ইংরাজি ম্যাডাম – নাসরিন জে. রানি | অখণ্ড গল্প

By Published On: September 3, 2022
নাসরিন জে. রানি 
গল্পকার, ছোট ও বড় গল্প লেখেন। ১৯৮৩-১৯৯৯ মফস্বলে থেকেছেন, ২০০০-২০১০ বিবিধ শহরে বেড়িয়েছেন, ২০১১- বর্তমানে বিশ্বের আনাচে কানাচে ঘুরছেন; বই পড়ছেন, নিজস্ব আঙ্গিকে চরিত্র-নির্ভর, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস লেখার জন্য খুব ধীরে তৈরি হচ্ছেন।

ইংরাজি ম্যাডাম (অখণ্ড গল্প)
নাসরিন জে. রানি

চিনাবাদাম ভাজা খাইতে আমার মজা লাগে। সকালবেলা স্কুলগেটের উল্টাদিকে কাইয়ুম কাগু একটা ছোট খাচিতে কইরা বাদাম আর বুট বেচে। সেখান থিকা দশ টাকা দিয়া এক ঠোংগা বাদাম কিনলে সারাদিনের তেংরাতুংরা খিদাটা আর আমারে বেশি জ্বালাইতে পারে না। কবে জানি এক পেপারে পড়ছিলাম, বাদাম খাইলে শইল্লে অনেক শক্তি পাওয়া যায় আর পেটও ভরা থাকে অনেকক্ষন। কথাডা মিছা না।

প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় স্কুলের প্রথম কেলাসটা শুরু হয় নাম ডাকাডাকি পর্ব দিয়া। আমি প্রায়দিনই দেরি কইরা ফালাইতাম। গত সাময়িক পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ আহনের পর থিকা আম্মা ফজরের আজানের লগে লগে চিল্লাইয়া আমারে বিছানা থিকা তুইল্লা দেয়, ডাকাডাকি করে আর মসজিদে যাইয়া জামাতের লগে নামায পড়তে কয়। এই শীতের সকালে এই বেডিরে কেম্নে বুঝাই আমি, ঠান্ডা পানি দিয়া ওজু করতে কিরাম কষ্ট লাগে আমার।

রাইতে ঘুমাইতে যাওনের সময় একবার মুততে গেলে কত কম কম পানি দিয়া ধোয়াধুয়ির কামডা সাইড়া ফালানি যায়, এইডা আমারে শিখাইছে কামরুলে।

স্কুলের পিছে এই চিপা জায়গাডায় আইছি মুতার কতা কইয়াই ক্যাপ্টেন শফিকুলরে।শফিকুল একটা শয়তান পোলা, ওয় এমনে এমনে কাউরে বাইরে যাইতে দেয় না। পোংটা আছে ম্যালা। প্রতিদিন স্কুল থিকা কেলাসরুমে আমগোরে টিফিন দিলে, মাঝে মাঝে আমার ভাগের টিফিনডা ওরে খাইতে দেই।

শফিকুলের পেটে ম্যালা খিদা। দুইডা পরাটার ভিতরে সামাইন্য একদলা সুজির হালুয়া দিয়া ভাজ কইরা, এক একজন ছাত্ররে নাস্তা দেয় স্কুলের কমিটি। শফিকুল তিন কামড়েই ওই নাস্তা ওর বিশাল আক্ক-করা মুখের মইদ্দ্যে হাওয়া কইরা দেয়। গতকাইলের টিফিনডাও ওই খাইছে।

আমগো গেরামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার বানিয়াকান্দা গেরামে। গেরাম থিকা ম্যালা আত্মীয়রা, হাসপাতালের ডাক্তার দেখানোর লেগা ঢাকা আসে, আমগো বাড়িতে ওঠে। আমার বাপ ছোটোখাটো একটা ব্যবসা করে। পয়সা কম। সন্দ্যায় একটা টেইলার্সে বসে। কাটিং মাস্টারি করে। বাপের, টাউনে, তিনজন পার্টনারের লগে, থান কাপড়ের ব্যবসা আছে।সিজনে ভালো বেচা-বিক্রি হয়। আমরা তিন ভাই আর দুই বইন। আমি আর ছোড্ড দুইডা ভাই স্কুলে পড়ি। বইনেগোরে মাদ্রাসায় দিসে। ছোটবেলা থিকাই পর্দা করে ওরা।

আইজকা বাসায় ম্যালা আত্মীয় আছে, দুইদিন আগে আইছে হেরা। হেগোর মইদ্যে একজনের পেট কাটতে অইবো। পেটে টিউমার অইছে। আমার এক মামা, টাউনের এক হাসপাতালে কনটাক্টরি করে। হেয় হাসপাতালে যে সব রোগীরা ডাক্তার দেখাইতে আসে আউটডোরে, হেগোর মাইদ্দে যাগোর অপারেশন আর টেস্ট-টুস্ট করা লাগে, হাসপাতালের অন্য ডিপারমেন্টের লোকেগো লগে কেম্নে জানি খাতির কইরা কম পয়সায় এইগুলা করাইয়া দেয়। হেইল্লেইগাই আগবর মামারে আত্মীয়রা ভালা গোনে।

আইজগা আমার ঘুম থিকা উঠতে দেরি হইয়া গেছে। ফজর নামায পড়তে যাইতারি নাই। এখন আম্মার সামনে পরলে কাঁচা গিল্লা খাইয়া-লাইবো।

তাই কোনমতে স্কুল ড্রেস আর ব্যাগটা কান্দে লইয়া বাসা থিকা বাইরে আইছি। স্কুলে আইয়া দেখি,সবায় তিন লম্বর পিরড চলতাছে।আরো একটা পিরড গেলে স্কুলের বুয়ায় টিফিনের সসম্যানডা লইয়া কেলাসে আইবো। আইজগার টিফিনও সফিকুল খাইবো এমনই সেটিং করা আছে।

 আর কয়দিন বাদেই ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হইবো। বই লইয়া পড়তে বইতে একটুকও ভালা লাগে না আমার। সারাদিন খালি শয়তানি করতে ইচ্ছা করে। তয় স্কুলে বইয়া থাকতে ভালা লাগে।

স্কুলের কেলাস বিল্ডিংয়ের পিছনের এই চিপা জায়গাডা, শফিকুলরে পেশাপ করার ছুতা দিয়া এইখানে আমরা আসি। এইখানে চুপ কইরা বইয়া থাকতে ভালাই লাগে।

বিল্ডিংয়ের ওয়ালে ডেলান দিয়া ঘুমাইয়া যাই মাঝে মাঝে। এই জায়গাডায় সব সময় ঠান্ডা একটা বাতাস থাকে। এইখানে এই ছ্যামায় বইলে শইলডা জুড়াইয়া যায়। কাইল রাইতে বাসায় কারেন্ট আছিলো না। আমি পাকাতে একটা আধোয়া চাইদ্দর দিয়া বিছানা পাইত্তা শুইছি। মশার জ্বালায় ঘুমাইতে পারি নাই।

যে বুড়ার পেট কাটবো হের আবার কয়েলের ধুয়া সহ্য হয় না। এত মশা যে কই থিকা আহে। আর আছে তেইল্লাচুইরা, নখ আর চামড়া খায় ওরা।

আমার মেহমান বাল্লাগে না। কিন্তু বাসাডা তো আমার না। আমার আব্বা অনেক রাগী মানুষ, হের মেজাজ খারাপ থাকলে আম্মার লগে অনেক মুখ খারাপ করে।এমনে অন্য সময়ে ভালা থাকে সে।

আব্বা আমারে পত্তেকদিন টিফিনের লেগা পয়সা দিতে চায় না। কিন্তু বেতনের নাম কইরা পতিমাসে হের কাছ থিকা আমি একটু বেশীই টেকা মারি। এইগিলি বুজে না আব্বায়, বলদা ব্যাডা একটা।

আজকের দশ টেকা মারছি মেহেমানগো ব্যাগের ভিতর থিকা।এমনে মেহমান আমার বাল্লাগে না। কিন্তু এগোর অনেকের ব্যাগ আর পকেট থিকা আমি টেকা চুরি করি,অল্পই নেই। হেরা কেউ এইগিলা চুরি টের পায় না তেমন। আর টের পাইলেও কিছু কইবো না।কেমুন শরমের ব্যাপার। মালেক মিয়ার পোলাপান চোর, এইডা কী কওন যাইবো? তারা ভাবে, চুপচাপ দিনগুলা পার করতে পারলেই ভালো। আইছি তো ডাক্তার দেখাইতে। আর থাক, ওরা আমগোর পোলাপানই তো। একটু পোংটামি করলে কি আর অইব! আমাগোডা নিব না তো কারডা নিব?

কাইল রাইতে যে টেকা চুরি করছি, এই দিয়া বাদাম কিন্নাও আরো কিছু টেকা আছে পকেটে। এই সপ্তাহের আমার হাত খরচা নিয়া টানাটানি হইবো না। স্কুলে তো পতিদিন হাইট্টা আসি আমি, আর হাইট্টা বাসায় ফিরত যাই।

টিফিন বিরতির পরের কেলাসে এখন বিজ্ঞান পিরড চলতেছে। এরপরেরডা আইবো ইংরাজি কেলাস।

ইংরাজি ম্যাডামের কেলাস আমার ভালা লাগে। তার ছোট মাইয়াডা খুউব সুন্দর। ওয় আমাগো নিচের কেলাসে পড়ে। আমার ইংরাজি ম্যাডামরে নাইস লাগে। ম্যাডাম খুব সুন্দর কইরা কেলাস নেন আর সব পড়াগুলাও বুঝাইয়া দেন আমগোরে।

ম্যাডাম কয়, ‘যেকোনো পরীক্ষার আগে শুধু পড়ালেখা করলেই চলবে না শুধু, এর পাশাপাশি তোমাদের পূর্নাঙ্গ বিশ্রামও নিতে হবে।”

ম্যাডাম শুদ্ধভাষায় কথা কয়, আমার শুনতে ভালা লাগে। ম্যাডামের কথা দিনরাত খালি শুনতেই ইচ্ছা করে। আমি বড় হইয়া সবার লগে ম্যাডামের মত সুন্দর কইরা কথা কইতে চাই। আমার বাসায় কেউ এম্নে সুন্দর কইরা কথা কয় না। কেউ কাউরে অত পাত্তা দেয় না। সারাক্ষন খেজি-ভেটকির উপরে রাখে,ধমকা-ধমকি করে, আর আম্মায় তো আদর কইরা কোনদিন কথা কয় না আমগোর লগে। ম্যাডাম আমার মা হইলে ভালা হইতো।

চিনাবাদামের খোসাগুলো ড্রেনের আশেপাশে ফেলে ফরিদ ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে যায়। পেছনের দরজা দিয়ে চুপেচুপে ক্লাসে ঢুকে মাথা নিচু করে কোল-হেঁটে দরজা বরাবর সবচেয়ে কাছের বেঞ্চের এক কোনায় ছাত্রদের দলে মিশে যায় সে। আলতাফ স্যার কোনদিনই টের পান না ফরিদের এভাবে চুপিসারে ক্লাসে আসা-যাওয়া। তিনি আজ ব্ল্যাকবোর্ডে আহ্নিক গতির চ্যাপ্টার নিয়ে আলোচনা করছেন এবং ছাত্ররা তা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বিজ্ঞান ক্লাস ফরিদের ভালো লাগে না তেমন। আলতাফ স্যারকে দেখলেই জীবন্ত কাক মনে হয় তার। ফরিদ এই ভেবে মনে মনে হেসে ওঠে, ‘কাউয়া পড়ায় বিজ্ঞান। ধুর! বাল।’

 অই ফরিদ, “সকালে না খাইয়া স্কুলে গেলি কেন তুই? ফজর নামায পড়তে গেছিলি?”

মায়ের কড়া জিজ্ঞাসার উত্তরে ফরিদ কোন জবাব দেয় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে উলটা দিকের তাকের উপরে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে বারান্দার এক কোনায় চলে যায় সে।

মেহমানের সংখ্যা বেড়েছে। পেট কাটা রোগী বাঁচবে না বোধহয়। গ্রামের অন্য আত্মীয়রাও এসেছে খবর পেয়ে। বাসায় এখন এক পা ফেলার মত খালি জায়গা অবশিষ্ট নাই, আর এইদিকে আরেক পাগুলো তো কোলে মুড়িয়ে রেখে হাঁটতে হচ্ছে তার ভাই বোনদের। আজ রাতের বেলা মনে হয় বসে বসেই ঘুমাতে হবে সবাইকে।

ফরিদের নিজের কোন ব্যক্তিগত রুম নেই, ওরা ভাইবোনরা সবাই মিলে একটা রুম আর ডাইনিংয়ে পাতা খাটে ভাগাভাগি করে থাকে। এবং ওদের সবার পড়ার বইগুলো বেশিরভাগ যার যার ব্যাগে থাকে, নাহলে ওয়ালে হুড়কো দিয়ে লাগানো ক্যারোসিন কাঠ দিয়ে বানানো পলকা আর লম্বা একফালি তাকের উপরে রাখা থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে,বই ছাড়াও কিন্তু কলম আর পেন্সিল নিয়েই সবচেয়ে বেশি মুসকিল হয় ভাইবোনদের মাঝে।

বারান্দার কোনায় বসে থেকেও ঘুম ঘুম চোখে ফরিদ আম্মার ডাক শুনতে পায়। আম্মা ডাকে, “ওই ফরিদ! ফরিদ! কই গেলি! এই দিয়ে আয় তো! কাম আছে।

বাজারে যাইতে অইবো। তর আব্বার আইতে দেরি আছে। রান্দা বহাইতে অইবো। যা কিছু বাজার কইরা আন গা।”

বড় চাচী আসছেন। পেট-কাটা অপারেশনের রুগী বুড়া হলো চাচীর বাবা। আজ বাসা ভর্তি চাচীদের বাড়ির আত্মীয়স্বজন, নতুন নতুন অনেকেই আসছে। ফরিদ তাদের চেনে না।

মা ফরিদের খোঁজে বারান্দায় চলে আসেন। ফরিদের হাত ধরে তাকে রান্না ঘরে ধরে নিয়ে আসেন। আর বাজারের ব্যাগ হাতে দিয়ে বলেন,

“হুন, দুই কেজি আলু, এক কেজি বাইগুন। আর তেলাপিয়া নাইলে পাংগাস মাছ কিনবি, মাঝারি দেইক্কা। লগে দুই মুঠা শাক আর এক কেজি মুসরির ডাইল। নে টেকা ধর। বাজার কইরা তাড়াতাড়ি আইবি কইলাম। এরা সারাদিন জার্নি কইরা আইছে, না-খাওয়া খিদা পেট সবাইর। তুই বাজার আনলেই আমি রানতে বমু।”

ফরিদ বাজারে যায়, পকেটে রয়েছে গরম বড় দুইটা নোট। চাচী দুইটা পাঁচশত টাকার নোট দিয়েছে আঁচলের খোট থেকে খুলে বাজার করতে।

আলু, বেগুন আর অন্যান্য সদাই কিনতে দুইশত টাকার কিছু কম টাকা খরচ হয়৷ পেয়াজ,আদা,রসুন মিলিয়ে আরো একশত টাকা চলে যায়। একশত বিশ টাকা কেজি দরে তিন কেজি ওজনের একটা পাংগাস মাছ কেনার পরেও ফরিদের হাতে বেশ কিছু টাকা থাকে।

বাসায় ফিরে এসে ফরিদ খুচরা টাকাগুলো মাকে ফিরিয়ে দেয়, আর দুইশত টাকার মাঝারি নোটদুটো পকেটে রেখে দেয়। আজ বাসায় সারারাত বসে বসে ঘুমাতেও তার ভীষন আনন্দ লাগবে।

আইজকা পাঁচ নম্বর পিরডে তসলিমা ম্যাডামের কেলাস। ইংরাজি আগে তেমন ভালা লাগত না, কিন্তু ম্যাডাম খুব আদর কইরা পড়ান। ম্যাডাম কেলাসে আইলে বেবাকতে ম্যাডামের সুন্দর চেহেরার দিকে চোখ মেইল্লা চাইয়া থাকে, ম্যাডাম যা যা পড়ান, চোখ টিপড়ানিতেই মুখস্ত হইয়া যায় আমার।

ম্যাডাম বলেন, সামনে তোমাদের ফাইনাল পরীক্ষা আসছে। শুধুমাত্র পড়ালেখা করলেই চলবে না, প্রতিদিন কমপক্ষে আট নয় ঘন্টা বিশ্রাম নিতে হবে, পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা অবশ্যই ঘুমাতে হবে। কেননা, ঘুমের মাধ্যমেই একজন মানুষের ব্রেইন কিন্তু সতেজ হয়।ব্রেইন সুস্থ থাকলে, সেই সুস্থ ব্রেইন ব্যবহার করে ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। বুঝতে পেরেছ!

দ্যাটস হোয়াই আমি তোমাদের সাজেস্ট করব, শুধুমাত্র পড়ালেখা করলেই চলবে না। ঘুমের ব্যাপারেও, বিশ্রামের ব্যাপারেও তোমাদেরকে নজর রাখতে হবে।

ইংরেজি ক্লাস শেষে ফরিদ পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়, ওই নির্জন কোনায় বসে একটু ঝিমিয়ে নিতে, গতরাতের ঘুমটা পুরা করতে। এরপরের ক্লাস বিজ্ঞান, এই ক্লাসে একই অধ্যায় পড়াচ্ছেন স্যার গত একমাস ধরে। শুধু ফরিদই নয়, অন্যান্য বেক- বেঞ্চাররাও এই সময়ে আনমনা বিজ্ঞানী স্যারের ক্লাসে বসে বসে চোখ খুলে ঘুমোতে থাকে।

বেশ অনেকক্ষন ঘুমিয়ে প্রায় পড়তি বিকেলে ফরিদের ঘুম ভাংগে। সে কোথায় আছে, কি করছে, কিছু না বুঝে , হঠাৎ করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঠান্ডা দেয়ালে গাল চেপে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, তাই অমসৃন দেয়ালের এব্রোখেব্রো ছাপ ফরিদের গালে লেগে একটা নকশা তৈরি হয়েছে। গাল থেকে ধুলো মুছতে গিয়ে টের পেলো ফরিদ,ততক্ষনে স্কুলের শেষ ঘন্টার ক্লাস চলছে। ধর্ম স্যার মজিদ মিয়া খন্দকার, ক্লাসে যাই পড়ান, ছেলেদের বাদ দিয়ে শুধু মেয়েদের পড়া ধরেন। তাই ফরিদরা এই ক্লাসেও কিছু না কিছু খেলায় মেতে থাকে। তোফায়েল ভালো ছবি আঁকে, সে মজিদ মিয়ার বিভিন্ন স্টাইলের মজাদার কার্টুন আঁকে, স্যারের নাক আপেলের মতন কোনটায় তো কানগুলোর বদলে দুটি পাখা বসিয়ে দেওয়া, তোফায়েল ফুলের ছবিও সুন্দর করে আঁকে। হাতের লেখা ভালো ওর, তাই ওকে দিয়ে ফরিদরা প্রেমপত্র লিখিয়ে তাতে ফুল লতাপাতা আঁকিয়ে নিয়ে, ছোট ক্লাসের মেয়েদের সাথে টাংকি মারে।

ঘুমের রেশ চোখে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পেছনের ধুলা ঝেড়ে ফেলে, বিল্ডিংয়ের কোনা থেকে বের হয়ে, বিল্ডিংয়ের সামনের সিড়িতে চড়ে ক্লাসের দিকে যাওয়ার পথে ইংরেজি ম্যাডামকে উলটো দিক থেকে হেঁটে আসতে দেখে ফরিদ, কি করবে বুঝে না পেরে সে আচানক সিড়ি থেকে নেমে একটা পিলারের পেছনে লুকিয়ে পরে। স্কুল চলাকালীন সময়ে এই কোণায় ছাত্রদের আসা বারন, এই ফ্লোরের একটি রুম শিক্ষকদের বিশ্রাম কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়,এই সময়ে কেউ সাধারণত থাকে না সেখানে।পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে ম্যাডামের, ওই রুমে প্রবেশ করা দেখে ফরিদ, এরপর পিলারের আড়াল থেকে বেড়িয়ে পা টিপেটিপে ক্লাসের দিয়ে যেতে থাকে সে, বিশ্রাম কক্ষ অতিক্রম করে সামনে দুই পা ফেলেছে যখন,তখন পেছন থেকে ডাক শোনে-

এই ছেলে, কোথায় যাচ্ছো তুমি?

পা টিপেটিপে হাঁটা থেমে যায় ফরিদের, পেছনে ফিরে দেখে ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছেন। ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে, চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ঘুমঘুম চোখে।

আকলিমা ম্যাডাম বসেছিলেন দরজার কাছের একটি চেয়ারে, তিনি ফরিদকে ভেতরে আসতে ডাকেন। ফরিদের ঘুম চোখের পাতায় আরো বেশি ঘুম নেমে আসে যেন, কিন্তু পায়ে পায়ে হেঁটে সে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে, ম্যাডামের সামনে যেয়ে দাড়াঁয়। তিনি চেয়ারে বসে ফরিদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন, বুঝতে পারেন ছেলেটা বেশ ক্লান্ত, ক্লাসেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলো, চোখেমুখে জল দিতে বাইরে এসেছে। ফরিদের গোপন বিশ্রাম স্থানটির সম্পর্কে কিছুই জানা নেই তার।

এই ছেলেটি তার ক্লাসগুলোতে খুব মনোযোগ দিয়ে বসে থাকে, পরীক্ষাগুলোতেও মোটামুটি ভালো নম্বর পায়, কিন্তু আরেকটু চেষ্টা করলে আরো ভাল করতে পারবে। ম্যাডাম প্রশ্ন করেন, কি নাম তোমার?

ফরিদ তার নাম বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি খেয়াল করেন, ছেলেটার ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখের পাতায় তাকিয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে,ইশারায় ফরিদের পাশে রাখা একটি খালি চেয়ারে ওকে বসতে বলেন।

– শোনো ফরিদ, সামনের সপ্তাহেই স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। বাসায় থাকবে সারাদিন, তাই এই সময়টা কাজে লাগিয়ে ভালো প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রচুর বিশ্রামের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে কমপক্ষে সাত আট ঘন্টা পড়াশোনা করতে হবে।

ফরিদ কিছু না বলে, ম্যাডামের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে। চোখ থেকে ঘুম কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ম্যাডামের ভালো আচরণ ভীষন ভালো লাগছে। ম্যাডাম বলেই যাচ্ছেন,

শোনো ছেলে, তখন তোমার স্কুল থাকবে না, কোচিং থাকবে না।পুরো সময়টাই পাবে বাসায় থাকার জন্য। আর বাসায় থাকলে যে কাজটা করবে, ঠিক সময়ে খাবার খেয়ে বিশ্রামের পাশাপাশি কমপক্ষে দশ থেকে বারো ঘন্টা পড়াশোনা করবে। এই দশ বারো ঘন্টা একটা ন্যূনতম সময় ধরে বলেছি,কিন্তু তুমি যদি আরো বেশি পড়তে পারো, তাহলে অনেক ভালো হয়।

আর পরীক্ষার রুটিন নিজের কাছে রাখবে, ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন কি তোমার কাছে আছে? লিখে নিয়েছো তুমি?

– হ্যা ম্যাডাম, আমি শফিকুলের কাছ থিকা লিখা নিছি, আমগো কেলাস ক্যাপটেন অয়।

-আচ্ছা, খুব ভালো কথা। কিন্তু এই রুটিন তুমি যে লিখে নিয়েছো, তা কি ভালো করে পড়ে দেখেছো? যেদিন বোর্ডে রুটিনটা লিখে দেওয়া হলো, তুমি স্কুলে আসনি? ক্লাসে ছিলে না  ওই সময়ে?

ফরিদ কিছু না বলে, চোখ মাটিতে রেখে, জুতোর ভেতরে থাকা পায়ের বুড়ো আংগুল দিয়ে সোলের উপরে চেপে চেপে গর্ত গর্ত খেলতে লাগল।আর মনে করতে চেষ্টা করছে- সেই ক্লাসটি কবে আর কখন হয়েছিলো? কিন্তু কয়েকদিন আগে শফিকুল নিজে থেকেই ওকে পরীক্ষার রুটিন লিখে নিতে ওর খাতা এগিয়ে দিয়েছিলো যখন, ফরিদ বেশ অবাক হয়েছিলো, শফিকুল এত ভালো নয়, তবু অন্যকিছু না ভেবে দ্রুতই রুটিনটা লিখে নিয়েছিলো সে, ক্লাস ক্যাপ্টেনের খাতা দেখে দেখে।

ম্যাডাম বলেই চলেছেন, এ ব্যাপারে তোমাকে সতর্ক হতে হবে, শফিকুলকে আমি আলাদাভাবেই চিনি, গত বছর শফিকুল একটি দুষ্টকান্ড করেছিলো, এবার আর যেনো সুযোগ না পায়। তুমি আগামীকাল টিফিন পিরিয়ডে টিফিন খেয়ে, এখানে এসে আমার কাছ থেকে রুটিন লিখে নিয়ে যেও। এখন ক্লাসে যাও, অযথা বাইরে ঘোরাফেরা করবে না।

শফিকুল আর আমি গতবছর এক সেকশনে আছিলাম না। কিন্তু ম্যাডাম বড় কেলাসের সব সেকশনেই ইংরেজি কেলাস নেন। শফিকুল আগেও কেলাস ক্যাপ্টেন আছিলো- এইসব কথা ভাবতে ভাবতে ফরিদ ক্লাসরুমের কাছে এসে পেছনের দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটুমোড়া বসে চুপিচুপি এগিয়ে গিয়ে শেষ বেঞ্চের খালি কোনাটায় বসে পরে, মনে মনে বলে- রুটিনডা আমি তাইলে আজমল, কবীরের লগে মিলাইয়া নিমু কাইলকা কেলাসে আইসাই।

শরীফ আর কবীর দুইজনের কেউ আইজ স্কুলে আসে নাই, ওগো বেঞ্চে মুক্তাদির বইছে আইজকা। মুক্তাদির একটা খারাপ পোলা, চোর। লুকাইয়া লুকাইয়া মোবাইলে বুলুফিলিম দেখে, চটি বই কিনে।

কাইলরাইতে গাদাগাদি কইরা ঘুমানির কারনে সকালে ঘুম থিকা উঠতে দেরি হইছে, আর আম্মায় ডাক দেয় নাই। মুক্তাদিরের লগের জায়গাডাই খালি আছে, এই বেঞ্চে বইলে চোখ খোলা রাইখাই ঘুমানি যায়।আকলিমা ম্যাডাম বলছে,ঠিকমত বিশ্রাম নিতে। এত কোনায় বসা ছাত্রগো স্যাররা পড়া জিগায় না, খেয়াল করে না।

বেঞ্চে বসার একটু পরেই ফরিদ ঘুমিয়ে পড়ে। স্কুলের শেষে মুক্তাদির ওর পেছন পেছন আসে।বেশ অনেকটা পথ হেঁটে ফরিদ যখন অন্য গলিতে ঢুকে যাবে তখন মুক্তাদির সামনে এসে পথ আটকায়।

– ওই ফরিদ্দা, তর ব্যাগে আমার একটা মাল আছে। টিফিন পিরডের পরে কেলাসে যখন বিড়ি খাইতে কেলাস থিক্কা বাইরাইছিলাম, তখন তোর ব্যাগে রাখছিলাম ঐডা, তুই তো কোনায় বইয়া ঘুমাইতেছিলি, তোর ব্যাগটাই সেফ লাগল। ব্যাগের চেন খোল ফরিদ্দা, দেখ, উপরের পকেটে আছে, মালডা দে।

– আমার ব্যাগে কিছু নাই। যা ভাগ।

– নাই মানে? আমি নিজের হাতে রাখছি। বাইর কর। নাইলে ব্যাগ ছিড়া বাইর কইরা নিয়া যামু কইলাম।

ফরিদ মুক্তাদিরকে পাত্তা না দিয়ে সামনে হেঁটে যেতে থাকে। মুক্তাদির আরো কিছুক্ষন পীড়াপীড়ি করে, ফরিদের কাঁধের ব্যাগটা ধরে টান দেয়, ফরিদ পাত্তা দেয় না। হাঁটতে থাকে, সে মুক্তাদিরের কথায় বিশ্বাস করে না। একটা ফালতু ছেলের ফাজলামিতে সে পরতে চায় না।

ব্যাগ না পেয়ে, মুক্তাদির পেছন থেকে ফরিদের কাঁধে একটা ঘুসি মেরে দৌড়ে অন্যদিকে চলে যায়। যেতে যেতে চিৎকার করে বলে –

অই খানকির পোলা, তোর মায়রে চুদি, বইনেগো চুদি, আমার বই দেস না কেন? আমার জিনিস আমারে ফেরত দে।

 ফরিদ কাঁধে হাত চেপে রেখে দ্রুত পায়ে সামনে দিকে হেঁটে যেতে থাকে। মুক্তাদিরকে ক্লাসের কেউ পছন্দ করে না, কেউ ওর সাথে মেশে না।

পেটকাটা রোগীর শ্বাস উঠেছে। লোকজন রোগীকে ঘিরে বসে আছে। ফরিদের মায়ের মুখ থমথমে।কাঁধের ব্যাগ কোথাও না রেখে কাঁধে নিয়েই ফরিদ বারান্দার এক কোনায় চলে যায়। পাশের বিল্ডিংয়ের রান্নাঘরের উজ্জ্বল লাইট থেকে এখানে সামান্য আলো এসে পড়ে, বারান্দার রেলিংয়ে মাথা রেখে কিছুক্ষন বসে থেকেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।

ফরিদকে কেউ ঘুম থেকে জাগায় না। সারারাত বারান্দায় আধাবসা হয়ে ঘুমিয়ে ভোরে ফজরের আযানের শব্দে ঘুম ভাংগে তার, হাত-মুখ ধুয়ে নামায পড়তে মসজিদে চলে যায় সে।

নামায পড়ে, সকালের নিরব রাস্তায় কিছুক্ষন হেঁটে ঘরে ফিরে এসে, সোজাসুজি বারান্দায় যেয়ে ব্যাগটা হাতে নিতেই তার মুক্তাদিরের কথা মনে পড়ে, দ্রুত ব্যাগটা হাতে নিয়ে রান্না ঘরে মায়ের খোঁজে উঁকি দিয়ে মাকে সেখানে না দেখে,ব্যাগটা কোলে নিয়ে পাশের দরজা খুলে বিল্ডিংয়ের সরু সিড়ি বেয়ে ছাদের এক কোনায় চলে আসে।

ভোরের হালকা কুয়াশা ভাব আছে এখনো, শীত নেই আজ, কাল রাতেও তেমন ছিলো না, কিন্তু ফরিদের মাথা ব্যথা করতে থাকে হঠাৎ । ব্যাগের ভেতরে কয়েকটা খাতার নিচেই একটা পাতলা ম্যাগাজিন পাওয়া যায়। কৌতুহল নিয়ে বইটা খুলে প্রথমপাতা উল্টেই পড়া শুরু করে সে। এরআগেও ফরিদ বন্ধুদের সাথে মোবাইল ফোনে দুই একটা পর্নসাইটে ঘুরেছে, সাইবার ক্যাফেতেও দেখেছে।কিন্তু কোনো বই পড়েনি। সে গোগ্রাসে বইটি পড়ে ফেলে সূর্য মাথায় চড়ার আগ পর্যন্ত। ছোট্ট একটা বই, গল্প সংখ্যা কম, কিন্তু তার মন ভরেনি, বরং কৌতুহল বেড়ে গেছে বহুগুণ। মুক্তাদিরকে তার অত খারাপ ছেলে মনে হয় না আর, গতকাল বিকেলের ঘুসির কথা ভুলে যায় যেন সে এবং  আজ ক্লাসে মুক্তাদিরের পাশের সিটে বসবে ঠিক করে।

স্কুলে আজ আজমল, শরীফ দুইজনই এসেছে, কবীরের পেছনের বেঞ্চে মুক্তাদির বসেছে,জায়গা খালি নেই, একেবারে শেষ বেঞ্চে গিয়ে ক্লাসের মধ্য-বরাবর পথের প্রথম সিটটাতেই বসে পরে ফরিদ, একাই বসেছে,বেঞ্চ খালি, উলটো পাশের বেঞ্চেও কেউ বসে নেই।

ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে যতবারই ওর দিকে চোখ পড়েছে, দেখেছে রাগী রাগী চেহারা নিয়ে ওকেই দেখছে মুক্তাদির। পরপর চারটি ক্লাস এভাবেই কেটে যায়। টিফিন পিরিয়ডের ঘন্টার আওয়াজে, সবাই যখন হুটোপুটি করে টিফিন সংগ্রহ করতে ব্যস্ত, মুক্তাদির ফরিদের পেছনে এসে, ফরিদের কোমর জড়িয়ে দ্রুতই ওকে ক্লাস থেকে বের করে সেই নির্জন কোনাটায় নিয়ে যায়, যেখানে প্রায়দিন ফরিদ একা বসে বসে কিছুটা বিশ্রাম নেয়, শরীর জুড়িয়ে নেয় ঠান্ডা শীতল বাতাসে, ঘুম পেলে ঘুমায়।

– তুই আমার মাল দে ফরিদ্দার গরের ফরিদ্দা, আচোদা মাইজ্ঞা হালার পুত।।

– কি মাল, মাল করতাছোত তুই! আমার ব্যাগে কিছু আছিলো না,তুই কেলাসে যাইয়া আমার ব্যাগ চেক কইরা দেখ।

– ওই মালডা আমি নিজের হাতে লইয়া তোর ব্যাগের ভিত্রে হান্দাইছি। আর তুই কস মাল নাইক্কা! আমারে মফিজ পাইছোত, হালা কুত্তা, বান্দির পোলা!- এই বলে ফরিদের গালে ঠাস ঠাস করে দু’টো চড় মারে মুক্তাদির।

চড় খেয়ে ফরিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।গতকাল বিকেলে রাস্তায় মানুষ ছিলো, তাই মুক্তাদির সাহস পায়নি, কিন্তু আজ সে প্ল্যান করে ফরিদকে এখানে নিয়ে এসেছে,মুক্তাদিরের ভাবভংগী ভালো লাগছে না। বইটা ফরিদ একটি প্লাস্টিকের ঠোংগায় ভরে ছাদে রাখা বালির ড্রামের ভেতরে গুজে রেখেছে, সাথে করে নিয়ে আসেনি আজ।

চড় খেয়েও ফরিদকে নিশ্চুপ দেখে মুক্তাদিরের সাহস বেড়ে যায়। সে ফরিদের পেটে আচমকা একটা ঘুষি মেরে বলে- চুতমারানির পুত, বইটা দিবি কিনা ক? তুই তো আমার থিক্কাও বেশি খারাপ। খারাপ বই রাখোস ব্যাগে।

ফরিদ ঘুসি খেয়ে বসে পড়ে,কথা বলার শক্তি পায় না। মুক্তাদির তখনো শান্ত হয়নি, ফরিদের নিচু করে রাখা মুখটি মুক্তাদিরের পেট বরাবর। ফরিদের ফোস ফোস করে ছাড়া নিশ্বাসের বাতাস তার তলপেটে লাগছে।

ব্যথায় কুকড়ে গেছে ফরিদের লম্বাটে মুখটা, চিৎকার দেয় সমস্ত শক্তি জড়ো করে, কিন্তু কেউ শোনে না।

হঠাৎ করেই মুক্তাদির ফরিদের মুখটা ওর তলপেটের সামান্য নিচে চেপে রাখে বেশ কিছুক্ষন। মুক্তির জন্য ফরিদের আছড়পাছড়েও ছেড়ে দেয় না। মজা পেয়ে মুক্তাদির গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে মুখটাকে ধীরে ধীরে তলপেটের আরো নিচের দিকে ঠেলে দিয়ে, তার দুই হাতে ফরিদের মাথার দুইপাশে চেপে রেখে, এপাশ থেকে ওপাশ অনবরত ঘসতে থাকে , প্রচন্ড এক ঘোরে ডুবে যায়।এভাবে বেশ অনেকটা সময় গড়িয়ে গেলে,একসময়ে ফরিদ অজ্ঞান হয়ে পড়ে, কিছুক্ষন পর সম্বিত ফিরে পেয়ে টের পেয়ে ওকে ফেলে রেখে মুক্তাদির ভয়ে পালিয়ে যায়।

স্কুল ছুটির পরে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়, ঠান্ডা বাতাসের মুহুর্মুহু দোলায় ঘুমন্ত শরীরে শীত লেগে জ্ঞান ফিরে আসে ফরিদের। চোখ মেলে তাকাতেই হঠাৎ করে মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, কিছুই মনে নেই। এভাবেই শুয়ে থেকে বেশ অনেকটা সময় পার হলে ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পড়ে তার।

শোয়া থেকে বসে গায়ের ধুলোবালি ঝেড়ে, ব্যাগ আনতে ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ায় সে। ক্লাসরুম অন্ধকার, তালা মারা, স্কুলের মূলগেইটেও তালা মেরে বাড়ি চলে গেছে দাড়োয়ান। ফরিদ কোনোমতে স্কুলের প্রাচীর টপকে রাস্তায় বেড়িয়ে আসে।

বাড়ি ফিরে দেখে শ্বাসওঠা রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে, একটানা কেশে যাচ্ছে,পাশেই চাচী বসে বসে বিলাপ করে কাঁদছে। আম্মা ঘরে নেই। ফরিদ হাত মুখ ধুয়ে একবাটি মুড়ি নিয়ে বারান্দার কোনায় চলে যায়। আর একমাস পরে ফাইনাল পরীক্ষা। বিশ্রাম বা পড়ালেখার কোনো পরিবেশ নেই এই বাড়িতে। ইংরেজি ম্যাডামের কথা বারবার মনে হয়, চোখ বন্ধ করে সে ম্যাডামের কথাগুলো ভাবতে থাকে। ম্যাডামের সব কথা, ভংগী- ফরিদের মুখস্ত হয়ে গেছে। ম্যাডাম সিন প্যাসেজ নিয়ে গত সপ্তাহের ক্লাসে যে পড়াটি করিয়েছিলেন, তাই মনে মনে ভাবতে শুরু করে সে।

ক্লাসের সবাইকে না বলে ইংরেজি ম্যাডাম যেনো শুধু তাকেই বলছে, এই রকমের একটা কল্পনায় ডুবে যায় ফরিদ।

ম্যাডাম ফরিদকে ডেকে নিয়ে ওই চেয়ারটি দেখিয়ে দিয়ে বসতে বললেন সেদিনের মত।আজ ম্যাডামকে অনেক বেশি হাসিখুশি লাগছে,পাশেই তার ছোটমেয়েটা বসে টিফিন খাচ্ছে।ম্যাডাম বলেন,

ফরিদ, তুমি ভালো ছেলে। আমার ক্লাসের সবচেয়ে মনযোগী ছাত্র তুমি। চেষ্টা করলেই ইংরেজিতে এ প্লাস পেতে পারো। তাই আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।তুমি খুব ভালো রেজাল্ট করো, এই প্রত্যাশা আমি করি।

ফরিদ কোনো জবাব না দিয়ে একমনে ম্যাডামের কথাগুলো মাথার ভেতরে শুনে যেতে থাকে, অনেকক্ষন ধরে চোখের একটি পাতাও না মেলে, বারান্দার এই ছোট্ট কোনাটায় বসে থাকে।

ম্যাডাম বলেন-

শোনো ছেলে, ব্যাগ থেকে খাতা বের করো, আমার কথাগুলো নোট করে রাখো।

ফরিদ মনে মনে নোট খাতা খোলে, বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া টাকা দিয়ে কেনা নতুন কলমটা ব্যাগ থেকে বের করে, কলমের মুখাটা খুলে মাথায় পরিয়ে দেয়।

‘পরীক্ষার খাতায় এন্সার কিভাবে লেখা উচিত, আমি তোমাদের ইংলিশ টিচার, এসএসসি ইংলিশ ফার্স্ট পেপার উত্তরপত্রের জন্য কিছু কৌশল নিয়ে আলোচনা করব। বিশেষ করে, প্রথমপত্রের উত্তরগুলো কিভাবে লেখা উচিত।’

ঘরের ভেতরে শ্বাসকষ্টের রোগীকে ঘিরে বিলাপকারীর সংখ্যা বেড়েছে, হইচই শুরু হয়ে গেছে- হাসপাতাল অবদি রোগীকে নেওয়া যাবে কি যাবে না, নিতে হলে এম্বুলেন্স ডাকতে হবে, তার জন্য যে খরচ হবে সেই টাকা কে দেবে? কোথাও যদি ভর্তি করতে হয়, তাহলে অল্প টাকায় অপারেশন করার সম্ভাবনাটুকু আর নেই আপাতত। এই দিকে তার বাবার অবস্থার ক্রমশ অবনতি দেখে সকাল থেকে বারান্দায় বসেই চিতকার করে বিলাপ করছে চাচি। এখান থেকে উঠে যায় ফরিদ; ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে চাইলে, মায়ের চোখ রাংগানীর সামনে পরে, ভয়ে ভয়ে আবার বারান্দার এই কোনায় এসে বসে পড়ে। কিছু করার নাই, তাই মনে মনে ম্যাডামের সাথে ওই চেয়ারে বসে কল্পনায় ডুবে যায় সে।

ম্যাডাম বলেই চলেছেন- ‘একটা কথা মনে রাখবে, ফার্স্ট ইমপ্রেশন ইজ দ্যা লাস্ট ইমপ্রেশন। এর মানে হলো- আগে দর্শনধারী, এরপর হলো গুণবিচারি। শোনো ছেলে, একটা জিনিস যদি দেখতে ভালো লাগে, সেখান থেকে কিন্ত ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায়।তোমার খাতায় যদি তুমি উত্তরগুলো সাজিয়ে, গুজিয়ে লেখো, তো টিচার অটোমেটিক্যালি খুশী হয়ে যাবে। বুঝতেই পারছ, টিচার খুশী হলে, মার্কসও তুমি একটু বেশী আশা করতে পারো। তো টিচারকে খুশী করার সেই উপায়টি আমি তোমাকে বলব। শোনো, প্রথমেই একটি প্যাসেজ থাকবে, সিন প্যাসেজ। বই থেকেই আসবে প্যাসেজটি। আমি কিন্তু তোমাদের ক্লাসে এই প্যাসেজগুলো নিয়ে অনেকবার আলোচনা করেছি। এরপরেও তুমি ভালোভাবে না বুঝলে, বুঝিয়ে দিচ্ছি আবার।

ফরিদ ঘরের দৃশ্য ও শব্দ এড়িয়ে মন দিয়ে শুনতে থাকে ম্যাডাম কি বলছেন। বারবার ধ্যান কেটে গেলে, যেখানে কেটে যায় সেখান থেকেই কল্পনা আবার শুরু করে সে, এই কাজটিতে তার মাঝে কোনোপ্রকারের ক্লান্তি দেখা যায় না। নিজের ভেতরে নিজের সাথেই মজার এক খেলায় মেতে ওঠে সে।

চাচীর বিলাপের শব্দে বেশ কয়েকবার ধ্যান ছুটে গেলে, ফরিদ আবার ডুবে যায়, কল্পনায় ম্যাডামের কথাগুলোর টুকরো টুকরো রিল জুড়ে দিতে।

ম্যাডাম বলছেন, প্রথমেই যে সিন প্যাসেজ থাকবে, এই রকমের প্যাসেজগুলো আমি যত্ন করে তোমাদের বারবার পড়িয়েছি। কিন্তু কিভাবে সুন্দর কর আন্সার করবে, তা মনোযোগ দিয়ে শুনে নাও।

‘যখন তুমি প্রথম প্রশ্নটির উত্তর দেবে, খাতার মধ্যে লিখবে- আন্সার টু দ্যা কোয়েশচন নাম্বার ওয়ান।এই কথাটা লিখেই এর নিচে একটা মার্জিন টেনে দেবে।‘

ফরিদের এইবার হঠাৎ করেই

প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, বলে-

আচ্ছা ম্যাডাম, মার্জিন না টানলে হইবো না?

ফরিদের জানার আগ্রহ দেখে ম্যাডাম খুশী হন,বলেন- অবশ্যই হবে ফরিদ। মার্জিন না টানলেও হবে। কোনো সমস্যা নেই কিন্তু মার্জিন হচ্ছে খাতার একটি সৌন্দর্য। অনেক সময় মার্জিন না টেনে খাতা ভাজও করা যায়।কিন্তু খাতা ভাজ করে যদি উত্তর লিখতে যাও, সেক্ষেত্রে তোমার আন্সারশীটের অর্থাৎ ওই খাতার উপরে যে ওএমএস শিটটা থাকে, সেটা কিন্তু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দ্যাটস হোয়াই তুমি মার্জিন টানার মতন একটা মন মানসিকতা রাখবে। তাহলে খাতাটার সৌন্দর্য বেড়ে যাবে।

ফরিদের আরেকটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, কল্পনায় ম্যাডামের সাথে কথা বলতে বেশ ভালো লাগছে। ফরিদ ম্যাডামকে প্রশ্ন করে- মার্জিন টানার জন্য কোন রংয়ের কলম লাগবো ম্যাডাম?

ম্যাডাম বলেন- তুমি যেকোনো কালি ইউজ করতে পারো, তবে অবশ্যই নীল ও লাল কালি বাদ দিয়ে। তুমি কালো কালিই ব্যবহার করো। প্রথমে তোমাকে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে, তা হলো- মাল্টিপল চয়েজ, সেখানে শুধু চয়েজ নাম্বার লিখে ছেড়ে দিলেই হবে না,নাম্বারের পাশাপাশি পুরো এন্সারটিও নোট করতে হবে। আরেকটা কথা মনে রাখবে, তুমি প্রথমে এক নম্বর উত্তরটি লিখলে কিন্তু এরপরের দুই নম্বর ও তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তরটি তুমি জানো না কিংবা পারছো না। কিন্তু পরের প্রশ্নগুলো অর্থাৎ চার ও পাঁচ নম্বর প্রশ্নের উত্তর জানো আর লিখে ফেললে, তা করা যাবে না। বরং সিরিয়াল ধরে তোমাকে সব নম্বরগুলো পরপর বসাতে হবে, লিখতে হবে উত্তরগুলো।যেগুলো পারবে না, সে ঘরগুলো ফাকা রাখবে, পরে চেষ্টা করবে উত্তর দিতে।

কল্পনায় ম্যাডামের সাথে এভাবে আলাপ চলতে থাকে। কখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে ফরিদ কল্পনার ঘোর থেকে ঘুমের অতলে হারিয়ে যায়,টের পায় না।

স্কুল বন্ধের দিন বিকালে শরীফ, কবীর, আজমলরা পরীক্ষার আগে একটু রিলাক্স অইতে একটা সিনামা দেকতে চায়, টাউনে গিয়া, আমারেও লগে যাইতে ডাকে।পরদিন দুপুর সাড়ে বারোটায় যে প্রথম শো আছে,  ওই  শো দেখমু আমরা,এরপর সবাই মিল্লা নদীর ধারে ঘুরতে যামু। তাই আগেরদিনই চান্দা তোলার কাজটা কইরা ফালায় শরীফ, যেন আমরা কেউ ফাঁকি দিয়া ভাগতে না পারি।

সিনামাডা ভালই লাগছে। একটা ফাইটিং  ফিলিম। সবাই মিল্লা চিল্লাইয়া মজা মাইরা দেখছি। শো ভাংলে হল থিকা বাইরে আইয়া হলের পাশের একটা খুপড়ি দোকানে বইয়া গরম গরম কিমা পুরি খাইলাম। দেখি আমাগোর স্কুলের ছোট কেলাসের কিছু পুলাপাইনরাও আইছে সিনামা দেকতে, তয় আমগোর লগে পুরির দোকানে ঢোকে নাই ওরা,একটু দূরে দূরে সইড়া খাড়াইয়া গল্প করতাছিলো।

পুরি খাওয়া শেষ হইলে আমরা শহরটা ঘুরতে বাইর হই। একটা পুরান বইয়ের দোকান দেইখা আমার মুক্তাদিরের কতা মনে পইড়া যায়। কেন জানি দোকানের সামনে খাড়াইয়া খাড়াইয়া একটা কৌতুহল নিয়া বইগুলা লাড়াচাড়া কইরা দেখতে থাকি।সব ধরনের বই আছে। একটা অন্য রকমের বই হাতে তুইল্লা লই, রংগিন ছবিওয়ালা বই, সুন্দর ডিজাইন। আমার হাতে ওই বই দেইখা দোকানি ব্যাডায় কয়- এইডা বিদেশি ম্যাগাজিন, সব ইংরাজি লেখা।

অনেক ভারি একটা বই, এইরাম বই আমি আগে দেখি নাই।দাম জিগাইলে, ব্যাডায় কয়- তিনশ টেকা, এই বইয়ের দাম।

এত টেকা তো নাই আমার কাছে। ওই বইডা হাত থিকা থুইয়া দিয়া, বেশ অনেকক্ষন দোকানের অন্য বইগুলা লাড়াচাড়া কইরা একটা বইয়ে চোখ আটকায়- ইংলিশ গ্রামার লেসন ফর অল ফিকশন রাইটার। বইটা হাতে নিতেই জানি আমার ইংরাজি ম্যাডামের কতা মনে পইড়া যায়। বইটার দাম জিগাইলে

দোকানি কয় – দুইশ টেকা। ব্যাডার হাতে-পাওয়ে ধইরা দেড়শ টেকা ধরাই দিয়া বইডা কিন্না লই, আরো কিছুক্ষন অন্য বইগুলা হাতাইয়া দেইখা ফিরা যাওয়নের আগে, ম্যাগাজিনডা শ্যাষবার হাতে নিয়া এই মাতা থিকা শেষ মাতা পর্যন্ত পাতা উল্টাইয়া লাড়াচাড়া কইরা দোকানিরে কই- আমিও একদিন এইখানে লেখুম |

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop