লীলা কাল মর্গে এসেছিলো

লীলা কাল মর্গে এসেছিলো
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
লীলা গতকাল গভীর রাতে মর্গে এসেছিলো। হরিৎ তাকে দেখেই হেঁচকি ওঠার জোগাড়। হরিৎ যে আজকে মর্গে আসবে তা কাউকে বলেনি। এটা তার স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট। পত্রিকা অফিস থেকে তাকেই বিশেষভাবে নির্বাচন করে দেওয়া হয়েছে এই অ্যাসাইনমেন্ট। বাংলার ছাত্র হরিৎ কখনও অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেনি। সে বরাবরই পাঠক ফোরাম কিংবা সাহিত্য সাময়িকীর বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। একটা আট বছরের শিশুকন্যা আজকে দুপুরে একটায় মারা গেছে। তার মৃত্যুর কারণ হলো বড় বোনের স্বামী, ভাসুর ও শ্বশুর কর্তৃক উপর্যুপরি ধর্ষিত হওয়া। ধর্ষণের আটদিন পরে সে মারা গেছে। বিষয়টি হৃদয়বিদারক। ঘটনাটি কোটি মানুষের মনে দোলা দিয়ে গেছে। তাই পত্রিকার সম্পাদক বেছে বেছে হরিৎকেই পাঠালেন বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে। এখানে রিপোর্টের সত্যতার সাথে আবেগের প্রবাহও থাকতে হবে যাতে মানুষের হৃদয়কে বিয়োগান্তক বেদনায় স্পর্শ করা যায়। যাতে জনগণকে ধর্ষকের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলা যায়। হরিৎ এতো রাতে অ্যাসাইনমেন্টের কাজে মর্গে আসার কারণ হলো অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমকে এড়িয়ে যাওয়া। কারণ সব পত্রিকার রিপোর্টিং এক হওয়া চলবে না। তার পত্রিকার রিপোর্টিং একটু আলাদা হতে হবে। এটার ওপর তাদের সিরিজ রিপোর্ট যেমন হবে তেমনি ফলো আপও থাকবে নিয়মিত। মর্গের দায়িত্বে যে পিয়ন থাকেন, তাকে হরিৎ আগে থেকেই কন্টাক্ট করে রেখেছে। হাতে শ’দুয়েক টাকা গুঁজে দিয়েছে চা-নাশ্তার খরচ হিসেবে। তারা অবশ্য চা খায় না কি দারু খায় তা হরিৎ জানে না। তার জানারও দরকার নেই। কিন্তু হরিতের মাথা এ মুহূর্তে বিগড়ে দিয়েছে লীলা। বলা নেই কওয়া নেই, কোত্থেকে সে হাজির। ভাগ্য ভালো, সে ছাড়া আর কেউ তাকে দেখতে পায় না। নচেৎ এই রাত দুপুরে হরিৎ স্বয়ং মর্গে লাশ হয়ে পড়ে থাকতো।
হরিতের এলোমেলো ভাবনাকে নাড়িয়ে দিয়ে লীলা জিজ্ঞেস করলো, এখানে কে আছে হরিৎ? হরিৎ বিরক্তি লুকিয়ে জবাব দেয়, আছিয়া। ওহ্! সেই মেয়েটা? লীলা উৎকণ্ঠা ভরে জিজ্ঞেস করে। যে কি না পরপর তিনজনের কাছে ধর্ষিত হয়েছে! আহা! কত কষ্ট যে মেয়েটা পেলো! লীলা মৃত মেয়েটার জন্যে শোক ঝরাতে লাগলো। হরিৎ এবার লীলাকে বলে, দাঁড়াও, কয়েকটা ছবি তুলি। আরে তোমার না! মেয়েটার। ছবি তুলতে তুলতে একসময় হরিতের নিজের চোখে বান জাগে। সে ঝাপসা দেখে। লীলা অবাক হয়। এই আপাত সীমারের বুকে এতো মায়া, এতো কষ্ট! লীলা এসে হরিৎকে সান্ত্বনা দেয়। বলে, দেখো, এ নিয়ে দেশ আবার উত্তাল হবে। আবার মেয়েরা রাস্তায় নামবে। এদেশকে ধর্ষক মুক্ত করার এ আন্দোলন এবার পরিণতি পাবেই। হরিৎ মাথা নাড়ে। বলে, হলেই ভালো। ছবি তুলতে তুলতে আর লীলার সাথে বকবক করতে করতে হরিতের কখন যে আধাঘন্টা কেটে গেলো টেরই পেলো না। টের পেলো তখন, যখন পিয়ন এসে তাগাদা দিলো মর্গ হতে বের হওয়ার।
এমনিতেই মর্গে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। প্রথমত মর্গে শীতল পরিবেশ। দ্বিতীয়ত ফরমালিনের গন্ধ আর তেজে চোখনাক জ্বালা করে। তৃতীয় যে কারণ তা অবশ্য হরিৎ মানে না। ভৌতিক কারণ। অনেকেই বলে, মর্গে আসে অপমৃত্যুর লাশগুলো। তাই এখানে ভূতপ্রেতের ভয় থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু হরিৎ কখনও এসব মানেনি। মর্গ হতে বের হয়ে হাঁটতে থাকে লন ধরে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চত্বর কখনও ঘুমায় না। এখানে রাত তিনটে বাজলেও পুয়া-পিঁয়াজু বানানো হয়। সাথে গরম গরম চায়ের ধোঁয়া ওঠে অনবরত। হরিৎ আর লীলা গোল চত্বরের রডে বসে পুয়া আর চায়ের অর্ডার দেয়। এক পিচ্চি খুব সুন্দর করে তাদের হাতে দিয়ে যায় খাবারগুলো। হয়তো মনে করেছে মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। আশেপাশে এরকম আরও কয়েকজোড়া হাঁটছে কিংবা বসে চা-পিঁয়াজু খাচ্ছে। এরা হয়তো ইন্টার্ন ডাক্তার হবে। কাঁধে স্টেথো। লীলার সাথে কথা বলতে বলতে হরিৎ মোবাইলে ইন্ট্রোটার ড্রাফ্ট লিখে ফেলে। তার রিপোর্টের শিরোনাম সে দিয়েছে বৃহত্তর পটভূমি নিয়ে। শিরোনাম ছিল, ‘মৃত আছিয়া পুনরুজ্জীবিত ধর্ষিত বাংলাদেশে।’ লীলাকে সে শিরোনামটা শোনায়। লীলা শুনতে শুনতে মন্তব্য করে, হুম। শিরোনামটা টাচি হয়েছে। তবে ধর্ষিত বাংলাদেশ না লিখে লেখো, ধর্ষকের বাংলাদেশে। পরামর্শটা মনে ধরে হরিতের। আসলেই তো। বাংলাদেশ যেন এখন ধর্ষকের স্বর্গরাজ্য। কথায় কথায়, যে কোন উছিলায় নারীরা এখানে ধর্ষিত হচ্ছে। শুধুই কি নারী? ছেলেরাও কি বলাৎকারের শিকার হচ্ছে না? এ বাংলাদেশ এখন আর বীরের বাংলাদেশ নেই, এ বাংলাদেশ এখন আর লাল-সবুজের বাংলাদেশ নেই। এ যেন ধর্ষকে টইটম্বুর এক দেশ। নারীরা আজ আর কারও কাছে নিরাপদ নয়। শিক্ষক থেকে শুরু করে নানা, শ্বশুর, ভাসুর, মামা এমনকি জন্মদাতা পিতার কাছেও কোন শিশুকন্যা আজ আর নিরাপদ নয়। লীলার শিরোনামটাই আজকের বাংলাদেশের জন্যে সঠিক। এ বাংলাদেশ ধর্ষকের বাংলাদেশ। হরিৎ শিরোনামটা সম্পূর্ণ করে : মৃত আছিয়া পুনরুজ্জীবিত ধর্ষকের বাংলাদেশে। লীলা আফসোস করে মাথা,দুলিয়ে; কী লজ্জা! কী লজ্জা!
চায়ে চুমুক দিতে দিতে লীলা হরিৎকে জিজ্ঞেস করে, জানো না কি, মর্গ শব্দটা কোত্থেকে এসেছে? হরিৎ মাথা দুলিয়ে বলে, না তো। লীলা এবার তার চিরাচরিত জ্ঞানভাণ্ডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মর্গ শব্দটি এসেছে মূলত ফরাসী থেকে। এর প্রাথমিক অর্থ ছিলো বেওয়ারিশ লাশগুলো চিহ্নিত করে না নেওয়া পর্যন্ত সংরক্ষণ করা। কিন্তু আধুনিককালে অপমৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্ত বা সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করার জন্যে মর্গ ব্যবহৃত হয়। আমেরিকানরা যাকে মর্গ বলে বৃটিশরা তাকে বলে মরচুয়ারি। মর্গের দুরকম ভেদ আছে। একটা হলো ধনাত্মক মর্গ আরেকটা হলো ঋণাত্মক মর্গ। যখন খুব অল্প সময়ের জন্যে লাশ সংরক্ষণ করতে হয় তখন কেবল কক্ষের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্যে দুই ডিগ্রি থেকে চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটাই ধনাত্মক মর্গ। তাপমাত্রার ধনাত্মক মানের কারণে মর্গের নাম হয়েছে ধনাত্মক মর্গ। ধনাত্মক মর্গে মৃতদেহের পঁচন পূর্ণমাত্রায় রোধ করা যায় না। আবার ফরেনসিক বিষয়গুলো সংরক্ষণের জন্যে কখনও কখনও মর্গের তাপমাত্রা মাইনাস দশ হতে মাইনাস পঞ্চাশে বজায় রাখতে হয়। এটাই হলো ঋণাত্মক মর্গ। ঋণাত্মক মর্গে মৃতদেহের পঁচন রোধ করা যায়। হরিৎ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে যায় লীলার এই বিনামূল্যে লেকচার। মাঝে মাঝে মেয়েটি অতি দরকারি কথা বলে। আছিয়ার রিপোর্ট লিখতে গেলে তার এই জ্ঞানটুকু দরকার ছিলো। লীলার কথা শুনতে শুনতে হরিতের মনে একটা প্রশ্নের উদ্রেক হয়। সে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা বলতো, প্রথম কখন কোথায় মর্গ তৈরি হয়? লীলা তার ডান হাত তুলে হরিৎকে থামায়। রোসো রোসো। ধীরে বন্ধু ধীরে। এই বলে সে চায়ে চুমুক লাগায়। তারপর বলতে শুরু করে। মর্গ শব্দটা প্রথম রেকর্ডেড হয় আঠারোশ পঁয়ষট্টি সালে। আঠারোশ ছেষট্টি সালে প্রথম মর্গ প্রতিষ্ঠিত হয়। নিউ ইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে প্রথম মর্গ তৈরি হয়। হরিৎ উত্তর পেয়ে আবার উৎসাহী হয়ে ওঠে। এখন সে একটু লীলাকে ভয় লাগাতেই জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, কেউ কি মর্গে রাখার পরও জীবিত হয়ে উঠেছিলো? লীলা হেসে দেয়। হরিৎকে বলে, তুমি কি মনে করেছো আমি ভয় পাবো এই রাতে? আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিজ্ঞান। আমি যুক্তি আর সত্য দিয়ে চলি। তথ্য আমার হাতিয়ার। শোনো, তোমার এই প্রশ্নেরও উত্তর আমার কাছে আছে। ইকুয়েডরের বাসিন্দা বেলা মনটোয়া নামের এক নারীকে মনে করা হয়েছিলো স্ট্রোকে মারা গেছে। তাকে মর্গে রাখা হয়েছিলো। অনুমিত মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে একজন ডাক্তার বেলার কফিনে ঠুক ঠুক আওয়াজ শুনতে পান। একবার নয়, পর পর দুবার তিনি এ আওয়াজ শোনেন। অবশেষে কোন কফিন থেকে আওয়াজ আসছে তা নিশ্চিত হয়ে কফিনের ডালা খুলে দেখেন, বেলা মনটোয়া জীবিত। ডালা খোলার সাথে সাথে তিনি উঠে বসেছেন। লীলার এই আজব কথা শুনে হরিতের রোমে কাঁটা দিয়ে গেলো। একটু ধাতস্থ হতে না হতেই অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের আওয়াজে তার দৃষ্টি ঘুরে যায়। একটু এগিয়ে গিয়ে জানতে পারে, এইমাত্র আরেকটা লাশ ঢুকলো মর্গের ঘরে। সে-ও ধর্ষিতা নারী, দু’সন্তানের জননী। সঙ্গে থাকা পুলিশের সাথে কথা বলে জানা যায়, ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঐ নারীর মাতৃত্বের অঙ্গগুলো ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। লীলা ক্ষেপে যায় একথা শুনে। আহা! কী নামলো দেশে! মানুষ যেন আদিম যুগে ফিরে গেছে উন্মাদ হয়ে। একটু ধাতস্থ হয়ে বসতে না বসতেই হাসপাতালের তৃতীয় তলা থেকে ভেসে আসে কান্নার রোল। এক তরুণী তার লম্পট স্বামী ও তার বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে মৃত্যুর সাথে গত দুদিন ধরে পাঞ্জা লড়ছিলো। বাঁচার ক্ষীণ আশা দেখিয়ে সে চলে গেলো অগস্ত্য যাত্রায়। লীলা তার দুকানে আঙুল চেপে বসে পড়লো। বুঝাই যাচ্ছে, সে আর নিতে পারছে না এতো বর্বরতার চাপ। অল্প কিছুক্ষণের অভিজ্ঞতা আজ হরিৎকে অনেক বেশি পরিপক্ক করে তুলেছে। রাত গভীরের টার্শিয়ারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চালচিত্রই বলে দেয়, দেশ ও কালের পরিস্থিতি এখন কেমন। মনে হচ্ছে, সবার অনুভূতির দন্ডে অজানা শয়তান ভর করেছে।
মনকে হাল্কা করতে হরিৎ বসার জায়গা পাল্টাতে চায়। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চত্বরে অনেক ভবঘুরে আছে যারা রাত কাটায় এখানে সেখানে। এদের ঘুম যেন চাহিবামাত্র চোখে ভর করে। আবার কখনও কখনও পুলিশে তাড়া দিলে ওরা বিছানা গুটিয়ে চলে যায়। ভবঘুরেদের অনেকেই নারী। এদের কেউ কেউ বয়ষ্ক আর কেউ কেউ কম বয়সী তরুণী। হরিৎ আর লীলা মনমতো বসার জায়গা পায় না। তারা হাঁটতে থাকে অডিটোরিয়ামের সরণি ধরে। রাস্তার বাতিগুলো কিছুটা আলো ধার দিয়ে সরণিটাকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। হাঁটতে হাঁটতে লীলা বলে ওঠে, আগেকার দিনে ব্রথেলগুলো মূলত এ কারণেই তৈরি করা হয়েছিলো। গৃহস্থ ঘরের মা-বোনদের নারীত্বের ঐশ্বর্য রক্ষায় কিছু সংখ্যক ব্রথেল চালু ছিলো যাতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ পুরুষেরা ঐসব জায়গায় গিয়ে জ্বালা মেটাতে পারে। হরিৎ বলতে শুরু করে, আসলে আমাদের আজকালের খাদ্যাভ্যাসও এই ধর্ষণপ্রবণতা বৃদ্ধির জন্যে একটা বড় কারণ। আজকাল মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সপ্তাহব্যাপী দিনে চারবেলা মাংস খায় মানুষ। অথচ চল্লিশ বছর আগেও আমাদের খাদ্য তালিকায় সপ্তাহে দুদিন বাজার বারে মাংস থাকতো। তখন মানুষের মধ্যে এধরনের পশুপ্রবণতার বাড়বাড়ন্ত ছিলো না। লীলা হরিতের সাথে একমত হয়। আসলে একটা ফ্যাক্টর নয়, আমাদের সমাজে অনেকগুলো ফ্যাক্টর একসাথে আজকাল ধর্ষণপ্রবৃত্তি বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে জড়িয়ে আছে। কেউ কেউ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে অতিরিক্ত যৌনতাকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ অবাধ তথ্যপ্রযুক্তিকে দায়ী করছে। আবার অনেকেই আগেকার দিনের চেয়ে আজকাল নারীসঙ্গের সহজলভ্যতাকে ধর্ষণ বাড়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছে। মূলকথা হলো ধর্ষণ বেড়ে গেছে। সে যে কারণেই হোক। এটাকে এখন শক্ত হাতে দমন করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ যেমন জরুরি তেমনি অভিভাবকদের সচেতনতাকেও বাড়াতে হবে। দুদিনের পরিচয়ে প্রেম নিবেদনকে যেমন প্রত্যাখ্যান করতে হবে কড়াভাবে তেমনি সন্তানেরা কোন্ ধরনের কনটেন্ট অনলাইনে বেশি পছন্দ করছে সে বিষয়েও বাবা-মার শ্যেন দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। প্রতিটি পরিবারে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি মননশীল বই পাঠের সময় ও সুযোগ বাড়াতে হবে। ঘরে ঘরে ওয়ারড্রোবের চেয়ে বুকশেল্ফের সংখ্যা বাড়াতে পারলে প্রজন্মের মনোচেতনায় সুন্দরের চর্চা গড়ে উঠবে। ঘরে বা ভবনে, বারান্দায় ও গলিতে ক্লোজড্ সার্কিট ক্যামেরা বসাতে হবে ব্যাপকভাবে। যাতে কুকর্ম করে কেউ পার পেয়ে না যায়। ধর্ষকের পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করা জরুরি। এতে আর কোন ব্যক্তি ধর্ষকের পক্ষে কথা বলবে না। দলীয় রাজনীতি যাই হোক, ধর্ষক যেন কোনো দলে স্থান না পায়। কঠিন আলোচনায় লীলা ও হরিৎ হাঁপিয়ে উঠেছে। এর ফাঁকে হরিৎ প্রশ্ন তোলে। তাই বলে কি ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব থাকবে না? তা না হলে তুমি আর আমি কি এ আলোচনায় অংশ নিতে পারতাম? লীলা বলে, অবশ্যই ছেলেমেয়ের মধ্যে বন্ধুতা থাকবে। তবে তা কোন গোপনীয়তায় নয়, পরিবারের অজানা কিছুই থাকবে না। এ বন্ধুতার সকল প্রকাশ আড়ালে আবডালে নয়, আলোর সমক্ষে তা হবে। পূতঃ পবিত্র বন্ধুতায় কোনো বাধা নেই। বন্ধুর মধ্যে নারী-পুরুষ ভাবনা যখন এসে যায়, তখন তা আর বন্ধুতা থাকে না। তাতে ধীরে ধীরে যৌনতার উপাদান অনুপ্রবেশ করে। আর আমার কথা বলছো? আমি ভালো করেই জানি তুমি কে আর আমি কে। কাজেই আমাদের সংগ যৌনতার প্রশ্নাতীত। একজন লীলা যখন হরিতের মননসখা তখন শরীরী ভাবনাগুলো সেখানে প্রবেশাধিকার পায় না। আর অশরীরী লীলার ধর্ষিতা হওয়ার আশঙ্কাই বা কোথায়?
কঠিন আলোচনায় দুজনের চায়ের পিপাসা পেয়ে যায়। তাই আরেকবার গলা ভিজিয়ে নেয় দুজনে। গরম চায়ে ফুঁ দিয়ে যে খায়নি সে জানে না, চায়ের মজাটা কোথায়। চা খেতে খেতে হুট করো হরিৎ জিজ্ঞেস করে চা-দোকানীকে, ভাই এ চায়ের গন্ধটা কেমন যেন। তার কতা শুনে দোকানী হেসে দেয়। বুঝতে পারছি ভাইজান, আপনি কী বলতে চান। এখানে কোনো ভেজাল চা-পাতা পাইবেন না। অবশ্য কেউ কেউ লাশের চা-পাতা ব্যবহার করে। আমরা কখনও করি না। চা-দোকানীর এ কথা শুনে লীলার যেন বমি পায়। হরিৎ আশ্বস্ত করে। আরে না, তারা লাশের চা-পাতা পাবে কই। মর্গে তো ফরমালিন ব্যবহার করে। হরিতের কথায় তবু লীলার সন্দেহ যায় না। সে চিন্তা করে, আর কখনও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চত্বরে রাতে চা খাওয়া সমীচীন হবে না।
সময় গড়াতে গড়াতে হরিৎ খেয়াল করে, লাইলাক প্রহর উপনীত। একটু পরেই অরুণরাঙা আকাশে নতুন ভোরের আগমনী দৃশ্যমান হবে। চারদিকে নিদ্রাচ্ছিন্ন পাখির কিচিরমিচিরে জগত যেন জেগে উঠেছে। মৌন তাপস আকাশের গেরুয়া বরণে হরিৎও হয়ে ওঠে ধ্যানী। তার ধ্যানে ভেসে ওঠে আছিয়ার বেদনাদীর্ণ মুখ, ভেসে ওঠে তরুণী বধুর পৃথিবীকে ধিক্কার জানিয়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি। দু’সন্তানের জননীর বুকে জেগে ওঠা মাতৃত্বের আর্তনাদ যেন হরিতের কানে বাজিয়ে চলেছে পাঞ্চজন্য শঙ্খের মহানাদ। নিজ ভাবনায় মুহূর্তে তলিয়ে যাওয়া হরিৎ লীলাকে খোঁজে। আশেপাশে লীলা নেই। লীলা কই? লীলা যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেছে আঁধার চেরা আলোর রেখায়। লীলা যেমন তার ঘুমের মধ্যে আসে, তেমনি লীলা আসে তার মননে-মস্তিষ্কে। ভাগ্যিস, এমন আর্তনাদের রাতে লীলা ছিলো পাশে! নচেৎ আছিয়ার বিদীর্ণ মুখচ্ছবিতে হরিৎও তলিয়ে যেতো মানব ইতিহাসের পুঁতিগন্ধময় অশিষ্ট জলে।
শুরু করলে আর নতুন করে কিছু ভাববার প্রয়োজন নেই। জেগে থাকো, হাঁটো কিংবা বিড়ি খাও…
Ismat Shilpi2025-03-30T20:27:10+00:00March 30, 2025|
কুন্টার মুক্তির আনন্দ
Sumon Biplob2025-03-30T10:38:17+00:00March 30, 2025|
গঙ্গা পাড়ের বৃত্তান্ত
Priyojit Ghosh2025-03-29T12:19:22+00:00March 29, 2025|
আমি ও জ্যোতি পোদ্দার
Jyuti Podder2025-03-30T09:42:15+00:00March 29, 2025|
চন্দ্রাগিরি
Sumanta Gupta2025-03-28T21:29:59+00:00March 28, 2025|
হোয়াইট আর্কেডিয়া এবং মেথুকীর গল্প
Syed Mahmud2025-03-28T21:30:01+00:00March 28, 2025|