ধ্রুপদী সুফি সাহিত্যের সমকালীন বিনির্মাণ “পাখিদের বিধানসভা”

By Published On: May 25, 2025Views: 14
Image

ধ্রুপদী সুফি সাহিত্যের সমকালীন বিনির্মাণ “পাখিদের বিধানসভা”
ইসমত শিল্পী

ফরিদ উদ্দীন আত্তার রচিত ধ্রুপদী সুফি কাব্য “মানতিকুত্ তোয়ায়ের” অবলম্বনে, ২২-২৩মে ৩টি সফল মঞ্চায়নের মাধ্যমে থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযোজনা, “পাখিদের বিধানসভা” নাটকটির সমাপ্তি হলো। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি রচনা করেছেন বিভাগীয় সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহমান মৈশান। পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় রয়েছেন অধ্যাপক ড. আহমেদুল কবির।

সুফি ঘরানার সেরা একটি পরিবেশনা এ মঞ্চনাটক। নাটকটি বাস্তবজীবন, পারলৌকিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে নতুন উপলব্ধির সৃষ্টি করে। সুফি সংগীত, সংস্কৃতির প্রতি বরাবরই আমার আগ্রহ কাজ করতো, এই নাটকটি দেখার পর, এর অভিজ্ঞতা অসাধারণ।

নাটকটির কোরিওগ্রাফি, অভিনয়, সংলাপ, লাইট, সেট, ডিজিটাল চিত্র, আবহ সঙ্গীত, প্রপস, কস্টিউম প্রতিটি শাখাই ছিল চমৎকার। পারফর্মাররা সবাই এত এনার্জেটিক ছিলো, অবিশ্বাস্য। নাটকের পুরোটা সময় জুড়ে নানারকমের পাখিদের অঙ্গভঙ্গি করা খুবই কঠিন বিষয় মনে হয়েছে আমার কাছে।

পাখির ডানার শক্তি, রাজনীতি, জ্ঞান, সুফীবাদ, দাসত্ব, প্রেম, প্রতারণা, আধ্যাত্মিকতা, মৃত্যু, এক সত্য থেকে আরও সত্যকে আবিস্কার প্রভৃতির মধ্য দিয়ে নিজেকে জানার অভিযাত্রা দেখানো হয়েছে এই নাটকে। যে অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে দর্শকদের মনে তৈরি হয় মুগ্ধতা। আসলে আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়েই নিজেকে জানা সম্ভব, এটাই এই নাটকের মূলমন্ত্র। অর্থাৎ নিজেকে জানা বা নিজেকে নিজেই দেখা।

পাখিদের বিধানসভা

প্রথম পর্বে দেখা যায় একটি ব্যর্থ হতে থাকা রাষ্ট্রে বিপ্লব আর প্রতিবিপ্লবের পর একদল যুবক-যুবতীর ভিতর-বাহিরে চলছে বহুমুখী ঘাত-প্রতিঘাত-অন্তর্ঘাত। এখানে নাগরিকগণের ভেতরের শূন্যতা কেবলই বড় হয়ে ওঠে। অবশেষে নাগরিকগণের অন্তর উপলব্ধি করে যে, শূন্যতা হলো গভীরে যাওয়ার আমন্ত্রণ। তারা নীরবতার মধ্যে শুনতে পায়-হৃদয় খোলো। কারণ গভীর রূপান্তরের আশায় যাত্রা করতে একটি খোলা হৃদয়ই যথেষ্ট। সেখানেই বাঙময় হয়ে আছে জীবনের সারমর্ম। জীবনের এক অপরিবর্তিত চিরন্তন স্তর। জীবনের সমুদয় উত্থান পতনেও সেই সুর বদলে যায় নি। এই হলো সোনার মানুষের এক চিরন্তন জীবন-রতন অধ্যায় যা খুলতে হয়। পড়তে হয়। খুঁজে নিতে হয় যৌথ জীবনের শান্তি, ভালোবাসা আর অসীম প্রজ্ঞা। পরবর্তী পর্বগুলোতে দেখা যায় পাখির রূপকে চিত্রিত মানুষের আত্মিক যাত্রা অর্থাৎ জীবনের পরম সত্য অর্থের খোঁজে এক অনিবার্য উড়ালযাত্রা। কাহিনিতে ফুটে উঠে পাখিরা একটি সম্মেলন ডেকে তাদের নেতা সিমুর বা পরম সত্যের প্রতীককে খুঁজে বের করার জন্য একসাথে হুদহুদ পাখির দিকনির্দেশে যাত্রা শুরু করে। পথের মধ্যে তারা বিভিন্ন বাধা, বিপদ এবং আত্মত্মবিশ্বাসের অভাবের মুখোমুখি হয়। তবে, তাদের মধ্যে কয়েকটি পাখি ধৈর্য্য, বিশ্বাস এবং আত্মবিশ্লেষণের শক্তিতে এই বিপৎসংকুল পথ চলতে থাকে। শেষপর্যন্ত, তারা যখন ত্যাগ, ভালোবাসা, জ্ঞান প্রভৃতি উপত্যকা পেরিয়ে বাদশাহ সিমুরের দরবারে পৌঁছায়, তখন তারা উপলব্ধি করতে পারে যে, তারা প্রত্যেকে নিজেরাই একেকটি সিমুর। অর্থাৎ আত্মজ্ঞান এবং পরম সত্যের খোঁজের জন্য বাহ্যিক অনুসন্ধান বস্তুত নিজের অন্তরের গভীরে ধাবিত হলেই গন্তব্য মেলে। এভাবেই পাখিদের যাত্রা সমাপ্ত হয়। সেই থেকে ৩০টি পাখি এই পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর আমাদের কাছে রেখে যায় পাখিদের বিধানসভার কাহিনি, মৃত্যুভয়হীন আত্মানুসন্ধানের এক রাজনৈতিক উড়ালের আধ্যাত্মিক গল্প। হুদহুদ পাখির ডানায় লেগে থাকে যে মেঘের দানা, তা হতে পারে সাকার মানুষের নিরাকার পাখি হবার কোনো কারণ।

“এভাবেই পাখিদের যাত্রা সমাপ্ত হয়। সেই থেকে ৩০টি পাখি এই পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর আমাদের কাছে রেখে যায় পাখিদের বিধানসভায় শাহাদাৎ বরণের উদ্দেশ্যে কথিত এক উড়ালের গল্প। হুদহুদ পাখির ডানায় লেগে থাকে যে মেঘের দানা তা হতে পারে সাকার মানুষের নিরাকার পাখি হবার কোনো কারণ।”

“সৌন্দর্যের আরাধনা আর রূপের সাধনা এক জিনিস নয়”
“যে ভালোবাসতে জানে সে সত্যকে আলিঙ্গন করে”

এরকমই সব ডায়লগ, পুরো দ’ঘন্টা এক রূপক জগতে নিয়ে যায়। পাখিদের এগিয়ে চলার ধৈর্য্য আমরা বাস্তব জীবনে যেকোনো বিপদ মোকাবেলায় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে লাগাতে পারি। ধ্রুপদী সুফি সাহিত্যের সমকালীন বিনির্মাণ রূপে রচিত হয়েছে নাটক পাখিদের বিধানসভা। এই নাটকের আখ্যান গড়ে উঠেছে – নাগরিকদের নৈরাজ্য ও পাখিদের উড়ালের বিভিন্ন সময়ের দৃশ্য; সিমুর্গের দরবারে পৌছানোর প্রেক্ষাপট। মোটকথা সুফি সাহিত্যের এক আধ্যাত্মিক গল্প “পাখিদের বিধানসভা”।

সংলাপ, নির্দেশনা, অভিনয় দুর্দান্ত ছিল। নাটক সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন, শুভকামনা। জয় হোক নাটকের, জয় হোক থিয়েটারের।

ইসমত শিল্পী 
কবি, সম্পাদক নান্দিক
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments