কথা বলা বানর – টুটুল রহমান

By Published On: November 14, 2023

মাটিডালি মহাসড়কে উঠে তার মনে হলো সে ভীমের জাঙ্গালের পাশ দিয়ে, অনন্তকাল ধরে সাইকেল চালিয়ে ছুটে চলেছে। কাঁধের ওপর চেপে বসা তার ‘খেল দেখানো’ বানরটির বয়স কমছে কম কয়েক হাজার বছর। তার বাবা সিফাতউল্ল্যা, বাবা কেন দাদা রহমতুল্লা না ঠিক তাও না, তার প্রথম পূর্বপুরুষ যে কিনা দ্বিতীয় পরশুরামের সময়ে মহাস্থান গড়ের পশ্চিম দিয়ে খিয়ার অঞ্চলের ভাসু বিহারে অথবা নরপতিধামের বাসিন্দা ছিল। সেই আদিকাল থেকে তারা বাননের খেল দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে। তার কাঁধে চেপে থাকা, মাথার চুল খামছে ধরে থাকা বানরটি ঠোট এখন করতোয়ায়া কিংবা শীর্ণ নাগরনদীর কালো জলের ধারার মতো স্তদ্ধ-নিস্তরঙ্গ হয়ে আছে। পৌষের কুয়াশাকাতর বেদনার দীর্ঘ নীল রাত্রীর মতো তার চোখের রং, ইতিহাসের ধুসর পাঠ্যপুস্তকের পৃষ্টার মতো তার শরীরে রং। তার ল্যাজটি প্রাচীনকালের যুদ্ধাহত প্রাচীনকালের সৈনিকের ধনুকের ছিলার মতো বেঁকে আছে। পুন্ড্রনগরীর মতো পুরনো এই বানরটির ভেতর আশি^নের খোলা মাঠে পড়ে থাকা ফসলের অংশ বিশেষে জমে থাকা শিশিরের মতো অনেক কথা। সে বলতে পারে না। তাকিয়ে থাকে। মালিকের দিকে তাকিয়েই থাকে। যেন অনেক কথা বলতে চায়।

বগুড়া শহরের জলেশ^রী তলার পাকা অথচ প্রশস্ত সড়কে বানরের ‘খেল দেখানো’ আলি হোসেন শেষ আসর আসর বসিয়েছিল দুপুরে। তপ্ত রোদে, কিংবা অবসরহীন মানুষের অভাবে সেই আসর জমেনি। তবুও ডুগডুগি বাজিয়ে, বিশেষ ধরণের লাল পোশাক পরিহিত আলি হোসেন পাতলা লোহার শিকলটা খুলে দিয়ে প্রতিদিনকার মতো বলেছে, সোনাবান ‘সগলিক সালাম দে তো বেটি। এবার দেকাবো লতুন জামাই ক্যাং কইরা শ্বশুরবাড়িত যায়।’ অথবা বানরটা যখন তার নির্দেশ মতো একাত্তুরে মুক্তিবাহিনী কিভাবে বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করেছে, রাজাকাররা ধরা পড়ে কিভাবে কালধরে উঠবস করেছে দেখিয়ে দিচ্ছে তখন আলি হোসেনের বুকটা তৃপ্তিতে ভরে যায়। পৃথিবীতে একমাত্র এই বানরটি তার কথা শোনে। আর কেউ না।

আসর শেষে মাটিতে পড়ে থাকা টাকা পয়সা গুছিয়ে, বানরের গলায় শিকল পড়িয়ে, সাথে থাকা তৈজষপত্রের ঝোলাটার মুখ আটকিয়ে আলি হোসেন সাইকেল চালিয়ে মাটিডালি মোড়ে এসে উপস্থিত হয়। যাবে গোকুল বাজারে। বেহুলা লখিন্দরের বাসর ঘরের পাশে দুর থেকে আসা দর্শনার্থীদের জন্য একটা আসর বসাবে। তারা পর্যটক। টাকা দেয় বেশি। গোকুল পৌছাতে প্রায় বিকেল হয়ে যাবে। এর মধ্যে কিছু আর খাওয়া হবে না। সোনাবান ইতোমধ্যেই চি চি করছে, আলি হোসেনের শরীরের এখানে ওখানে দাঁত বসিয়ে জানান দিচ্ছে তার পেটে দানাপানি দিতে হবে।

শীর্ণ অথচ ভারী একটা পা হঠাৎ আসমানের দিকে তাক করে আবার মাটিতে শৃংখল ভাবে রাখে আলি হোসেন। সাইকেল স্ট্যান্ড করে। ততক্ষণে সোনাবানও চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসার জন্য ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। ওখানে বসে থাকা ছেলে-বুড়ো সকলেই বানরের বাদরামির সাথে যোগ দেয়। কেউ কেউ বলে, ক্যা বারে চাচা খেলাদেখাবিন? পোশাদিমুহিনী। দেকান।’

আলি হোসেন তাদের কথায় কর্ণপাত করেনা। সে সোনাবানকে জিজ্ঞেস করে ‘এখন কি খাবু ক?’
মাথায় হাতবুলায়, শরীরের হাত বুলায় ল্যাজের ধুলো ঝেড়ে দেয়। বানরের মালিকের এই অপত্যস্নেহ বিতরণের সাক্ষী হয়ে অবাক বিস্ময়ে মাটিডালি মোড়ের উৎসুক মানুষ তাকিয়ে থাকে।
‘চাচা আপনের বানর কতা কয় নাকি?’ কতা উই বোজে?
আলি হোসেন মুচকি হেসে বলে ‘হ কবার পারে। ২০ বছর ধরে শিকাচি। শুইনবেন? ট্যাকা লাগবি।’
চায়ের দোকানে অলস বসে থাকা, লুঙ্গির ওপর দিকে পাছা চুলকানো টাউটের মতো দেখতে এক লোক বলে উঠে, মিছা কথা কইচ্চেন ক্যা বারে। বান্দর কন্দিন কতা কয়? বাওয়ালি মারিচ্চেন চাচা।’
আরেকজন তাকে বাধা দিয়ে বলে, এ জগতত কত কিছুই না ঘটিছে রে হেলাল। ক্যা শুনিস নি, কুয়ার পানি দিয়া মরা সৈন্যনক জেতা কইরছে। মাছের পিটত চইরা শাসুলতান আইচ্চে মস্তানগড়ত। ক্যা তুই এইল্যা মানিস না? বেহুলা ভেলাত ভাইসতে ভাইসতে পাতালপুরী যায়া, লকিন্দরের হাড় দিয়া তাক জীবন দিছে হে? বুজচো? কত কেচ্চারে শালা। ভীম তার ভাইগ্নার চড় মাইরছিল, সেটি চাপড়া বিল হছে। সত্য যুগে কত কিছু হছে। টিয়া কথা কবার পারলে বান্দরও পারবি। ভেজাল করিস না। দেখি বান্দরের মুখের কথা শুইনবার পারি কি না।’
এই সমস্ত অমীমাংসিত আলাপচারিতা, কৌতুহল, উদ্দিপনা আড়াল করে আলি হোসেন তার সোনাবানের সাথে কথা বলে।
‘বুসছি, তুই এ্যাকন কলা খাবু, রুটি খাবু। পোসাপাতি যা কামানো সব তো তুই খ্যায়া শ্যাষ কর‌্যা দিলো।’

সোনাবান দাঁত খিচিয়ে ভ্যাংটি কাটে। চোখের তারায় আনন্দ নাচিয়ে ল্যাজ ঝাপটিয়ে, চার-হাত পায়ে লম্ফ-ঝম্প করে মালিকের সাথে কথা বিনিময় করে। নির্বাক সেই কথার স্রোতে কেবল ভেসে যায় আলি হোসেন ম্রবণ ইন্দ্রিয়ে। বানরের কালো শুস্ক আঙ্গুল, ধারালো ধুসর রঙের নখ, রোম, নীল চোখ আর মানুষ হতে গিয়ে থমকে যাওয়া অবয়ব বিকেলের ম্লান রোদকে আরো বিষন্ন করে তোলে। সোনাবান রুটি খায়, কলা খায়, চায়ের কাপে মুখ দিয়ে ছ্যাকা খেয়ে চিচি করে এ প্রান্ত ও প্রান্ত লাফায়। মুহুর্তেই মাটিডালি মোড় হুলুস্থল এক জনাকীর্ণ চিত্রকল্পে রূপ নেয়। আলি হোসেন ভাবে, মানুষের এতো বান্দর খেলা দেখার আগ্রহ কেন? বানর কি তবে মানুষের পূর্ব পুরুষের ইতিহাস বহন করে চলেছে তার থমকে যাওয়া অবয়বে? উত্তর পায় না আলি হোসেন। গোকুলের দিকে যাত্রা করে। মহাসড়ক ধরে। তার এই অনন্ত যাত্রার একমাত্রা সঙ্গী বানর।

গোকুলে যখন তারা পৌছালো তখন এক চক্ষু পদ্মাদেবীর ক্রোধান্বিত মুখের মতো বেহুলার বাসর ঘরের টিলাটি দাঁড়িয়ে আছে আবছা আলো অন্ধকারে। এখন আর খেলা জমবে না। গোকুলে এলেই কানের ভেতর সাপের হিসহিস ধ্বনি শুনতে পায় আলি হোসেন। অসংখ্য, কালো অথবা শতরঙ্গা সুতানলি সাপ মা-মনসার মন্ত্রপাঠের সাথে-সাথে যেন ছুটে আসছে যেন তার দিকে। ডুবুডুব সূর্য। তাদের যেতে হবে শিবগঞ্জের পশি^মে, বিহারে। অনেকটা সময় লাগবে। আজ আর খেলা নয়। আলি হোসেন জোরসে প্যাডেল মারে সাইকেলে। সোনাবান তার কাঁধে চেপে বসে ঝাপটে ধরে থাকে আলি হোসেনের মাথা। আলি হেসেনের সাইকেল, আলি হোসেন নিজে এবং সোনাবান অতিপ্রাকৃতিক এক হাওয়ার ভেতর ভাসতে ভাসতে একবার উপড়ে উঠে এক বার মাটি স্পর্শ করে। আকাশ-মাটি একাকার করা এ যাত্রা যখন থামে তখন সন্ধ্যা।

ধেয়ে আসা গাঢ় নীল অন্ধকারে মহাস্থান গড়ের পরশুরাম নির্মিত মাটির নিচে ডুবে যাওয়া দুর্গপ্রাচীর গভীর বিষন্নতায় আরো তলিয়ে যেতে থাকে। আদিকালের নিস্প্রভ ইতিহাস জেগে উঠে যেন। শিলাদেবির ঘাটের পাথরগুলো থেকে চুইয়ে চুইয়ে অন্ধকার পড়ে শীর্ণকালো করতোয়াকে ভরে দিচ্ছে। চকচকে অন্ধকারের সরু এক রেখা হয়ে করতোয়া দিগন্তে চুটে যেতে যেতে শেষ মাথায় আকাশের দিকে উঠে গেছে। কিন্তু কি আচানক ব্যাপার। মহাস্থানে রাত নামতেই আকাশে পূর্ণ চাঁদ। ভরাপূর্নিমার জোৎস্না যেন ক্রমশ দুধসাদা হয়ে উঠছে। শিলাদেবির ঘাটের পাথরগুলোর বুকে স্নানপূর্ব নারীদের একে দেয়া সিঁদুর চিহ্ন ও চন্দনের তিলক স্পস্ট দেখা যাচ্ছে। মুহুর্তেই ঝলমল করে যেন জেগে উঠলো মৃত নগরী। গা- ছমছম করা নিশুতি রাত নামবার আগেই থাকে ফিরতে হবে। জাদুঘরে দরোজা পেরিয়ে পরশুরামের রাজপ্রসাদের খিলান, শাহ সুলতান বলখীর নির্মিত গম্বুজ, ইতিহাসের টুকরো-টাকরা নির্দশন আর ডুবো যাওয়া গড়ের প্রাচির পেরিয়ে আলি হোসেন ছুটে চলে দ্রুত। গড় পেরিয়ে সে চলে আসে ফসলের প্রান্তরে। যেখানে অনেক দুরে দিগন্ত।

বিরাট-বিস্তৃর্ণ খোলা প্রান্তর ভাগ করা হাতির শুড়ের মতো একটা কালো পিটঢালা পথ ছুটে গেছে ভাসু বিহারের দিকে। সেই পথে ঢুকতেই, জোৎস্না ভেতর ভাসতে থাকা আলোকিত পৃথিবীর পথ, ছোপছোপ বাড়িঘর, দূরের ক্ষীন হয়ে আসা আলোগুলোকে মনে হচ্ছে দুরাগত কোনো ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জাহাজের স্থির ছায়া। মায়াবি এই নি:সঙ্গ-নিস্তদ্ধ পথের ছুটে চলা দুটি প্রাণী আলি হোসেন ও সোনাবান আজ হয় ভিন্ন কোনো সময়ের মধ্যে জেগে উঠেছে। সত্যিই তো ওপাশে দুর্গের দেয়ালে কাছেই মনে হলো রাজার সিপাহী আর তার ঘোড়ার খুরের প্রতিধ্বনি। যুদ্ধের দামামা বাজছে যেন কানের ভেতর। শতশত ভিক্ষুর পায়ের প্রতিধ্বনি আলি হোসেনের কানের মধ্যে তরঙ্গের মতো নেচে যাচ্ছে। এই আগ্রাসী জোৎস্না রাতে, নিশি নামতে থাকা সময়ে, জনশুন্য সড়কে খুব ভয় লাগছে আলি হোসেনের। সে ভয় কাটাতে বানরের সাথে কথা জুড়ে দেয়, বুজলো আইজবানি বাড়িত ফিরতে ফিরতে ভোর হয়্যা যাবি। প্যাডেল মারার বল পাইচ্চিনা। কি আন্দিমু আইজ। তাই ভাবিচ্চি। দোকানতথিনি চাউল, ডাল, কাঁচা পইত্তা লিয়্যা খিচড়া আন্দিমু। কি কইস। তাই খায়্যা নিন আসমু।’

নিস্তদ্ধ শুন্য প্র্ন্তার ভাগ করা পথে কথাগুলো বিরাট গতিতে ছুটে চলে। আচানক এই ভয়ার্ত ভূগোলে কথা জবাব দেয় সোনাবান, ‘হয়, চইলবিনি। খিচরা খায়্যা নিন আসমো।’
আলি হোসেনের সাইকেল দুম করে থেমে যায়। কে কথা বলে উঠলো, ভূত না প্রেত সেই আশংকায় তার শরীর কাঁপতে থাকে। সোনাবান কথা বলতেই পারে না। গত ১২ বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। আজ মনে হয় খ খ করা জোৎস্নার ভেতর জি¦ন পরী নেমে এসে আলি হোসেনের সাথে কথা শুরু করে দিয়েছে।
তবুও আলি হোসেন দাঁড়িয়ে সোনাবানের দিকে তাকায়? কি রে তুই কথা কলু নাকি? সোনাবান নিশ্চুপ। সে দাঁতে আলি হোসেনের পিরান কাটতে থাকে। আলি হোসেন কয়েকবার সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আবার যাত্রা শুরু করে।

আবার গল্প।
‘হয় রে সোনাবান। তোগেরথিনি নাকি হামাগেরে জন্ম। বিজ্ঞানিরা কয়। কিন্তুক হামরা ইসব বিশ্বাস করিনা। হাগাগেরে প্রথম লবী আদম। আমরা আদম হাওয়ার সইল-পইল।’ সোনাবান আর কথা বলে না। সে খকখক করে কাশি দেয়। আজ এই জোৎস্নার ভেতর অলৌকিক রাত্রীতে সোনাবান অবিকল মানুষের মতো কথা বলছে, কাঁশছে, এটা কি মনের ভুল না অন্য কিছু আলি হোসেন ভাবনায় পড়ে যায়।

সোনাবানের কথা শোনার জন্য সে আবার চালাকি করে বলে, আচ্ছা সোনাবান কত তো হামরা গরীব কিসক?
এবার কথা বলে সোনাবান। বলে, আপনে গরগ কলা দেইখ্যা ভোট লিয়া চেয়ারম্যান সব একলাই খায়। তা গরীব হবিন না কিসক?
কি আশ্চর্য সত্যিই তো মেয়েলি গলায়, মধুর ধ্বনিতে কথা বলছে সোনবান। মনে হচ্ছে পূর্নযৌবনা কোনো ললনা আলি হোসেনের কাঁধ থেকে নেমে সাইকেলে পেছনের ক্যারিয়ারে শক্তপোক্তভাবে বসে আসে সোনাবান। নব বিবাহিত স্ত্রীর মতো তারা শশুরবাড়িতে যাত্রা শুরু করেছে। এবার কাঁধ বাঁকিয়ে পেছনে তাকায় আলি হোসেন। আজ এই রাতে, ভয়, স্বপ্নের মতো পরিবেশ, নির্জনপথে সত্যমিথ্যা যাচাই করার মতো মনোবল আর আলি হোসেনের নেই। সে কাকে বলবে কাকে এই রাতে জানাবে, এই অত্যাশ্চর্য অলৌকিক ঘটনা। তার সোনাবান অবিকল মানুষের মতো কথা বলছে? কে বিশ্বাস করবে? সে ভয়ে এটা সত্য ধরে নিয়ে কথা চালিয়ে যায়?
‘ হ। তুক কছে। চেয়ারম্যান হামাগেরে দু:খের কারণ। আরে ওয়াজত শুনিসনি আল্লাহ যাগরক বেশি ভালোবাসে তাগরক ধন সম্পদ দেয় না। গরীর কইর‌্যা রাখে। হামরা তো বিনা হিসেবে বেহস্তত যামু। বুজলু বান্দর কুন্টিকার?’

এই মানুষ আর লক্ষ বছর আগের অর্ধমানবের আলাপন বিরাটপ্রান্তরের বাতাসে ভাসতে ভাসতে এক সময় পথ ফুরিয়ে আসে। ভাসু বিহারে লাল মাটির দেয়ালের ছোট্ট ঘরে এক সময় তারা প্রবেশ করে। যে ঘরে মায়াবি জোৎস্নার আলো ঢোকে না। গাঢ় অন্ধকার শরীর বিছিয়ে আছে। হারিকেন জ¦ালে আলি হোসেন। দোকান থেকে আনা চাল, ডাল, মরিচ রাখে মেঝেতে। সোনাবান তখনো শিকলে বাঁধা। সে ঘরে একোন ওকোন করতে থাকে। গড় থেকে বিহারের আলি হোসেনে ছোট্ট কুটির পর্যন্ত দুজনের আলাপনের অলৌকিক দৃশ্যাবলী তখন আলি হোসেনের মাথা থেকে অনেকটাই মুছে গেছে। স্বপ্নের ঘোর কেটে সে এখন স্বাভাবিক আর সাধারণ দুনিয়ায় প্রবেশ করে।
‘হয় বান্দর কুন্দিন কথা হয়। হামাক আবুল পাছু তো? নিজের সাথে কথা বলে আলি হোসেন।
সোনাবান বলে উঠে, হামার কথা আপনে বিশ্বাস করিচ্ছেন না? হামি কতা কচ্চি তো। কাইল চেয়ারম্যানের কাছত হামাক লিয়্যা চলেন তাক হামি দেইকপ্যান সালাম দিমু।’
চিন্তায় পড়ে যায় আলি হোসেন। এই বান্দর বলে কি? সত্যিই তো কথা বলছে। ব্যাপারটা তো সুরাহা করা দরকার। ‘বান্দর কথা কইচ্ছে। এডা তো চেয়ারম্যানক বলাই লাগবি। সারাদেশের লোক আইসপি। পেপারত ছবি তুইবি। মেলা টেকা পয়সা পাওয়া যবি। এবার হামি ঠিকই বড়লোক হমু।’
রাতে একটু কম ঘুম হয় আলি হোসেনের। ভোরে আলো ফুটতেই সে চেয়ারম্যানের বাড়ি গিয়ে হাজির। আশ্চর্য হয় চেয়ারম্যান।
এতো সকালত তুই ? ঘটনা কি রে আলি হোসেন?

-আর কবিন না চেয়ারম্যান চাচা। হামার যে বান্দরডাক দিয়া খেলা দেকাই সিডা কথা কইচ্ছে। আপনেক ছালাম দিছে।’
সাজ সকালে এটাকে রঙ তামাসা ধরে নিতে পারতেন আনোয়ার চেয়ারম্যান। কিন্তু আলি হোসেন তো তার সাথে ইয়ার্কি করবে না। এতো দিনের পুরনো চেয়ারম্যান সে। এই এলাকার লোক কি এক মোহে তার কথায় উঠে-বসে। সে যা বলে তাই শোনে। যদি বরাদ্দে চাউল-গম না দিয়ে নিজে গায়েব করে দিয়ে বলে, এবার কোনো চাউল-গম আসে নাই রে। রাস্তার তৈরির টাকা নিজের পকেটে তুলে কোনো রকম রাস্তা তৈরি করে সে যদি বলে, আরেকবার উটি ইলেকশনত তাইলে পাকা করমু। ভাবিস না তো।’ আনোয়ার চেয়ারম্যানের এসব কথা, ইলেকশনের আগে দেয়া নানা প্রতিশ্রুতি সব এরা বিশ্বাস করে, অন্ধের মতো সিল মারে আনরস মার্কায়। তার সাথে তো আলি হোসেন ইয়ার্কি করবে না।
‘কইস কি আলি হোসেন? তোর বান্দর কথা কইচ্ছে?
‘হয় চাচা। হামি কিসক মিথ্যা কমু। কইচ্ছে কি চেয়ারম্যানের কাছে হামাক লিয়া চলেন হামি তাক সালাম দিমু।

একটা ঘোর, একটা আশ্চর্যজনক প্রশ্ন মাথার মধ্যে নিয়ে চেয়ারম্যান খালি পায়েই ছুটে যায় আনোয়ারের ঘরে এবং সত্যিই সেই ঘটনাই ঘটলো। সোনাবান খাটি আরবী ভাষায় আনোয়ার চেয়াম্যানকে সালাম ঠুকে দিয়ে ঘরময় দাপিদাপি করতে লাগলো।
৭০ বছরের জীবনে এই আশ্চর্যতম ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করার পর আনোয়ার চেয়াম্যানম্যান অনেকটা চিন্তুশুন্য হয়ে শুন্য মাথা নিয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে দিলো। তারপর এই ঘটনাটি তার ইউনিয়নের মানুষদের প্রত্যক্ষ করানোর জন্য কথা বলা বানর দেখাতে একটি মজলিসের আয়োজন করলো। সেদিন রাত্রে রঙ্গীন সামিয়ানার নিচে হেজ্যাক বাতির আলোয় আলোকিত হয়ে যায় স্টেজ। প্রধান অথিতির আসনে বসে তাকে আনোয়ার চেয়ারম্যন। পাশে মাইক্রোফেন ধরে দাঁড়ায় আলি হোসেন। কিন্তু কয়েক ঘন্টা কেটে যায়। সোনাবান কোনো কথা বলে না। আলি হোসেন বিরক্ত হয়ে মাইক্রোফোন সরিয়ে সোনাবানকে ধমকাতে থাকে। ‘খারাপ কুন্টিকার? একন কথা না কবার পালে চেয়ারমাান চাচার মান সম্মান থাকপি?
সোনাবান দাঁত খিচিয়ে কিচিরবিচির করে। মানুষ ভাবে এই বুঝি ভরা মজলিসে সোনাবান কথা বলে উঠবে।
কিন্তু না। ভোটের আগে চেয়ারম্যানের দেয়া নানা প্রতিশ্রুতির মতো বানরের কথা শোনাবার এই আয়োজনটিও মিথ্যা অনুষ্ঠানে পরিনত হয়। রাত ভরে মানুষের এই অপেক্ষা, প্রতীক্ষার জ¦ালাযন্ত্রনা ভুলতে ইতোমধ্যে অনেকেই চেয়ারম্যানের গুিিষ্ট উদ্ধার করতে শুরু করেছে।
বানর কুন্দিন কতা কবার পারে? শালা খালি মিথ্যা কতা হয়। আইজ ধর শালাক।’

‘ধর’ শব্দটি বন্দুরের গুলির শব্দের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তারপর হুলুস্তুল। চেয়ারম্যান করেকবার থামাবার জন্য হাত ঝাকায়। কে শোনে কার কথা। কয়েকজন তেড়ে আসতে থাকে মঞ্চের দিকে। চেয়ারম্যানকে কি ঘুষি মারে। কেউ পাঞ্জাবি ছিঁড়েফেলে। কেউ পাজামা খুলে নেয়। লেংটু চেয়ারম্যান বেকুপের মতো মঞ্চে স্থির দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে। সে দেখতে পায় মগডাল থেকে আরো- আরো অসংখ্য বানর শ্লোগান দিতে দিতে নেমে আসছে। এই শেষ রাত্রে, চাঁদ ডোবা অদভুত আঁধারে নির্বাক সোনাবানকে কাঁধে নিয়ে আলি হোসেন ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে।

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop