“গুলমোহর” ও সুরের রাজনীতি

By Published On: May 21, 2025Views: 24
Image

গুলমোহর” ও সুরের রাজনীতি
ইসমত শিল্পী

সা রে গা মা পা ধা নি সা
সপ্ত সুর, সাতটা মেইন ক্যারেক্টার।

“গুলমোহর” রিলিজ হলো কয়েকদিন আগেই ১৫ মে, ২০২৫ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি-তে। দুদিনের মাথায় দেখেছি। এত ভালো গল্প আর মেকিং যে এক বসাতেই শেষ করলাম সিরিজটি। আর সবার অভিনয়ের প্রসংসা করতেই হয়। এক কথায় দারুণ।

দেখতে দেখতেই ইচ্ছে হচ্ছিল লেখার। ফেসবুকে ইদানিং তাৎক্ষণিক কোনকিছু লিখি নি। তখন থেকেই মূলত দারুণ এক সুরলহরীর লুপে আটকে গেছিলাম। এখনো তার আমেজ কাটেনি।

একটু সেজেগুজে সাজিয়ে লেখার ইচ্ছে থেকে আজ লিখছি। আমার ভাষায়। আমার নিজস্ব মন্তব্য; যেহেতু আমি নামধারী ক্রিটিক নই। যদিও কয়দিন আগে “গার্গি” মুভির উপর একটি পর্যালোচনা লিখেছি- ভারতীয় একটি পত্রিকায়।

তেমন কোন আলোচনায় নেই আমি। সচেতনভাবেই নেই। হতেই পারে এটি আমার অক্ষমতা। তবে যাই হোক, প্রতিযোগীতা এড়িয়ে চলার অভ্যেস!

প্রত্যেক সপ্তাহেয় আমি একাধিক মুভি দেখি। বাইরের দাপাদাপির চেয়ে একা বসে বসে মুভি দেখা দারুণ প্রিয় কাজ। ওকে, “গুলমোহর” নিয়ে কী লিখতে পারি দেখি।

গুলমোহর মূলত বাড়ির নাম। বাড়ির কর্ত্রী গুলবাহারের নামের সঙ্গে মিল রেখেই বাড়ির নামকরণ করা হয়েছে। গল্পটা খুব সুন্দর। রিয়েলিস্টিক। আমাদের কালচারের সঙ্গে এই গল্প সামঞ্জস্যপূর্ণ। সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কথা কাটাকাটি, মনোমালিন্য সব ফ্যামিলিতেই কম বেশি হয়। গুলমোহরেও সেটাই হয়েছে। মসজিদ কমিটির মিটিং এর সিকোয়েন্সটা খুব পছন্দ হয়েছে।

কবুতরের পেছনে ছুটতে গিয়ে একটা স্পেসিফিক একটা জায়গায় থেমে যাওয়ার পটভূমিটাও সুন্দর। গল্পে এই জিনিসটা আলাদা ওজন যোগ করে। ওয়েবসিরিজে গল্পের এমন সাবালিল চলন চোখে পড়ার মতন।

অভিনয়ে আছেন, সুষমা সরকার, মুস্তাফিজুর নূর ইমরান, সারিকা সাবাহ, ইন্তেখাব দিনার, মোস্তফা মনোয়ার, সারা জাকেরসহ আরও অনেক গুণী শিল্পী।

এই সিরিজের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের ওটিটি কনটেন্টে অভিষেক- ওপার বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের। শ্বাশ্বত বরাবরই ভীষণ প্রিয় আমার। তাঁর অভিনীত প্রচুর সিনেমা, সিরিজ দেখেছি। এইসূত্রে একটি বয়ান দিই ছোট্ট করে। শ্বাশ্বত অভিনীত “কেয়ার অফ স্যার” দেখে রীতিমতো নেশা ধরে গিয়েছিল। দু’বার দেখেছি।

“ক্ষমতার দেয়ালে আটকা পড়ে গেছে সম্পর্কের সুর।” আমার মতে রেটিং: ১০/০৯
ভারতীয় একজন অভিনেতা মাতিয়ে দিয়েছেন, তার অভিনয় দিয়ে। পাপ বাপকেও ছাড়ে না, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় এটাই এই সিরিজে উপস্থাপন করেছেন। সত্যের জয় হয় সব সময়। নাম, যশ, আধিপত্য এগুলো সময় সাপেক্ষ, সত্য উন্মোচন একদিন না একদিন হয়ই।

এই পৃথিবী কারও একার নয়,
তবু কাগজে নামে নাম—
যারা হারায় ঘর; তারা হারায় অধিকার,
থাকে শুধু নিয়তির, অশ্রুসিক্ত ঘাম।

“গুলমোহর” শুধু উত্তরাধিকার নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বের গল্প নয়। গুলমোহর তাদের জন্য — যাদের ঘর নেই। যাদের জমি কাগজে ছিল না, তাই ইতিহাসে নেই! এই গল্পে যে দাহ জাজ্বল্যমান তা, নদীর বুকে চরের জমি উচ্ছেদের আহাজারি, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভস্মীভূত বাড়ি দুমড়ে পড়ার শব্দ কিংবা আকস্মিক আক্রমণের পর জীবন রক্ষার্থে কাঁটাতারের নিচ দিয়ে পালাবার সময় উদ্বাস্তুর দীর্ঘশ্বাস।
গুলমোহর এর গল্পে ডুব দিলে মনে হবে— এই তো, রাজশাহী বা ফরিদপুরের কোনো পুরনো জমিদার বাড়ির পুকুরপাড়ের উঠানে গিয়ে উঠলাম। বাড়ির মুরুব্বি, বাবা মারা গেছেন, সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ নিয়ে টানাটানি। কিন্তু গল্প যত এগোয়, ততোই বোঝা যায়, এটা শুধু বাপ-দাদার জমি নিয়ে টানাটানি না— এটা আসলে মাটি নিয়ে লড়াই। কিন্তু এই মাটি কার? কাগজের ভাষায় যা ছেলেমেয়েদের, বাস্তবে কি তাই?

Gulmohor

গুলমোহরের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক তার ‘hidden history’ এলিমেন্ট। অনেকগুলো রিডলস আনফোল্ড হতে থাকে ধীরে-ধীরে— কে কাকে ফাঁকি দিয়েছিল, কে কার জমি বিক্রি করে দিয়েছিল, কে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। এই ‘মিসিং লিঙ্ক’-গুলো খুঁজতে খুঁজতেই গুলমোহর আমাদের নিয়ে যায় সেই মানুষের কাছে, যারা একদিন এই গুলমোহরের ছায়ায় সু্রে-সুর বেঁধে জীবনের গীত গাইতো!
বাংলাদেশ,পার্বত্য বাংলাদেশ, প্রতিবেশি দেশ, ফিলিস্তিন, ইউক্রেন; বা যেকোনো ভূখণ্ড যেখানে হাজারো মানুষ ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে, সেখানের এই গল্প; একটা নীরব চিৎকার। এটা কোনো হারিয়ে যাওয়া সুর নয় বরং জোর করে ছিনিয়ে নেয়া কন্ঠের হাহাকার!

“যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,
কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়
———————————-
শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়—”

তখন আমায় ভুলেও কি মনে রাখবে?
গুলমোহর শুধুই পারিবারিক থ্রিলার নয়। এটা একধরনের স্মৃতিচিহ্ন— যেখানে প্রত্যেক গাছ, দেয়াল, কাঠের কেদারা, সুরহীন তানপুরা হয়ে উঠেছে এক জবরদস্তির অবর্ননীয় জিল্লতের জ্যান্ত উদাহরণ। আর ঘরহারা মানুষের চোখে দেখলে, “গুলমোহর” শুধু সিরিজ নয়— এটা তাদের একটুখানি ঘরের খোঁজ। এই সিরিজ নির্মাণের পেছনের সবাইকে প্রশংসা। প্রোমোশন-ম্যাটেরিয়ালসে আরো ভালো করার সুযোগ ছিল; নির্মাতারা, বিষয়বস্তুর রাজা

আমার মনে হয়, একজন পরিচালক যখন একটা সফল কন্টেন্ট বানান এবং তার পরবর্তী কন্টেন্টগুলোকেও যদি আমরা সেই পূর্ববর্তী কন্টেন্টের সাথে তুলনা দিতে থাকি, সেটা ভুল জাজমেন্ট। প্রথমত, তার বানানো সব কন্টেন্টই সফল হবে না। দ্বিতীয়ত, সে তখন এক্সপেরিমেন্ট করার সাহস হারাবে, পপুলিস্ট ঘরানার একটা সেট প্যাটার্নে চলার চেষ্টা করবে। সৈয়দ আহমেদ শাওকী সেটা করেননি। ‘গুলমোহর’ শাওকীর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে এক্সপেরিমেন্টাল কন্টেন্ট। তাই এই কন্টেন্ট দেখার সময় একটা ‘তাকদীর’ কিংবা ‘কারাগার’ এর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে পুরোপুরিভাবে।

বাড়ির নাম গুলমোহর। বাড়ির কর্ত্রী গুলবাহার বেগমের নামে বাড়ির নামকরণ করেছিলেন তার শ্বশুর। গুলবাহার বেগমের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। বাবার মৃত্যুতে পরিবারের সবাই একত্রিত হয় উত্তরাধিকারের দাবী ও ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে। পরিবারের সম্পর্কের বাঁধন আলগা করে ক্ষমতার লোভ। কাটতে থাকে সম্পর্কের সুর। এমনই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এগিয়েছে গুলমোহরের গল্প।

বাংলাদেশের ওয়েব দুনিয়ায় ভালো কন্টেন্টের কারিগরের মধ্যে যাদের নাম প্রথম দিকে থাকবে তাঁদের একজন সৈয়দ আহমেদ শাওকী। ‘তাকদীর’ এ থ্রিলার, ‘কারাগার’ এ মিস্ট্রি ড্রামার পর এবার শাওকী ‘গুলমোহর’ সিরিজে বেছে নিলেন ফ্যামিলি ড্রামা ও মিস্ট্রি।

আট পর্বের এই সিরিজের নামগুলোর সাথে মানবিক সম্পর্কের সুরগুলো যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা বেশ সুন্দর। পাশাপাশি পারিবারিক দ্বন্দ্বের আড়ালের নোংরা রাজনীতি, লোভ, ক্ষমতা, পাপের প্রতিফলের বিষয়গুলো দারুণভাবে মেটাফোরিক্যালি তুলে ধরা হয়েছে। সংলাপগুলোও বেশ বাস্তবিক।

সিরিজের কাস্টিং এবং তাদের পারফরম্যান্স বেশ ভালো। বিশেষ করে মোস্তাফিজুর নুর ইমরান ও জিসান নিজ চরিত্রে সপ্রতিভ। সারিকা সাবা, সুষমা সরকার ও ইন্তেখাব দিনার- সবাই কনভিন্সিং ছিলেন নিজেদের চরিত্রে। তবে স্বল্প সময়েও জাদুকরী পারফর্ম করেছেন ওপার বাংলার শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়।

টেকনিক্যাল দিক থেকে সিরিজটা বেশ রিচ। সিনেমাটোগ্রাফি, মিউজিক, কালার গ্রেডিং এবং আর্টের কাজ বেশ ভালো। তবে মন্দ লাগার মতো জায়গাও আছে বেশ কিছু। সিরিজে অনেকগুলো সাবপ্লট আনলেও সেগুলোর সমাধান মেলেনি। এছাড়াও গল্পটা এগিয়েছে অনেকটা ঢিমেতালে, যদিও শেষটা বেশ তাড়াহুড়োয়। এছাড়া চরিত্রগুলোর প্রতি না কাজ করে কোনো মায়া, ক্যারেক্টারগুলোর সাথে দর্শকের কানেকশান বিল্ডআপটা হয়ে ওঠেনি ভালোভাবে। প্রথম এপিসোডের জানাজার দৃশ্যটাও কনভিন্সিং নয়। থিমটা সুন্দর হলেও প্রেজেন্টেশনে খুঁত চোখে পড়বে। তাই পরিবারের পাশাপাশি গল্পের সুরও কেটেছে মাঝেমধ্যে।
তবে সৈয়দ আহমেদ শাওকীর অ্যাভারেজ কাজও অন্য অনেক পরিচালকের ভালো কাজের তুলনায় অনেকগুন ভালো।

‘কারাগার’ ও ‘তাকদীর’-এর খ্যাতনামা পরিচালক সৈয়দ আহমেদ শাওকীর নতুন ওয়েব সিরিজ — “গুলমোহর”। যেকোন বিষন্ন বিকেলের সঙ্গী হতে পারে তাই খুব সহজেই…

ইমরান আর জিসানের জন্য ভলোবাসা
অন্যদের পাশাপাশি অপহৃত হওয়া চশমা পরা পিচ্চি— ওর ভাবসাব চোখে লেগে রয়েছে।

‘গুলমোহর’এর হারিয়ে যাওয়া সুর কি ফিরবে আবার?
রেওয়াজের সুর প্রতিধ্বনিত হোক প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে।

“গুলমোহর”-এর সুর পৌঁছে যাক ঘরে ঘরে, সবার কাছে!!

পরিচালককে ধন্যবাদ। শুভকামনা এই ওয়েব সিরিজ এর সহশিল্পী ও কলাকুশলীদের।

ইসমত শিল্পী
কবি, প্রাবন্ধিক
সম্পাদক নান্দিক
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments