কবি শ্বেতা শতাব্দী এষ স্মরণে

By Published On: September 12, 2025Views: 38
Image

কবি, শ্বেতা শতাব্দী এষ। আমাদের খুব কাছের এবং খুব আপন। বহুদনি ধরে তাকে অনন্তের পথে ডেকে চলছিলো কিন্তু কবি শত চেষ্টা করেও যেতে চাইছিলেন না আমাদের ছেড়ে। কারণ আমরা জানি, এই পথে কেউ একবার চলে গেলে আর ফিরেন না। কখনই না। কিন্তু অমোঘ নিয়তি আমাদের। আমরা না চাইলেও এই পথ আমাদের ডেকে নেয়। শেষঅব্দি আমরা কেউই মুখ ফেরাতে পারি না। তাই এই পথটাকে মেনে নিয়েই কবি শ্বেতা শতাব্দী এষকে সে পথে চলে যেতে হলো। প্রিয় কবি, তুমি চিন্তা করো না, আমারও আসছি। একে একে, হয়তো একটু দেরি হবে। তবে আসবো…
তোমাকে স্মরণ করি। এবং স্মরণ করছি। ভালো থেকো

খেলা শেষ, শেষ দান

চল একদান দাবা খেলি।
 – এখনো সাদা আর কালো, এখনো রাজা আর বোরে, অথচ, ঘোড়ার আড়াই চাল
আমি সেই কবে ভুলে গেছি !
তাহলে তাস ?
– এখানেও সেই রাজা-রাণী-গোলাম, আচ্ছা তুমি কি জোকারকে চেন? তাসের পাতার
দিকে একদিন চেয়ে চমকে উঠেছিলাম, জোকারটা হেসে হেসে বলে উঠেছিলো-
সার্কাস, জীবনের সমার্থ! সেদিন থেকে আর তাস খেলি না—
সাপ-লুডু খেলবে তো নিশ্চই ?
-জন্ম থেকে একটা সাপ আমাকে তাড়া করে ফিরছে, এবারের মতো মাফ করে দাও,
আমি উপরে উঠতে জানি না!
তবে এমন কোন খেলা আছে, যা তুমি আমার সাথে খেলতে পারো ?
– আমি যে খেলাই খেলতে গিয়েছি, অনিবার্য নিয়তিতে পেয়েছি ‘পরাজয়’। তবু
তোমার সাথে আমি খেলবো শেষ-খেলা, চল, তার আগে করি রক্ত বিনিময়!


লাল পায়রা

ফিরে যাচ্ছে বন,
নদীর অতল বলে কিছু নেই—
ভেঙে যাওয়া ঘুমে!
অন্ধকারের স্নায়ু ছিঁড়ে উড়াচ্ছি,
উড়িয়ে যাচ্ছি একান্ত শান্তির
লাল পায়রা।

মোহ

এক আশ্চর্য আপেল থেকে বের হয়ে আসছে ছুরি
আমার বুক বরাবর-
এ এক অনিঃশেষ অতৃপ্তি- একে একে সব ফুল
ঝরে যাবার পর তবু একটি অন্তিম মাধবীললতার ঘ্রাণে
পৃথিবীতে ঘোর নেমে আসে- আর আমার হৃদয়
মৃত্যুর আঙুল ধরে উচ্চারণ করে- জীবন সুন্দর! 
 
এইসব রাস্তা 

যাওয়া আর আসার একই রাস্তা কিন্তু একই নয়- 
এইখানে বিশাল ব্যবধানে উলটে যায় 
রহস্যময় হাওয়া । ফুলতোলা জামার আস্তিনে 
মুছে যায় দ্রুতগামী সকাল । বিকেলের কথা 
আর কী-ই বা বলার আছে- কেবল কৌনিক দূরত্ব 
বেড়ে চলে একই রাস্তার অচেনা মেরুকূলে !

আহত-অশোক

গলার ভেতরে ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে অলিভ অন্ধকার- 
ভাষাহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সম্মোহিত শোক ! 
আমি এখনো আছি, যেভাবে নীল হয়ে জেগে থাকে আহত-অশোক
 
অলিখিত অন্ধকার 

কোনো দূরবর্তী আকাশে এখনো শীতকাল- 
আমি শীতের কথা ভাবতে ভাবতে আরো 
হীম হয়ে আসি । নিদ্রায় নত হওয়া চোখ 
ভুলে যায় ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের পথ । 
শীতঘুম । 
ঘুমনদী । 
ক্লান্তির মুদ্রায় ঢেকে যায় সবুজ সময় । 
কোনো দূরবর্তী আকাশে এখনো একটা 
মুখ জেগে থাকে । 
আমি শীতের কথা ভাবতে ভাবতে ক্রমশ 
মৃত নক্ষত্র হয়ে যাই ।

উপসংহারপূর্ব 

তোমরা জানো সব; জীবনের অত্যাশ্চর্য
প্রজ্ঞার আলোয় ভরে থাকে তোমাদের মুখ।
তাই কিছু বলবার নেই,
আর কিছু বোঝাবার নেই,
এখানে দাঁড়ি টেনে দেয়, সময়ের গতি থেকে বিচ্যুত,
পাথরের মতো দুটো চোখ।

শব্দের দাগ

১।
সেই বিকেলের নিরানন্দ বিদায়ের পর
পৃথিবীর সমস্ত পেয়ালার চা
ঠান্ডা হয়ে গেছে!

২।
তোমার কল্পনার ভূগোল ততদূর 
বিস্তৃত কিনা জানি না,
আমার মাইলকে মাইল-
ক্লান্তি ছড়িয়ে আছে 

৩।
মুহূর্তের কাছ থেকে যা কিছু পেয়েছি
সেসবের খতিয়ান লেখা আছে
কালো পাথরটার ওপর, যা
একসময় আমার হৃদয় ছিলো!

৪।
স্মৃতি ও বেদনা বলে কিছু নেই,
যা আছে – অনন্তে অন্ধকার হাসি ! 
এই পথ, সূর্যে সূর্যে চলা, সমুদ্র 
মুছে মুছে বেঁচে থাকা রক্তের স্রোত ভালোবাসি-

থেমে থাকা পথ

‘সবাই আছে কিন্তু কেউ নাই’
আপনার কখনো এমন মনে হয়?
ভেতরটা খুব ফাঁকা, রিক্ত, অবশ।
জ্বর এলে যেমন লাগে—
একটা কেমন ঘোর!
তাপে পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে
চেতন ও অবচেতনের মাঝখানে
কোথাও ঝুলে থেকে
স্মৃতির কাছেও যেতে ইচ্ছা করে না।
যেন, কেউ কোথাও ছিলোই না কখনো!
এরকম নির্জন। জীবন।
খুব জরুরি কিছু পরে থাকে স্থবিরতায়।
হিম বরফের দেশে আটকা পড়ে
হারিয়ে যাচ্ছে সময়।
রোদ এসে পৌঁছাবে—সে পথ
বড় দীর্ঘ মনে হয়! 
 
বিয়োগ

অনুভূতি নাশ করে
ফিরে যাচ্ছে ফুল
বনের উলটো পথে-
তার কোনো অভিমান নেই
বৃক্ষের-বাতাসের-ভ্রমরের সাথে
তবু সে পাপড়ি থেকে ঘ্রাণ রেখে
চলে যায় একা
নিজের ছায়ার সাথে-
দূর পথে তাকে ডাকে শূন্যতা!

শ্বেতা শতাব্দী এষ
জন্ম: ১২ অক্টোবর, ১৯৯২, জামালপুর শহরে
বাবা: জ্যোতিষ চন্দ্র এষ
মা: ছবি ভৌমিক
শিক্ষা: স্নাতকোত্তর, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কবিতাগ্রন্থ 
অনুসূর্যের  গান  (২০১০) জলসিঁড়ি, ঢাকা
রোদের পথে ফেরা  (২০১৩) মুক্তচিন্তা, ঢাকা
বিপরীত দুরবিনে  (২০১৬) ঐতিহ্য, ঢাকা
আলাহিয়ার আয়না (২০১৭) ফেস্টুন, ঢাকা
ফিরে যাচ্ছে ফুল (২০১৯) ঐহিক, কলকাতা

‘বিপরীত দুরবিনে’ বইয়ের জন্য ‘আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭’ এবং
তরুণ কবি ক্যাটাগরিতে ‘আদম সম্মাননা ২০১৯’
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments