হনন

By Published On: June 6, 2025Views: 20
Image

গল্পের সূত্রপাত ও মূলবক্তব্য:
পাশ্চাত্যের বেশ কিছু দেশের দুগ্ধ খামারে যে সকল গাভী লালনপালন করা হয়, সেখানে কোনো কোনো গাভীর সদ্যোজাত বাছুরকে জন্মলগ্নেই মেরে ফেলা হয়, এতে নরম চামড়ার প্রয়োজন পূরণ হয়, উন্নত রেস্তোরাঁর জন্য বিশেষ মাংস, সেইসঙ্গে গাভীর দুধের কোনো অংশীদার থাকে না। কয়েক বছর আগে বিষয়টি পশু অধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণায় উঠে এসেছিল। মানুষ সোচ্চার হয়। সেরকম এক আউটলাইনকে সামনে রেখে এই গল্পের প্লট-সেটআপ ও এনডোমেন্ট। গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড বিদেশি ফার্ম হাউস, চরিত্রের নাম, সেটআপ, কথোপকথন ও ঘটনাপ্রবাহ তেমনই সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার চেষ্টা আছে। ছোটগল্প: হনন। শব্দ সংখ্যা: ১৮৪৫। প্রমিতরীতি বানান।

হনন
মাহবুব আলী

ডেরিক হাতুড়ি জোর দিয়ে উপরে তুলেছে, এবার যেভাবেই হোক কাজ সেরে ফেলবে; সহসা চোখে ভেসে উঠল অন্যকোনো দৃশ্য। সে পারবে না। কোনোভাবেই পারবে না। লিসার নয় মাস পেরিয়ে গেছে। বেচারা ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। তার গর্ভে দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে শিশু। ডেরিকের স্বপ্ন। তার সন্তান। ডেরিকের হাত থেকে আলগোছে হাতুড়ি নিচে নেমে আসে। সে এখন কী করবে? তার চেহারা আকস্মিক ভাবলেশহীন অসহায় হয়ে পড়ে। ওদিকে বোবা প্রাণিটা নিশ্চিত মনে তাকিয়ে আছে। বড় করুণ দৃষ্টি। তার প্রসবদ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে প্রায়। আঠালো তরলের রেখা ঝুলে আছে। সে গোঙাচ্ছে। তার চোখের কোণে কি অশ্রুর দাগ? একটি জীবন একটি উপলব্ধি। গাভীরও কান্না আছে। স্বপ্ন দেখে। মানুষের মতো মায়ামমতা মানঅভিমান রাগ সন্তোষ আছে। মানুষ কেন তবে বিশাল খামার করে শেকল আর দড়িতে বেঁধে রাখে? মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কি এই? ডেরিক জানে না। সে ভাবতে চায় না। তাকে কাজ করে জীবনযাপন করতে হয়। তার কাজ হলো দায়িত্ব। এখন এমন কাজ কীভাবে করবে? করতে পারবে? সে ভীষণ করুণ দৃষ্টিতে যুগপত অবলা প্রাণি আর হাতুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে।

এই খামারে অনেক গাভী। প্রায় তিরিশ-চল্লিশ। সেগুলো ছেড়ে দেওয়া থাকে। নিজেদের শরীরের ভারে দূরে কোথাও যেতে পারে না। বিশাল মাঠে চরে বেড়ায়। প্রয়োজনে একটি-দুটি খাঁচায় নেওয়া হয়। শক্ত খুঁটিরর সঙ্গে বেঁধে রেখে কাজ চলে। দোহন। ভ্যাকসিনেশন। আর্টিফিসিয়াল ইনসেমিনেশন। ইত্যাদি। ডেরিক ইনসেমিনেশনের কাজ করে। একটি লম্বা গ্লাভসে ডানহাত পুরো ঢেকে গাভীর জরায়ুতে বীজ বপন। কাজটি ভালো লাগে না। সারাশরীর ঘিনঘিন করে। উপায় নেই। কাজ। পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের পছন্দের চাকরি পায় না। কেউ কেউ বেকার জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। কষ্টের জীবন। সরকার যৎসামান্য ভাতা দেয় বটে, পরিমাণ ভিক্ষের মতো; সেই তুলনায় অনেক ভালো আছে ডেরিক। সপ্তাহ শেষে শনিবার উইকলি পেমেন্ট হাতে পায়। লিসার জন্য দামি ফলমূল আর ওষুধপথ্য কেনে। ওইদিন ঘরে রিচফুড রান্না হয়। আজকাল রেস্তোরাঁ থেকে প্যাকেট করে নেয়। লিসাকে কিচেনে বেশিক্ষণ রাখতে দিতে চায় না। ডেরিক তার নিজের কাজ আর চাকরি নিয়ে খুশি কি না, সেই জিজ্ঞাসার তুলনায় লিসার অসন্তোষ নিয়ে বেশি কুণ্ঠিত; কখনো মন খারাপ হয় তার। এবার অন্যকোনো সুযোগ পেলে চাকরি ছেড়ে দেবে। ডেরিক সবসময় এমনই ভেবে নেয়, কিন্তু আরেকটি চাকরি পাওয়া ততখানি সহজ নয়; ইদানীং নতুন দায়িত্ব কাঁধে আসার পর ভাবনা-দুর্ভাবনা আচ্ছন্ন করে রাখে সবসময়। কোনো পথ পাচ্ছে না। সে অসহায়ের মতো গাভীটার দিকে তাকিয়ে থাকে। জন একটু দূরে কাজ করছে। সে ব্যস্ত সত্ত্বেও সবকিছু লক্ষ্য শেষে চেহারা কঠিন করে নেয়। এমন কোমল আর নাজুক মন নিয়ে কাজ করতে পারবে না ডেরিক। জন তারপরও ওর হয়ে কাজ করতে পারবে না। খামারের চারিদিকে সিকিউরিটি ক্যামেরা বসেছে। কে কীভাবে কাজ করে নাকি একপাশে অলস বসে সিগারেট টানছে সবকিছু মনিটর হয়। অফিসার রেকর্ডেট ভিডিও দেখে। সুতরাং জন কোনো রিসক্‌ নিতে চায় না। সে পুবে তাকিয়ে একনজর দেখে নেয় মাত্র।


লোহার বিশাল গেট খোলা হচ্ছে। বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বুঝি শহরের কলরোল ভেসে আসে। পিকআপ মৃদু গর্জন দিতে দিতে বড় রাস্তায় বেরোয়। পিকআপে রয়েছে কুড়ি-বাইশটি ড্রামভরতি দুধ। সেটি বাঁয়ে মোড় নিতে নিতে উইন্ডস্ক্রিন থেকে রোদের ঝলক প্রতিসরিত হয়ে চোখে লাগে। ঝলসে উঠে চারপাশ। জন আরও একবার তাকায়। গাভীটি খুব শিগ্‌গির বিয়োবে। ডেরিক তেমনই নির্জীব বসে আছে। তার হাতে ধরা হাতুড়ি গলে পড়া পনিরের মতো ঝুলে পড়েছে। সে বোধকরি আজও পারবে না। জন কি তার হয়ে কাজটি পুনরায় করে দেবে? সে এইসব ভাবনার মধ্যে শুকনো খড় আর তাজা ঘাস কুচির সঙ্গে চাউল-গম-ভুট্টা গুড়ার বিবিধ পেস্ট মেশাতে শুরু করে। সেখান থেকে চিৎকার দেয়, –
‘কি ডেরিক, পারছ না? তোমাকে পারতে হবে ম্যান। ইউ হ্যাভ টু ডু ইয়োরসেল্‌ফ।’
‘আই ক্যান্‌ট জন। আই ক্যান্‌ট।’
‘তোমার দয়ার শরীর হে! বীজ বপন করতে পারো শুধু। অপদার্থ!’

জন পুনরায় খামারের শেডের ভেতর চলে যায়। জুলি এক এক করে গাভীগুলোর বাঁট থেকে সাকারগুলো খুলে নিচ্ছে। স্টেইনলেস স্টিলের পাইপগুচ্ছের ভেতরের ভেলভেট রাবারে দুধ লেগে থাকে। এখনো খামারে রোবোটিক মিল্কিং শুরু হয়নি। একটি গাভী থেকে দুই মিনিটে এক লিটার দুধ দোহন হয়। পাঁচ-সাত মিনিটেই কাজ শেষ। জুলির কাজ চলে কুড়ি থেকে তিরিশ মিনিট। তার নিতম্বের ভারী ভাঁজ কম্পনের তালে তালে এত দূর থেকেও অনেক স্পষ্ট দেখা যায়। জুলি আজও দেখে গাভীগুলোর বাঁট চুপসানো আর প্রত্যেক বৃন্ত রক্তাভ হয়ে আছে। এ আর এমন কি!

আঠালো পিচ্ছিল তরলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে একটি প্রাণ। শুভ্র সাদা আর কালচে লোম দেখা যায়। একটি প্রাণ। একটি জীবন। ঈশ্বরের মহিমা। ডেরিক কী করবে? কী করতে পারে সে? সে হাতুড়ির হাতলে হাতের পাঁচটি আঙুল জড়িয়ে নেয়। কবজি শক্ত করে। তখনই লিসার শরীর পুনরায় ভেসে ওঠে।

পিকআপ বোধকরি এতক্ষণে ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে গেছে। সেখানে তৈরি হয় পাস্তরিত দুধের প্যাকেট। বাটার-পনির আর সুস্বাদু ইয়োগার্ট। আজকাল এসবের মধ্যে যোগ হয়েছে আরও নতুন নতুন প্রোডাক্ট। এই খামার থেকে দেড় মাইল দক্ষিণে শুরু হয়েছে লেদার প্রসেসিং অ্যান্ড ইউসফুল কমোডিটিস উইং। সেখানে তৈরি হয় চামড়ার রঙিন শিট, জুতো-স্যান্ডেল-ব্যাগ আরও কত কি। একদিন চমৎকার লেডিজ ব্যাগ দেখেছে জন। কি মোলায়েম তার চামড়া! হাতের সূক্ষ্ম কারুকাজ আর রঙের বাহার। কে বলবে এখানে জীবন-মৃত্যুর কান্না লুকিয়ে আছে। ডেরিক প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না। এসবও হয় নাকি? সে অনেক বোকা। জন কি তেমনই ছিল? সেও বোকা। কাজ করতে করতে শিখেছে। মানুষ নিজের অস্তিত্বের জন্য কতকিছু করে যা পছন্দ করে না। জীবিকা কিংবা অন্য কারও পছন্দে নিজের রুচি নৈতিকতা কতকিছু বলি হয়ে যায়। মানুষ বাধ্য হয়। সময়ের অপেক্ষা শুধু। ডেরিকের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। পুওর ডেরিক!

কয়েকদিন আগে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। গোঁধূলির অস্তরাগে পাশের চিকন নদী বেয়ে গড়িয়ে আসা মৃদুমন্দ বাতাস বড় অদ্ভুত ছিল। কোনোদিন ডেরিকের ডেরায় এসে পড়ে জন। সিলভি সঙ্গে থাকে। সে লিসার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে।
‘লিসা নিশ্চয়ই তোমার টুইন হবে। আমি এত বড় পেট কারও দেখিনি।’
‘কি জানি সব ভগবানই জানেন।’
‘জানো সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম, কোন গ্রামে এক মহিলা একসাথে চারটি শিশুর জন্ম দিয়েছে। একজনকেই সামলানো যায় না, সেখানে দুই নয়, তিনও না, একসাথে চার-চারটি; ভাবা যায়!’
‘আজকাল দেখি মানুষ কুকুরের মতো হয়ে গেল।’
‘ওসব কেন হয় জানো তুমি লিসা?’
‘কেন? সব ঈশ্বরের মহিমা। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সব তার হাতে।’ ‘আ রে দূর! ওরা ডগি স্টাইলে…বুঝলে না!’

লিসার ফরসা গাল আরও আরক্ত হয়। সে স্যুপের বাটি এগিয়ে দিতে দিতে একবার ডানদিকে তাকায়। তার কান দিয়ে গরম ভাপ বেরোয় বুঝি। সিলভি যে কি! কোনোকিছুই মুখে আটকায় না।। ডেরিক আর জন খুব কাছেই ধোঁয়া গিলছে। তারা শুনতে পেল কি? এসব আলোচনাই-বা কেন? লিসা তার ভারী পেট আলতোভাবে স্পর্শ করে। ডেরিক একরাতে একেবারে উদোম পেটের উপর হাত বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞেস করে, –
‘লিসা আমাদের ছেলে না মেয়ে হবে বলো তো?’
‘আমাকে তোমার কেমন দেখায়?
লিসা পালটা জিজ্ঞেস করে। ডেরিক আসলেই বুদ্ধু। সে ঠিকমতো বুঝতে পারে না। আশপাশে পাইন গাছের পাতায় পাতায় চাঁদের আলো ছড়িয়েছে। ধীরলয়ের হালকা বাতাস। জানালার কাচ গলিয়ে রুমের মধ্যে এসে পড়ে। মায়াময় পরিবেশ।
‘তোমাকে আবার কেমন দেখায় মানে? তুমি লিসা। আমার প্রিয়তমা। আগে স্লিম ছিলে, এখন একটু ভারী। এটা ভালো।’
‘তুমি অন্ধ। আমার চেহারা কি আগের চেয়ে বেশি সুন্দর দেখায় নাকি শুকনো রোগা-পাতলা-দুর্বল?’
‘তুমি দুর্বল বটে, তবে আগের তুলনায় আরও সুন্দরী লাগে। তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি।’
‘এসব আর নয়। তবে আমি নিশ্চিত, পেটে কে আসছে।’
‘কে মহারানি?’
‘বোধকরি হ্যাঁ। আমার ঠাকুমা বলত, গর্ভাবস্থায় চেহারা-সুরত আরও সুন্দর হলে নাকি কন্যাসন্তান জন্ম হয়।’
‘আর চোখ-মুখ শুকিয়ে গেলে পুত্র। আমি একটি মেয়ে চাই। আমার রাজকন্যা।’
‘যিনি রাজা তার মেয়ে রাজকন্যা। তুমি তো ফার্মে কাজ করো। একজন সামান্য এআই কাম কেয়ারেটেকার।’
‘পৃথিবীতে কোনো কাজ খাটো নয় লিসা। ছোট চাকরি করি বটে, নিজের ভুবনে মনের রাজ্যে আমি রাজা। আমার মেয়ে তাই রাজকন্যা।’
‘সরি ডেরিক। তোমাকে আঘাত দিতে এমন উক্তি করিনি। আই লাভ ইউ সো মাচ ডিয়ার।’
‘দেন আই সুড হাগ ইউ নাও।’
‘ইউ ডার্টি ম্যান!’

ডেরিকের চোখে পুনরায় লিসার স্ফীত পেট আর অনাগত কন্যার কল্পিত চেহারা ভেসে ওঠে। তার বেবির চেহারা কেমন হতে পারে? সে কি বাবার চেহারা পাবে নাকি মায়ের, অথবা দু-জনের কম্বিনেশন? এসব জানা নেই। অনুমান করা যায় না। আগামী দু-এক সপ্তাহের মধ্যে পিতা হয়ে যাবে সে। তার বুকে অনাস্বাদিত পুলক দুপুরের হালকা হিমেল বাতাসের মতো অপার্থিব স্পর্শ দিয়ে যায়। সে আরও একবার পুবে তাকিয়ে দেখে। অসহায় চোখ। জন কি একবার কাছে আসতে পারে না? জুলি বেশ দূরে জলের পাইপ নিয়ে বোঝাপড়া করছে। শেডের গোবর আর মুত্র পরিষ্কার করবে আরও একবার। তারপর ছুটি। ডেরিকের ছুটি নেই। সে নিশ্চল পাথরের মতো বোবা প্রাণির দিকে দৃষ্টি ধরে আছে। পশুটি দাঁড়িয়ে আছে। বেশিক্ষণ সম্ভবত থাকতে পারবে না। তার প্রসবদ্বার উন্মুক্ত হয়ে আবার বন্ধ হচ্ছে। সেইসঙ্গে গোঙানি। আর্তনাদের শব্দ বিশাল খামারের প্রাচীর টপকিয়ে যেতে পারে না। এখানে-ওখানে মাথা উঁচু ঘাসের ডগায় লেপটে থাকে চিৎকার। গাভীটি ছটফট করছে। ডেরিক হাতে আলগা হয়ে যাওয়া হাতুড়ি শক্তভাবে চেপে ধরে আবার ছেড়ে দেয়। সেদিন জন বলছিল।
‘পুরুষের জীবনে নিষ্ঠুরতাও রাখতে হয়।’
‘এটা কোনো ক্রাইটেরিয়া নয় যে, সে পুরুষ মানুষ। জীবে দয়া করে যে-জন, সে-জন সেবিছে ঈশ্বর।’
‘ঈশ্বর কোথায়? উর্ধ্ব আকাশের কোন কোণায় ডেরিক? ঈশ্বর হলো টাকা। টাকা হাতে থাকলে পৃথিবীতে সবকিছু পাবে।’
‘তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না? নাস্তিক?’
‘ঈশ্বর আছেন। এত বড় বিশ্ব কে তবে সৃষ্টি করল? আমি ধর্ম বিশ্বাস করি না। ধর্ম বিভেদ তৈরি করে। ঈশ্বর আমার মনের গহিনে।’
‘তারপর তুমি চার্চে যাও। কেন যাও?’
‘মানুষের সাথে রি-ইউনিয়ন। আর অন্য এক কারণে যাই।’
‘যেমন?’
‘পৃথিবীর সকল উপসনালয় হলো প্রশান্তির জায়গা। মনের মধ্যে হাজারও অশান্তি হাজারও ক্ষোভ প্রশান্তিতে ভরে যায়। আমি নতুন করে বাঁচতে শিখি।’
‘আমি এই হত্যা শেষে কি শান্তিলাভ করব?’
‘আমার জানা নেই। পৃথিবীতে কোনো প্রাণিকে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। আমাদের তবু করতে হয়। কেননা ঈশ্বরের জায়গায় পৃথিবী এখন লুসিফার পরিচালনা করছে।’
‘তুমি আমাকে সাহায্য করো জন। আমি পারব না।’
‘তোমাকে পারতে হবে। জগত এমনই। এক প্রাণি আরেক প্রাণিকে সংহার করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে, সর্বক্ষেত্রে এমনই নিয়ম। বড় মাছ ছোট মাছ ধরে খায়। বাঘ বেঁচে থাকতে হরিণশাবক হত্যা করে। আরও কত দৃষ্টান্ত আছে। তুমি সে-সব জানো।’
‘আমাকে যে কাজ করতে বলা হয়েছে, সেটা প্রকৃতির নিয়ম নয়।’
‘মানুষের সভ্যতা, পুঁজিবাদ, নগরায়ন আর আধুনিকায়নের নিয়ম।’
‘এটা নিয়ম নয় জন, নিয়ম নয়; এটা অপরাধ। আমার দ্বারা হত্যা সম্ভব নয়।’ ‘তোমাকে তবে এই ফার্মের চাকরি বাদ দিতে হবে। তখন তুমি কী করবে? তোমার বউ পোয়াতি। কয়েকদিন পর বাচ্চা বিয়োবে। তার জন্য ডাক্তার-ওষুধ আর ভালো ফলমুল খাবার কেনার প্রয়োজন পড়বে। যদি মায়ের বুক শুকনো থাকে, দুধ না আসে; বাচ্চার জন্য দুধ কিনতে হবে। কোথায় পাবে টাকা?’

ডেরিক অসহায়ের মতো চারিদিক তাকায়। আকাশে ধীরে ধীরে মেঘপুঞ্জ ভেসে ভেসে কোথায় চলেছে? বাতাসে ভেসে যাওয়া মেঘ কখনো কখনো বৃষ্টি ঝরায়। মানুষের জীবনে মেঘ আসে। সেই মেঘে কান্না ঝরে। কোনো কান্না দেখা যায় কোনোটা নয়। যে কান্না নিশ্চুপ দীর্ঘশ্বাসের ভাঁজে ভাঁজে থাকে সেটি দেখতে পায় না কেউ। জন মুখ ঘুরিয়ে বলে, –
‘যখনই বাছুর মাটিতে নেমে আসবে, অবশ্যই পুরুষ; হাতুড়ির এক ঘা। মাথার মধ্যখানে। মৃত্যু যন্ত্রণা বোঝার সময় পাবে না।’
‘এরপর বাছুরের চামড়া দিয়ে তৈরি হবে মসৃণ হ্যান্ডব্যাক। কোনো শো-পিস। শহরের জাকজমকপূর্ণ দোকানে শোভা দেবে। মানুষ কিনে নিজেকে ভাগ্যবান ভেবে নেবে। কি আশ্চর্য এই সভ্যতা!’
‘এবং পৈশাচিকও বটে। এতে দুটো লাভ। বাছুরের জন্য দুধের প্রয়োজন থাকল না। সেই দুধটুকুও ফ্যাক্টরিতে চলে যাবে। তুমি সকালে যে চা বা কফি খাও কে জানে, সেটা ওই উদ্বৃত্ত দুধ কিনা?’
‘সেই তো। ভয়ঙ্কর কাজ। হত্যা।’
‘মানুষ অমৃতের সন্তান। সেই মানুষের মধ্যে নিজেদের নিষ্ঠুরতাও আছে। এখন তোমার সিদ্ধান্ত।’

বোবা প্রাণিটা উঠে দাঁড়িয়েছে। পেছনের পা-দুটো ভেঙে একটু কুঁজো হয়ে গেছে। গোঙানির স্বর অন্যরকম বিকট। প্রসবদ্বার প্রসারিত হতে শুরু করেছে। আঠালো পিচ্ছিল তরলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে একটি প্রাণ। শুভ্র সাদা আর কালচে লোম দেখা যায়। একটি প্রাণ। একটি জীবন। ঈশ্বরের মহিমা। ডেরিক কী করবে? কী করতে পারে সে? সে হাতুড়ির হাতলে হাতের পাঁচটি আঙুল জড়িয়ে নেয়। কবজি শক্ত করে। তখনই লিসার শরীর পুনরায় ভেসে ওঠে। তার আপেল বোঁটার মতো গভীর নাভি উঁচু হয়ে গেছে। পৃথিবীর মতো গোলাকার পেট। উত্তর-দক্ষিণে চাপা। একেবারে কমলার মতো। নরম আবার শক্ত। আর মাত্র কয়েকদিন। একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হবে পৃথিবীতে। সে বড় হবে। ডেরিক আদর করে কোলে নেবে। চুমু দেবে। তার রাজকন্যা। ডেরিক দিশেহারার মতো এদিক-ওদিক তাকায়। জন আশেপাশে নেই। মাথার উপর পুনরায় মধ্য দুপুরের রোদ গনগন করছে। অনেক অনেক দুরে পশ্চিমের আকাশে মেঘ জড়ো হয়। সব মেঘে বৃষ্টি হয় না। এখানেও কি বৃষ্টি নামবে? কোথা থেকে আসে এত জল? পৃথিবী কি কাঁদে?

ডেরিকের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

লেখক:
মাহবুব আলী
গণেশতলা, সদর, দিনাজপুর বাংলাদেশ
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments