হ্যামিলটনের হাবিল-কাবিল

By Published On: March 28, 2025Views: 37

হ্যামিলটনের হাবিল-কাবিল
মোশতাক আহমদ

কানাডার অন্টারিও প্রদেশের হ্যামিলটন শহরে এরশাদের বাড়ি, নায়াগ্রা প্রপাতের কাছেই। এরশাদের বাড়ি আসার আগেই নূতন—মাসুদ  ভাইয়ের বাড়ি থেকে বন্ধুদের বড় দলে এসে একবার নায়াগ্রা দেখা হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল আরেকবার যদি যেতে পারতাম কিছু স্যুভেনির কিনে আনা যেত। সোনিয়ার জন্যে একটা ঘড়ি কিনতে পারলেও ভালো হয়। প্রথমদিন এরশাদ আর রাভী তো আমাকে রেখে অফিসে গেল, বাচ্চারা স্কুলে। কোথায় কোন খাদ্যবস্তু আছে, কীভাবে গরম করতে হবে, বাইরে গেলে কীভাবে তালা লাগাতে ও খুলতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি লিখে আমার তলকুঠুরির দরোজায় একটা রঙিন নোটিশ টাঙ্গিয়ে রেখে গেছে। বেলা করে উঠে খানাখাদ্যের সদ্ব্যবহার করলাম।  ভাবলাম, একটু হেঁটে আসা যাক। আমার বন্ধু বলেছে, এ দেশে নাকি একা রাস্তায় ছেড়ে দিলে কানার ভাই আন্ধাও পথ হারায় না। অভ্যাস হল, বিকেলে অফিস ফেরত মিতালী লণ্ড্রী, ভাই ভাই স্টোর, মহব্বতের চায়ের দোকান,  বরিশাল ফার্মেসিতে ঢুঁ মারা। বিকেলে ঠাণ্ডায় ছাতা হাতে ধরাচুড়াসহ হ্যামিলটনের পাড়ার দোকানে ঢুঁ মেরে এলাম। পাড়ার দোকান খুঁজে পেতে অনেক হেঁটে বড় রাস্তায় যেতে হলো। আবারো টিম হর্টনের কফি। টিম হর্টন ছিলেন কানাডার বিখ্যাত হকি প্লেয়ার। অবসরের পর ১৯৬৪ সালে তিনি একটা কফি শপ খোলেন। এখন এই কফি শপ ছটিয়ে পড়েছে মাশরুমের মত। কফিমাতাল জাতের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে এই Tim Hortons.স্কারবোরোর এক টিম হর্টনেই দেখা হয়েছিল কবি ফেরদৌস নাহারের সাথে। তিনি উপহার দিয়েছিলেন তাঁর ‘কফি শপ’ নামের চমৎকার একটা গদ্যের বই।

সন্ধ্যায় ফিরে এরশাদ নিয়ে গেল চ্যাপ্টারস নামের বুক স্টোরে।প্রাণ জুড়িয়ে গেল চ্যাপ্টারসের বইয়ের শোভায়, ঘ্রাণে। কবিতার বই খুঁজতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি। আমার বন্ধু বই বিক্রেতাকে বলছে, ইনি স্বদেশের একজন খ্যাতিমান কবি, নানা দেশের কবিতা অনুবাদও করে থাকেন; এবারে তোমাদের দেশ থেকে বই নিয়ে গিয়ে অনুবাদ করবেন! দৌড়ে এল দুজন। কবিতার বই দেখি আর আড়চোখে ডলারে লেখা দাম দেখি। জানি মহাকবির পরিচয়ে ডিসকাউন্ট মিলবে না। শেষে একটা সমকালিন কেনেডিয়ান কবিতা সংকলন নিলাম, ৫০ জন কবির কবিতা আছে জীবনী সহ; দাম ২২ ডলার পড়ল। পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে, কেনেডিয়ান কবিরাই সবচেয়ে কঠিনভাবে কবিতা লিখেছেন। অবশ্য কয়েকটা কবিতা পেয়েও গেছি অনুবাদ করার জন্য। সামনে ক্রিসমাস বলে সব মল বা দোকানই ক্রিসমাসের সাজে সাজছে, সান্টা ক্লজ কোথাও এসে গেছে, কোথাও বা সান্টার আগমনের প্রস্তুতি চলছে। লাইব্রেরিতেও লাল সবুজ কাভারের বইগুলো দিয়ে একটা কর্নারে ক্রিসমাসের আবহ আনা হয়েছে। রাতের আহারের পর এরশাদের সাথে লং ড্রাইভ। পরদিন সকালে উঠে এরশাদ তার হাসপাতালে একটা সিক কল দিয়ে ফেলল; মানে আজ সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অফিসে যেতে পারছে না। আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। এখানেই ফিস এন্ড চিপস দিয়ে ব্রেকফাস্ট হলো, কফি পর্ব শেষে পুরো ইউনিভার্সিটি ঘুরে দেখলাম। সারা পৃথিবী থেকে ছাত্র ছাত্রী এসেছে। চীনা ছাত্ররা ‘বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং’ করতেও চলে আসে। এরপরে পার্কিং-এ অতিরিক্ত সময় গাড়ি রাখার দণ্ড নিয়েএরশাদ যখন নিজের ওপর বিরক্ত, তখন ওকে মনে করিয়ে দিলাম সতীনাথের কোন গানগুলো ওর গলায় ভালো খেলতো।

সতীনাথের মেঘমেদুর কন্ঠের মতোই একটা দিন আজ। গাড়িতে সতীনাথ চলল, আর গরীবের সতীনাথ হ্যামিলটনের আরো কিছু দর্শনীয় জায়গা ঘুরিয়ে দেখাল, এর মধ্যে ওয়েবস্টার ফলস ছিল সবচেয়ে মনকাড়া নিসর্গ। ঝরনা আছে, ঝোরার উপর পাথুরে সেতু আছে, চারপাশে নভেম্বরের কঠিন শীতেও মাথা তুলে আছে সবুজ।

সবকিছুই ছোট ছোট সংরক্ষিত, সুরক্ষিত;তাই সিলেট আর কক্সবাজার বেড়ানো—চোখে ঠিক প্রাকৃতিক লাগে না। আমার দেশের মতো নয়। কোথাও সেতু দেখলে আমার ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে যাবার পুরনো ব্যারাম আছে। স্বভাবতই সেটা মাথা চাড়া দেয়।
ডানডার্ন ক্যাসেলে গেলাম দুপুরের দিকে। ১৮১২ সালে কানাডার সাথে আমেরিকার যুদ্ধ হয়, সে যুদ্ধের কথা আমেরিকা ভুলে যেতে চাইলেও কেনেডিয়ান ইতিহাসে তা এক গৌরবময় অধ্যায়। যুদ্ধের কৌশলগত অঞ্চলটি ঘুরে দেখলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাহাজ হাইডা দেখতে গেলাম; কিন্তু উনি শীতকালীন বিশ্রামে গেছেন অন্যত্র। পুরনো আরো কিছু জাহাজ নোঙ্গর করা ছিলো। রাতে চললো ক্যাসিনো অভিযান। পাশের শহরে নৈশ অভিযানটাই রোমাঞ্চকর ছিল, খেলতে যেহেতু পারি না, অল্প কিছু পয়সা গচ্চা দিয়ে ফিরে এলাম। ক্যাসিনোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় হয়। ক্যাসিনোর আয় সরকারি কোষাগারে যায়। ক্যাসিনোটা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ঢাকা। ক্যাসিনোতে শুধু গচ্চাই গেল তা নয়, একটি কবিতা নিয়েও ফিরেছিলাম—

ক্যাসিনো টেবিলে
ঝর ঝর ঝর
স্মৃতির মুদ্রা!

তুষার শহরে
ধরাচূড়া কাঁপে
হেই সামালো!

মুদ্রা ঝরিতেছে
জিতেই যাচ্ছি বুঝি
এ খেলায়!

বিপুল দিলখুশ
মুদ্রা ঢেলে যাই
ভাগ্যচাকায়!

যা কিছু বিজিত
খেয়ে নিল সব
মুদ্রারাক্ষুসী!

ক্যাসিনো টেবিলে
ঝর ঝর ঝর
স্মৃতির মুদ্রা!
(জুয়া)

আমার সাথে গুণদার একটাই পার্থক্য; ক্যাসিনো থেকে তিনি ডলার নিয়ে ফিরেছেন আর আমি কবিতা নিয়ে ফিরেছি। আর হ্যাঁ, ওরা বিনে পয়সায় এক পেয়ালা শরবতও পান করিয়েছিল!

পরদিন লন্ডন থেকে সাদী এসে হাজির। এই লন্ডন বিলেতে নয়, এটাঅন্টারিও প্রদেশেরই একটা শহর। আমার সহকর্মী মীনা আপা ফেসবুকে আমাকে এদিকে দেখে ফোন করে বলেছিলেন, তিনি লন্ডনে আছেন, আমি সময় পেলে যেন দেখা করি। ভ্যানকুভারের কনফারেন্সে তিনি অল্প সময়ের জন্য এসেছিলেন, কিন্তু আমার সাথে দেখা হয়নি। আমি হয়তো গিয়েছিলাম গ্র্যানভিল আইল্যান্ডে। এদিকে আমি জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের এলামনাইদের সাথে কফির দাওয়াত কবুল করে ফেলেছি, যেতে হবে টরন্টো। সাদীই নিয়ে যাবে। তাই মীনার সাথে দেখা হলো না। দেখা হলো শুভ্র, সাদিয়া তন্বী, ডায়ানা, তানভীর আর অন্তরাদের সাথে। রাতে এরশাদের বাসায় ভোজ ছিল। নূতনের বাসায় যেমন নিখিল উত্তর আমেরিকান বন্ধুরা জুটেছিল, এরশাদের বাসায় তেমনটি না হলেও নিখিল অন্টারিওবাসীর উপস্থিতি ছিলো। দুই ভোজ নিয়ে আলাদা করে লিখবো, পাছে না আবার খাবারের চাপে এই রচনাটি তরলীকৃত হয়ে যয়।

আট বছর পরে লিখতে বসে দিনক্ষণ—স্থান—পাত্র একটু এদিক ওদিক হতে পারে। কিন্তু সাদীর গাড়িতে করে যে হ্যামিলটনের প্রথম স্কুলটি দেখেছিলাম সেটা মনে আছে, কিছুটা গথিক গির্জার স্থাপত্যে গড়া সেই স্কুল— তাও মনে আছে। সাদী আমাকে খুব আগ্রহ নিয়ে স্কুলটা দেখিয়েছিলো, কেননাএইস্কুলেইওরকন্যারপ্রথমস্কুলিংহয়েছিল।ত্বরিতরাস্তা পার হল এক কাঠবিড়ালি। কানাডার তিনটি শহরেই দেখলাম কাঠবিড়ালিদের অভয় আশ্রম। এরশাদ কয়েক বছর আগে ঢাকায় আমাকে কানাডা ভ্রমণের লোভ দেখিয়েছিল এইভাবে—বন্ধু, পার্কে কাগজ কলম নিয়ে বসে থাকবা সবুজ ঘাসের ওপর, আর দেখবা কাঠবিড়ালি বা খরগোস আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে।

কবিতা না লিখে তোমার উপায় নাই! কাঠবিড়ালি দেখিলাম, কিন্তু বিড়াল দেখিলাম না! পাকিস্তান আমলে চীন ঘুরে এসে একজন রাজনীতিবিদ লিখেছিলেন, “কিন্তু কোথাও বাঘ দেখিলাম না!” ওনার হয়তো ধারনা ছিলো চীনে পথেঘাটে বাঘ ঘুরে বেড়ায়। এই ঘটনাটা ফয়েজ আহমদ লিখেছিলেন কোথাও।

এই অঞ্চলে বিড়াল পোষার নিয়ম পাশ হচ্ছে না, কেননা একটা পর্যায়ে বিড়ালেরা স্ট্রে ক্যাট অর্থাৎ পথের বিড়াল হয়ে যায় যা কিনা আইনের চোখে অন্যায়! গলায় চেনবাধা কুকুর, কুকুরছানা দেখা যায় বেশ, এগুলোর অধিকাংশ অভিভাবকই বুড়ো বুড়ি। কুকুরকে গ্রুমিং করতে, মানে লোম নখ কাটতে, শ্যাম্পু করাতে, পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে খরচ করছে অফুরন্ত ডলার। গেলাম গোর পার্কে। এটা একটা ব্যস্ত চৌরাস্তা এলাকা। এই চৌরাস্তায় রাণী ভিক্টোরিয়ার ভাস্কর্য আছে। রাণীর মাতৃ ও স্ত্রীরূপকে এখানে বড় করে দেখানো হয়েছে। গোর পার্ককে বাঙালীরা বলে ‘ঘুরপাক’, কেননা এটি হ্যামিল্টনের গুলিস্তান।

সন্ধ্যায় সাদীর সাথে জলপ্রপাত যাবার পথে Upside down homeদেখতে গেলাম। নায়াগ্রার এই বাড়িতে টিকেট করে ঢুকতে হয়। উলটা বাড়ি। ভেতরের রুমগুলোও উলটা করে সাজানো। ঢোকার একটু পরেই মতিভ্রম শুরু হয়! বেডরুমে ঢোকামাত্র টেলিফোনে একটা ম্যাসেজ আসে! হরর মুভির দর্শকের মতো আত্মারাম। ততক্ষণে উল্টাগীতের শ্রোতা—দর্শকের অবস্থা বেহাল। টলতে টলতে নিচে নেমে দেখি সাদি এক লম্বা হাসি নিয়ে অপেক্ষা করছে। রাতের নায়াগ্রা ঘুরে ঘুরে দেখছি। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। বঙ্গবাজারের বাংলা টুপিতে কান আর মাথা মানছে না। হুজুগে কোন জাতি না পাগল! ক্রিসমাসের আগে ব্ল্যাক ফ্রাইডে উপলক্ষ্যে বিরাট মূল্য হ্রাসের সুযোগে কেনাকাটার ধুম! ঘড়ি পছন্দ হয়, কিন্তু দাম দেখে দমে যাই। সব ঘড়িতে ছাড় দেয়নি। ঘড়ি কেনা হলো সেই ডিসকাউন্টের সুযোগেই! সাদী অনেকগুলো স্যুভেনির কিনে দিল। স্যুভেনির কিনতে নিজের পয়সা কমই খরচ হলো। আগের সপ্তাহে নূতন আর শায়লা কিনে দিয়েছিল। সাদী আমাকে কোনো একদিন দিনের বেলায় আর্ট গ্যালারীতে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯২০ সালে কানাডায় গ্রুপ সেভেন নামে আর্টিস্টদের একটি দল শিল্প আন্দোলন শুরু করে, প্যারিসের শিল্পীদের মতোই।তার ধারাবাহিকতায় কানাডায় আধুনিক শিল্পকলার যাত্রা শুরু। সাদী পরে আমাকে লিখে পাঠিয়েছিলো- ‘শিল্পীদের দলটি গ্রুপ অফ সেভেন বা এলগনকুইন স্কুল নামে পরিচিত, ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যেচিত্রশিল্পীদের একটি গ্রুপ ছিল, মূলত ফ্রাঙ্কলিন কারমাইকেল, অনিকের হ্যারিস,উ ওয়াই জ্যাকসন, ফ্রাঙ্ক জনস্টন, আর্থার লিজমের, জেইএইচ ম্যাকডোনাল্ড এবং ফ্রেডেরিক ভার্লেই মিলে দলটি গড়ে উঠেছিল।

তাদের বিশ্বাস ছিল যে কানাডিয়ান প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র কানাডিয়ান চিত্রশিল্প গড়ে তোলা যায়, এবং এরাই প্রথম প্রধান কানাডিয়ান জাতীয় শিল্প আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। তাদের বেশ কিছু চিত্রশিল্প আর্ট গ্যালারি অফ হ্যামিল্টনে আছে।

‘ভেতরে গ্যালারির পর গ্যালারি, স্থাপনা শিল্প, আধুনিক শিল্পীদের প্রদর্শনী চলছে। পরীক্ষা নিরীক্ষার ছাপ আছে। গ্যালারির কিউরেটর দর্শক সম্পর্কে, চাহিদা সম্পর্কে জানতে চায়। সাদী আমাকে সেখানে কী বলে পরিচয় করিয়ে দিল তা বলে বেড়াবার মত নির্লজ্জ আমি হইনি। বাইরের সবুজ মুক্তাঙ্গনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাস্কর্য—নারীর, পুরুষের। কৌতূহল বোধ করলাম একটি ভাস্কর্য দেখে, সেটা হাবিল কাবিলের ভাস্কর্য। একটা নিদারুণ সেলফিতে ফ্রেমবন্দি হলো আমাদের দুজনের পিছনে কাবিল, তাঁর সহোদর ভাই হাবিলকে হত্যায় উদ্যত—নারীরকারণেপৃথিবীর প্রথম খুনী ও তার শিকার।

0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments