ব্যস্ততা

By Published On: March 27, 2025Views: 8

ব্যস্ততা
বিশ্বজিৎ দাস

এক
কপালের ঘাম মুছলেন সাবির আলী।
ঘরে এসি চলছে। তবু গরম লাগছে। গলার কাছে টাইটা ঢিলে করে দিলেন।
আরামদায়ক সোফায় বসে আছেন। দু’চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
সামনের টেবিলের উপর পা রেখে সটান সোফায় ঘুমিয়ে পড়লে মন্দ হতো না।
পা রাখার অবস্থা অবশ্য এই মুহূর্তে নেই। কারণ সামনের টেবিলে নাস্তা রাখা। সাথে গ্লাসভর্তি পানি।
সেই নাস্তা ঘণ্টা দুয়েক আগে পরিবেশন করা। কাজের মহিলা সেই যে দিয়ে গেছে, তারপর আর উঁকি পর্যন্ত দেয়নি। বোধহয় কাজের মহিলাও আমাদের করুণ অবস্থা বুঝতে পারে—ভাবলেন সাবির আলী।
হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিলেন তিনি। এক চুমুকে খেয়ে ফেললেন সবটুকু পানি।
ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালেন।
রাত সাড়ে এগারো। সেই সন্ধ্যা সাতটায় এসেছেন তিনি। তখন থেকে বসে আছেন।
‘ম্যাডাম বাসায় নাই। বাইরে মিটিং আছে। মিটিং সাইরা ফিরবেন রাতে। আপনেরে অপেক্ষা করতে কয়া গেছেন।’
কাজের মহিলার চাঁছাছোলা কথা।
সাবির কথা বাড়াননি। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছেন। ঘনঘন মোবাইলে কল আসছিল। বিরক্ত হয়ে রিংটোন বন্ধ করে রেখেছেন। এর আগেও অপেক্ষা করেছেন। তবে সেটা এত দীর্ঘ নয়।
ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালেন আবার। পৌনে বারেটা। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পায়চারি করলেন কিছুক্ষণ। গলা খাঁকারি দিলেন। জোরে জোরে। তাতে মনে হয় কাজ হলো। একটুপরই ভেতরে ঢুকল কাজের বুয়া।
‘আপনে অহনো যান নাইক্যা?’
‘ম্যাডামের সাথে দেখা করতে এসেছি। কয়েকটা ফাইল আছে। উনার সই লাগবে। উনি কি এখনো আসেননি?’
‘ম্যাডাম তো অনেকক্ষণ হইল আইছে। আপনে ফোন কইর‌্যা দ্যাহেন।’
‘ফোন করেছি। বিজি দেখাচ্ছে।’
‘তাইলে আর কী। বাড়িত যান গ্যা।’ পান চিবুতে চিবুতে বলল মহিলা।
‘ম্যাডাম কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’
সাবির আলী ভেবে পেলেন না মন্ত্রী কখন বাসায় এলেন। বাসায় ফিরলেন অথচ কোনো সাড়া শব্দ নেই।
এ বাসায় দুটো ওয়েটিংরুম।
একটা নেতাকর্মীদের জন্য।
অন্যটা অফিসের লোকজনের জন্য।
‘আপা জাগনাই আছে। আমি আপনার কথা হেরে কইছি। হ্যার খুব মাথাব্যথা করতাছে। আপনারে কাইলক্যা আসতে কইছেন।’ চাপা হাসি হেসে বলল মহিলা।
রাগে, দুঃখে মাথা হেট হয়ে আসল সাবির আলীর। কে বলবে তিনি রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। কে বলবে তিনি একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সচিব।
‘আচ্ছা,আসি।’ ফাইলগুলো নিয়ে বের হয়ে আসলেন সাবির। ভাগ্যিস, সাথে পিয়ন আনিনি-ভাবলেন তিনি। রাতের ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা কম। মানুষজন কম।

পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন তিনি। কললিস্ট দেখলেন। চব্বিশটা কল এসেছে। নেট অন করতেই অসংখ্য নোটিফিকেশন এসে বিপবিপ করতে শুরু করল। আনমনে স্ক্রল করতে শুরু করলেন সাবির।

মন্ত্রীর আজকের অনুষ্ঠানের ছবিগুলো সামনে এসে পড়ল।
ম্যাডাম হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় ভাষণ দিচ্ছেন। পুরস্কার দিচ্ছেন। অনুষ্ঠান উপভোগ করতে করতে হাততালি দিচ্ছেন।
সাধারণ বেশভূষাতে তাকে অপূর্ব লাগছে।
নাহ্। খামোখাই মন্ত্রীকে ভুল ভাবছি—ভাবলেন সাবির আলী।
এমন অনুষ্ঠানের পর মাথাব্যথা করবেই এতো সাধারণ ব্যাপার। ঠিক করলেন, কাল খুব সকালেই মন্ত্রী ম্যাডামের বাসায় যাবেন।
ফাইলগুলো সই করাতে।

দুই
‘হঠাৎ করে তুমি মন্ত্রণালয় চেঞ্জ করতে চাইছ! ব্যাপারটা কী?’ একগাদা কাগজে সই করতে করতে জানতে চাইলেন এস. এম মনিরুল হক। মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
ব্যস্ত মানুষ তিনি।
অনেক কষ্টে আজ তাকে একা পেয়েছেন সাবির আলী। আজ শনিবার। অন্যান্য অফিস বন্ধ থাকলেও মনিরুল হক বিশেষ কারণে অফিস করছেন।
‘চুপ করে রইলে যে?’ মুখ্য সচিব জানতে চাইলেন।
‘স্যার।’ অস্ফুটে বললেন সাবির আলী। অনেক কষ্টে কান্না চাপলেন।
মুখ তুলে চাইলেন মনিরুল হক।
‘মাই গড! তুমি দেখছি আবেগী হয়ে পড়ছ। আবেগকে কন্ট্রোল করো মাই বয়। যাও ওয়াশরুম থেকে মুখ ধুয়ে আস।’
ওয়াশরুম থেকে আসার পর সাবির মুখোমুখি হলো বসের।
‘এবার বলো কী সমস্যা?’ কাগজপত্র সরিয়ে রাখলেন মনিরুল হক।
‘স্যার, আমাকে অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দিন, প্লিজ।’
‘তুমি তো ভালো মন্ত্রণালয়ে আছো। কত বড় মন্ত্রণালয়! কত মানুষ তোমার অধীনে! তুমি চেয়েছিলে দেশসেবা করতে। এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর কোথায় পাবে বলো? দেশপ্রেম কি কমে গেল তোমার?’
‘স্যার, দেশপ্রেম আমার একটু কমেনি। মানুষের সেবা করার ইচ্ছাও ভালোভাবেই আছে। শুধু আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দিন স্যার।’
সাবিরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মনির।
চোখ নামিয়ে নিল সাবির।

‘স্যার, মন্ত্রী মানুষের সামনে বিশেষত নেতাকর্মীদের সামনে কর্মকর্তা কর্মচারীদের অপদস্থ করতে পছন্দ করেন। জরুরি ফাইল নিয়ে গেলেও সই করেন না। সকালে গেলেও কাজের লোককে দিয়ে বলে পাঠান, রাতে আসতে। রাতে গেলে বলেন মাথা ধরেছে, পরে আসুন।’

‘কিন্তু তোমার মন্ত্রণালয়ে কাজ তো মনে হয় ভালোই হচ্ছে। প্রতিদিনই তো অনেক অনেক অর্ডার হচ্ছে।’
‘জ্বি স্যার। বদলির অর্ডার। বদলি, প্রমোশন ইত্যাদির অর্ডার হচ্ছে।’
‘মন্ত্রীর স্বাক্ষর বা তাঁর অজান্তেই বদলিগুলো হচ্ছে বলতে চাইছ?’
‘না স্যার। ম্যাডামের অনুমতিক্রমেই বদলি আর প্রমোশনগুলো হচ্ছে। কিন্তু আমি স্যার কিছুই জানি না এসবের বিষয়ে। আপনার মতো আমিও ঘটনাগুলো ফেসবুক দেখেই জানতে পারি।’
‘আর তুমি যেসব ফাইল নিয়ে উনার বাসায় গিয়েছিলে, সেই ফাইলগুলি কীসের ছিল?’
‘ওগুলো বদলি বা প্রমোশনের ফাইল ছিল না স্যার। ওগুলো অন্যান্য বিষয়ের ফাইল ছিল।
‘তুমি বলতে চাইছ, বদলির ফাইলগুলোতে অনৈতিক কিছু একটা ঘটছে।’
মাথা ঝাঁকালেন সাবির।
‘আমি সেই অভিযোগ করছি না স্যার। উনি রাজনীতি করেন। পছন্দের বদলি করতেই পারেন। কিন্তু গত মাসে ঢালাওভাবে অনেকগুলো বদলি হয়েছে স্যার। ফেসবুকের গ্রুপগুলোতে ব্যাপক লেখালেখি হচ্ছে যে, বদলি বাণিজ্য চলছে এবং এর সাথে আমি না কি জড়িত। অথচ এ বিষয়ে কোনো কিছুই জানি না স্যার।’ কান্নায় কণ্ঠস্বর বুঁজে এলো সাবিরের।
‘চোখ মোছো। দেখি আমি কী করতে পারি।’ গম্ভীর গলায় বললেন মনিরুল হক।
এক সপ্তাহ পরেই সাবির আলীকে আগের মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয় দেওয়া হলো।

তিন
সারাশরীর ব্যথায় টনটন করছে।
বেশ কয়েকবার বমি করে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তাঁর। রিমান্ডের নামে গত চারদিন ধরে তার উপর অত্যাচার চলেছে। চিৎকার করার সুযোগটুকুও দেয়নি ওরা। কখনো লাঠি দিয়ে পিঠিয়েছে। কখনো আঙ্গুলে প্লাস দিয়ে নখ উপড়ে ফেলেছে। কখনো কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে পিটিয়েছে। কখনো গায়ে গরম পানি ঢেলে দিয়েছে।
—কত টাকা পয়সা ইনকাম করেছিস বল।
—কোন দেশে টাকা পাচার করেছিস বল।
—তোর নাঙরা কে কোথায় লুকিয়ে আছে বল।
কান্না করার ফুরসতও পাননি তিনি। মাঝে মাঝে ওরা খেতে পর্যন্ত দিয়েছে। খাওয়ার পর পরই উঠিয়ে নিয়ে আবার জেরা করতে শুরু করেছে।
‘কী রে খুব তো মন্ত্রীগিরি দেখিয়েছিলি। এখন তোর মন্ত্রীগিরি পাছা দিয়ে ঢুকাব। এই গরম ডিম আন, তাড়াতাড়ি।’
অত্যাচারের এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি। অনেকক্ষণ পরে টের পেয়েছিলেন হাতে কে যেন ইঞ্জেকশন দিয়েছিল। আঁধবোজা চোখ দিয়ে নার্সকে দেখলেন তিনি। তারপরই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
কতদিন আর কোথায় ঘুমিয়েছিলেন মনে নেই তাঁর। জ্ঞান ফেরার পর আবার হাজতেই আবিষ্কার করলেন তিনি নিজেকে।
গরাদ খোলার শব্দ হলো।
‘আসেন আপা।’ মহিলা কনস্টেবল বলল।
‘কোথায়?’
‘আইজক্যা আপনার হাজিরা আছে। রিমান্ড শেষে আপনাকে আজ আদালতে পেশ করা হবে।’

অনেক কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাজত থেকে বের হলেন তিনি। পড়েই যাচ্ছিলেন। দু’জন মহিলা কনস্টেবল দু’দিক দিয়ে ধরে অনেক কষ্টে তাকে গাড়িতে তুলল। সারা শরীর ব্যথা করছে। ঠাণ্ডা লাগছে। বোধহয় জ্বর এসেছে।

আদালতের কয়েদখানায় ঢোকার মুখে বমি করে দিলেন তিনি।
কনস্টেবলরা তাঁকে হাজতে ভরে ছুটল পানি আনতে।
দেওয়ালে হেলান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকালেন তিনি। পরিচিত একটা অবয়ব দেখতে পেলেন। চেনা চেনা লাগছে। কে হতে পারে লোকটা।
বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি চিনতে পারলেন—সাবির আলী। একসময় তাঁর মন্ত্রণালয়ে সচিব ছিল।
বানভাসি মানুষ যেমন খড়কুটো দেখলে আঁকড়ে ধরতে চায়, তেমনি তিনিও যেন সাবির আলীকে দেখে প্রাণ ফিরে পেলেন।
‘সাবির সাহেব।’ প্রাণপণে চেঁচানোর চেষ্টা করলেন। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না।
গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে হাতছানি দিয়ে সাবিরকে ডাকার চেষ্টা করলেন তিনি।
‘কী হয়েছে ম্যাডাম? নিন পানি নিন। বমি করেছেন, একটু পানি খান।’ মহিলা কনস্টেবল পানি হাতে ফিরে এসেছে। গ্লাসের পানিকে অগ্রাহ্য করলেন তিনি। হাত লম্বা করে সাবিরকে দেখিয়ে তাঁকে ডেকে দেওয়ার জন্য ইশারা করলেন।
কনস্টেবলটি মনে হয় বুঝতে পারল। ছুটে গেল সাবির আলীর দিকে।
সাবির আলী মন্ত্রণালয়েরই একটা কাজে আদালত প্রাঙ্গণে এসেছিলেন। কাজ শেষ। গাড়িতে উঠতে যাবেন এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে একজন মহিলা কনস্টেবল তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল।
‘স্যার, ম্যাডাম আপনাকে ডাকছেন।’
‘কোন ম্যাডাম?’
‘মন্ত্রী ম্যাডাম। আজ রিমান্ড শেষে উনাকে আদালতে হাজির করা হবে। ঐ যে দূরে হাজতে তিনি আছেন। আপনাকে দেখে অস্থির হয়ে ডাকাডাকি করছেন। প্লিজ আসুন স্যার।’
সাবির আলী থমকে গেলেন। মুহূর্তের জন্য।
‘উনাকে বলবেন, আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে দেখা করব।’
গাড়িতে উঠলেন সাবির আলী।
ব্যস্ততার সময়ে মানুষ কেন যে এত ডাকাডাকি করে!

0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments