একটি খুনের আনন্দ (পর্ব ৬) – মহসীন চৌধুরী জয়

By Published On: December 8, 2023

আর বলতে পারছি না। আমি জানলা বন্ধ করে দিলাম। এ রাত কেমন হিংস্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারই যেন ভয়ংকর শরীর। অন্ধকারই যেন ক্রূর চোখ। আমি কেঁপে উঠছি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে নিশ্বাসের ওঠানামার মতো। ছোটো ভাইকে যখন ধরে নিয়ে গেল আমার মন খারাপের মিছিল কেমন করে যেন জড়ো হয়ে গেল। বাড়িতে বসে থাকতে পারলাম না। মাকে না জানিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা পায়ে হেঁটে কিছু রাজনৈতিক নেতার বাড়িতে গেলাম এক এক করে। প্রত্যেককে অনুরোধ করলাম চয়নকে ছাড়ানোর জন্য। কেউ কেউ চয়নকে গালাগাল করল। কেউ কেউ আরেক বার সুযোগ দিতে বলল সংশোধনের আশায়। কে যে সত্যকে সামনে রেখে কথা বলেছে আর কে যে অভিনয় করেছে বুঝতে পারিনি। মাদক বিক্রি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না, আমার এরকম প্রশ্নের উত্তরে সবাই কেমন পাশ কেটে গেল। এর পেছনে নাকি বড়ো বড়ো লোকের হাত। কোটি কোটি টাকার ব্যাবসা। এ ব্যাবসা বন্ধ করা যাবে না। ব্যাবসা? কথাটা শুনে আমার কেমন হাসি পেয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য ব্যাবসাকে হালাল করা হয়েছে।’ মাদক বিক্রিও নাকি ব্যাবসা! এই নামমাত্র ব্যাবসাতে বিবেক বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! মনুষ্যত্ব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে!

রাতেই ফিরে এলো চয়ন। ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে। আমার মুখে স্মিথ হাসি ফুটে উঠল। যদিও বুঝতে পেরেছিলাম, পুলিশ চয়নকে মেরেছে। খুব বেশিই মেরেছে। মারের ব্যথাই চেহারায় ফুটে উঠেছে। এদিকে মা চয়নকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেল। আতঙ্কিত হয়ে উঠল। ছোবলের অপেক্ষায় থাকা বিষাক্ত সাপ দেখার মতো অবস্থা। মায়ের চোখমুখ দেখে আমার ভেতরেও কেমন ভয় ঢুকে গেল। চয়ন আমার কাছে এসে দাঁড়াল। ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হওয়া ওর মুখ দেখছিলাম তখন। কোনো কথা না বলে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বাবা-মায়ের রুম থেকে আমাকে বের করে দিলো। অতঃপর আমার রুমে নিয়ে গেল। আমি কোনোরকম প্রতিবাদ না করে হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে ঢুকেছিলাম। সেদিন আমার শরীরও বেশ ক্লান্ত ছিল। সারা দিনই তো চয়নের জন্য ছোটাছুটি করেছি। রুমের ভেতর ঢোকা মাত্রই বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো। আমি হতভম্ব হয়ে জানলার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।

কিন্তু বুঝতে পারিনি শুধু হতভম্ব নয়, রীতিমতো আতঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয় অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। সেদিন চয়নের পুরো রাগই ছিল মায়ের ওপর। সে দৃশ্যটা সামনে চলে এলো ধীরে ধীরে। পুলিশের মারের কতগুণ বেশি শোধ তুলবে তখনো বুঝতে পারিনি। চয়ন দেরি না করে মাকে চুলের মুঠি ধরে বাইরে বের করে আনে। এশার নামাজ হয়েছে বেশ সময় হলো। রাত বেড়ে চলছিল গাঢ় অন্ধকার নিয়ে। তবু চাঁদের আলোয় বেশ দেখতে পাচ্ছিলাম জানলায় দাঁড়িয়ে। মায়ের চিৎকার জোরালো হওয়ার আগেই মুখ বেঁধে ফেলল। বাড়ির বাইরে নিয়ে হাত-পা বেঁধে আমগাছের সাথে বাঁধল পুনরায়। যে আমগাছের নিচে মা ও ছেলের সহস্র স্মৃতি নীরব ভালোবাসা হয়ে বেঁচে ছিল এত দিন। সেদিন ভালোবাসার সমাপ্তি টেনে নির্মমতার গল্প শুরু হলো। গাছ লাগানোর জন্য দুটো গর্ত করা ছিল আগে থেকেই। মা-ই সে গর্ত করেছিল। সন্তানও এই মা-ই জন্ম দিয়েছে। অনেক অনেক মানতের সন্তান! আকাঙ্ক্ষিত এ সন্তান! মায়ের সর্বনাশের জন্য তাহলে কি মা-ই দায়ী? আজ আমিও বিদ্রুপ করব মাতৃত্বের! মাতৃত্বের বিদ্রুপ করার সুযোগ যে আজই! আমার অসংলগ্ন ভাবনার ভেতর চয়ন দ্রুত কোদাল এনে গর্ত দুটোকে এক করে ফেলল। মায়ের হাতে গড়া সর্বনাশ ষোলোকলা পূর্ণ হচ্ছে। পলিথিন দিয়ে মায়ের নাক-মুখ পেঁচিয়ে ফেলল। আমি অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছিলাম। কান্না সে চিৎকারের আওয়াজ অনেকটাই খেয়ে ফেলছিল। বাবা জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে। সাহস করে শক্ত একটি পা নিয়েই এগিয়ে গেল। বাবাকে নিয়ে কী আশ্চর্যরকম পরিহাস! সেদিন বাবাকে লাথি খেতে হলো। চয়নের দেওয়া প্রচণ্ড এক লাথিতে বাবা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। মাতাল সন্তান বাবা-মায়ের জন্য কতই না ভয়ংকর। এ সন্তান মৃত্যুর পর বাবা-মাকে আপন হাতে মাটি দিবে, এমনটা তারা তখন ভেবেছিল কি? তাদের ভাবনায় নিশ্চিত আতঙ্ক ছিল, এ সন্তান তাদের জীবন্ত মাটি দিবে! আমি চেয়ে দেখলাম, দু-একজন পুরুষ-মহিলা এ দৃশ্য দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। মাকে গর্তে ফেলে চয়ন যখন চলে যাচ্ছিল তখন মায়ের হাত-পা-নাক-মুখ বাঁধা। চাঁদের আলোয় ঠিক বুঝতে পারছিলাম, মা ছটফট করছে বাঁচার তাগিদে, জীবনের তাড়নায়। এসব দৃশ্য আমি আর সহ্য করতে পারিনি। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছিলাম। সেই রোমহর্ষক দৃশ্যের যবনিকা আমার দেখা হয়নি।

Share:
5 1 vote
Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop