবী। স্টেশনের সেই যুবকটিও উপস্থিত ছিল, তবে তার হাতে ফুলের তোড়া ছিল না। তিনজন মহিলা হাসছিল এবং মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তারা তাদের চোখের পাতা দ্রুত নড়াচড়া করছিল। তারা কী অভিনয় শিল্পী? একদল ছাত্র ছিল।  সুতরাং এরা সবাই এই মহান এবং বিখ্যাত টি.-এর পূর্ব প্রুশিয়ার ভক্ত এবং অনুরাগী পাঠক।  

‘লেখালেখি ছাড়া আমার কাছে জীবনে আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি জানি, আপনি আমাকে বুঝতে পারবেন।’ সুতরাং লেখকের কাছ থেকে শেষ চিঠি এভাবেই শেষ হয়েছিল, যা মহিলা পেয়েছিলেন । তিনি বুঝতে পারেননি। লেখকের মতে শেষ চিঠিতে একটা অমিল ছিল, যা মহিলা খুঁজে পাননি। মহিলার কাছে টাকা ছিল; লেখক ভেনিস বা অন্য কোথাও তার সঙ্গে বসবাস করতে পারতেন এবং লেখালেখিও চালিয়ে যেতে পারতেন। বোধহয় তাই ছিল অন্তরায়। সম্ভবত তিনি যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন না, হয়তো তার পরিবার যথেষ্ট ভাল ছিল না। তিনি স্মরণ করেন যে, যখন লেখক ‘অধ্যাপক’ শব্দটি শুনেছিলেন, তখন মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করেছিলেন। বিষয়টি অদ্ভুত ছিল যে, তার মতো কেউ সুনামের প্রতি এতটা অনুরাগী হতে পারে। সত্যি, শেষপর্যন্ত তিনি একজন অধ্যাপকের মেয়েকে বিয়ে করেন। এটা কী সম্ভব ছিল যে, তাদের ভেনিসের জীবনের পুরো এক বছর না পেরোতেই তিনি অন্য কাউকে বিয়ের প্রস্তাব করলেন, এমনকি তিনি অন্য কারও প্রেমে পড়তে পারলেন? ওহ, মহিলা বিশ্বাস করেন না যে, লেখক অন্য একজনকে ভালবাসেন; সেখানে অবশ্যই কোনো অসৎ উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকতে পারে, যা হয়তো কোনো হালকা মেজাজের ছোটগল্পের সূচনা। তার কারণ কেউ কেবল ভাল জিনিস সম্পর্কে লিখতে পারেন না; লেখায় কিছু ভুলত্রুটিও থাকে । তখন মহিলার বিশেষত্ব ছিল অজুহাত সন্ধান করা । সেসব অজুহাত একটির সঙ্গে আরেকটির কোনও সামঞ্জস্য ছিল না।

মহিলা লেখককে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি কখনই সেই চিঠির জবাব পাননি। লেখক নিশ্চয়ই চিঠি পড়ার সময় দলা পাকিয়ে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছেন। হয়তো তিনি পুড়িয়ে ফেলেছেন, সম্ভবত তাকে তার আত্মজীবনী সম্পর্কে চিন্তা করতে হয়েছিল এবং বিষয়টি তাকে একটি উপযুক্ত জায়গায় তুলে ধরতে হয়েছিল। একজন মানুষ তার জীবনে যা চায়, বিষয়টা আসলে তেমন ছিল না। জীবন আমাদের নেতৃত্ব দেয়, লক্ষ্য উপলব্ধি করতে সহায়তা করে, যা আমাদের পক্ষে দেখা কঠিন এবং সেদিকেই আমাদের টেনে নিয়ে যায়। এই চিন্তাটা অকস্মাৎ মহিলাকে এতটাই আতঙ্কিত করে তুলেছিল যে, একসময় তিনি শহরের রোদেলা ঝলমলে রাস্তায় বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন।

তারপর লেখক মহিলাকে কখনই আর কিছু লেখেননি। মহিলা জানতে পেরেছিলেন যে, লেখক বিবাহিত ছিলেন এবং তাদের সন্তান ছিল। দু’জন অথবা তিনজন। যখনই লেখকের নাম কোথাও ছাপা হত, তখনই মহিলা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন যে, সেখানে তার সম্পর্কে কিছু লেখা হয়েছে কি না। লেখক যা লিখেছেন, তিনি ঠিক একই ভাবে তা পড়েছেন। আবেগতাড়িত হয়ে তিনি যা লিখেছেন, সেখানে সম্ভবত তার জন্য কোনো ইঙ্গিত রয়েছে। হয়তো লেখক এভাবেই সেই ভয়ানক বাক্যটি ব্যাখ্যা করবেন: ‘লেখালেখি ছাড়া জীবনে আর কিছুই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় ।’ 

যে হলঘরে লেখকের নিজে লেখা পড়ার কথা রয়েছে, সেখানে শ্রোতারা ধীরে ধীরে প্রবেশ করে নিজেদের আসন নেয়। মহিলা অন্যদের সঙ্গে ভেতরে যান এবং রক্তিম মখমলে আচ্ছাদিত টেবিল থেকে যতটা দূরে সম্ভব, সেখানে বসেন । ঘরের ভেতর কোনও প্রাকৃতিক আলো ছিল না। তাই ওপর থেকে টেবিলে আলো ফেলে কিছুটা আলোকিত করা হয়েছে। এটা ভালই হয়েছে । সেখান থেকে লেখক তাকে দেখতে পাবেন না। স্পটলাইটের আলোয় লেখকের দৃষ্টি আচ্ছ্ন্ন হয়ে যাবে।

হলঘরের ভেতরে তৈরি হয়েছিল নাটকীয় পরিবেশ। শ্রোতারা অত্যন্ত নিচু স্বরে কথা বলছিল এবং তারা হলের চারদিকে ইতিউতি তাকাচ্ছিল। স্থানীয় একজন আলোকচিত্র শিল্পী নিঃশব্দে একটা তেপায়া স্ট্যান্ড স্থাপন করে। অবশেষে দরজার দিক থেকে মৃদু গুঞ্জন ভেসে এল। রক্তমাংসের টি. সেখানে উপস্থিত হন। তাকে ত্রুটিহীন লাগছিল। তিনি ছিলেন নিখুঁত। তিনি অন্যদের থেকে আলাদা ছিলেন, কিন্তু ঠিক কীভাবে, মহিলা তা জানতেন না। লেখকের কাছ থেকে একধরনের বিশুদ্ধতা বের হচ্ছিল—তার শেভ করা মসৃন ফ্যাকাশে মুখ, সাদা শার্ট, শার্টের শক্ত কলারের তীক্ষ্ণ রেখা, চোখে রুপালি ফ্রেমের চশমা । ইস্পাতের রঙের মতো ধূসর স্যুট। মহিলা তার বসার জায়গা থেকে লেখকের জুতা দেখতে পাননি, কিন্তু হঠাৎ তার মনে পড়ে দশ বছর আগে জুতা জোড়া দেখতে কেমন ছিল—বাদামী, চোখা মাথা, সামান্য বাঁকা। আরও মনে পড়ে তার নগ্ন পায়ের কথা, যা যে কোনও স্বীকারোক্তির চেয়ে বেশি প্রকাশ্য। লেখককে খালি পায়ে হলঘর জুড়ে হেঁটে যাওয়ার ছবি তিনি কল্পনা করেন।

লেখকের বয়স বেড়েছে। তিনি অনেক বদলে গেছেন। তিনি জনগণের দিকে তাকান নি। তিনি হাতলওয়ালা চেয়ারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাকে এক জগ পানি ও একটা গ্লাস দেওয়া হয়েছে । তিনি একপাশে ঠেলে সরিয়ে রাখেন। তিনি তার জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে গলা পরিস্কার করেন এবং তখনই তিনি কেবল সামনের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকান। মহিলা কাঁপছিলেন। কারণ একমুহূর্তের জন্য তিনি তার শরীরে লেখকের দৃষ্টি অনুভব করেন। তবে ক্রমশ তা হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু লেখক তাকে চিনতে পারেননি। তিনি তাকে চিনতে পারতেন না, কেননা তিনি অনেক দূরে বসেছিলেন। অথচ যে কোনও ভিড়ের মধ্যে মহিলা সর্বদা তাকে চিনতে পারেন এবং যে কোন দূরত্ব থেকে।

‘ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়বৃন্দ,’ লেখক শুরু করেন, ‘আমাকে এখানে আমার অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে …’

তিনি শহর সম্পর্কে কিছুই বলেননি, মুগ্ধ শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে হাসেননি, তাদের দিকে ফিরেও তাকাননি, ফুলের জন্য এবং হলঘর ভর্তি উত্তেজনার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাননি। তিনি নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেননি, তিনি কে, এমনকি তিনি অনুষ্ঠান পছন্দ করেছিলেন কি না, এসব বিষয়ে কিছুই বলেননি। এছাড়া মে মাসের সূর্য্যের তাপ, মহিলাদের টুপি কিংবা তাদের স্বামীর ঘড়ির চেইনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলেননি। তিনি কথার মাঝে থামেননি, দীর্ঘশ্বাসও ফেলেননি । তার চোখেমুখে কোনো অভিব্যক্তি ছিল না । তিনি পরিস্কারভাবে কথা বলেছেন, তবে তার কথা বলার মাঝে একঘেয়েমি ছিল। তিনি শুধু একবার টাই ঠিক করেছেন, যেন তিনি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে, টাইটা সঠিক জায়গায় রয়েছে। তিনি নিশ্চয়ই উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে নিজেকে একজন সার্বজনীন ইউরোপীয় লেখক, নির্বিকার জ্ঞানী, উদাসীন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই অনিশ্চয়তার আড়ালে লুকিয়ে থাকাকে একটি বিশেষ গুণ বলে মনে করেছেন। আভিজাত্যের মার্জিত ভাবসাব; অন্য কিছু নয়, তার থেকে কমও নয়। তার এসব বিষয় মহিলার কাছে পরিচিত ছিল, খুবই পরিচিত ছিল। যাহোক, বিষয়টি উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, তবে কেবল সেই সময় পর্যন্ত যখন মহিলা জানতেন যে, মুখোশটি যেকোনো মুহূর্তে খসে যেতে পারে। বৈপরীত্যটাও ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। ঠিক লেখকের এই জিনিসটাই মহিলা ভালবাসতেন । তবে লেখক দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

তিনি ধীরেসুস্থে মূল প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিলেন। তবে মাঝে মাঝে তিনি বিরতি দিয়ে তার দৃষ্টি ছাদের দিকে তুলে ধরছিলেন। বিরতিগুলো ছিল কমা, স্পেস এবং ড্যাশের মতো দীর্ঘ। সত্যিই তিনি অনেক এগিয়ে গেছেন । তিনি সঙ্গীত নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু সাহিত্য নিয়ে বলেননি। শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো হতাশ হয়েছে, কারণ একজন লেখকের কী সাহিত্য নিয়ে কথা বলা উচিত ছিল না?

‘… এবং মনে হয় শোক সঙ্গীত তার নিজস্ব স্বকীয়তা পাল্টে একাধিক স্বর এবং সুরেলা ধ্বনির দিকে পরিবর্তিত হওয়ার মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। যদিও আসলে তা বর্বরদের বিজয়, তবে সাধারণত অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, …’  মহিলা এটুকুই বুঝতে পেরেছিলেন ।

মাধ্যাকর্ষণের কারণে লেখকের মুখ মহিলার দিকে ঝুঁকে আছে । তার চোখেমুখে কিশোরের হাসি—অর্ধেক নিষ্পাপ, বাকিটা নিষ্ঠুর । সেখানে দুঃখের চিহ্ন ফুটে আছে, আনন্দের নয় । ঘামের ফোঁটা জমেছে । একটা বোতাম ছিঁড়ে গেছে ।

যখন লেখক শেষ করেন, তখন সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিল, যেন তিনি একজন নামকরা অপেরা গায়ক। একসময় কয়েকজন লোক টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। তিনি পকেট থেকে কলম বের করেন, যা স্পটলাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল । তারপর তিনি বইগুলোর ওপর ঝুঁকলেন।

মহিলা বেরিয়ে যান এবং দ্রুত হোটেলের দিকে হাঁটতে থাকেন। তিনি এখন দু’বার, তিনবার, অনেকবার একাকীত্ব বোধ করে হতাশার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেন। কিছুই ছিল না, কিছুই তিনি বদলাতে পারতেন না। ঈশ্বর যা দিয়েছেন, তার জন্য কেন তিনি তাকে ধন্যবাদ দিতে পারলেন না? কেন প্রশংসা করা এত বেশি কঠিন ছিল? কেন একজন মানুষ সবসময় এমন কিছু চায়, যা তার কাছে নেই? মানুষের চিন্তাধারার এসব ভুলত্রুটি কোথা থেকে আসে?

অভ্যর্থনা ডেস্কে কেউ ছিল না। হোটেলের ভেতর সদ্য বানানো কেকের গন্ধ মৌ মৌ করছিল। মহিলা ডেস্কের কাছে অভ্যর্থনাকারীর জন্য একমুহূর্ত অপেক্ষা করেছিলেন, কিন্তু অভ্যর্থনাকারী লোকটি আসেনি। সম্ভবত সে-ও অনুষ্ঠানে গিয়েছে। সুতরাং তিনি তার কক্ষের চাবির দিকে হাত বাড়ান । তারপর কোনোকিছু না ভেবেই তিনি অন্য একটি চাবি আঁকড়ে ধরেন। চাবিটা রোমান সংখ্যা এক থেকে ঝুলছিল । কী রকম অন্যমনস্কতা! কীভাবে তারা সেই চাবিটা এখানে ঝুলিয়ে রাখতে পারে? তিনি চোরের মতো সিঁড়ির দিকে ছুটে গেলেন।

মহিলা সতর্কতার সঙ্গে বিলাসবহুল কক্ষের দরজা খোলেন। তিনি আলো জ্বালাননি—কেননা অস্তগামী সূর্যের উষ্ণ আলোয় ঘর প্লাবিত হয়েছিল। বিশাল এক ব্যালকনি, জানালার দামী পর্দা উভয় পাশে সরানো এবং ঘরের মধ্যে একটা বিশাল আকৃতির বিছানা । লেখক স্যুটকেস থেকে জিনিসপত্র খুলে গুছিয়ে রাখারও সময় পাননি । স্যুটকেসটি বিছানার ওপর খোলা। পাশেই তার সর্বশেষ বইয়ের তিন কপি। বইগুলো ঝকঝকে, সম্ভবত নতুন। হাতলওয়ালা চেয়ারের ওপর একটা স্যাঁতসেঁতে, ভেজা তোয়ালে পড়ে আছে, যা অবশ্যই হোটেল কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে তার আগমন উপলক্ষে, কিনেছে। তিনি সাবধানে তোয়ালেটা স্পর্শ করেন। কাছেই বাথরুম, বেশ বড়, জানালার পাশে বাথটাব এবং বাথটাবে পিতলের প্রুশিয়ান কল লাগানো আছে। এছাড়া আছে কাপড় ঝুলানোর জন্য ওয়াশস্ট্যান্ড এবং সেখানে দাড়ি কামানোর জন্য সাবানের একই ধরনের কাঠের বাক্স আছে। এটা অসম্ভব, তিনি ভাবলেন । তিনি হাতে সাবান তুলে নেন এবং সাবানের গন্ধ শোঁকেন। পরিচিত গন্ধ। যদিও তিনি আশা করেছিলেন যে, সাবানের গন্ধ তার ওপর আরও বেশি প্রভাব ফেলবে। তিনি বিভিন্ন ওষুধের দোকানে এ জিনিসটির অনেক খোঁজ করেছেন এবং প্রতিবারই না পেয়ে আরও বেশি হতাশ হয়েছেন। শেভিং ব্রাশ ভেজা—তিনি চলে যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই দাড়ি কামিয়েছেন। টুথব্রাশ শুকনো। টালির মেঝেতে তার কালো মোজা পড়ে আছে । মহিলা বাথটাবের পাশে বসে একটা অদ্ভুত জিনিস ভাবলেন: লেখককে যথাযথভাবে ভালবাসতে হলে তাকে তার মতোই হতে হবে। তার অন্তরে ঢুকতে হবে। তার নিজের হাত দিয়ে লেখকের শরীরকে আদর-সোহাগ করতে হবে। তিনি নিজেকে যেভাবে এবং যতটুকু যত্ন করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি যত্ন করতে হবে। যদি আমরা দু’জনই সেখানে থাকতে পারতাম, মহিলা ভেবেছিলেন। তবে লেখক লিখতেন, যদি তা তার কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়, এবং আমি তার যত্ন নেব। সেখানে কোনো পাপ, কোনো বিচ্ছেদ কিংবা কোনো অনিবার্যতা থাকত না। শুধু বাথরুমের চ্যাপেলের কোমলতার মতো নিজের নিষ্পাপ ভালবাসা থাকত। তার নিজের ত্বক স্পর্শ করার বিষয়টি সত্যি যত্নশীল ছিল না, এমনকি প্রেমের বিষয়ও ছিল না, বরং তা ছিল তার ত্বকের জন্য সেরা সাবান আবিস্কার করার মতো বিষয় । ‘আমি তার শরীরের প্রতিটি সেন্টিমিটার হৃদয় দিয়ে জানতে পারতাম,’ তিনি ভেবেছিলেন, ‘আমি তার মুখের অভ্যন্তরটি তার নিজের জিহ্বার মতো, এমনকি প্রতিটি দাঁতের আকৃতি জানতে পারতাম । তার ঘ্রাণ আমার কাছে অন্য কারো গন্ধের মতো মনে হবে না, কারণ তা আমার নিজের হবে । আমি তাকে যত্ন করে আঁকড়ে  রাখতাম।’

নীচতলা থেকে একটা শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে তার নিজের তলায় চলে যান।

তিনি ডাইনিং হলের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে বিল পরিশোধ করছিলেন। তখন সবাই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসেছে। লেখক কিছু একটা বলার সময় তিনি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন।

‘তিনিই হলেন সেই টি.,’ অভ্যর্থনাকারী গর্বের সঙ্গে ফিসফিস করে বলল । ‘আমার স্ত্রী তার সব বই পড়েছে।’

মহিলা অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। তিনি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন—কেবল টাকা গোণার জন্য তিনি হাত বাড়িয়েছিলেন।

ট্যাক্সিতে ওঠার সময় হঠাৎ মহিলা নিজেকে পুরোপুরি নিঃস্ব বোধ করেন । তার মনে হয়েছে যে, তার দেহের ওজন এক টন, এমনকি ঘোড়াও একইরকম ভাবছিল—কেননা ঘোড়া কিছুতেই নড়াচড়া করতে চাচ্ছিল না।

তিনি অনেকক্ষণ নীরব ছিলেন। একসময় ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাবেন, ম্যাডাম?’

‘স্টেশনে,’ তিনি বলেন।

অ্যালেনস্টাইনের মতো শহরগুলোতে সবকিছু অবশ্য স্টেশনেই আরম্ভ এবং শেষ হওয়া উচিত।

[মূল গল্পে নেই, কিন্তু পাঠকের সুবিধার্থে কয়েকটি অপরিচিত শব্দের টীকা জুড়ে দেওয়া হলো]
১. প্রুশিয়ান অর্ডার – তৎকালীন প্রুশিয়া রাজ্যের সামরিক বাহিনীর মেডেল, যা বিভিন্ন পদবী অনুযায়ী প্রদান করা হত। উল্লেখ্য, প্রুশিয়া ছিল প্রাক্তন জার্মান রাজ্য, যা ১৭০১ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে গঠন করা হয়েছিল । বলাবাহূল্য, প্রুশিয়া ছিল ১৮৭১ সালে জার্মানির একত্রীকরণের নেপথ্যে মূল চালিকা শক্তি এবং ১৯১৮ সালে বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত জার্মান সাম্রাজ্যের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্র ছিল।
২. এশিয়াটিক মেলানকোলি – এশীয়দের মানসিক অনুভূতি বা মেজাজ, যেমন বিষন্নতা ।

লেখক পরিচিতি: নোবেল বিজয়ী পোলিশ ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, বামপন্থী অধিকারকর্মী এবং বুদ্ধিজীবী ওলগা তোরাকচুক (পুরো নাম ওলগা নভোয়া তোরাকচুক) ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন । মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন । তার প্রথম উপন্যাস দ্য জার্নি অব দ্য বুক পিপল’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে । ইংরেজিতে অনূদিত ‘ফ্লাইটস্’ তার সবচেয়ে সফল এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস । এই উপন্যাসের জন্য তিনি ২০১৮ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল বুকার’ পুরস্কার এবং ২০১৯ সালে ঘোষিত ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জণ করেন । ইংরেজিতে অনূদিত তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘হাউজ অব ডে, হাউজ অব নাইট’, ‘প্রিমেভাল অ্যান্ড আদার টাইমস’, ‘ড্রাইভ ইয়োর প্লাউ ওভার দ্য বোনস্ অব দ্য ডেড’, ‘দ্য লস্ট সৌল’ এবং ‘দ্য বুক অব জ্যাকব’। উল্লেখ্য, ‘দ্য বুক অব জ্যাকব’ ২০২২ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল বুকার’ পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে । তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন । 
গল্পসূত্র: ‘জনৈক লেখকের সঙ্গে এক সন্ধ্যা’ গল্পটি ওলগা তোকারচুকের ইংরেজিতে ‘অ্যান ইভিনিং উইথ দ্য অথার’ গল্পের অনুবাদ । পোলিশ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জেনিফার ক্রফট । গল্পটি ‘শর্ট স্টোরি প্রজেক্ট’-এ (অনলাইন) প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে ।
Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop