একটি খুনের আনন্দ (পর্ব ৭) – মহসীন চৌধুরী জয়

By Published On: December 16, 2023

মা চলে যাবে এমনটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তখনো সময় নির্ধারণ করেনি। বলেছিলাম না কিছু কিছু কারণে সুজনকে আমি পছন্দ করি। মাকে উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলার ঘটনা তার মধ্যে অন্যতম। সুজনের এ ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। কিছু কিছু ঋণ শোধ করা যায় না কখনোই। সুজন নতুন করে মায়ের জীবন দান করেছে বিষয়টা এমন না। সুজন মায়ের মৃত্যুকে আটকে দিয়েছে বিষয়টা তেমনও না। মানুষের হায়াত নির্দিষ্ট। সেদিন মায়ের মৃত্যুর দিন নির্দিষ্ট ছিল না। সুজন স্রষ্টার পক্ষ থেকে সহযোগী হয়েছিল মাত্র। মাকে উদ্ধার করে দ্রুত স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। স্রষ্টা সুজনকে না পাঠালে পশু চয়নের হাত থেকে, চয়নের পাশবিকতা থেকে মায়ের মুক্তির কোনো পথই ছিল না। মায়ের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছিল আপন সন্তানের হাতে। মায়ের জীবন প্রদীপ আলোকিত হলো অন্য কারো সন্তানের হাতে। মা আমার ফিরে এসেছে তাতেই আমি খুশি। আমার কথা বাদই দিলাম, বাবার অসহায় জীবনের জন্য, এ সংসারের জন্য মাকে তখন ভীষণ প্রয়োজন। অন্ধকারের বিপরীতে আমার মা যেন এক আলোক পিণ্ড।

কিন্তু কিছু দিন পর এ কোন আলোর পথ বেছে নিল মা? নাকি শত আলোর হাতছানি থাকা সত্ত্বেও এ পথ আদতে অন্ধকারই। সুস্থ হওয়ার পর মায়ের কথা বলা কমে গিয়েছিল। নিশ্চুপ থেকে সারা দিন একা একা কী সব যেন ভাবত। তখন সুজনের সাথে প্রায়ই দেখা যেত মাকে। কী এত আলোচনা ওদের মধ্যে? চয়নের অগোচরেই তাদের মধ্যে যোগাযোগ হতো। চয়ন এখন আর বাড়িতে থাকে না। সেদিনের ঘটনার পর স্থানীয় মেম্বারের সাহায্যে বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। পুলিশের ভয়ে চয়ন পালিয়ে পালিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে বেশ রাত করে বাড়িতে আসে। হম্বিতম্বি করে টাকা নিয়ে যায়। চয়নের জন্য আলাদা করে কিছু টাকা সব সময় রাখতে হতো। বাড়িতে এসে টাকা না পেলে মায়ের জীবন আবারও বিপন্ন হতে পারত। এমনকি আমার জীবনও। বাবা তখন আরও মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে। কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় সারা দিন। কারো কারো সন্তান হয় গর্বের, কাজ করে মানুষের কল্যাণে। আর এ সন্তান বাবা-মাকে ফেলে দেয় গর্তে, গতিহীন জীবনে—জীবন্ত কবরের উদ্দেশ্যে।

স্বপ্না ও চম্পা আপা একদিন এসেছিল মা-বাবাকে দেখতে। বহু দিন পর তিন বোন একসাথে। সেদিনের রাতে আমরা গল্প করতে পারিনি। আমরা কান্নার আয়োজন করেছিলাম। ভাইয়ের অবদানে কান্না। জীবন কতভাবেই না বিদ্রুপ করে আমাদের! আসলে আমাদের জীবন কি আর জীবন ছিল? বনের ভয়ংকর রাত আমাদের মনে জেগে ছিল প্রতিনিয়ত। বাড়ির ভয়ংকর রাত তারচেয়ে বেশি নির্মমতা নিয়ে হাজির হলো একদিন। সেদিন রাতে নেশাগ্রস্ত চয়ন বাড়িতে ঢুকতেই সুজন ও তার সঙ্গী পেছন থেকে জাপটে ধরে। বেঁধে ফেলে ওর হাত-পা। আমি আমার রুমেই ছিলাম। জানলা দিয়ে দেখছিলাম। বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মা যেন সুজনকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। সুজন আচমকাই ছুরি বের করে চয়নের পেটে পরপর দুইবার ঢুকিয়ে দেয়। আঁতকে উঠেছিলাম। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে সেই মুহূর্তে মনে হয়েছে, মা আজ জোছনা খুন করবে, চাঁদ খুন করবে, রাতের অন্ধকারও খুন করবে। দিনের আলো বাঁচানোর স্বার্থে মা খুন করবে হাসিমুখে। বাবার উঠে দাঁড়ানোর কথা মনে হলো, আমার নতুন জীবনের কথা মনে হলো, মায়ের স্বস্তি মুখের কথা মনে হলো। এসব মনে করার পরও আমি ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ছিলাম। মৃত্যু নিশ্চিত করে সুজন চলে গেল। মা আমাকে আগে কিছুই বলেনি। আমি জানলে কি এরকম ভয়ংকর স্বস্তির কাজে মত দিতাম? যে বেঁচে থেকে সবার মৃত্যুর কারণ হয় তাকে আপন মা-ও বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। শত আকাঙ্ক্ষিত হওয়ার পরও। এমন ভাবনা যখন ভেতরে ভেতরে সান্ত্বনা হয়ে জড়ো হচ্ছিল তখনই আচমকা চয়ন জেগে ওঠে। পেটে হাত দিয়ে রক্ত আটকে দিয়ে বলে, ‘তোদেরকে আমি দেইখা নিমু।’ এ কথা শোনার পর মা ও আমি পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। মায়ের আতঙ্কিত মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করল। চয়ন বেঁচে উঠলে সবার মৃত্যু নিশ্চিত লেখা হয়ে যাবে, এমনটা ভেবে। অবচেতনের চেতন যে কত ভনায়ক হবে ভেবে আমি শিউরে উঠেছি বারবার। মা আমাকে চয়নের শরীর জাপটে ধরে থাকতে বলে বাইরে বের হয়ে যায়। কিছু দিন আগে চয়ন যেমন করে আমার মাথায় পা দিয়ে ধরে, আমিও তেমনি ধরে থাকি হাত দিয়ে। অতঃপর একটা নিশ্চিত মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষায় আমি গভীর অন্ধকারে যখন কেঁপে উঠছিলাম, অধিক সময় নিয়ে, বাবা তখন এক পায়ে দৌড়ে এসে চয়নকে জাপটে ধরে আমাকে শক্তি দেয়। এদিকে সুজনসহ মা দ্রুতই চলে আসে স্বস্তির বার্তা নিয়ে। সুজন চয়নের মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি মায়ের স্বস্তির নিশ্বাসে দেখেছিলাম একটি খুনের আনন্দ।

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop