একটি খুনের আনন্দ (পর্ব ৪) – মহসীন চৌধুরী জয়

By Published On: November 24, 2023

কিছু দিন পর যা ঘটল তাতে মনে হলো, বাবাকে উসকে দিয়ে আমি যে অপরাধ করেছিলাম সে অপরাধ ছিল সামান্যই। চয়ন বাবাকে একটা ধাক্কাই তো দিয়েছিল। তারচেয়ে বেশি কিছু নয়। বাবার অপমানে আমি যে মর্মাহত ছিলাম সেটাকে আবার স্বাভাবিকতায় নিয়ে এলো ছোটো ভাই চয়নই। এবার বাবাকে স্ট্যাম্প দিয়ে পায়ে আঘাত করল। বাবার বাম পা-টা ভেঙে গেল। এখন বাবার সময় কাটে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। আমার প্রতি এখন আর সামান্যতম অভিযোগ নেই বাবার। নিশ্চয়ই নেই। এখন বাবার চোখের দিকে আমাকেই তাকাতে হয়। চোখের পানি মুছে দিতে হয়। চোখে চোখ রেখে শরীরের পরিচর্যাও করতে হয়।

চয়নের নেশার টাকার দরকার পড়ছিল প্রতিনিয়ত। শুরুতে বাড়ির এটা-সেটা চুরি করেই নেশার টাকার জোগান দিত। কিন্তু বাড়িতে চুরি করে সে টাকায় কত দিন আর নেশা করা যায়? এ তো ভাত মাছ না যে শরীর বেশি প্রাধান্য পাবে। নেশা তো মনকে প্রভাবিত করে। যখন ইচ্ছে তখনই নেশা করতে মন চায়। প্রতিবেশীর বাড়ি থেকেও শুরু হলো চুরি। অতঃপর চৌর্যবৃত্তিই প্রধান উৎস। পুরো এলাকাতে চলল নেশাকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। কিন্তু কত দিন? এভাবে আর কত দিন চলে?অন্য কোনো পথ না পেয়ে নেশার টাকার জন্য শুরু করল মায়ের সাথে বাদানুবাদ। বাবা দায়িত্ব নিয়ে প্রতিবাদ করতে আসায় এই পরিণতি। বাবা বিছানায় পড়ে গেল। মাটিতে পড়ে গেল পারিবারিক বন্ধন, পারিবারিক সৌন্দর্য।

আমাদের সংসারে অশান্তি তখন নিত্যদিনের। চয়ন আমাকে আপু বলে ডাকত। কী যে মায়াময় ও রসমিশ্রিত ছিল সে ডাক। কত মধুর স্মৃতিও আছে ওর আর আমার। নেশায় ডুবে পরবর্তী সময়ে আপু নয়, চায়না বলা শুরু করল। একটি মাত্র ছোটো ভাই আর ছোটো রইল না। ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করা এ কষ্ট কে অনুভব করবে? বড়ো বোনের কাছে একমাত্র ছোটো ভাই হয় পুরো পৃথিবীর চেয়েও বেশি আকাঙ্ক্ষিত। ভাই ছাড়া পৃথিবীটাই শূন্য হয়ে যায়। সেই ভাই আমার সাথে এমন অশোভন ও অসঙ্গত আচরণ করা শুরু করেছিল। তখন আমি আমার এ দুর্ভাগ্যের কথা কাকে বলতাম? বড়ো বোনদের?বড়ো দুই বোন বাড়িতে আসা বাদই দিয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে তাদের মানসম্মান আর থাকছে না। এ তো মিথ্যে বলাও নয়। দুটি পরিবারের সম্পর্ক সৌন্দর্যের বিনিময়েই বজায় থাকে। অথচ আমাদের পারিবারিক সৌন্দর্য তখন তলানিতে।

এদিকে অসুস্থ জীবন-বাস্তবতায় মা-বাবা প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল। এই সেই মা, যে তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়েছিল। একটি পুত্র সন্তানের মুখ কি তার নারীত্বকে পূর্ণতা দিবে না? কত অনাসৃষ্টি কাজ করেছিল পুত্র সন্তানের মানতে। এক্ষেত্রে বাবার দুঃখটা বরাবরই বেশি। বাবাই আমার নাম রেখেছিল চায়না। কন্যা সন্তান আর চায় না। এ যে পুত্র সন্তানের প্রতি প্রেম, আকাঙ্ক্ষিত ধন হিসেবে চাওয়া। সংসারে অশান্তিও করেছিল বাবা পুত্র সন্তান পুত্র সন্তান করে। মাকে ছোটো করে কথা বলেছে প্রতিনিয়ত। নতুন বিয়ের হুমকিও দিয়েছিল। সবই তো পুত্র সন্তান পাওয়ার জন্য। এই চয়ন বাবার মুখে হাসি ফুটাল। বাবার হাতে হাত রেখে হাঁটতে শিখল। বাবার পায়ের ওপর ভর দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে শিখল। সেই চয়নই বাবাকে পঙ্গু করে দিলো। বাবা নামক অস্তিত্বকে উপেক্ষা করে, অবমূল্যায়ন করে, এমনকি অস্বীকার করে। ‘সন্তান বাবাকে মেরেছে’ এরকম বিচার আমরা কার কাছে চাব? পারিবারিক মানসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে কীভাবে প্রকাশ করা সম্ভব? আমরা তিনটি প্রাণী কেমন অসহায় হয়ে উঠলাম আমাদের অতি আদরের ধন, বাড়ির একমাত্র প্রদীপের কাছে। আমি বলতে না পারলেও মা জনাকয়েক বিশিষ্টজনের কাছে প্রকাশ করেছে কিছু নির্মম সত্য। বিচারের দাবি জানিয়েছে তাদের কাছে। কিন্তু কী অদ্ভুতরকম সত্য, তাদের কারো কারো আশ্রয়েই নাকি চয়নদের প্রশ্রয়। আবার কেউ কেউ চয়নদের ভয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করল না। এলাকার অধিকাংশ ছেলে নেশাখোর। যারা নেশার বিরুদ্ধে কথা বলে তাদেরকেই এখন ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। আতঙ্কে থাকতে হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ সমাজজীবনকে ব্যাধিতে পরিণত করেছে। পারিবারিক এই অসুস্থতার মধ্যে সুজন একদিন মায়ের কাছে আমাকে চাইল। বিয়ের প্রস্তাব দিলো।

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop