একটি খুনের আনন্দ (পর্ব ৫) – মহসীন চৌধুরী জয়

By Published On: December 6, 2023

মা সুজনকে ফিরিয়ে দেয়। সুজন আমার যোগ্য না এ ব্যাপারে শুধু মায়ের কেন কারোরই কোনো সন্দেহ নাই। তাই বলে প্রার্থী হিসেবে আমার খুব গ্রহণযোগ্যতা তা-ও জোর দিয়ে বলা যাবে না। আমার ভাই মাদকসেবী, মাদক বিক্রেতা। পুরো এলাকার মানুষ ওর অসামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানে। পরিবারের অসচ্ছলতাও স্পষ্ট। বাবার পেনশনের কিছু টাকা, আমার টিউশন, আর বোন দুলাভাইদের সহযোগিতা—এভাবেই পরিবারের খরচ চলে। এ দুরবস্থায় পরিবার নিয়ে নিশ্চয়ই বড়াই চলে না। পারিবারিক স্ট্যাটাস মেইনটেইন সহজ কোনো বিষয় না। রুচিতে নিম্নবিত্ত না হলে অর্থসম্পদ কম থাকলেও সামাজিকতার সৌন্দর্যে মিশে যাওয়া যায়। কিন্তু চয়নের হাত ধরে সব সৌন্দর্যই নষ্ট হয়ে গেল।

আমার ছাত্র, পাঁচ বছর বয়সের, আমাকে যা জিজ্ঞেস করল, সে বিষয়টার মর্মে গিয়ে আমি রীতিমতো অসুস্থ বোধ করেছি। ছাত্রটি বলেছিল, ‘ম্যাডাম, আপনার ভাই নাকি হি-রু-ন-চি?’ আমি প্রথম অবস্থায় শব্দটাই বুঝতে পারিনি। ও তো কখনোই এ প্রসঙ্গে কথা বলে না। বুঝব কীভাবে! ওর সুন্দর মুখে ভাঙা ভাঙা শব্দে এই অপবিত্র শব্দটা ঠিকমতো উচ্চারিতও হচ্ছিল না। দ্বিতীয়বার বলার পর বুঝলাম। এ-ও বুঝতে পারলাম, ওর গার্ডিয়ানরা আমার পরিবার নিয়ে সমালোচনা করে। পরিবারের একজনের পাপ অন্যদেরও রেহাই দেয় না। জাহাজের একটা কক্ষ ডুবে গেলে পুরো জাহাজই ডুবে যায়। কিছু দিন পর গার্ডিয়ানরাই শুরু করল আমার নেশাখোর ভাইকে নিয়ে নানান আলোচনার নামে সমালোচনা। এতে তারা একটা স্বার্থবাদী দিক খুঁজে পেল। মানুষ স্বভাবতই সুযোগসন্ধানী। তারা মাছের বাজারে যেমন সুযোগ নেয়, সন্তানের শিক্ষকের সাথেও সমান সুযোগ নেয়। মাদকের নেশাখোর আর স্বার্থের নেশাখোরদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না নৈতিকতার বিচারে।

চলতি মাসেই আমার টিউশনের টাকা বাড়ানোর কথা ছিল। এ বিষয়টাকে গোপন উদ্দেশ্যে রেখে তারা নানান কথা বলতেছিল শিক্ষকের পারিবারিক মর্যাদা নিয়ে। এসব কথা তোলার অর্থ হলো আমার বাজারদর বুঝিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ সম্মানি বাড়াবে না। ওনাদের রুগ্ণ ভাষা এতটাই অস্বচ্ছ। আমি যতই ভালো পড়াই, আমার ভাই তো নেশাখোর, তাই আমি খুব ভালো শিক্ষক না। মানসিক পীড়নের সেই সময়ে চয়ন একদিন আমার ওপর আবারও চড়াও হলো। টিউশনের টাকা পাওয়ার ঠিক দু-তিন দিন পর। কখন আমার কাছে টাকা থাকে আর কখন থাকে না এটা না বোঝার মতো মাতাল ও না। আমি টাকা দেবো না বলে স্থির ছিলাম। কারণ গত মাসেও টিউশনের প্রায় অর্ধেক টাকা নিয়ে গেছে। আমার কাছে যখন টাকা চাইল, রাগে আমার শরীর জ্বলছিল। বলেছিলাম, ‘তোর জন্য আমার টিউশনের বেতন বাড়ছে না, নতুন কোনো টিউশনও পাচ্ছি না। পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে জিজ্ঞেস করে, আমার ভাই হিরোইনচি কি না? গার্ডিয়ানরা জিজ্ঞেস করে তুই নিষিদ্ধ জিনিস পাচারের সাথেও জড়িত কি না?’

চয়ন এসব কথা শুনে অনুশোচনায় নিশ্চুপ থাকেনি। বরঞ্চ অস্থিরতায় কথা চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, ‘ওই রকম সুশীল হালার পুতগো কথা আমারে শুনাবি না। ওই হালারা কি চোর না? ঘুস, সুদ খায় না? মাগিবাজী করে না? তুই আমাকে টাকা দে।’ এরকম কিছু অশ্লীল কথা ছিল, অস্থির মুহূর্ত ছিল। তারপর চয়ন জোর করে আমার সব টাকা নিয়ে গেল। জোর করার সময় কত যে মারল আমাকে। লাথি পর্যন্ত দিলো। যাবার সময় ডান পায়ে মাথায় পাড়া দিলো, গলায়ও পাড়া দিলো শক্ত করে। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। প্রথম দিনের সেই চড়ে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। সেদিন লাথি খেয়ে কি আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল? দিন যত যাচ্ছিল চয়নের পাশবিকতা ততই বাড়ছিল। সেদিনের পর থেকে আমি ও বাবা চয়নের ব্যাপারে আর কোনো কথাই বলতাম না। সাহস হতো না। মা কিছুটা প্রতিবাদ করত। টাকা তো মাকেই দিতে হতো অধিকাংশ সময়। এখন মাকে প্রায় প্রতিনিয়ত চড় থাপ্পড় খেতে হয়। মা প্রথম প্রথম নিজের মাথা দেওয়ালে ঠুকত। মাঝে মাঝে এমন হতো আমরা মা-মেয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে সারা রাত কান্না করতাম। সেসময় রাতকে কেমন ভয়ংকর মনে হতো। রক্ত হিম হয়ে যেত উৎকণ্ঠায়। দুশ্চিন্তার সে রাতগুলো কতই না নির্মম ছিল। তারপর কেমন মানিয়ে নিতে শিখল মা আমার। একে তো নিশ্চয়ই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বলে না। বড়োজোর আটকে থাকা বলে। চয়ন এক রাতে মাকে মারধর করে আমার বিয়ের স্বর্ণ নিয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বিয়ের আনন্দ লুট হয়ে যেতে দেখলাম। মা বিছানায় আছড়ে পড়ে উচ্চৈঃস্বরে কান্নার আয়োজন করল। বাবা নির্বিকার। বাবার মুখটাও বাম পায়ের মতো হয়ে গেছে। অচল, অথর্ব। মায়ের সহ্য করার ক্ষমতা যেন সেদিন থেকেই কমে গেল। এবার বোধহয় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা। মা কি ঘুরে দাঁড়াল তবে? সকালে স্থানীয় মেম্বারের সহায়তায় চয়নকে পুলিশে ধরিয়ে দিলো।

Share:
1.5 2 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop