আমি ও জ্যোতি পোদ্দার

By Published On: March 29, 2025Views: 44

আমি ও জ্যোতি পোদ্দার
জ্যোতি পোদ্দার

দুই
জ্যোতি পোদ্দারকে রেখে এসেছি শব্দময় তাঁতিপাড়ায়।
তাঁতি পাড়ায় সে এলেই অন্য মানুষ—অন্যস্বর; হল্লা কিংবা কথকতায় ফুটে তোলে বয়ন ও বুননের গল্প।
আড়াআড়ি আর খাড়াখাড়ির রঙিন সুতার যে শাড়ীজীবন সে জীবনের লিঙ্করোডে
জ্যোতি পোদ্দার নির্মাণ করে বাড়ি ও একটি সলজ্জ নারীমুখ।
ওর নারী রঙিন সুতায় কাজ করা নারীমুখ;
ফুল পাতা লতা আঁকা পাটভাঙা সুতিশাড়ীর নারীমুখ।
ম্যাচিং ব্লাউজ আর পেটিকোটে রিনিঝিনি কাঁচের চূড়ির নারীমুখ।
খটখট খটাখটে ধ্বনি ব্যঞ্জনে সুর বাঁধে কাঁচের চূড়ির রিনিঝিনি।
জ্যোতি পোদ্দারের রিনিঝিনি ভালো লাগে।
ভালো লাগে তাঁতিপাড়ার শব্দময় খটখট খটাখট খটখট।

চার
সিরাজগঞ্জি গামছা কিনেছি বটে—কিন্তু ব্যবহার করি না।
ত্যানার মতো নেতিয়ে পড়া গামছা দিয়ে ভেজা শরীর
মুছতে ভালো লাগে না।গোছলের শরীর ওম চায়।
পেলবতা চায়।নরম তুলতুলে তোয়াল খোঁজে ভেজা শরীর।

নয়ন তারার মতো কড়া গোলাপির রঙের তোয়ালে যখন
এখানে সেখানে শিশির ভেজা মাটির মতো সিক্ত হয়ে থাকে
তখন শুধু দেখতে নয়—আরামে ওম নিয়ে আসে শরীর ও মনো৷

হোক ভেজা নগ্ন শরীর অথবা গিন্নীর সিক্ত চুলে সাপের মতো
পেঁচিয়ে মাথায় উপর চুল আর তোয়ালের যৌথ খোঁপা দেখতে
শুধু পুলকিত হই না লোভ ও কাম ফুটে ওঠে চোখে আর জিভে।

বাথরুমের রিঙে মোচড়ানো নিঙড়ানো গামছার চেয়ে কড়া
গোলাপি রঙের পরিপাটি তোয়ালের দুলদুল দুলুনি
কার না ভালো লাগে? লাল টুকটুকে সিরাজগঞ্জি গামছা
মাফলার মতো জ্যোতি পোদ্দারের গলায় ঝুঁলে থাক না!

পাঁচ
মুখ ফস্কে গিন্নী বলেই ফেললো… তুমি কি লাঠিয়াল ?
এমন করে কাছা দিও না তো? বিচ্ছিরি লাগে।
উপুড় করা বাটির মতো কালো কুচকুচে পাছার
মাঝখান দিয়ে দড়ির মত পাকানো লুঙ্গির গিঁট্‌টু
মোটেও তোমার সাথে যায় না।
মনে হয় গাঙের গভীর থেকে চিতই পিঠার সাদা বুকের
মতো জেগে ওঠা চরের দখলদার তুমি।

রঙ ও বহর যুৎসই হবার পরও কেনা লুঙ্গি
আর পরা হলো না ৷
লুঙ্গির আট ভাঁজ এখনো পরিপাটি ।
ট্রেডমার্কের রঙিন কাগজে লেখাঃ
সাকিনঃ রান্ধনিবাড়ি;
জিলা:সিরাজগঞ্জ
সাঁটা রয়েছে লুঙ্গির পিঠে।

ছয়
শব্দময় তাঁতিপাড়ায় জ্যোতি পোদ্দার এলেই সে শুধু বোবা
নয়—অচেনা জন—কায়দা করে লুঙ্গির কুঁচি ঝুঁলিয়ে
খটখট খটাখট খটখটের পাড়া চক্কর দিতে দিতে
এপাশে লাল রঙের চাড়ি
ওপাশে নীল রঙের চাড়ি
আরেকটু দূরে পাতা সবুজ রঙের চাড়ি
অথবা কালচে রঙের চাড়ি তাঁতঘরের পাশে
কিংবা ধরো শর্ষে রঙের হলুদ রঙের চাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে
ধ্বনি চাতুর্য্যের সুরে সুর মেলাতে মেলাতে
আমার চেনাজানা বোবা জ্যোতি পোদ্দার।

সাত
বোবা জ্যোতি পোদ্দার বোবা নয়—বরং বাকপটু।
অপরকে ট্রাফিক আইল্যান্ডে লাল বাতির নিচে দাঁড়
করিয়ে রেখে নিজেই শহরময় ঘুরে আসার লোক তিনি।

শুধু খটখটের সামনে বোবা তিনি।
শুধু এই জন্মে নয়—আগের জন্মেও—তার আগের আগের
জন্মেও তিনি শব্দময় তাঁতিপাড়ায় বোবা
অন্য নামে একই বোবা

এই জন্মে জ্যোতি পোদ্দার।
অন্য জন্মে চিত্ত বসাক—পাথরাইল গ্রামের তাঁতি ও বোবা।

চিত্ত বসাক তার ঠাকুরদার কাছেই শিখেছিল ‘নীলাম্বরী’র
গল্পের বয়ন ও বুনন ৷
নীলাম্বরী’র গল্প তাঁতি পাড়ার গল্প।
ঠাট ও জেদের গল্প ৷
মাকু আর সাদাসাদা মিহিদানা তুলার আঁশের গল্প।

সব সুতাতে কী আর বর্ষকাল ফুটে।
সব বয়নে ও বুননে নীলাম্বরী হয় না।
নীলাম্বরী শাড়ি তাঁতি পাড়ার নিজস্ব বুননে নিজস্ব বয়ান।

নীলাম্বরী’র জ্ঞান পরম্পরায় জ্ঞান। চিত্ত বসাক জেনেছিল
গত জন্মে ঠাকুরদার কাছে।তার ঠাকর’দা জেনেছিল
তার ঠাকুরদার কাছে। দুই চোখামুখে সুতা নিয়ে ছুটে চলা
মাকুর মতো অতীতে ঠাকুর’দা ভবিষ্যতে প্রোপৌত্র চিত্ত বসাক।

সেই চিত্ত বসাকই এই জন্মে জ্যেতি পোদ্দার।
শব্দময় তাঁতিপাড়ায় বাকপটু জ্যোতি পোদ্দার বোবা ও অচেনা।

0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments