শুধু বিয়োগ নয়, যোগ দিয়েও ভাবা উচিৎ। তাহলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়
ইসমত শিল্পী
যুগ যতই আধুনিক হোক না কেনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা পাল্টাবার শক্তি সমাজের কোনোদিনই হলো না। আদৌ হবে কি ? হবে কি করে ? আমরা কয়জন নারী আছি, যে অন্য নারীকে আহত হতে দেখলে প্রটেকশন দিতে পারি ! দুরবস্থা বুঝে হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারি ! নারীবাদ নিয়ে শ্লোগান দিয়ে, তথাকথিত জনদরদী হয়েই বা কতটা উদার হতে পেরেছে নারীসমাজ ! যেটা হচ্ছে, এক কথায় নিজ নিজ অবস্থান তৈরি এবং অনরকম হব এই মনোভাব নিয়ে কাজ করা। মানে নারীর অধিকার বাস্তবায়ন ও সামাজিক উন্নয়ন। উন্নয়ন কোথায়; কতটা ? কীভাবে হচ্ছে ? কোনদিক থেকে ? যেটুকু হচ্ছে, সেটুকু যার বুক কেটে রক্ত ঝরছে, বুকের বাকি অর্ধেকখানি নিয়ে নিজের শক্তির উপর ভর দিয়ে সামনে চলার দৃঢ় মনোবল তৈরি করেই সে চলছে। সেই কৃতিত্ব একেবারেই তার নিজস্ব-আমি বলবো। খুব কমই দেখা যায়, সঙ্গের লোকটা উদার হতে। আর সঙ্গের নারীটি এগোতে পেরেছে ধাপে ধাপে। বা এমনটা হয়েছে – টাকার কমতি নেই বলে অবলীলায় সবই করতে পারছে। স্বামী ও পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে তাই নিয়ে করতে পারছে। কিন্তু যারা শুধুমাত্র যোগ্যতার উপর দাড়িয়ে চলে ! সবকিছুর মূল তো ক্যাপিট্যাল টাকা। যুগকল্পের বিচারে যুগকে মেলাতে গেলেই যত অমিল। এই যুগ সেই যুগ, এখন যার যত টাকা তার তত বেশি ক্ষমতা। ডিগ্রী টিগ্রী কোনো ব্যাপার না। ব্যাপার হলো প্লাটফর্ম। ক্ষমতা। পাওয়ার। রেফারেন্স। গড়ে দেওয়া প্লাটফর্মে ইচ্ছেমত কাজ করা যায়ই। কিন্তু কাজের জন্যে অবস্থান তৈরি করে নিতে হলে বোঝা যায়- কত ধানে কত চাল। কর্মজীবী নারী মানেই তো সবাইকে একই অঙ্কে হিসেবে বসানো যায় না। তবে হ্যাঁ, মেধার বিচারে স্থান পাওয়া অন্য কথা। কিন্তু বর্তমানে এই অঙ্কে হিসেব কষা নিরর্থক। নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু না। সেখানেও উপরের ব্যাপারগুলোই থাকে।
সমস্যা যেনো শুধু তাদেরকে নিয়েই। শ্রমজীবী নারী। কর্মঠ নারী। দক্ষ নারী। একশো ভাগ নিজের শ্রম, দক্ষতা এবং মেধা খাটিয়ে উপর্জন করে জীবন চালানো নারীর।
তবু, শুধু বিয়োগ নয়, যোগ দিয়েও ভাবা উচিৎ। তাহলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। যাদের সাথে কথা বলি যেসব দেখি- এসবের অতীত আমাকে ভাবায়। এগুলোই লেখার জন্য পীড়ন সৃষ্টি করে। না লিখে থাকতে বড্ড কষ্ট হয়। নিজের অতীত নিয়ে কিছুই লেখা যায়নি কখনো। যাবে কি কখনও…! সবকিছু লেখা যায় না।
মাঝে মাঝে ঝেড়ে ফেলে দিই-অনুভব। ধূর, কী হবে এসব আবেগ অনুভূতি ! অথবা জীবন আর জীবিকার তাগিদে হারিয়ে যায় সব অনুভূতি। আসল জীবনকে বাদ দিয়ে ঘামের মতোন অস্বস্তিকর আরেক জীবনকে বুকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার রুটিন। মাঝে মাঝে মনে হয়-যা লেখি তা কিচ্ছু হয়না, ভুল প্রলাপ; পড়ে থাকুক সব। কাজ করতে হয়-জীবিকার তাগিদে। জীবনের প্রধানতম লড়াই-টিকে থাকার হয় না- বেঁচে থাকার হয়ে ওঠে। তখন আর লেখার শক্তি থাকে না। লিখতে ইচ্ছে করে না। কবিতাকে কবিতা মনে হয় না-একটাও। নিজেকে লেখার কাছে ফেরাতেও যেনো ক্লান্ত লাগে বড্ড। তার মাঝেও কিছু ভালোলাগা অপ্রত্যাশিত। ইমোশনাল করে তবে ছাড়ে। অনুভূতিকে জাগিয়ে দেয়, ভালোলাগা বুঝি এমনই। নিজের আবেগকে মূল্য দিতে শেখায় সে—।
বাঁশির শিল্প, শ্রম মূল্যহীন হয়েছে বলেই তার সুর এমন করুণ। বাঁশি, মিলিয়ে যায় ঢাকের শব্দে…! এই যুগ এমনই।
এই যুগ বা সেই যুগ বলে কোনো কথা নেই। যুগ মানে একটা অধ্যায়। একটা দীর্ঘ সময়। এক চক্রব্যুহ থেকে আরেক চক্রের আবর্তে; একটা ঘোর থেকে আরেক ঘোরে। আসলে যুগ হলো একটা চক্র। দৌড়োনো অথবা স্থির বলেও কোনো কথা না, চলমান একটা আবহ; ঘুরপাক খেতে থাকা। পাক খেতে খেতে কোন পথে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। জানার বিষয় থাকে অনেক কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই জানাতে কূল হয় না। যুগের আবহ নিজ গতিতে চলবে বা চলছে তাও বলা যায় না। ভাবনাবোধের জায়গাগুলো যদিও সবই ঠিকঠাক থাকে। পাক খেতে থাকে সেই ভাবনা। ভাবনাও স্থির হতে পারে না এই ব্যুহের চক্রে। অস্থির একটা আবহে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ক্লান্তি মানেই স্থিও বা অচঞ্চল বসে থাকা নয়। ক্লান্তি মানেই অবসর নয় জিরোতে পারাও নয়। এই ক্লান্তি ঝিমিয়ে যাওয়ার এক রূপ। সেটাও যুগের প্রয়োজনে; এই চক্রের আবহেই।
এই ক্লান্তিতে অস্থিরতার জন্ম। অস্থিরতা মানেই চঞ্চলতা নয়। ছুটতে থাকা নয়। হেটে চলার মতো রিমঝিম এক ছায়ার চলন বলন। এই অস্থিরতা রাতদিন পায়চারি করতে থাকে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। কতক শব্দ উৎপন্ন হয়। অথচ চলতে পারে না। নতুন সৃষ্টিতে মগ্ন হতে পারে না; মস্তিষ্কের কোষ এবং শব্দেরা। কোথায় যেনো ঘা’ খায় দিনরাত; শব্দরা মরতে থাকে দিনদিন। কী এক অচেনা চিত্রপটে ধাক্কা খায় শিল্প। কী এক মৃত্যু আঁধার ছেয়ে ফেলে দশদিক। শব্দের কান্নায় ঘুম জেগে থাকে সারারাত। কিছুতেই ঘুমোতে পারে না প্রথম থেকে দ্বিতীয় প্রহরের ঘুম। তৃতীয় প্রহরে স্বল্পনিদ্রার একটা কালঘুম এসে দানা বাঁধে চোখের পাতায়। তাকে ঘুম বলা যায় না। সেও এক অসুখ, বিকট ভোগান্তির প্রহর। বিশাল এক পেরোতে না পারা কাল। সেটুকু না হলেই বরং ভালো হতো। সেই প্রহরটা জন্ম না হলেই বরং বেঁচে যেতো ঘুম।
ঘুমের ভেতর কতক স্বপ্নের আবাস; জন্ম, চলাচল। বাড়তে বাড়তে হঠাৎ ভেঙ্গে পড়া চারাগাছ- সেই গজিয়ে ওঠা স্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন নাকি সে ! না। দুঃস্বপ্নও এক দীর্ঘ প্রহর। এ তো তাও না। এটাও বরং একটা যুগ হয়ে গেলে ক্ষতি হতো না। ভালো হতো খুব। স্বপ্নের একটা আবহ। একটা নতুন যুগ। স্বপ্নযুগ যদি বলা হয় ? ভুল হয় ? না, ঠিকই হয়। সেই যুগে খানিক বিস্মৃতি খানিক তলিয়ে যাওয়া অতলে, ঘুমের প্রহরে। তন্দ্রাক্তুক্ত একটা কাল। বিকশিত দুঃখগুলোর মরে যাওয়া প্রহর। দুঃখপ্রহর নাকি সে ? নাকি দুঃসময় ! নাকি দুঃখকাল !
যুগ মানে দুঃসময়ের খাঁচা। শুধুমাত্র দুঃখের বেড়ে ওঠা নয় শুধুমাত্র ক্ষয়ে যাওয়া নয়। সময়ের অযাচিত ক্ষয়ে যাওয়া প্রহর। সময়ের আবর্তে চলতে থাকা সময়। এর নাম যুগ। কাল থেকে কালান্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যত রোদ সবই কী তবে দুঃসময়ে পতিত হয়েছে ? না, সবের বেলায় তা হয়নি। হবেও না। মুষ্টিমেয়দের দল বরাবরই ওজনে ভারি হয়। তাই খুব বেশি প্রকৃষ্ট হয়ে ধরা পড়ে সেই কাল। সেই মুষ্টিমেয়কে নিয়ে কোনো যুগ বেশিদিন সচল থাকতে পারে না। কিন্তু মুষ্টিমেয় দিয়েই সংখ্যাগুলো বেঁচেবর্তে আছে-এই যুগে। একটা খণ্ডিত যুগের আবহে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই। কেউ বুঝে, কেউ বা না বুঝে। কেউ ইচ্ছে করে, কেউ জীবনের দায়ে। জীবনের দায় ছিলো-ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু ক’জনের বেলায় তা ঘটে ? অধিকাংশের বেলাতেই জীবনের কাছে ইচ্ছের মৃত্যু ঘটছে। চলমান যুগ ইচ্ছেঘুড়িকে দাম দেয় না। নিজের দরকারে নিজস্ব ব্যুহের ভেতরে বসবাস করছে সময়। দরকারকে দাম দিয়ে মুষ্টিমেয়ের দ্রুতগতি জীবন-যাপন। স্রেফ জীবন বলা যায় না এমন একটা গতির মধ্যে পতিত হচ্ছে আনন্দ ভর্তি সাদা পানির গ্লাস। গ্লাসগুলো রং বদলায়, রঙিন হয়। যাপন রং ধরে হাজার রকম। জীবন হারিয়ে যায় ছোট্ট গ্লাসের ভেতর।
এই মুষ্টিমেয় তবে কারা ? চোখ দিয়ে চেনা যায়, যায় না। মন দিয়ে বোঝা যায়, যায় না-এমন। স্রোতের মতো সকল পানীয় গড়তে গড়তে সেই চকচকে গ্লাসে গিয়েই আটকে যাচ্ছে। সকল জীবনকে মুষ্টবদ্ধ করে পিষে মারতে উদ্দত হয়েছে কিছু হাত। মুষ্টিমেয় এইসব হাতের বিপরীতে তাকিয়ে থাকছে অধিকাংশ এক শ্রেণী। বড্ড তির্যক সে দৃষ্টি। বড্ড তৃষ্ণার্ত সেই চোখ। ভয়ানক কিছু দলিতের কণ্ঠ; জন্ম নিয়েছে ঘুম ঘোরের শেষ প্রহরে। যেই প্রহরের আবর্তে আবদ্ধ থাকতে পারেনি কোনো দুঃস্বপ্ন। জন্ম নেয়নি কোনো দুঃসময়। সে এক অন্যরকম শব্দ। অন্যরকম কর্কশ এক কাল। অন্যরকম ঘুমের যুগ পার হয়ে জেগে ওঠে সেই চিত্রপট। হাজার হাজার শব্দ দিয়েও আটকে রাখা যায় না তাকে। যার নামকরণ করা হয়-বঞ্চিত।
সব কালকে ছাপিয়ে এই শব্দ বেজে ওঠে সকল যুগের তালে তালে। সব ঘুমকে গিলে খেয়ে জেগে থাকে একটাই প্রহর। একই প্রবাহ, একই যাত্রা। সব যুগকে হাততালি দিয়ে উচ্ছেদ করতে উদ্দত হয়েছে এই প্রবাহমান কাল। এটাই সময় এবং সময়ের আসল মানে। এটাকেই যুগ বলা যেতে পারে। দীর্ঘ এক পদযাত্রা, দীর্ঘ মিছিল এক। একই আবর্তে ঘুরে ফিরে চলছে একটাই যুগ। একইভাবে ধাবমান সময়।
যুগ থেকে যুগান্তরে এই যে যাত্রা এটাই কী তবে চেতনা প্রবাহ !!!
ইসমত শিল্পী
সম্পাদক, নান্দিক
০২.০৯.২০২১