আবদুল মান্নান সৈয়দ : শিল্প প্রাচুর্যের জহুরি

By Published On: November 9, 2023

জীবন মূলত একটি কাল্পনিক বাস্তবতা এটি কবির জন্য আরও ভয়াবহ ভাবে সত্য। মানুষ তার জীবনের শুরু থেকে মৃত্যু পর্র্যন্ত নানা রকম কল্পনায় বাঁচে। সে কল্পনার কোথাও কোনো কমতি দেখা গেলে কেউ কেউ হতাশ হয়ে পড়েন। সে হতাশা থেকেই আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর কাজটি কেউ কেউ করে বসে। এর কারণ ব্যক্তির কল্পজগতে নতুন কোনো স্বপ্ন না থাকা। যার ফলে জীবনের প্রতি তার আগ্রহ কমে যায়। এমন লেখকের সংখ্যা কম নয় পৃথিবীতে। কেউ আবার নতুন কোনো স্বপ্ন বা কল্পনায় বাঁচতে শুরু করে। এই বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষ আর কবির জন্য এক নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে কৃষকের কথা; তাদের ফসল শীলাবৃষ্টি, বন্যা কিংবা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে নষ্ট হলে তারা নতুন করে ভালো ফলন পাবার প্রত্যাশাব্রত হয়। ভাগ্যের উপর নির্ভর করে আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে; কল্পনায় কোনো এক ভাগ্য দেবতার অলৌকিক শক্তির উপর তারা ভরসা রাখেন। এখানে প্রশ্ন হতে পারে কল্পনা ও স্বপ্ন ভিন্ন কিছু? আপত চোখে যদিও তা দেখতে এক কিন্তু তার ভিন্নতা অবশ্যই আছে। এর উত্তর খোঁজার আগে বলে নিই কল্পনাই একমাত্র বাস্তবতা। যেমন-

কেউ বললো ‘পাখির গান’ আমরা ধরে নিই যে পাখিটি আছে তার মানে হলো এখানে অদৃৃশ্য পাখিটি বাস্তবিক পক্ষেই আছে এবং এটি আমাদের কল্পনা। ‘গান’ এখানে ক্রিয়ারূপে আবর্তীত হয়েছে যা স্বপ্ন এবং তার জন্যে প্রয়োজন পড়ছে কল্পনার পাখি। এখানে যা স্বপ্ন কবিতায় তা ঞবীঃ হয়ে আসে। কবিতার টেক্সট কেমন? তা নিয়ে নানান কথা বলা যেতে পারে তবে সেদিকে যাচ্ছি না। যিনি কবি সে নিজেই নিজের ভাগ্য নির্মাণ করে; কোনো অলৌকিক সত্যের মোহে কবি আবিষ্ট নন। জীবনকে দেখে, তার আবহকে অনুভব করে; নিজে যা কল্পনা করে অপর মানে পাঠক কবির কল্পনার সাথে নিজ কল্পনার সংযোগ ঘটিয়ে কল্পনার নতুন একটি জগৎ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। যে কারণে কবি ও সাধারণের কল্পনা এক নয়। যাপনের ভূমিকায় যার কল্পনা যত সুন্দর তার জীবন তত লাবণ্যময়। তবে এটা সত্য যে কবিদের কল্পনা জটিল ও ক্ষেত্র বিশেষে অবিশ্বাস্য বা অসত্য। কিন্তু যিনি কবি তিনি জটিল কল্পনায় স্বচ্চ একটি ধারণা বা বাস্তবতাকে যেমন করে তোলেন কাল্পনিক। তেম্নি কল্পনাকে করে তোলেন বাস্তবতার প্রতিবিম্ব। ফলে কবির কল্পনায় ঘুরতে থাকা অবিশ্বাস্য সত্য প্রকট সত্য রূপে প্রকাশিত হয়। আবার কোনো কোনো সত্য কল্পরূপে রহস্য জাল বুনে দেয়। যে কারণে কবিতা হয়ে ওঠে বিমূর্ত। Albert Einstein বলছিলেন Imagination is more important than knowledge জ্ঞানের চেয়েও তিনি কল্পনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন তার কারণ হলো-

কল্পনায় আছে সৃজনশীলতা আর সৃজনশীলতায় আছে নতুন জ্ঞানের চাবিকাটি যা দিয়ে আমরা অপার সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে পারি। কবিদের কল্পনাকে বলা যায় অলৌকিক সুন্দরতার আনন্দ-

ফলে কবিতা হয়ে ওঠে মুগ্ধতার বিষয়। সে মুগ্ধতা কেবল মুগ্ধতা নয়; বরং মুগ্ধতার অধিক প্রাণস্পন্দনে থাকে শৈল্পিকতার অনুরণন বা প্রাণনা। মূূল আলোচনায় যাবার আগে এখানে দুটি বিষয় পরিস্কার করে নিই। প্রথমত আলোচনাটি পড়ার সময় উপরের কথা গুলো মনে রাখতে হবে যা বাকি আলোচনায় গোপনে রেখাপাত করবে। দ্বিতীয়ত এই প্রবন্ধে আমি আলোচনা করবো আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা নিয়ে। স্থানে স্থানে আসতে পারে রোমান্টিসিজম বা মর্ডানিজম এর আলোচনা। এখন বলতে পারেন এ আবার নতুন কি? আমেরিকান কবিতায় প্রচুর আছে। অথচ আমেরিকার কবিতা এগিয়েছে ফরাসি কবিতার হাত ধরে। আবার ফরাসি কবিতা আরাবিয়ান কবিতা থেকে এমন বলিষ্ঠরূপ ধারণ করেছে যে-

উইরোপ, আমেরিকার কবিতা ফরাসি কবিতার প্রভাবে প্রভাবিত হতে বাধ্য হয়। পাবলো নেরুদার কবিতা পড়লে আরাবিয়ান কবিতার ছাপ তার কবিতায় পাওয়া যায়। বিশেষ করে Rasidencia en la tierra এর কবিতা। আবার আল মাহমুদের কবিতা পড়তে গেলে তার কিছু কবিতায় নেরুদার ছাপ পাওয়া যায়। ফিউশন শিল্প জগতে ভয়ংকর একটি দিক। পৃৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যে সকল শিল্পের আর্বিভাব হয়েছে তার সাথে ফিউশনের গোপন যোগ সূত্র জড়িত আছে নিবিড় ভাবে। কবিতা থেকে শুরু করে চিত্রশিল্পে; শিল্পের প্রায় প্রতিটি শাখায় তার দেখা পাওয়া যায়। তবে এই ফিউশন প্রথমে আসে চিত্রশিল্পে পরে তা কবিতায় প্রবেশ করে; কবিতা থেকে গানে। সালভাদার দালির কথাই যদি বলি; তার জীবনের প্রথম দশটি বছর কেটেছে পিকাসোকে অনুকরণ করে। আর পিকাসো? পিকাসো মূলত ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের স্ট্রোক গুলো ভেঙে চিত্রশিল্পে রেখার সূত্রপাত ঘটান। আবার ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ পল গোগাঁর চিত্রকর্ম থেকে অনেকটা অনুপ্রাণিত। কিন্তু তারা প্রত্যেকে সেই অনুপ্রেরণাকে নিজস্ব শৈল্পিকতায় একটি আকার দাঁড় করাতে পেরেছেন-

যা তাদের সৃৃষ্টিশীলতাকে বহন করে। কবিতার ফিউশনাল বাস্তবতা এক সময় আমি নিজেও মেনে নিতে পারতাম না এখনো যে পারি তাও নয় মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছি এই যা। ফিউশন নিয়ে কথা বলার কারণ হলো সমস্ত শিল্প জগৎ নিয়ে একটি ধারণা দাঁড় করানো যেহেতু সব কিছু ধরে ধরে কথা বলতে গেলে আলোচনাটি দীর্ঘ হয়ে যাবে। বাংলা কবিতায় ফিউশন তেমন কোনো উজ্জ্বলতা আনতে পারেনি। বরং আমাদের কবিরা অন্যের কবিতা দ্বারা ব্যাপক আকারে প্রভাবিত হয়েছেন। একটি শিল্প প্রকরণ ভেঙে ভিন্ন একটি শিল্প প্রকরণ গড়ে ওঠার মাঝের সময়টাকেই আমি ফিউশন মুমেন্ট মনে করি। আবার একটি শিল্প প্রকরণ ভেঙে ভিন্ন একটি শিল্প প্রকরণ গড়ে ওঠতে ফিউশনের প্রয়োজন নাও পড়তে পারে। ৬০ এর দশকে সৈয়দ আলী আহসান ইউরোপীয় নন্দনতত্ত্ব ও ফ্রয়েডীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন বৈচিত্র তিনি আনেন এবং তার কবিতা আধুনিক হয়ে ওঠে বটে। কিন্তু শৈল্পিকতার কাঠামোতে তার নিজস্ব শিল্পায়ন না থাকার ফলে তাঁর সে ধারাটি এখন নিশ্চিহ্ন। যে কারণে আমাদের কাব্য জগৎ ফরাসি, ইউরোপ, আমেরিকার কাব্য জগতের মতো এখনও উজ্জ্বলতা পাচ্ছে না। তবে না হওয়ার মাঝেও দুই একটি কাজ হয়েছে বটে যেমন মজনু শাহ’র লিলাচুর্ণ শঙ্খ ঘোষের গন্ধার্ব কবিতাগুুচ্ছ থেকে অনুপ্রাণিত হলেও মজনু শাহ’র শৈল্পিকতার গুণে তা এখন গৌণ। শঙ্খ, ভাস্কর, উৎপকুমার কিংবা জহরসেন মজুমদারের কবিতার প্রভাবের কথা অনেকে বলেন। কিন্তু শিল্পের বিচারে তাদের কথা গৌন হয়ে পড়ে। আমরা লিলাচুর্ণ বলতে এখন মজনু শাহকেই চিনি। তার সকল কবিতায় মজনু শাহকে একক ভাবেই চেনা যায়। তবে তাদের প্রভাব যে ছিল এটা সত্য। এই বইটির প্রভাব সাম্প্রতিক কিছু কিছু কবিদের কবিতায় দেখতে পাই। কিন্তু তা বলতে গেলে আদা পাদা নুন শাদা কাহিনি হয়ে যাবে। কাব্য সৌন্দর্যের জায়গায় কাব্য বিশৃঙ্খলা বা কাব্যকলহ দেখা দেবে। এই ফিউশনাল বাস্তবতা একটি ভয়ংকর বাস্তবতা যা বলতে গেলে অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়। মূলত শিল্প-ধারণার সঙ্গে মিল রেখেই এসব পরিবর্তন আসে, এসেছে এবং আসবে। এবং ফিউশনের মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্পের উদ্ভব হয়েছে। যেমন রোমান্টিসিজম মূলত Rationalism এর উৎস থেকে উদ্ভাবিত। রোমন্টিকতা বলতে আমি বুঝি কল্পনাপ্রবণতা। এই হিসেবে মানুুষ আদিযুগ থেকেই কাল্পনিক; আজ যা আমার কাছে বাস্তব রূপে প্রকাশিত তাও মূলত কল্পনার একটি অংশ। সুতরাং রোমান্টিসিজম আমার কাছে পুরাতন কিছু নয় বরং এটাকে শিল্পের মৌলিক গুণ বলে বিবেচনা করি। অনেকে মনে করেন রোমান্টিকতা রিয়ালিস্টিক ধারণা; এটা সত্য তার থেকেও বড় সত্য হলো এটি অতিকাল্পনিক ধারণাকে প্রকাশ করে যা আমাদের প্রায় সময় বোধগম্য হয়ে ওঠে না। যেমন :

‘দেখছি ঘাসের মেজে ছিন্ন, লাল মুণ্ডু নিয়ে খেলে বিনা পায়ে, বিনা অপব্যয়ে: সূূর্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে কালো রেলগাড়ি:

এই লাইনটি আবদুল মান্নান সৈয়দের রাত্রিপাত কবিতা থেকে নেয়া। এই একটি মাত্র লাইনে তার কল্পনার সক্ষমতা জানতে পারার সাথে সাথে বুুঝতে পারি যে, কবিতা হয়ে ওঠার প্রথম কাজটিই হলো কল্পনা করতে পারা। এখানে পরাবাস্তবতা ও চিত্রকল্পের যে বিষয়টি আছে তা আপাতত আলোচনা করছি না বরং পরবর্তীতে ভিন্ন দুটি কবিতায় মান্নান সৈয়দের পরাবাস্তবতা ও চিত্রকল্প নিয়ে কথা বলবো। এখানে কবিতা ব্যাখ্যা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কবিতার কোনো ব্যাখ্যা আছে বলে আমি মনে করি না। কবিতার শব্দ গুলো ধরে ধরে আমরা শুধু একটি ধারণার কাছে পৌঁছাতে পারি। পূর্বে উল্লেখ করেছি পাঠক কবির কল্পনার সাথে নিজের কল্পনাকে যুক্ত করে নতুন একটি কল্পনার জগৎ নির্মাণ করে। সুতরাং কবিতার ব্যাখ্যা করতে চাওয়া শেষ পর্র্যন্ত অপচেষ্টা। মান্নান সৈয়দের এই লাইনটিতে তিনি যেখানে কল্পনা করছেন ‘ঘাসের মেজে’ তা মূলত একটি সজীব পৃথিবী। ‘লাল মুণ্ডুু’ বলে তিনি কল্পনা করছেন সূর্য। এখানে বুঝতে পারি কবি বলতে চাচ্ছেন পৃৃথিবী সূর্যকে নিয়ে খেলছে বিনা পায়ে বিনা অপব্যয়ে। কালো রেলগাড়ি বলতে কবি এখানে কল্পনা করছেন রাত। রাতকে রেলগাড়ি বলার আরেকটি কারণ হতে পারে বহন যোগ্যতা ও গতিশীলতার একটি কনসেপ্ট ক্রিয়েট করতে চাওয়া। অর্থাৎ এই লাইনে কবি তার কল্পনায় পৃথিবীতে রাত্রি নামার কথা বলেছেন বিভিন্ন ইমেজ এবং পরাবাস্তবতা সৃষ্টি করে। এই কবিতা আমার কাছে যতটা না সুররিয়ালিজম তার চেয়ে আরো বেশি ম্যাজিক রিয়িালিজম আমি তো বলি শুধু মাত্র এই কবিতার আবহ টুকুই সুররিয়ালিস্ট মনে হয়। রাত্রি আসলেই কি আমাদের কোথাও নিয়ে যায়? ধারণা করি জ্যোৎস্না রাতে গৌতম বুদ্ধের গৃহ ত্যাগ; নবী মুহাম্মদ (স.) এর মেরাজের রজনীর কল্পনা থেকে কবির মনে রাতকে রেলগাড়ি কল্পনার সূত্রপাত মানে সে আমাদের পৌঁছে দেয় একটি উদ্দেশ্য থেকে অন্য একটি উদ্দেশ্যে। কালো রেলগাড়ি চলছে…

আল্লাহ আছেন তাঁর অবাক সৃষ্টিতে গালে হাত দিয়ে, মানে বৃষ্টি হচ্ছে, যেন ছেলেরা চলছে স্কুলের; অন্ধকার দেখে আলো হেসে ফেলল বরং, তথা জ্যোৎস্নার ঘাগরা পরে অভিসারী সত্য জানালায় এসে টোকা দিচ্ছে নিঃশব্দে; আমি করতলে চাবি নিয়ে, ঘুমেরু ভিতর ফিরি দুয়ারে দুয়ারে।
(রাত্রিপাত-আবদুল মান্নান সৈয়দ)

কবিতার এই পর্যায়ে এসে এটি হয়ে উঠছে জীবনচচক্র। যা একটি আত্ম-বিস্মৃত জগৎ। এখানে তাঁর যে জীবনভঙ্গি কিছুটা পলায়নবাদী আত্ম-উদারবর্তদ্রষ্টাসুলভ। কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এই কবিতার ভিতর দিয়ে মূলত নিজের সন্ধান শুরু করেছিলেন। যার ছাপ তার পুরোটা জীবন ধরে থেকে গেছে। যার দেখা তিনি আর পাননি কোথাও এমনকি তাঁর রচিত ‘সকল প্রসংশা তাঁর’ কাব্য জগতেও না। বলছিলাম ফিউশন ফরাসি, ইউরোপ বা আমেরিকার কবিতায় যে উজ্জলতা এনেছে বাংলা কবিতা তার মতো পারেনি বিশেষ করে বাংলাদেশের কবিতা। তার একটি বড় কারণ হচ্ছে রাজনীতি। ৭০ দশকে রাজনৈতিক কবিতার নামে যে হৈ চৈ শুরু হয় তা ছিল মাছ বাজারের মতো সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে তা নিবিড় হয়ে এসেছে। বাংলা কবিতা মূলত ৫০ এর দশক থেকেই বিদেশি কবিতা দ্বারা ব্যাপক আকারে প্রভাবিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক কবিতা আফ্রিকান কবিতা দ্বারা প্রভাবিত। এর বাহিরে এসে কেউ কেউ ভালো কবিতা লেখার চেষ্টা করলেও ভাষা নির্মাণের বিষয়টি কারো মাঝে লক্ষ কারা যায়নি। সুতরাং তাদের কাব্য সাধনাকে এক সঙ্গে কাব্য সংকলণ বলা যায়। আসলে ভালো কবিতা লিখতে পারা সহজ কাজ কিন্তু ভাষা নির্মাণ অসাধ্য বটে। রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতা ভাঙার পর বাংলা কবিতা আক্রান্ত হয় তিরিশি সিনড্রমে বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশের প্রভাবলয়। যার প্রভাব বাংলা কবিতা এখনো বয়ে যাচ্ছে। ৫০ দশকে উজ্জ্বল কবিদের মাঝে শামসুর রাহমান একজন তার প্রথম দিকের কবিতা জীবনানন্দ দ্বারা প্রভাবিত। শামসুর রাহমান মূূলত তিরেশের কবিতা এবং আধুুনিক ইঙ্গ-মার্র্কিনি কবিতা আত্মস্থ করে কবিতা রচনা শুরু করেন পরবর্র্তীতে নাগরিক সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকেন। সে সময় বুদ্ধদেব বসু, অমীয় চক্রবর্তী সহ যারা আধুনিক কবিতা লেখতে শুরু করেন তাদের আধুনিকতা মূলত বোদলেয়ারিয় আধুনিকতা যা এখনো চলমান। ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দিকে এসে বাংলা কবিতা আল মাহমুদ, শমসুর রাহমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখের কবিতা কবিতার জগতে নতুন কাব্য ভাষা এনেছে ঠিকই কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক যেমন ফ্রয়েডীয় কবিতা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন সমকালে শহীদ কাদরীর কবিতা দ্বারা সমান ভাবে প্রভাবিত লক্ষ করা যায় বিশেষ করে তার বোশেখে রচিত পঙক্তিমালার কবিতা। যে করণে তার কবি পরিচয়টি গৌণ বলে বিবেচনা করি। এর বাহিরে গুটি কয় ভালো কবিতা তার আছে সে কথাও স্বীকার করি। ষাটের দশকে শহীদ কাদরীর কবিতা সবার প্রথম স্বতন্ত্রসূচক হয়ে ওঠে কিন্তু বিশেষ কোনো বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় না তার কবিতায়। তার কারণ হতে পারে সুধীন দত্তের প্রতীকি আশ্রয় ও বোদলেয়ারের আধুুনিকতা। ষাটের আরেক কবি রফিক আজাদের কথা বলা যায় তিনি কবিতায় নতুনত্বের ধারক নন। বরং কবিতার নামে তিনি যা করে গেছেন তার পুরোটাই ফাঁকিবাজি। এই ফাঁকিবাজ লোকটি ষাটের কবিতার সাক্ষরে তাও সন তারিখ হয়ে বসে আছে। তবে ষাটের দশকে বাংলা কবিতার ধারণা অমূল পালটে দেন আবদুল মান্নান সৈয়দ আমরা পাই নতুন কাব্য ভাষা। নতুন কাব্যভাষা গড়ে উঠে কবিতার প্রকৃতির কারণে। প্রশ্ন হতে পারে কবিতার প্রকৃতি কেমন? পৃথিবীতে সব প্রশ্নের নির্ধারিত উত্তর থাকলেও কবিতার নির্ধারিত কোনো উত্তর হয় না। কবিতা নানান রকম অভিজ্ঞতার মিশেলে প্রতিনিয়ত বদল হয়। তাই কবিতার আবহ থেকে একেক জনের প্রকৃতি একেক রকম হয়ে থাকে। তবে সমগ্রিক ভাবে বলা যায় কাব্য-অলংকার যা কবিতাকে শৈল্পিক করে তোলার পাশাপাশি নূতন নূতন কাব্য জগৎ গড়ে তোলতে সাহায্য করে। যেমন আবদুল মান্নার সৈয়দের প্রকৃতি বলতে বুঝি পরাবাস্তবতা বেষ্টিত কল্পনার জগৎ। সে জগতে আর কি কি থাকে তা পরে ধারাবাহিক আলোচনা হবে।

জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়, আমার চারদিকে যতগুলি দরোজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের; জ¦লছে গাছ সকল সবুজ মশাল; বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র; আর সমস্তের উপর বরফ পড়ছে।
(অশোককানন- আবদুল মান্নান সৈয়দ)

বলছিলাম কবিতার প্রকৃতির কথা। বস্তু জগৎ সব সময় ভিতর জগতকে প্রভাবিত করে। তার অন্তরগত আকাঙ্খা প্রকাশ পায় নানান সৃষ্টির মাধ্যমে। এটি হয়ে উঠে মননের, প্রজ্ঞা-প্রতিভা, অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের মাধ্যমে। যার কারণে কবিতার সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়ে সামাজিক বাস্তবতা। কবি মাত্রই এখানে কল্পনা প্রবণ। ‘ জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়’ জ্যোৎস্না একজন সাধারণ ব্যক্তিও দেখেন কবিও দেখেন। কিন্তু জ্যোৎস্না বলতে কবি কি দেখছেন? তাই এখানে আলোচনার বিষয়। ‘জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়’ তার এই দাঁড়ানো দেখে মনেই হতে পারে সে কোনো মেয়ে মানুষ বা কবির প্রেমিকা। এখানে যেটা হলো জ্যোৎস্নাকে পারসোনিফিকেশন এর মাধ্যমে নরোত্তারূপ করা হয়েছে যা কিনা একটি আবহ মাত্র। সে প্রকৃত জ্যোৎস্নাই। এই আবহটি পরাবাস্তব আবহ হয়ে ওঠে জ্যোৎস্নাকে ভূত বলার মাধ্যমে। সমাজ জানে জ্যোৎস্না ভূতের মতো নয়-

ভূত কালো, রহস্যময় ও অশরীরী। কবি বলছেন জ্যোৎস্না দাঁড়িয়ে আছে ‘ সব দরোজায়, আমার চারদিকে যতগুলি দরোজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের; এই পর্যন্ত এসে পারসোনিফিকেশনের ধারণাটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখানে জ্যোৎস্নার ডেফিনেশন কি? আমারা জানি চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। আর এই কবিতাটি এখানেই ঘুরে গেছে রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে। কবি এখানে যে জ্যোৎস্নার কথা বলছেন তা মূলত পাকিস্তানি জীবন ব্যবস্থা যেখানে সত্যের আলো বাধা প্রাপ্ত। তাই তিনি জ্যোৎস্নাকে দেখেন ভূূতের মতো দাঁড়িয়ে। যে মানুষের দরোজায় দাড়িঁয়ে জীবনকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। যা পাঠককে Hallucination করে তোলে। সে অন্ধকার ঘর থেকে দেখছে ‘জলছে গাছ সকল সবুজ মশাল; বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র; আর সমস্তের উপর বরফ পড়ছে।’ Blurred or Indefinite এর তন্ময়তায় আমরা একটি আকাঙ্খার কথা শুনতে পাই ‘জ¦লছে গাছ সকল সবুজ মশাল’ লাইনটির মানে হলো (‘জ¦লছে গাছ সকল) যুদ্ধকলিন পরিবেশ (সবুজ মশাল) যুদ্ধ পরবর্র্তী সম্ভাবনা বা স্বপ্ন। রেনে ম্যাগ্রিৎ তার চিত্রকলায় অগ্নি, পাখি, শিলা, জানালা ইত্যাদি ব্যবহার করে বাস্তব ও বিভ্রমের সংযোগ স্থাপন করতেন। কবিতা অবশ্য ভিন্ন একটি প্রকরণ এখানে ব্যবহৃত সকল প্রযুক্তি আলাদা আলাদা অর্থ প্রকাশ করে। যেমন এই কবিতায় ‘দোকান একটি নক্ষত্র’ এর মানে হলো অর্থনীতি। আর দরোজা হলো সম্ভাবনার প্রতীক। যার পিছনে মুক্ত প্রান্তর যে যার ইচ্ছে মতো জীবন যাপন করতে পার মানে দরোজা এখানে মুক্তির প্রতীক। যে কারণে কবিকে এখানে Individuality of a poet হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে। ষাটের দশকের প্রধান সাফল্য প্রাকরণিক সাফল্য। গ্রামীণ নস্টালজিক কাব্য প্রকরণ পাশ কাটিয়ে ইউরোপীয় নন্দনতত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পরেছিল বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা। ষাটের কিছু কবি ইন্দো-মার্কিন কবিতার ভাবধারায় পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট ছিলেন। ষাটের দশকের কবিদের বিষয় হয়ে ওঠে রোমান্টিকতা, স্বপ্নচারিতা ও আত্ম নিমজ্জনের বর্ণনাত্মক চিত্র। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুুর রহমান প্রমুখের কবিতায় স্বগত কথার মতন রোমান্টিক জীবনাকাক্সক্ষা ভাষারূপ পায়। কবিতার এই পরিচিত পরিমণ্ডল পাশ কাটালেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। তিনি হাঁটতে শুরু করলেন কবিতার অজানা এক জগতে, কবিতার অন্যকোনো খানে। তাঁর কবিতা হয়ে উঠতে থাকলো ইমেজনারির ও পরাবাস্তবতার মিশেলে অচেনা এক জগৎ। এই জগতে চিত্রকল্প- রূপক- উপমা- প্রতীক মিলেমিশে একাকার যার কারণে আচ্ছাদিত এক রহস্যময় জগতের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে পাঠক; পাঠিকা। বিশেষ করে উপমা, প্রতীক, সামাসোক্তি, অন্যাসক্ত নির্ভর অলংকার গুলোর উপর চড়িয়েছেন চিত্ররূপময়তা- পুুলিশ, নক্ষত্র, মশাল, পুরোনো বাড়ি, সিঁড়ি, মেয়েমানুুষ, জাহাজ, জ্যোৎস্না, রাত্রি, বাস, দোকান, বরফ, ঘোড়া, কুকুর, আয়না প্রভৃৃৃতি প্রতীক হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে পরাবাস্তব অনুসঙ্গ হিসেবে-

চাঁদের মুুখে ঐ ধুলো ছুড়ে মারল পৃথিবী; আর আকাশের ব্র্রিজ ঝনঝনা তুলে ফের স্থির হয়ে যায় নক্ষত্রের ঢেউয়ের উপর; কেবলি নির্দেশ দিচ্ছে তারা চোখ পিটপিট করে; ‘দুপুর নিবিয়ে, ফুল মেখে নাও কৈশোরবেলায়।’
(জীবন আমার বোন- আবদুল মান্নান সৈয়দ)

অথবা

ট্র্রেনগাড়িতে দেখেছিলাম একবার
সোনালি-লাল বিশাল বল এর মতো
ভোর বেলার সূর্য লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে।
(ইমেজ- আবদুল মান্নান সৈয়দ)

প্রথাগত কাব্য বেষ্টনি থেকে আবদুল মান্নান সৈয়দ শিল্প আন্দোলের জায়গা গুলো নিবির ভাবে প্রর্যবেক্ষণ করেন। যার ফলে ষাটের প্রচলিত কবিতা প্রকরণের সাথে তার বিরোধ ঘনিয়ে ওঠে। এই বিরোধ তাকে প্রভাবিত করে ভিতরে ও বাইরে। শুরু হয় বর্হিজগতের দ্বন্দ্বময় অভিঘাতে অর্ন্তজগতের সঙ্কোচন। অর্থাৎ জাগতিক বস্তুকে অতিজাগতিক অনুভূূতির বলয়ে ভাবতে শুরু করেন। এবং তার অভিপ্রায় ও উত্তরণে অন্তর্জীবনের স্পন্দন পেতে শুরু করেন। যার ফলে তাঁর কবিতা ইম্প্রেশনিজমে প্রবেশ করে। Impressionism বা অন্তর্মুদ্রাবাদ কথাটি বেশি আলোচিত হয় চিত্রকলাকে ঘিরে-

সূর্যাস্তের মতো রাঙা বেশ্যা
নীল জানালার পাটাতনে বসে আয়না ধরেছে
যেন মুখের সম্মুখে তার ধরে আছে নিবিড় বঘিনী;
সারিÑসারি আমগাছ মেহগনিÑবৃক্ষ হয়ে যায়,
তার ফাঁকে-ফাঁকে
জাফরান রোদ সন্ধ্যার চিকুরে আঁচড়ায় সোনার চিরুনি

(লণ্ঠন- আবদুল মান্নান সৈয়দ)

ইম্প্রেশনিস্ট কবি ও চিত্রশিল্পীর প্রধান কাজ হলো আলোছায়া তৈরী করা। অর্থাৎ বর্হিবাস্তব প্রকৃতির পরির্পাশি^কতাসহ বর্ণ ও আলোর প্রতিসাম্যে উপস্থাপিত করাই ইম্প্রেশনিস্ট কবিদের প্রধান লক্ষ। ‘সূর্যাস্তের মতো রাঙা বেশ্যা’ মানে বৈকালিক রহস্যময়তা ও আলোÑছায়ার নির্ভরতায় আমগাছ মেহগনিÑবৃক্ষে রূপান্তরিত হওয়া এবং জাফরান রোদের উল্লেখ কবিতাটিতে ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রকল্পে বদলে দিয়েছে। কেননা ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী বা কবি আলোর বর্ণিল রং, কালি প্রবাহ প্রভৃতি তার উপলবদ্ধি ও অভিজ্ঞানে তুলে ধরেন। অর্থাৎ এখানে কবির মনোচৈন্তের স্ফীত প্রাধান্য পেল এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতির বিশেষ আবহ Atmosphere গুরুত্ব পেল প্রকাশভঙ্গিতে। যার ফলে হুবহু বাস্তবতার অনুকৃতি নয় সূর্য একটি প্রাণময় সত্তার স্পন্দিত অবয়বে মনোজাগতিক রূপান্তর, অভ্যন্তরিন প্রতিক্রিয়া বিবৃত হয়েছে আলোর প্রতিসাম্যে। আবদুল মান্নান সৈয়দ নতুন কাব্যরিতী নির্মাণের জন্যে রিয়ালিজম ও ন্যাচারালিজম থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্তর্বাস্তবতাকে প্রধান্য দিলেন এবং বর্হিবাস্তবতাকে অস্বীকার করলেন। তখন ফিউচারিস্ট কবিরা চাইলেন High speed ও Fever-কে রূপ দিতে আর আবদুল মান্নান সৈয়দ Distortion ও Exaggeration-কে রূপ দিতে গিয়ে এক্সপ্রেশনিস্ট হয়ে পড়েন-

কী চড়া বাজার! আমাদের পাশের লোকটির সত্যি গলা কেটে নিল চীনে প্লেটের এক গাঢ় দোকানদার। এরকম প্রমাণ আমি দেখিনি। তারপর করলোকি? – না, তার কাটা মুণ্ডু ঝুলিয়ে দিল দোকানের উইন্ডোর নিচে বিজ্ঞাপনে টপটপ।
(সমস্ত ভাসান দিলাম সমস্ত উড়াল- আবদুুল মান্নান সৈয়দ)

১৯১০ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে অর্থাৎ প্রথম বিশ^যুদ্ধের আগে ও পরে এক্সপ্রেশনিজম সর্বোচ্চ বিস্তৃতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। মূলত দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী অসুুস্থ জার্মানের অস্বস্তিরতার প্রকাশ হলো এক্সপ্রেশনিজমের মূল ভিত। তাই এক্সপ্রেশনিস্ট কবির কাছে জীবন স্বাভাবিক ভাবেই অস্বাভাবিক, কল্পনাধিক্যে ব্যঞ্জিত। আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। কবিতার এই অংশটি একটি খুনের ঘটনাকে ঘনীভূূত করে তুলেছে। পাশের লোকটির গলা টাকা তারপর চীনা প্লেটে স্থাপন করা অতঃপর এটিকে আরও দৃশ্যগ্রাহ্য করে তুলতে দোকানের উইন্ডোতে মুণ্ডু ঝুলানোর বিষয়টি এক্সপ্রেশনিজম এবং তাজা রক্তের দৃৃশ্যটি ঘনীভূত করে তুলেছে টপটপ শব্দটি। শহীদ কাদরীর কবিতাই পরাবাস্তবতা থাকলে ষাটের দশকে আবদুল মান্নান সৈয়দ এ ধারার প্রধান রূপকার। সুররিয়ালিজম মূলত একটি শিল্প আন্দোলন তার পূূর্বসূত্র নিহিত আছে ডাডাবাদের মধ্যে। ডাডাবাদই প্রথম যুুক্তি ও র্তাকিক শৃঙ্খলাকে অসস্বীকার করে চেতন নয় অবচেতনকেই তারা ধারণ করলো কবিতার বাইরে ও ভিতরে। রুমানীয় কবি সিস্তান জারা, জার্র্মান লেখক হোগো বল, কবি হেনস বার্গের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। মূলত ডাডাবাদের আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়লে পরাবাস্তবতার যাত্রা শুরু হয়। এমনকি শিল্পের প্রতিটি শাখা তার প্রভাবলয়ে আত্মসর্মপন করে-

পায়ের নিচে দয়া বিচিয়ে একটিমাত্র চোখের একজন ভদ্রলোক খুলে দিচ্ছেন আমাকে: ঘৃণা যন্ত্রণা আক্রোস ছোট ছোট নুড়ির মতো আমার কালোÑহয়েÑআসা মুখের মণ্ডলে এসে পড়েছে, আমি ভূতের মতো উল্টোÑপায়ে পুরোনো এই বাড়িতে উঠছি, নামছি, চাবিহীন হাসছি- কতদিন আমি কাঁদিনি মনে হলো : আমার একটি মাত্র কান্নার ফোঁটার উপর বিরাট একটি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, নোঙর নেমে গেছে মাটি ভেদ করে পাতালের দিকে, মাল্লারা দড়িদড়া ছুড়ে দিচ্ছে চারদিক থেকে, যেÑমমতার দড়ি আমাকে ফেলেছে বেঁধে ; আমার প্রণয়নীরা পরপাওে ইজিচেয়ারে বসে আলো ফেলছে মুখ দিয়ে, একটিমাত্র হাত ভীষণ-সুুন্দর তালি দিচ্ছে, আমাকে ঘিরে ঘিরে নাচছেন সাতÑআটকোনা চারকোনা পাঁচকোনা আয়না।
(পাগল এই রাত্রিরা- আবদুল মান্নান সৈয়দ)

Art for arts sake অর্থাৎ শিরেল্পর জন্য শিল্প এই অজুহাতের কৌশলে সমাজা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিযেছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ এর ফলে তার কবিতার প্রধান প্রযুক্তি হয়ে দাঁড়ায় কল্পনা মূূলত তিনি কল্পনাকে সঙ্গী করে বর্হিজগৎ অর্থাৎ বাস্ততবতা বা চেতনকে অস্বীকার করেন

জ্যোৎস্না কী?-না, জ্যোৎস্না হয় জল্লাদের ডিমের মতো চুুলহীন জলবায়ুহীন মুণ্ডু, জোড়া জোড়া চোখ, সাতটি আঙুলের একমুষ্টি হাত, রক্তকরবীর অন্ধকার, এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ¦লজ¦লে চীৎকার॥
(জ্যোৎস্না- আবদুল মান্নান সৈয়দ)


পরাবাস্তববাদি কবিরা নিয়মÑশৃৃঙ্খলার সকল সীমানা অস্বীকার করে। তাদের স্লোগান হয়ে দাঁড়ায়- ‘যা কিছু স্থির ও সুস্থিত তাকে ভাঙো, তাকে গুড়িয়ে দাও, পুুড়িয়ে মার প্রাচীনকে।’ তারা বোধগম্যতার ধার না ধেরে উদ্ভট কল্পনা, অর্থহীনতার কুয়াশা নিয়ে হাজির হয়। পরাবাস্তববাদি কবিরা মনে করেন চেতন অংশের তুলনায় অবচেতনের পরিধি বেশি। মানুষ স্বপ্ন দেখে আর স্বপ্ন নিয়ম-শৃঙ্খলা, যুক্তি-তর্কের ধার ধারে না। যে কারণে জ্যোৎস্না হয়ে পড়েছে পরাবস্তবতা সৃষ্টিকারী অনুষঙ্গ। জ্যোৎস্না- ‘চুলহীন’ এবং ‘জলবায়ু মুণ্ডুহীন’ আবার ‘জল্লাদের ডিম’ এটি লজিকহীন বর্র্ণনা তার কারণ স্পষ্ট হয় অন্য একটি চিত্রকল্পে- ‘একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ¦লজ¦লে চীৎকার’ অর্থাৎ কবির প্রাপ্তিত জ্যোৎস্না প্রয়াসী চৈতন্তের অন্তসারশূূন্যতা। তার কাছে সমাজ, মানবিকতা ও দায়বদ্ধতার সকল প্রাপ্তি যেন ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ¦লজ¦লে চীৎকার। আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় এন্টি মাইমেসিস অর্র্থাৎ অন্তর্বাস্তবতা প্রকট হয়ে উঠায় অনেক কবি ও সাহিত্য বিজ্ঞানী লোক বলেন এই কবিতা আমাদের নয়।

আমি তোমার ডাকনাম নাম রাখলাম বাতাসে, আর অম্নি দুষ্টু বাতাস একটা বল হয়ে ঠোঁট কুঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়ল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু গাছের মাথায়।
(একেকটি দিন একেকটি সবুজভুক সিংহ- আবদুল মান্নান সৈয়দ)

অথবা

দুপাশে তোমরা কাতার বানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো, চোখের মণিকে জিভ ফলিয়ে চাখো মজা, বাজাও আমিষাশী করতালি, আমার দিকে তাকিয়ে যেÑআমি একটা মাছির মতো অসহায়, যে আমাকে তিনটি সস্তনের একজন মেয়েমানুষ তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র্র অবধি, যেখানে একটি মাত্র গাছে সমস্ত ফল ঝোলে আত্মহত্যা ভেবে। জনৈক বৃদ্ধ বৃৃক্ষ শাদা এবড়োখেবড়ো ডালপালার দাঁত বের করে খুুব পরিস্কার হাসছে, দ্যাখো।
(গাধা ও আমি- আবদুল মান্নান সৈয়দ)

আলোচনার প্রথমে বলেছিলাম কবির কল্পনা অধিকাংশে অবিশ্বাস্য সত্য হয়ে ধরা দেয় তা কখনও বা বুনে দেয় রহস্য জাল। কিন্তু কবির এই অসত্য প্রকট সত্য রূপে প্রকাশ পায় বাস্তবিকতার প্রতিবিম্ব হয়ে যেমন-
‘জনৈক বৃদ্ধ বৃৃক্ষ শাদা এবড়োখেবড়ো ডালপালার দাঁত বের করে খুুব পরিস্কার হাসছে’ এই লাইনে একটি পাতা ঝরা গাছের চিত্র ঘনীভূত হয়। দাঁতের সাথে ডালপালার উপমা ও হাসার বিষয়টি চিত্রকল্পটিকে আরো দৃশ্যগ্রাহ্য করে তুলেছে। কিংবা ‘আমি তোমার ডাকনাম নাম রাখলাম বাতাসে, আর অম্নি দুষ্টু বাতাস একটা বল হয়ে ঠোঁট কুঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়ল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু গাছের মাথায়।’ এই যে নান্দনিক চিন্তার পুষ্পিত উপস্থাপন এর পরেও আমরা কেমন করে বলতে পারি এই কবিতা আমাদের নয়। মানুষের অনেকগুলো জীবন হয়, অনেক গুলো মৃৃত্যু হয়। আমরা ভাবি মানুষ একবার জন্মে ও একবার মরে। মূলত দৃশ্য মৃত্যু ও দৃশ্য জন্ম থেকেই এই ধারণার সূূত্রপাত। অথচ গোপনে গোপনে মানুষ মরে যায় বহুবার তা অন্যেরা টের পায় না ব্যক্তি নিজেও না। এটি প্রগাঢ় ভাবে টের পান কবি ও চিত্রশিল্পী। তাই আবদুুল মান্নান সৈয়দ মাটির গভীরে ছিপ ফেলে আত্মার সন্ধান করতেন-
খটখটে মাটির ভিতর উনিশ বছর আমি ছিপ ফেলে বসে আছি আত্মার সন্ধানে।
(পাগল এই রাত্রিরা- আবদুল মান্নান সৈয়দ)

মূলত আবদুল মান্নান সৈয়দ আমাদের স্বাভাবিক চিন্তা পদ্ধতিকে ভেঙে করে দিয়েছিলেন অতিকাল্পনিক। পাকিস্থান পিরিয়ডের রাজনৈতীক বিশৃৃঙ্খলা তার চিন্তাকে আরো করে দিয়েছিল অতি প্রাকৃত।

Share:
1.5 2 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop