ভারতের বিখ্যাত নারী কবি কমলা সুরাইয়া (৩১ মার্চ, ১৯৩৪ – ৩১ মে, ২০০৯), যিনি কবিতা রচনা করতেন ইংরেজি ভাষায়। নিজস্ব ঘরানার ‘ভারতীয় ইংরেজি’ ভাষা সৃষ্টি করেন তিনি। সোজাসাপটা, অকপট ভাষায় নারীর যৌনতা ও কামনা-বাসনার বয়ান তাকে ভারতীয় পপুলার কালচারের এক আইকনোক্লাস্টে পরিণত করেছে। প্রথম বিয়ের পর স্বামীর নামানুসারে তার নাম হয়েছিল কমলা দাস। সেই নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিতি তার।
কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প, কলামও নিয়মিত লিখে গেছেন অধুনা কেরালায় জন্ম নেওয়া কমলা। ইংরেজিতেই শুধু নয়, লিখেছেন মালয়ালাম ভাষাতেও। ‘মাই স্টোরি’ নামক আত্মজীবনী লিখে পেয়েছেন ঈর্ষণীয় সাড়া। যেমন মিলেছে ভূয়সী প্রশংসা, তেমনই জুটেছে গালমন্দও।
একসময় মাধবীকুট্টি ছদ্মনামে লিখতেন কমলা। আবার এক মুসলিমকে ভালোবেসে বিয়ে করবেন বলে ধর্মান্তরিত হন তিনি । ফলে মৃত্যুর আগে তার নাম ছিল কমলা সুরাইয়া। সেই নামটিই আমরা ব্যবহার করছি বর্তমান লেখায়।
আপনি নিজেকে গদ্য ও কবিতা দুইয়ের মাধ্যমেই ব্যক্ত করেছেন। তবু মনে হয়, একজন শিল্পী হিসেবে আপনার সত্যিকারের সংবেদনশীলতার কাছাকাছি পৌঁছতে ও বিশ্বস্ত থাকতে পেরেছে কবিতাই। আপনার কি মনে হয়, নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে গদ্য ও কবিতার মধ্যে কোনো পার্থক্য রয়েছে?
কমলা : হ্যাঁ, এ কথা সত্যি। আমি গদ্য লিখেছি টাকা উপার্জনের অভিপ্রায়ে, কিন্তু কবিতা আমার কলমে উঠে এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, অন্য কোনো অভিসন্ধি ছাড়াই। আমার কবিতা আমার কাছে শিশুর নৃত্যের মতো। হঠাৎ করেই শিশু নাচতে শুরু করে, কিন্তু কেউ জানে না কেন নাচছে সে। তো, আমার কবিতারও কোনো উপযোগিতামূলক উদ্দেশ্য নেই। আমি কখনোই প্রকাশের কথা ভেবে কবিতা রচনা করিনি। আমার প্রথম কবিতা সংকলন বের হয় ১৯৬৫ সালে, এবং সেটিও এ কারণে যে, দিল্লিতে ছাপাখানা আছে এমন একজন ব্যক্তি আমার স্বামীকে বলেছিলেন আমার একটি বই প্রকাশ করা উচিত। এভাবেই বাজারে আসে আমার ‘সামার ইন ক্যালকাটা’বইটি।
কাব্য রচনাকে কেন আপনার কাছে বেশি উপযুক্ত মনে হয়?
কমলা : কবিতা লেখা আমার কাছে ডায়েরি লেখার মতো। আমার ব্যক্তিগত আবেগের খুবই সহজাত বহিঃপ্রকাশ ঘটে এর মাধ্যমে।
প্রত্যেক সৃজনশীল শিল্পীর সৃষ্টিকর্মেই তার ব্যক্তিগত জীবন ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান কিছু প্রভাব লক্ষ করা যায়। আপনার জীবনের তেমন কোন প্রভাবগুলো আপনাকে এমন অসাধারণ একজন কবিতে পরিণত করেছে?
কমলা : আমি ভিন্ন ভিন্ন যেসব সংস্কৃতিতে বাস করেছি, সেগুলোর কিছু আধিপত্যশীল প্রভাব-প্রতিপত্তি আমার রচনার সঙ্গী হয়েছে। আমি থেকেছি কলকাতায়, এবং মালাবার নামে কেরালার একটি ছোট গ্রামে। এভাবেই, দুটি সংস্কৃতি প্রবেশ করেছে আমার অন্তরে, এবং তাদের মধ্যকার পারস্পরিক পার্থক্য আমাকে শক্তি জুগিয়েছে উভয় সংস্কৃতিতেই টিকে থাকার। ব্রিটিশরাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার কবিতায় প্রভাব ফেলেছে। শৈশবে আমি একটি ব্রিটিশ স্কুলে পড়তাম, এবং সেটি ছিল এমন একটি সময় যখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে শাসন করছিল। প্রত্যেক ভারতীয় শিশুই তখন ব্রিটিশদের অনুকরণ করত। আমিও সেটিই করতাম। তাই আমি কেবল মালয়ালাম ভাষাতেই নয়, ইংরেজিতেও কবিতা লিখতে পেরেছি।
‘মাই স্টোরি’ নামক আত্মজীবনীতে আপনি উল্লেখ করেছেন যে মেয়েবেলা থেকেই আপনি “মস্তকবিহীন পুতুল”-এর মতো আবেগঘন কবিতা রচনা করতেন। সেসব কবিতার সঙ্গে কি আপনার বিয়ের পর লেখা কবিতার কোনো মিল রয়েছে?
কমলা : আমি জানি না কীভাবে দুটো একই ব্যক্তির লেখা হতে পারে। আমি খুবই সংবেদনশীল, আবেগতাড়িত একজন মানুষ। আমার মনে হয়, আবেগই আমার কবিতার মূল ভিত্তি; তা সেসব কবিতা শৈশবেই লেখা হোক, কিংবা তাতে উপস্থাপন ঘটুক আমার ব্যক্তিগত জীবনের।
আপনার কবিতায় ছন্দ কিংবা গতানুগতিক কবিতার অন্যান্য ধরাবাঁধা নিয়ম চোখে পড়ে না। এটি কি এ কারণে যে আপনার কবিতাগুলো মূলত আপনার আবেগের বিস্ফোরণ, তাই আপনি কোনো ধরনের বন্ধনকেই আমলে নিতে চান না?
কমলা : কখনোসখনো আমার কবিতায় অন্তর্নিহিত ছন্দ থাকে বটে, কিন্তু আমি কখনোই আঙ্গিকগত ছন্দের নিয়মনিষ্ঠতায় খুব একটা নজর দিই না। আমার কবিতা নৃত্যের মতো, কারণ যখনই আমি কবিতা লিখি, মনে হয় আমি যেন শব্দের সঙ্গে নাচ করছি।
আপনি বেড়ে উঠেছেন খুবই রক্ষণশীল এক মালয়ালি পরিবারে, অথচ আপনার কবিতা প্রতিনিধিত্ব করে সমাজ ও পরিবারের গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে আপনার বিদ্রোহের। যে রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপে আপনার বিকাশ ঘটেছে, তা আপনার কবিতায় ঠিক কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?
কমলা : কোনো সন্দেহ নেই, আমার পরিবার ছিল খুবই সনাতনী প্রথার প্রতি নিষ্ঠাবান। আমি যখন স্কুলে পড়ি, আমার ঠাকুরমা আমাকে লম্বা লম্বা স্কার্ট বানিয়ে দিতেন, কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন মেয়েদের কখনোই পা উন্মুক্ত রাখতে নেই। কিন্তু আমি সবসময়ই এসব রক্ষণশীলতার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেছি। আমার মনে হয়েছে, সমাজে প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে, কেউই চাইছে না প্রকৃত বাস্তবতাকে প্রকাশ করতে। লোকে বলে তারা ঝগড়াবিবাদ করে না, অথচ বাস্তবে সত্যিই তা করে। এ ধরনের হিপোক্রেসি আমাকে কষ্ট দেয়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিই, এমন একটি জীবন বেছে নেবো যেখানে আমি সবসময় একজন সত্যিকারের মানুষ হয়ে বাঁচতে পারব। এজন্যই আমি আমার কবিতার মাধ্যমে সবসময় নিজেকে সাহসিকতা ও সততার সঙ্গে প্রকাশ করেছি।
আপনার কাব্যিক সংবেদনশীলতা আপনার মায়ের কবিতার ধর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গিকে কতটুকু ধারণ করে?
কমলা : আমার মা নিঃসন্দেহে একজন অসাধারণ কবি। এখনো বেঁচে আছেন তিনি। কিন্তু তার দ্বারা আমি কখনোই অনুপ্রাণিত হইনি। আমাদের দুজনের মাঝে ছিল বিস্তর ব্যবধান। নিজের জীবনের নানা ঘটনা ও পরিস্থিতি আমাকে একজন কবি করে তুলেছে।
আপনার অনেক কবিতা এবং আপনার আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে আপনার বৈবাহিক জীবন সুখের ছিল না, এবং আপনি কবিতার মাধ্যমে নিজের তিক্ততাগুলোকে অবমুক্ত করতে চেয়েছেন। তিক্ত বৈবাহিক জীবন কতদূর অবধি আপনার ভেতরকার কবিসত্তার জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত?
কমলা : আসলে, বেশিরভাগ বিয়েই কিন্তু সুখের হয় না, যদিও লোকে এ কথা স্বীকার করতে চায় না। তারা তাদের সম্পর্কের অপ্রীতিকর বিষয়গুলোকে ঢেকে রাখতে চায়, প্রকাশ্যে আসতে দিতে চায় না। কিন্তু আমি তা দিয়েছি। আমার বিয়েটা আমার বাবা-মায়ের বিয়ের চেয়ে ঢের ভালো ছিল। আমার বাবা-মা তো প্রায়ই রাতের বেলা ঝগড়া করতেন। ছোট থাকতে সেগুলো দেখতে আমার ভালো লাগত না, অস্বস্তি হতো। আমি আর আমার স্বামী অবশ্য সেরকম ঝগড়া করতাম না, কারণ আমি চিৎকার-চেঁচামেচিতে বিশ্বাসী নই। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিই লেখার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করব। যখনই আমার বিষণ্নবোধ হতো, আমি লিখতাম। এজন্য আমি আমার স্বামীর কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে কষ্ট দিতেন।
আপনার কবিতার প্রধান থিম হিসেবে উঠে এসেছে ভালোবাসার প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক। সমাজে তো অন্য আরো অনেক ইস্যু, অনেক সমস্যাই আছে যেগুলোর কাব্যিক উপস্থাপন প্রয়োজন। সেগুলো বাদ দিয়ে এই বিষয়টিই কেন আপনার প্রিয়তম বিষয়ে পরিণত হলো?
কমলা : এটি হয়েছে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কারণে। ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা অন্যান্য জাগতিক বিষয়আশয় সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই। আমি এই চিন্তাকে কেন্দ্র করেই মোহিত থেকেছি যে মৃত্যুর আগে আমাকে ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। আমি সেরকম সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ পেতে চাই, যেমনটি আমরা শুনেছি রাধা-কৃষ্ণের বেলায়। এই থিম সবসময়ই আমার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়, এবং সেই প্রতিধ্বনি এতটাই জোরালো যে, আমার মনে হয় আমিই বুঝি রাধা, অপেক্ষা করে আছি আমার আদর্শ ও চিরন্তন প্রেমিক কৃষ্ণের জন্য।
আপনার পরিচিতি প্রধানত একজন ভালোবাসার কবি হিসেবে। আপনার মতে ভালোবাসা কী?
কমলা : ভালোবাসাই জীবন। ভালোবাসাই ঈশ্বর। এর চেয়ে সুন্দর আর কিছুর কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। আমার সব কাজের প্রধান জ্বালানি ভালোবাসা। আমার সব অনুপ্রেরণার উৎস এটি। জীবনে আমি যত ভুল করেছি, তার নেপথ্যে দায়ী ভালোবাসা। কিন্তু আমি মনে করি, সেগুলো আসলে ভুল নয়, কেননা দিনশেষে সেগুলো সবই দারুণ সব জিনিস হয়ে ধরা দিয়েছে। তাই আমি অসংখ্য পুরুষের প্রেমে পড়া নিয়ে আক্ষেপ করি না। আমি অনুভব করি যে কাউকে যদি আমি সুখী করতে পারি, তাহলে সেই ব্যাপারটি কোনোভাবেই খারাপ হতে পারে না, এবং কারো ভালোবাসা পাওয়ার বিষয়টি ঠিক স্বর্গে প্রবেশের মতো। আমি খাবার ছাড়া বাঁচতে পারব, কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া বাঁচতে পারব না। কেউ যদি আমায় না বলে যে “আমি তোমাকে ভালোবাসি“, তবে আমি বাঁচতে পারব না। ভালোবাসাই আমার শক্তি।
আপনার ভালোবাসার কবিতায় খুব সুন্দর সংশ্লেষণ ঘটেছে শারীরিক, আবেগিক, ইন্দ্রিয়গত ও আধ্যাত্মিক ভালোবাসার। ভালোবাসার কোন দিকটিকে আপনি সত্যিকারের ভালোবাসা বলবেন?
কমলা : ভালোবাসার প্রতিটি অনুষঙ্গই বিশুদ্ধ ও সর্বশ্রেষ্ঠ। কোনোটিই অদরকারি নয়, কেননা ভালোবাসা হলো শরীর, হৃদয় ও আত্মার যথাযথ সমন্বয়। আবেগ হলো ভালোবাসার মূল ভিত্তি, এবং কামনা থেকে গঠিত হয় ভালোবাসা। কামনা ছাড়া ভালোবাসা অসম্পূর্ণ। আমি বলছি ভালোবাসার মানুষটির কাছাকাছি থাকবার কামনার কথা। যদি কামনা না থাকে, তবে যৌবন মূর্ছা যায়। কৃষ্ণের প্রতি কামনাবিহীন রাধা, এমনকি বৃদ্ধা রাধাকেও, আমি চিন্তা করতে পারি না। কেউ কেউ আমায় জিজ্ঞেস করে, এখনও আমি কীভাবে সুন্দর ও তারুণ্যময় রয়েছি। আমি বলি, এর উৎস আমার কাউকে ভালোবাসা ও কারো ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার কামনা। সেই কামনাই জ্বলজ্বল করে আমার চোখে-মুখে।
আপনার ভালোবাসার কবিতায় চিরাচরিত শরীরী প্রেম থেকে শুরু করে শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক উত্থিতি, ভালোবাসার বিস্তৃত ও বিচিত্র সব রূপ ধরা পড়েছে। এই দুই চরমাবস্থাকে আপনি কীভাবে আপনার কবিতায় ধারণ করেছেন?
কমলা : আমি পরিকল্পনামাফিক আমার কবিতাকে সাজাইনি। খুব সহজাতভাবেই এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
‘In Love’ কবিতায় আপনি ভালোবাসাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে যে এটি “A skin communicated thing”। আসলেই কি ভালোবাসা কেবলই “skin communicated thing”?
কমলা : এটি তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু। ভালোবাসার যোগাযোগ হয় ত্বকের মাধ্যমে। ভালোবাসেন যে পুরুষকে তাকে যদি আপনি স্পর্শ করেন, তাহলে হঠাৎ করেই সেই স্পর্শ আপনাকে বৈদ্যুতিক শক দেবে। আপনার মধ্যে কিছু একটা হবে, এবং আপনি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারবেন যে এই মানুষটিই সেই বিশেষ কেউ যাকে আপনি চান। আপনার যদি ত্বক না থাকে, তবে কীভাবে বুঝবেন যে এই পুরুষটিই আপনার জন্য সঠিক ব্যক্তি?
যৌনতা ছাড়া কি ভালোবাসা থাকতে পারে?
কমলা : অবশ্যই সেরকম আকাঙ্ক্ষা জন্মাতে পারে মনে, কিন্তু তারপরও সেটি খানিকটা অপরিণতই থেকে যায়, পুরোপুরি বিকশিত হয় না। যৌনতা ভালোবাসাকে বিকশিত করে, এবং ভালোবাসা ও যৌনতার সংমিশ্রণই হলো একমাত্র যথাযথ সম্মিলন।
আপনি আপনার ভালোবাসার কবিতায় কখনোই ভালোবাসার ধারণাকে আদর্শায়িত করার চেষ্টা করেননি। আপনি একে উপস্থাপন করেছেন যৌন তাড়নার একটি পরিপূরক হিসেবে। ভালোবাসা ও যৌনতার আপেক্ষিক গুরুত্ব কী?
কমলা : আমি মনে করি ভালোবাসায় অবশ্যই স্থানিক নৈকট্যের প্রয়োজন রয়েছে। নৈকট্য প্রেমিকদের মাঝে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করে। যেকোনো মানুষের উচিত প্রেমিকের যতটা সম্ভব কাছাকাছি যাওয়ার। যেখানে কোনো শারীরিক দূরত্ব নেই, সেখানে মানসিক দূরত্বেরও নিশ্চিতভাবেই অবসান ঘটবে।
ভালোবাসায় যৌনতার গুরুত্বের উপর আপনি যেভাবে জোর দিয়েছেন, তা অনেকটা ওশোর আদর্শের সঙ্গে মিলে যায়। আপনি কি ওশোর যৌনতা থেকে অতিচেতনার (সুপার কনশাস) ধারণায় বিশ্বাস করেন?
কমলা : না, কারণ ওশো মানুষকে অনেক বেশি স্বাধীনতা দিয়েছেন। সঙ্গী বদলের স্বাধীনতা, এবং তার মাধ্যমে এইডস হতে পারে। আমি এ ধরনের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি না, কারণ আমার মতে, যে মানুষটিকে আপনি ভালোবাসেন তাকে পাওয়াই যথেষ্ট। যদি আমরা সত্যিকারের ভালোবাসার সন্ধান পাই, তাহলে আমাদের অন্য কারো কাছে যাওয়ার, এমনকি এ ব্যাপারে চিন্তা করারও, প্রয়োজন পড়ে না।
সত্যিকারের ভালোবাসার উষ্ণতাকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আবেগ-অনুভূতি ও ভাবপ্রবণতা কী ধরনের ভূমিকা পালন করে?
কমলা : আবেগই হলো ভালোবাসার ভিত্তি। আবেগ ছাড়া ভালোবাসা নিজে নিজে প্রকাশিত হতে পারে না। প্রেমিকের মনে আবেগের জন্মই ভালোবাসার প্রথম ধাপ।
বিয়েই কি সত্যিকারের ভালোবাসার চূড়ান্ত গন্তব্য, নাকি বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের বাইরেও সত্যিকারের ভালোবাসা চরিতার্থ করা যেতে পারে?
কমলা : বিয়ের কাজ হলো শুধুই সমাজের মানুষকে সন্তুষ্ট করা। তাদের পেট পুরে খাওয়ানো, ভালো কাপড় পরার সুযোগ করে দেওয়া, এবং বিয়ের অনুষঙ্গ হিসেবে সোনাদানাসহ অন্য নানা অযৌক্তিক কারণে অঢেল পরিমাণে টাকা খরচ করতে দেওয়া। আমার বিয়েতেও এই সবকিছুই হয়েছে। আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমি নিছকই শিশু। যৌনতা সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই আমার বিয়েটা দেওয়া হয়। এখন আমি মনে করি, প্রত্যেক মেয়ের উচিত তার নিজের ভালোবাসার পুরুষকে খুঁজে নেওয়া। তার অবশ্যই উচিত ওই পুরুষকে চেনা, জরিপ করে দেখা যে সে আসলেই বিয়ের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি কি না।
কিছু কিছু কবিতায় আপনি রাধা-কৃষ্ণের চিত্রকে মহিমান্বিত করেছেন সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে। এর অর্থ, সত্যিকারের ভালোবাসা বিবাহের বন্ধনকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। এ সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন?
কমলা : বিয়েকে কে তোয়াক্কা করে? বিয়ে খুবই তুচ্ছ একটি ব্যাপার, এবং ভালোবাসা মহান। বিয়ে হলো মঙ্গলসূত্রের মতোই ছোট একটি জিনিস, কিন্তু ভালোবাসায় কোনো মঙ্গলসূত্রের দরকার পড়ে না। আত্মনিবেদনের সর্বোচ্চ রূপ ধরা পড়ে কেবলই ভালোবাসায়।
আমাদের সমাজে ধর্ম-বর্ণ প্রধান আধিপত্যশীল বিষয়। আপনার কি মনে হয় ভালোবাসা ধর্ম, বর্ণ বা বয়সের বাধাও মানে না?
কমলা : এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। ভালোবাসা ধর্ম-বর্ণের তফাৎ বোঝে না। আমি একজন মুসলিমের প্রেমে পড়েছি। আমি নিজের ধর্ম এবং বাদবাকি সবকিছু ছেড়ে এসেছি ভালোবাসার জন্য, কেননা ভালোবাসা মানে হলো শ্রেষ্ঠতম বিসর্জন। আমি অন্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়েও সুখী, কারণ আমার কাছে ভালোবাসা অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি মূল্যবান।
“The Looking Glass” কবিতায় আপনি “Endless female hungers” বলে একটি বিতর্কিত শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন। এই শব্দগুচ্ছ দিয়ে কী বোঝায়?
কমলা : এ দিয়ে বোঝায় যে ওই নারী তার চাহিদার সমতুল্য ভালোবাসা পাচ্ছে না। এটি ইঙ্গিত করে সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতি তার সীমাহীন ক্ষুধাকে।
আপনি আপনার কবিতায় পুরুষ ও নারীর দেহকে খুবই সোজাসাপটাভাবে প্রকাশ করেছেন, এবং শব্দের ব্যবহারে একধরনের অতিরিক্ত সোজাসাপটা ভাবও লক্ষ করা যায়। এ ধরনের নগ্ন সত্য বলার শক্তি আপনি কীভাবে পেলেন?
কমলা : আমি লোকের প্রতিক্রিয়াকে পাত্তা দিই না। আমি যা ভাবি ও যা অনুভব করি, তা-ই লিখি। আমি মনে করি, সত্যকে অবশ্যই বের হতে দেওয়া উচিত। আমাদেরকে অবশ্যই নিজেদের ভেতরকার সত্যকে মুক্তি দিতে হবে। লোকে আমাকে বলে, “যদি সত্যি কথাও হয়, তবু ওভাবে বোলো না। যদি সমাজে বাস করতে চাও, তাহলে এভাবে সত্য প্রকাশ কোরো না।” কিন্তু আমি তাদের কথা মানতে পারি না। আমার কাছে সত্যকে গোপন করে রাখা ঠিক যেন কোনো শিশুর জন্মগ্রহণকে প্রতিরোধ করা। বিষয়টি এমন যে আপনি আঁতুড়ঘরে গিয়ে সন্তানসম্ভবা নারীকে বলছেন বাচ্চা প্রসব না করতে, বাচ্চাটিকে ফের গর্ভে পাঠিয়ে দিতে। সেটি তো সম্ভব না। গর্ভাশয় বাচ্চাকে আর থাকতে দেবে না। একইভাবে, আমিও সত্যি কথা না বলে থাকতে পারি না। আমার মনে হয় সত্যকে প্রকাশিত হতে দিতেই হবে, এবং আমি হলাম একজন ধাত্রীর মতো, যে সত্যকে জন্ম নিতে সাহায্য করছে।
পুরুষের শরীরকে বর্ণনা করতে গিয়ে আপনি “A sun stained cheek” কিংবা “Uneven teeth gleam” এর মতো নেতিবাচক শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন। এগুলো কি ইঙ্গিত করছে যে আপনি সমগ্র পুরুষজাতিকেই অপছন্দ করেন?
কমলা : না। যদি কোনো ব্যক্তির সত্যি সত্যিই অসমান দাঁত থাকে, আমি সেটি উল্লেখ করেছি। আমি অনেক সুদর্শন পুরুষও দেখেছি। আমি মনে করি সৌন্দর্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এবং এটি একজন নারীকে আকৃষ্ট করে। পুরুষ ময়ূর দেখতে সুন্দর, এবং সে তার এই সৌন্দর্যের বদৌলতেই নারী ময়ূরকে আকৃষ্ট করতে পারে। আমি শুধু বাস্তবতারই উল্লেখ করেছি, এবং এতে করে পুরুষদের প্রতি আমার অপছন্দের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায় না। কারণ আমার কাছে সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভালোবাসা।
আপনার অধিকাংশ কবিতাতেই আপনি পুরুষদের নিরাবেগ জীব হিসেবে অভিহিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ “The Sunshine Cat” কবিতায় দেখা যাচ্ছে, সব প্রেমিকই আপনাকে বলেছেন “I do not love you. I cannot love. It is not in my nature.” আপনার কি মনে হয় সব পুরুষই এমন?
কমলা : আমার মনে হয় নিরানব্বই শতাংশ পুরুষ এমন। তাদের আকর্ষণ শুধুই নারীদেহের প্রতি। তারা সত্যিকার অর্থে একজন নারীকে ভালোবাসে না। তাদের কাছ থেকে সত্যিকারের ভালোবাসা আশা করা একটি বিভ্রম বৈ আর কিছু নয়।
কিন্তু আপনি তো কৃষ্ণের গুণকীর্তন করেছেন। আপনার মতে কৃষ্ণ কি একজন আদর্শ প্রেমিক?
কমলা : সন্দেহাতীতভাবে কৃষ্ণ প্রতিটি হিন্দু মেয়ের কাছেই একজন প্রেমিক পুরুষ। কোনো হিন্দু মেয়ে তাকে ভালো না বেসে থাকতে পারে? কিন্তু একইসঙ্গে সে একজন পুরুষও বটে। সে রাধাকে ফেলে চলে গেছে, আর কখনোই তাকে দেখার জন্য ফিরে আসেনি।
আপনার কাছে আদর্শ পুরুষের ধারণা কেমন? পুরুষ ও নারীর আদর্শ সম্পর্কের স্বরূপই বা আপনার মতে কেমন?
কমলা : আমি কোনো আদর্শ অবস্থার আশা করি না, কারণ আমি জানি সেটি সম্ভব নয়। আমি জানি সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী, পরিবর্তন অনিবার্য। আমি জানি সবকিছুরই শেষ আছে, আমাদের শেষ আছে, এবং আমি নিশ্চিত এই পৃথিবীও একদিন শেষ হয়ে যাবে। তাই আমি মনে করি না কোনো কিছুই চিরন্তন ও আদর্শ।
বলা হয়ে থাকে, একজন পুরুষ লেখক সচেতন থাকেন যে তিনি একজন লেখক, অথচ একজন নারী লেখক পরিপূর্ণভাবে সচেতন থাকেন যে তিনি মূলত একজন নারী। এ ধরনের বিবৃতি কি আপনার সৃজনশীল রচনার ক্ষেত্রে খাটে?
কমলা : হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি নিজেকে একজন লেখক হিসেবে ভাবি না। আমি নিজেকে ভাবি একজন নারী যে আগ্রহী পাঠকের কাছে, এবং কখনো কখনো আগ্রহী দর্শনার্থীর কাছে, নিজেকে প্রকাশ করছে।
আপনি আপনার কবিতায় নারী স্বাধীনতা ও নারী সমতা নিয়ে কথা বলেছেন। এটাই প্রধানত নারীবাদের মূল ভিত্তি। আপনি আজকের দিনের নারীবাদ সম্পর্কে কী ভাবেন?
কমলা : তাদের মধ্যে অনেকেরই সত্যিকারের স্বাধীনতা নেই, তাই তারা সেটি চায়। আমি কোনো আন্দোলনে যোগ দিইনি, কারণ আমি অনেক বেশি নারীসুলভ। আমি আমার পুরুষের কাছে নিজেকে সঁপে দিই। আমি তার অনুগত থাকতে উপভোগ করি। আমি তার উপর জোর খাটাতে, তাকে আদেশ দিতে চাই না। আমি হলাম নিচু রাস্তার মতো। আমি তার দাসী, কিন্তু আমি তার প্রিয়তমাও হতে চাই। যখন আমি প্রেমে পড়ি, আমি পুরোদস্তুর নারীসুলভ আচরণ করি, এবং তখন আমার মধ্যে কোনো ধরনের নারীবাদ বাস করে না।
আপনার রচনার ধাঁচ অনেকটাই স্বীকারোক্তিমূলক। এটি কি নিছকই একটি রচনার ধরন, নাকি আপনি সত্যি সত্যিই আপনার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকেন?
কমলা : যখন আমি লিখি, তখন কেবল সত্যি কথাই লিখি। এভাবেই আমি আমার লেখার মাধ্যমে নানা স্বীকারোক্তি দিই। কিন্তু রোমান ক্যাথলিকরা যেমন বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তি দেয়, সেরকম স্বীকারোক্তির আমার প্রয়োজন নেই। আমি মিডল ম্যানে বিশ্বাসী নই। আমি আমার ভেতরের কণ্ঠস্বরকে শুনি। সেটি হলো ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর। সৃষ্টিকর্তার প্রতি যদি আমাদের বিশ্বাস থাকে, এবং তার সঙ্গে থাকে গোপন যোগাযোগ, তাহলে পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ থেকে শুরু করে আইন-আদালত, কাউকেই আমাদের ভয় পাওয়ার দরকার নেই।
আপনার স্বীকারোক্তিমূলক কবিতাগুলোর সঙ্গে সিলভিয়া প্ল্যাথের কবিতার মিল রয়েছে। জীবনের কোনো পর্যায়ে কি আপনি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন?
কমলা: অনেক গবেষকই এমন তুলনা করছেন। সচেতনভাবে আমি কখনো কোনো লেখককে অনুকরণ করিনি, কারণ আমি অন্য কোনো ব্যক্তির কথা নিজের মুখে বসাতে চাই না। আমার জীবনের সঙ্গে তার জীবনের অনেক মিল রয়েছে, কেননা আমরা দুজনই ছিলাম অসুখী নারী। তাই এমনটি হতেই পারে যে দুজন নারী কবির অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ একই রকম।
মানুষকে আপনি কী বার্তা দিতে চাইবেন?
কমলা: সবসময় ভালোবাসার পথ অনুসরণ করুন। জীবজন্তুকে ভালোবাসুন, গাছকে ভালোবাসুন, দরিদ্রকে ভালোবাসুন, বয়োজ্যেষ্ঠদের ভালোবাসুন, শিশুদের ভালোবাসুন। ভালোবাসুন সবকিছুকেই, কেননা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র পথ হলো ভালোবাসা।