হায়েনার চোখ

হায়েনার চোখ
রাশেদুজ্জামান কানন
আঘন মাস। প্রকৃতি তুলোর মতন নরম বিছানা পেতেছে বাংলা জুড়ে। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে হিমেল হাওয়া।কথিত আছে এক সময় এমাসই ছিল বাংলা ক্যালেন্ডারের পয়লা মাস। এ মাসের আরও একটি নাম আছে মার্গশীর্ষ। মৃগশিরা’ নামের এক তাঁরার নাম থেকে এসেছে অগ্রহায়ণ মাসের এ নাম। ধানের সাথে এমাসের নিবিড় সম্পর্ক। অভাবের কার্তিককে পেছনে ফেলে কৃষকেরা সোনালী ধান ঘরে তুলছে। কোনো কেনো মাঠে এখনো পাকা ধান পড়ে আছে। মাঠের পর মাঠ শুণ্য হতে শুরু করেছে। সেই ফাঁকা মাঠে গ্রামের গরীবঘরের ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ধান কুঁড়ায়। ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে যে ধান পায় তা নিয়ে তাধিন তা ধিন করে বাড়ি ফেরে। মায়ের কাছে বায়না ধরে এ ধানের চাল দিয়ে পিঠা বানাতে হবে। কিষান মায়েরাও অল্প কয়টা ধান দিয়েই চাল বেনে সন্তানের আহ্লাদ পূরণ করেন। গত কয়েকদিন ধরেই ধান কুঁড়াচ্ছে রাজু আর রাবেয়া। পিতৃহারা ভাইবোন দুটির মা এ বাড়িতে ও বাড়িতে কাজ করে তিনটি প্রাণীর দুবেলা আহারের ব্যবস্থা করেন। এ সময় ওদের মা লায়েলা খাতুনেরও কাজের খুব চাপ। মল্লিক বাড়িতে খন্দ সেরে দিয়ে কিছু ধান পায়। রাত দিন মন কে মন ধান মারই, সেদ্ধ করে সেই ধান আবার বেড় এ তুলে দিয়ে নিজেও কিছু পায়। তাই এসময়ে তার ফুরসরৎ নাই। ওদের মা যে ধান পায় তা দিয়ে ওদের কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে দিন চলে যায়। পিঠাপুলির মতন বিলাসিতা ও দিয়ে সম্ভব না। সামনে শীতে পিঠা খাওয়ার জন্যই ওদের যত আয়োজন।
সৃষ্টির হাজারো রকম প্রাণীর মতন কোনো মতে টিকে থাকা রাজু, রাবেয়া আর লায়লা খাতুনের দিকে সহানুভূতি নিয়ে কেউই তাকায় না। এদের মত প্রাণীর না থাকে আত্মীয়-স্বজন না থাকে সৃষ্টিকর্তা। এরা আগাছার মতই অবহেলায় সমাজের এক কোনায় পড়ে থাকে। তবে এত না থাকার মধ্যেও রাবেয়ার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ওর ভাই।
ছোট বোনটাকে সে আগলে রাখে সব ঝড় ঝ্বঞ্চাটের হাত থেকে। দুজনের বয়সের তাফাৎই বা কত? রাজুর ১২ কি তেরো এদিকে রাবেয়া এবার সাতে পা দিল। কাদা মাটি গায়ে মেখেও রাবেয়াকে দেখলে পরির বাচ্চা বলে ভ্রম হয়।
আজকে ওরা বেশ কিছু ধান পেয়েছে। এদিকে সূর্যটা পশ্চিমপাড়ের গাছগুলোর দিকে হেলে পড়েছে। কুসুমের মত লাল সূর্য। বিকেলের এমন পড়ন্ত সূর্য দেখে রাবেয়ার ডিমের কুসুমের কথা মনে পড়ে যায় প্রায়শ। মন চায় মল্লিক বাড়ির মেয়ে জুঁই এর মত কাটা চামচ দিয়েডিমের কুসুমরে মতন করে সূর্যটাকে কেটে খাই। কিন্তু আজ ওসব আকাশ কুসুম চিন্তার সময় নেই। দু ভাইবোন মিলেক্ষেতটা খুঁড়ে শেষ করেছে প্রায়। এক্ষেতে ইঁদুরের এত গর্ত! যেন অভয়আশ্রম। এখন শুধু ধান সংগ্রহের পলা। এদিকে বেলা পড়ে এলে মা ফিরে আসে। ওদের জন্য খাবার দিয়ে যায়। যে কদিন মল্লিক বেিড়তে খন্দ সারবে সে কদিন ওদের তিন জনেরই দুবেলার খাবার আসে ও বাড়ি থেকে। খাবার বলতে পাতিলের নিচে পড়ে থাকা চাচি ভাত আর ডাল কিংবা ঝোল। তাই ওদের কাছে অমৃত। দুপুরের খাবার আসতে আসতে সন্ধ্যে নামে। মা এসে ওদের না পেলে চিল্লাচিল্লি করবে। তাই রাজু বুদ্ধি করে রাবেয়াকে কিছু ধানসহ বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। বাড়ি বেশি দূরেও না। এ চড়া পাড়ি দিলেই বাড়ি। মাঝে একটা আম কাঠালের বাগান। মন্ডলদের বাড়ি ছিল আগে। এখন এখানে কেউ থাকে না। সবাই টাউনে চলে গেছে। ওই বাগানে গ্রামের কৃষকেরা দুপুর বেলায় জিরিয়ে নেয় কিন্তু এখন এই কাজের সময় জিরিয়ে নেবারসময় কই তাদের। রাবেয়া ছোট ছোট পায়ে মন্ডলদের বাগানের পাশে চলে আসে। চারপাশে মানুষজনের চিহ্ন মাত্র নেই। মাথা থেকে ধানের বস্তাটা নামিয়ে একটু দাঁড়ায় সে। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। ভাইজানও হয়ত এতক্ষণে চলে আসছে। দিনের আলো অনেকটা কমে এসেছে। এমন সময় দুজন লোক ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।লোকদুটোকে চিনতে পারে না রাবেয়া। এগ্রামে কখনো এদের দেখেছে বলে মনে পড়ে না। একজন ওর সামনে উবু হয়ে জিজ্ঞাস করে :
কিগো পরির বাচ্চা এখানে তুমি একা একা কী করছ?
বাড়ি যাই।
আরেকজন আদরের নামে গাল টিপে দিয়ে জিজ্ঞাস করে
কী নাম তোমার?
রাবেয়া।
আপনাদের বাড়ি কনে?
মেলা দূর।
তোমার?
ওই পাড়ায়। ওই পাড়া বলতে রাবেয়া যে কোন দিকে ইঙ্গিত করল তা দু আগন্তুক ঠাহর করতে পারে না। কিন্তু আগন্তুক দুজন একে অপরের চোখের ভাষা ঠিকই বুঝে নেয়।
একজন ব্যাগ থেকে একটা পাউরুটি বের করে রাবেয়ার সামনে তুলে ধরে দাত কেলিয়ে জিঞ্জেস করে
খাবে?
রাবেয়া হাত বাড়ায়।
কথায় কথায় নির্জন বাগানের এক কোনায় চলে আসে ওরা তিনজন।
সূর্য পশ্চিমের গাছগাছালির নিচে লুকিয়ে পড়লে ধানের একটা বস্তা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় রাজু। মন্ডলদের বাগানের সামনে এসে রাবেয়ার ছোট ছালাটা দেখতে পায়। তারমানে রাবেয়া এ বস্তা না নিয়েই বাড়ি ফিরে গেছে? নাকি এখনো বাড়ি ফেরেই নাই? সাত পাঁচ ভেবে বস্তাটা কাধে তুলে নেয় আর তখনই বাগানের পাশের ঝোপ থেকে গোঙ্গানির শব্দ পায় রাজু।
বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে ওঠে ওর। ভয়ে শরীর হিম হয়ে আসে। ভুতপ্রেত ভেবে দৌড় দিতে গিয়েও নিজের অজান্তেই এগিয়ে যায় শব্দের উৎসের দিকে। আলো ছায়ার গোধুলির আলোয় দেখতে পায় তার আদরের ছোট বোনটি মাটিতে পড়ে আছে।প্রায় উলঙ্গ।পড়নের ফ্রকটা ছিড়ে গেছে এখানে সেখানে। শরীরজুড়ে আচড়ের দাগ। কাপড়ে লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। পড়নের ফ্রকে রক্ত আর রক্ত। এত রক্ত ও জীবনেও দেখেনি।
সে যাত্রায় বেঁচে গেছিল রাবেয়া তবে মৃত্যুর দূতের সাথে দুস্তর লড়াই করতে হয়েছে তাকে।সেই সাথে সেই এক টুকরা রুটি আর আঘনের বিকেল তার পুতুল খেলার জীবনটাকে ওলোট পালট করে দিয়ে গিয়েছিল । বেশ কিছুদিন হাঁটতেই পারেনি। বিছানার সাথে লেপ্টে গিয়েছিল। মাস তিনেক পর উঠে দাঁড়াতে পারলেও একসময় দেখা যায় প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। যেখানে সেখানে যখন তখন পোষাক নষ্ট করে ফেলছে। তাছাড়া পুরুষ মানুষ দেখলেই কেমন কুঁকড়ে যায়। বিড়ালছানার মত মায়ের কাছে লুকায়। রাজু অনুমান করেছিল তার বোনকে শিয়ালে ধরেছিল কিন্তু মা লায়েলা খাতুন ঠিকই বুঝে যায় কোন শিয়াল কিংবা হায়েনা তার ছোট্ট পরির বাচ্চাটাকে ছিবড়ে খেয়েছে। কিন্তু কীই বা করার আছে তার? তার মত স্বামী পরিত্যাক্ত নারীর আর্তনাত কেই বা শুনবে? কার নামে কার কাছেই বা বিচার দেবে? সে বিচার করার হাকিমই বা কোথায়?তাছাড়া যতই লোক জানাজানি হবে ততই কলঙ্ক রটবে ছোট্ট মেয়েটির নামে। জীবন মরণের সাথে তুমুল লড়াই করে ফিরে আসা ছোট্ট মেয়েটি সেই ভার বইবে কেমনে? কিন্তু খারাপ খবর বাতাসের আগে বয়। ছোট্ট রাবেয়াও মানুষের মুখরোচক আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু হয়। খেলার সাথী হারায়, বাড়ির বাইরে যাওয়ার অধিকার হারায় সেই সাথে হারায় তার শৈশব ও কৈশর। এমন সমাজ পরিত্যাক্ত মেয়ে নারী হলেই বা কী? যার শৈশব কৈশরকেই হায়েনা খেয়েছে তার জীবনে যৌবনের অধ্যায়ই বা থাকবে কেন?
ছোট রাজু বড় হয়ে গেছে। বিয়েও করেছে। লায়েলা খাতুন ইহলোক সাঙ্গ করে পরকালে পাড়ি দিয়েছে। তাদের গ্রাম আর আগের দিনের মত নেই। বিদ্যুতের বাতিতে ঝলমল করে পুরো গ্রাম। রাস্তাঘাটও সব পাকা হয়ে গেছে। গ্রামে শিক্ষিতের হারও বেড়েছে অনেক। তবে রাবেয়া কিংবা রাজুর ভাগ্যকে সে শিক্ষার আলো আলোকিত করতে পারেনি। একটা তাতের মিলে কাজ করে অবশ্য ভালই কামায় রাজু।ভাইয়ের সংসারে প্রথম প্রথম ভালো থাকলেও আজকাল ভাইবউ তাকে খুব একটা সহ্য করতে পারে না। যখন তখন যেখানে সেখানে পোষাক নষ্ট করে ফেলাটাকে সে সহ্যই করতে পারে না। আর পাড়া প্রতিবেশির কাছে তো সে বরাবরই অপয়া, অচ্ছুত। তাই নিজেকে নিয়ে একলা পড়ে থাকা বাদে তার আর কিছু করারও নেই। বাড়ির বাইরের দিকে একটা ঘর তুলে দিয়েছে রাজু। সেখানেই পড়ে থাকে লায়লা খাতুনের পরির বাচ্চা, সমাজ পরিত্যাক্ত রাবেয়া।
একদিন রাতের খাবারের পর রাজু, রাজুর বউ আর একমাত্র মেয়ে তাদের ঘরে টিভি দেখছিল। এই সময়টাতে রাবেয়া গিয়েও বসে তাদের দরজার সামনে। ও ঘরে যাওয়া নিষেধ ওর। তাই দরজার সামনেই একটা টুল পেতে বসে পড়ে রাবেয়া। নাদের চৌধুরীর নাটক হচ্ছে। নাদের চৌধুরীকে ওর খুব পছন্দ। কি সুন্দর দেখতে। একদম রাজপুত্র। এর মধ্যেই রাত ৮টার বাংলা সংবাদের সময় হলে সবাই নড়েচড়ে বসে। রাজুর মেয়েটা ব্রেক টাইমে বাইরে বের হয়। তাকে যায়গা করে দিতে সরে বসে রাবেয়া। হঠাৎ একটা খবরে খুব হইচই শুনে মনোযোগ দেয় রাবেয়া। শিরোনাম শেষ করে বিস্তারিত বলছেন সুন্দরী সংবাদ পাঠক।
প্রথমেই চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের খবর। রাজধানীতে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণ করেছে দুর্বৃত্তরা। ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে মেয়েটি। বিস্তারিত খবরে মেয়ের বাবার ইন্টারভিউ দেখানো হয়। বুক ফাটা আর্তনাত করছেন ভদ্রলোক। কোনো কথাই বলতে পারছেন না। বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন।
আত্মীয় স্বজন ধরে রেখেছেন তাকে।বাবার একমাত্র মেয়ে। ধর্ষিতার মেয়ের বাবার আর্তনাত দেখে রাবেয়ার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয় রাবেয়া। উহু, এ চোখ, এ কণ্ঠ সে কোনোদিনও ভুলবে না। উঠানের মাঝে এসে দাঁড়ায় রাবেয়া। অন্ধকার আকাশকে আলোকিত করে জ্বলতে থাকা লক্ষ কোটি তারার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে ও। ধর্ষিতা মেয়ের বাবার অশ্রু সিক্ত চোখ আর বুক ফাটা আর্তনাতের মাঝেও আঘন মাসের সেই হায়েনাকে চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় না রাবেয়ার। আকাশের দিকে তাকিয়ে দু হাত তুলে অজপাড়া গাঁয়ের ধর্ষিতা রাবেয়া চিৎকার করে বলে, তবে আজ তোমার ব্যর্থতা ঘুচল!
শুরু করলে আর নতুন করে কিছু ভাববার প্রয়োজন নেই। জেগে থাকো, হাঁটো কিংবা বিড়ি খাও…
Ismat Shilpi2025-03-30T20:27:10+00:00March 30, 2025|
কুন্টার মুক্তির আনন্দ
Sumon Biplob2025-03-30T10:38:17+00:00March 30, 2025|
গঙ্গা পাড়ের বৃত্তান্ত
Priyojit Ghosh2025-03-29T12:19:22+00:00March 29, 2025|
আমি ও জ্যোতি পোদ্দার
Jyuti Podder2025-03-30T09:42:15+00:00March 29, 2025|
চন্দ্রাগিরি
Sumanta Gupta2025-03-28T21:29:59+00:00March 28, 2025|
হোয়াইট আর্কেডিয়া এবং মেথুকীর গল্প
Syed Mahmud2025-03-28T21:30:01+00:00March 28, 2025|