আত্মার প্রতিশোধ

আত্মার প্রতিশোধ
আখতারুল ইসলাম
১
ক’দিন থেকে একটা বিষয় কিছুতেই মাথা থেকে সরছে না।রাতের ঘটনাগুলো কাউকে বলতে যেমন পারছি না, তেমনি মেনে নিতেও পারছি না।ভাবনাগুলো মনের উপর এমন প্রভাব ফেলছে, কোনো কাজে মন বসছে না।গত পরশু রাতের ঘটনা। পড়াশুনা শেষ করে ঘুমোতে গেলাম রাত ১১টার দিকে। আমি আর বাবা এক বিছানায় ঘুমাই। কিছু¶ণের মধ্যে বাবার ঘুম আসে। বাবা গভীর এক ঘুমের দেশে। অথচ আমার চোখ থেকে ঘুম উধাও। চারদিকে সুনসান নীরবতা।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি আর ঘড়ি দেখছি।রাত বারোটার পর। অমাবস্যা হওয়ায় জানালা দিয়ে শুধু কালো আঁধার দেখা যাচ্ছে। আঁধারে অন্য কিছু দেখার উপায় নেই। রাত প্রায় ১টা।হঠাৎ জানালা দিয়ে এক মিষ্টি বাতাসে শরীরও মন ভালো লাগায় ভরে ওঠে। সিলিং ফ্যান চলছে। প্রচন্ড গরম। এপ্রিল মাস। এ সব ছাপিয়ে এমন একটা শীতল বাতাস। ভাবনাটা এলোমেলো করে দেয়।বাতাসের রেশ শেষ না হতেই, স্বাভাবিক একটা শব্দ। শব্দ বলতে কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে।
জাহিন! জাহিন। ঘুমাচ্ছ না কেন?
আমি বললাম, কে? কে আপনি?
এটা বলতে শব্দটা বন্ধ। ভাবছি বাবা না তো। বালিশের পাশের মোবাইলটা নিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম, বাবা অঘোরে ঘুমাচ্ছে।বাবাকে হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলাম।বাবা ঘুম তো ঘুম।লাইট বন্ধ করেছি।আবার শব্দ। জাহিন! এই জাহিন! ঘুমাবে না?
একটু ভয়ও লাগছে। একটু অদ্ভুতুরে লাগছে।ডাকটা কোন দিক থেকে আসছে খেয়াল করতে চেষ্টা করছি। একটু সাহস সঞ্চয় করে আলো জ্বালালাম না। দেখি শব্দটা কোথা থেকে আসছে। যা ভেবেছি, দেখছি শব্দটা জানালার দিক থেকে আসছে।
আবার ডাকছে জাহিন!এই জাহিন ভয় পেয়েছ?
এবার আমি কী করবো বুঝে ওঠার আগে, বললাম কে তুমি? বার বার ডাকছ কেনো?
“আমি”!
হ্যাঁ। কে তুমি?
আমি রাশিদ! ভুলে গেলে?তোমার বন্ধু রাশিদ।এবার উঠে বসলাম,আবার লাইট জ্বালাই।কিন্তু কাউকে দেখলাম না। জানালার কাছে গিয়ে মোবাইলের আলোয়বাইরের আশপাশ দেখলাম। কই কিছুই নেই। অদূরে কোনো কোনো বিল্ডিং এ মিটি মিটি আলো জ্বলছে।সব মানুষই ঘুমে। মধ্যরাত।কোন সাড়া শব্দ নেই।এবার বেড সুইচদিয়ে রুমের আলোটা জ্বালাই। তাতেও কাউকে দেখতে পেলাম না। পাশে বাবা ঘুমাচ্ছে। লাইট বন্ধ করে খাটে বসে রইলাম। সেই বিদঘুটে আঁধার। ভাবছি আমার বন্ধু! রাশিদ!সে তো মারা গেছে। তাও এক বছর হয়ে গেল। আমাদের আর রাশিদের বাসা ছিল পাশাপাশি। একসাথে খেলাধুলা দুষ্টুমি, আড্ডা, স্কুলে যাওয়া সব।সে যখন মারা যায়, তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়তাম।
একদিন স্কুল ছুটির পর। বিকেলে। ছাদে, আমি রাশিদ ঘুড়ি ওড়াচ্ছি । আমদের সাথে অনেকেঘুড়ি উড়াচ্ছে।রাশিদ ভালো ঘুড়ি উড়াতে পারতো। সাথে ছিল ফারহান, সোহান,তূর্য সবাই একসাথে। যে যার ঘুড়ি নিয়ে ব্যস্ত। নানান রং বেরঙের ঘুড়ি। আশে পাশের ছাদেও অনেকেঘুড়ি উড়াচ্ছে। রাশিদের ঘুড়ি অনেক উপরে, আকাশের অদূরে রাশিদের ঘুড়ির সাথে অন্য বিল্ডিং এর ছাদের ঘুড়ি উড়াচ্ছে এমন একজনের ঘুড়ির সাথে প্যাঁচ লাগে। রাশিদ চেষ্টা করছে,সেই ঘুড়িটাকে কেঁটে দিতে। বিল্ডিং এর এপাশ ওপাশে যাচ্ছে। কখনো আমাদের বলছে সর, দেখি। হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটলো যা ছিল অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্খিত। কেউ ভাবতে পারেনি।
রাশিদ ওই ঘুড়িটা কেটে দেয়। বলে,ওয়াও! ঠিক সেই মুহূর্তে ছাদের রেলিং ভেঙ্গে রাশিদ পাঁচ তলা থেকে নিচে পড়ে যায়। অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা। কেউ বুঝতে পারেনি। তুর্য চিৎকার দিয়ে বলল, রাশিদ! তত¶ণে সে নিচে পড়ে যায়।আমরা দ্রুত ছুটতে থাকি। নিচে নামতে নামতেআল্লা আল্লাকরছি। আশপাশ থেকে সবাই ছুটে আসছে।আমরা যারা ছাদে ছিলাম সবাই নেমে আসি। ততক্ষণে দেখি রাশিদের নিথর দেহ। পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আশ পাশ। সবাই মেডিকেলে নিলেও বাঁচেনি রাশিদ।আমরা কেউ তা মেনে নিতে পারিনি। প্রিয় বন্ধুর এমন মৃত্যু।
খুব কেঁদেছি তার জন্য। সেই থেকে কখনো আর ঘুড়ি উড়াইনি। ঘুড়ি দেখলে রাশিদের কথা মনে পড়ে। কিছুদিন পর বাবা রাশিদের সাথে থাকা সেই বাসাটা ছেড়ে দেয়। অনেক দিন তো হল। নতুন পরিবেশ। নতুন জায়গা। নতুন বন্ধু। তবুও মাঝে মাঝে মনে নাড়া দেয় রাশিদ। মনে পড়লে রাশিদের কথা নিজের অজান্তে চোখের পানি ঝরে। কিন্তু গত দশ বারো দিনের মধ্যে একবারও তার কথা ভাবিনি। ভাবিনি ঘুড়ি উড়ানোর কথা ও। চোখেঘুম নেমে আসছে।লাইট বন্ধ করে দিলাম। আবার সেই ডাক,জাহিন! তুমি কি রাশিদকে ভুলে গেলে? কিছুটা ভয়ও করছে। তবু এবার সাহস করে কথা বলতে শুরু করলাম। বললাম, না ভুলিনি। ভুলব কেনো।
“সত্যি কি ভুলে যাও নি?”
“না। ভুলে যাই নি।” অনেকটা রাগ করে বললাম।
ভুলে না গেলে গত বারো তেরোদিন তো তোমার মনের সীমানায় ও রাশিদ ছিলনা।
এবার অবাক না হয়ে পারলাম না। মৃত রাশিদ অশরীরিকভাবে কথা বলছে। তা না হয় ঠিক আছে। কিন্তু আমার যে বারো তেরো দিন রাশিদের কথা মনে পড়েনি। তা কিভাবে বুঝলো? ভৌতিক নানা গল্পে মৃত আত্মা কথা বলে, কারো ওপর ভর করে। এসব নিছক গল্প।অথচ আমার জন্য সত্যি হবে। তা বিশ্বাস করতে পারছিনা। নিজের শরীরে নিজের চিমটি কেটে দেখলাম। কোনো স্বপ্ন টপ্ন দেখছি কিনা। না স্বপ্ন না। আমি তো জেগে আছি। শুধু আঁধার।আঁধারে জেগে আছি।আবার রাশিদের কন্ঠ। কী ভাবছ, জাহিন? আমি সব জানি।
“আরে ভাই তুমি তো মৃত। মৃত মানুষ।
“হ্যাঁ, আমি মৃত। এটা তো সত্যি আমি তোমার বন্ধু ছিলাম।”
এবার নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। খাটে একটা আঘাত করে বললাম, ছিলে। তুমি মনে থাকবে আজীবন। খাটের আঘাতের শব্দে বাবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাবা রলছে, জাহিন কী হয়েছে? তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ?আর খাটে আঘাত করলে কেন?
“না বাবা। ঘুম আসছিল না তো। এপাশ ওপাশ করতে করতে উঠে বসেছি মাত্র।ঘুম আসছে না বলে নিজের উপর রাগ করে হাত ফসকে খাটে আঘাত লাগে।”
বাবা আবার বলল, কী হয়েছে? ঘুম আসছে না কেন?
“না বাবা, এমনি। কাল স্কুলে পড়া আছে তো। ভালো মত শেখা হয়নি।”
জানিনা বাবা কী বুঝেছে। বলল,ঘুমাও। সকালে পড়া দেখে নিও। রাত অনেক হয়েছে। শুয়ে পড়ো তো দেখি।বাবার কথায় সুবোধ বালকের মতো শুয়ে পড়লাম। বাবা মাথার চুলে বিলি কাটতে লাগল।বাবার আদর ও বিলি কাটায় অবচেতন মনে কখন ঘুমিয়ে পড়ছি মনে নেই।
২
গতরাতে ঘটে আরও অদ্ভুত কান্ড। ঠিক আগের মত আমি আর বাবা ঘুমোতে গেলাম, পাশের ক¶ে মা আর ছোট বোন। গতরাতের কথা ভাবছি। গতরাতের কথা মাথায় ঢুকে খটমট করছে। ইতোমধ্যে বাবা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাও বলে, নিজেই ঘুমায় রাজ্যে হারিয়ে গেলেন। আমার রাজ্যে এখনো রাশিদ। দিনভর মাঝেমধ্যে গতরাতের ঘটনা মনে দু’এক বার উঁকিঝুঁকি দেয়।
তাও মাঝে মধ্যে।আমি একটা জিনিস বুঝিনা। ঘুমোতে এলে কেন দুনিয়ার সব ঘটনা মাথায় এসে ভর করে। ভাবতে ভাবতে এপাশ ওপাশ করছি। না। আজ আর সেই মিষ্টি বাতাসও নেই। নেই রাশিদের অদৃশ্য ডাকও। চোখে তন্দ্রার ভাব। চোখে ঘুম আসবে আসবে ভাব। ঘুমের জন্য প্রস্তুত চোখও। আমি সটান বাম কাত হয়ে শুয়েছি। ঠিক সেই মুহূর্তে অদৃশ্য রাশিদের কন্ঠ, জাহিন! এই জাহিন। ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?
আমি শুনেও না শোনার ভান করে আছি। গতকাল রাতে বলেছিল, ঘুমাবে না জাহিন। আজ বলছে, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?
আবার ডাকছে জাহিন! এই জাহিন!জানি তুমি এখনো ঘুমাওনি। ভান ধরো না।তোমার সাথে কথা আছে। খুব জরুরী। আমি চুপ করে আছি। শব্দ আসছে জানালা থেকে। আজ তেমন ভয় লাগছে না। ভাবছি,যতই ডাকো কোন লাভ হবে না। আমি জেগে জেগেই ঘুমিয়ে আছি। জেগে জেগে ঘুমালে কেউ ঘুম থেকে তুলতে পারে না। পুনরায় ডাকছে জাহিন। ওঠো। গতরাতে তোমার সাথে কথা বলতে পারিনি। তোমার বাবার ঘুম ভেঙ্গেছে বলে। আর আমাকে ও তো চলে যেতে হয় আমাদের রাজ্যে। শুধু তোমার সাথে কথা বলব বলে, আমাদের রাজ্য থেকে তোমার কাছে আসতে হয়েছে। এবার আমার ভাবনায় ছেদ পরে। রাজ্য মানে, ও তো মৃত। মৃত মানুষের রাজ্য আছে নাকি? স্থির থাকতে পারলাম না। ঘুমের ভান মুহূর্তেই কেটে গেল। উঠে বসলাম।আচ্ছা তুমি মরে গিয়েও আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না? আর কথা শেষ করতে পারেনি।
রাশিদের অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বলে,তুমি জাহিন।আমার কত কাছের বন্ধু ছিলে। আমাদের একসাথে কত স্মৃতি। পড়ালেখা। এমনকি খাওয়া দাওয়া, বেড়ানো, খেলাধূলাও ছিল একসাথে।
আমি বললাম, সব তো ঠিক আছে। তোমাকে তো ভুলিনি। আর তোমার মত এখনো কোনো বন্ধু পায়নি। পাবো কিনা জানিনা।
তাই বলে?
“তাই বলে কী?”
“তাই বলে এখন তুমি আমাকে বিরক্ত করবে এভাবে। ঘুমাতে দিচ্ছ না। বাবা জানলে আমি কী বলবো? ”
রাশিদের কণ্ঠস্বর বলল, বাবা জানবে না। আমি বললাম, ঠিক আছে বাবা জানবে না। কী বলতে চাও দ্রুত বল?
রাশিদ বলতে শুরু করে “তোমার মনে আছে, একদিন বর্ষাকালে আমি আর তুমি স্কুল থেকে ফিরছি। কারো ছাতা ছিল না।”
আমি বললাম, মনে আছে। দ্রুত রাস্তা পার হচ্ছিলে। অপর পাশ থেকে দ্রুত ট্রাক আসছিল। ট্রাকটা ছিল দ্রুতগামী, আমাকে মেরে দিচ্ছে।ঠিক সেই মুহূর্তে, তুমি আমার হাত ধরে টান দিলে। আমি পরে গিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলাম।মানে তুমি আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালে।রাশিদের কণ্ঠস্বর বলল, তোমার ব্রেন তো খুব তীক্ষ্ণ।ভুলে যাওনি। সব মনে রেখেছ।
কিন্তু…
কিন্তু কী? আমি বললাম।
“কিন্তু তোমরা তো আমাকে একটু বাঁচাতে চেষ্টাও করলেনা।”
“মানে কী? কী বলছো এসব? আমরা কিভাবে তোমাকে বাঁচাতাম?ঘুড়ি নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিলাম। এখনো পর্যন্ত কল্পনাও করতে পারি না, তুমি এভাবে পরে যাবে। আর….
“আর কী?”
“ যখন নিচে নামলাম দেখি,তুমি… ”আমি কথা শেষ করতে পারিনি।
মানে,আমি মারা গেছি, রাশিদের কণ্ঠস্বর বলল।
“হ্যাঁ,তাই তো।”
“না জাহিন। আমি মারা যায়নি তখনও।”
“কী বলছ এসব! তুমি মারা যাও নি মানে।” আমি রীতিমতো চমকে উঠি।
রাশিদের কণ্ঠস্বর বলল,আমাকে তোমরা দ্রুত হাসপাতালে নাওনি। তোমাদের গাড়ি পেতে দেরি হয়েছে। দেরি হয়েছে পথে। রাস্তাজুড়ে দীর্ঘ জ্যাম। তাও যে হাসপাতালে নিলে,ডাক্তার প্রটোকল মেইন্টেন করে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। আমি কতবার বলেছি, আমাকে বাঁচাও!বাঁচাও! কেউ শুনতে পাওনি আমার কথা। কত জোরে চিৎকার করেছি।কুকুর, বিড়াল, বাদুর হলে ঠিকই বুঝত।ওদের শ্রবণ শক্তি ভালো।”
আমি বললাম,কী বলছ এসব?
“হ্যাঁ জাহিন। তখন ডাক্তার স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুকে আমার শ্বাস প্রশ্বাস দেখছে আর আমার হাতের শিরা দেখছিল। তখনো আমি জীবিত ছিলাম। ”
কিন্তু..
“কিন্তু কী?”
“কিন্তু ডাক্তার , অন্য একটা রোগী দেখে এসে আমাকে দেখছিল। তখন ওনার সেন্স ভালো কাজ করেনি। হুট করে বলল, বেঁচে নেই। অথচ আমি মরিনি। যদি তখন ডাক্তার আইসিউতে নিতো, আমি বাঁচতে পারতাম। এরপর ধীরে ধীরে আমি কোমায় চলে যায়।
অথচ আমাকে মৃত ভেবে নিয়ে এলে। দিয়ে দিলে কবর। আমি তখন,মানে আমার আত্মা বলছে, আমাকে কবর দিও না। আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু কে শোনে কার কথা।আমাকে কবর দিয়ে তোমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলে।কত না কষ্ট পেয়েছে আমার বাবা-মা। এখনো প্রতিদিন, নিরবে নিভৃতে কাঁদে আমার জন্য।আমি তাদের একমাত্র ছেলে। ছোট বোনটি ছিল দুই বছর। সে কিছু বুঝতো না।”
আমি অবাক। নিজেকে ও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। কী বলছে রাশিদ। এমনটি ও হয়।
আমি বললাম, ঠিক আছে মানলাম। কিন্তু সেখানে আমাদের কী করার ছিল?
করার ছিল…
বলে কোন শব্দ শোনা গেল না। বাবা বলছে, কি হল জাহিন? তুমি কার সাথে কথা বলছ? আমি থতমত খেয়ে বললাম না, বাবা। বাবা উঠে বসেন। কী হয়েছে তোমার? গতকালও দেখি কী সব করলে। আজ দেখি কথা বলছ। আমি আমতা আমতা করে বলছি, না… বাবা। না বাবা….
“না বাবা বললে হবে না। এমন করলে তো পড়ালেখা হবে না। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর খারাপ হবে।শরীর ভালো না থাকলে মন ভালো থাকবে না। মন খারাপ হলে তো ভালো পড়ালেখা হবে না। আর পড়ালেখা না করলে যে যোগ্য মানুষ হতে পারবে না।”
এত রাতেও বাবার উপদেশ। বাবা যেনশি¶ক, আমি ওনার ছাত্র। সব সময় উপদেশ আর উপদেশ। এই রাত দুপুরে ও উপদেশ। বাবার উপদেশগুলো ভালো। আমি মেনে চলতে চেষ্টা করি। তাইতো মোবাইল ধরি না, গেইম খেলি না। ফেসবুক দেখিনা। শুধু দরকারি কোনো তথ্য জানার থাকলে গুগলে সার্চ দিই।কিন্তু মধ্যরাতে উপদেশ ভালো লাগছে না। আমি ছিলাম,রাশিদের আত্মর রাজ্যে। অন্য এক দেশে। অচিনপুরে। কিছু বলছি না দেখে । বাবা বলল,কী ভাবছ?
“না বাবা! কিছুই না।”
ঘুমাও।
আমি ও সুবোধ বালকের মতো শুয়ে থাকি।বাবাও শুয়ে যায়। কখন চোখে ঘুম নেমেছে মনে নেই।
৩
আজ সকাল থেকে মনটা খুবই খারাপ। কিছুই ভালো লাগছে না। ভাত খেতেও ইচ্ছে করছে না। স্কুলে যেতে ও ইচ্ছে করছে না। স্কুলে যাব কী যাব না, ভাবছি আর ভাবছি। একদিন না গেলে কী হয়। খুব বেশি কি ক্ষতি হয়? নিজেকে প্রশ্ন করি বার বার। কিন্তু আমার প্রিয় জায়গা হচ্ছে ইশকুল।ভালো লাগে পড়ালেখা। কত কিছু জানা যায়। ভালো লাগে অমল স্যারকে।কি দারুণ স্যারের বুঝানোর ¶মতা। ইংরেজি বিষয়টা এখন আর কঠিন মনে হয় না। ভালো লাগে অশোক স্যারকে।কড়া হলেও গণিতের দ¶তায় মুগ্ধ হই।মুগ্ধ হই,হেড স্যার পূর্ণেন্দু ভট্টচার্যকে।কত সুন্দর সুন্দর নীতি নৈতিকতার, আদর্শের কথা বলে। জীবন গঠনের দিক নির্দেশনা দেয়, জমির উদ্দিন স্যার। আর রঞ্জিত স্যার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা। ভাষা দিবসের কথা। দেশকে ভালোবাসার কথা। মানুষকে সাহায্য করার কথা। টুনটু স্যারের থাপ্পরের কথা, যে এক পেয়েছে সে জীবনে ভুলবে না। ঠিক পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে যায়। অবশ্য আমার ভাগ্যে এখনো জুটেনি। সেদিন ইকবাল পড়া রেডি করে আনেনি বলে, ঠাস করে দেয়া টুনটু স্যারের পাঁচ আঙুলের ছাপ নিয়ে বাসায় গেলে বাবা মায়ের রোশানলে পড়তে হয়, ইকবালের মুখে শোনা কথা ও মনে পরে। আয়া দিদি সুমিতা আর বাবুল দা’র কথা, কত আদর করে আমাকে। তাই একদিন স্কুলে না গেলে কোনো কারণে ,ওনাদের কথাগুলো মনে উঁকিঝুঁকি দেয়। বন্ধুদের কথাগুলো ঠকঠক করে কানে বাজে। নাড়া দেয় মনের দরজায়। তাসিফ ক্রিকেটে ভালো। বেট করে টি টুয়েন্টি ধাঁছে, চার ছক্কা ছাড়া কথাই নেই। ব্যাট যেন তার রানের খাতা ভরে তোলে।সোহেল খেলে ফুটবল।দারুণ তার খেলার গতি। যেন,আমাদের একজন মেসি, একজন নেইমার। তাপস ভালো গান করে।অনিম ভালো ক্রিকেটে বলিং এ।যেন একজন তাসকিন, মোস্তাফিজ। কত হাসি আনন্দ,টিফিন পিরিয়ডে গল্প আড্ডা, না বলা জমিয়ে রাখা কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে বসা।যতটুকু সময় পায়,নানান কথায়, খেলায় গল্প গুজবে সময় কেটে যায়। ৪০ মিনিটের টিফিন টাইম যেন চার মিনিটে শেষ হয়ে যায়। ভালো সময় দ্রুত শেষ হয়। আনন্দটা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো থামানো যায় না। খারাপ সময় সহজে শেষ হয় না। আমাদের ইশকুল আনন্দের ইশকুল। মজার ইশকুল। ভালোবাসার ইশকুল। স্বপ্ন দেখার ইশকুল । জীবন আদর্শের ইশকুল। বন্ধু আর বন্ধনের ইশকুল।
আজ কেন যেন সিদ্ধান্ত হীনতায় ভূগছি।যাবো কী যাবো না।আনন্দের এই ইশকুলে।ভাবতে ভাবতে মা এলো। বলল,জাহিন!স্কুলে যাবি না?
“যাবো।”
যাবো মানে? কখন? কী হয়েছে জাহিন?
“না মা। কিছু হয়নি।”
“কিছু একটা তো হয়েছে।যে ছেলেকে আমরা কোথাও নিতে পারি না, নিতে পারি না গ্রামের বাড়িতে। সে যেতে চায় না চাচ্চুর বাসায়। ফুফুদের বাসায়। খালামনির বাসায়। মামার বাসায়। যায় না কোনো বন্ধুর বাসায়। যার ভাবনাজুড়ে শুধু স্কুল। বলে আমার লেখা পড়া মিস হবে। যদিও শুক্র, শনিবার মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে যায়। কোনোমতে লেখাপড়ার ফাঁকি দেয় না। আজ তবে কী হলো কী জানি। ”
মা ভাবতে ভাবতে বলছে, বাবা জাহিন মন খারাপ? কই দেখি, দেখি বলতে বলতে, মা কপালেও বুকে পিঠে হাত দিয়ে দেখে। কিছু হয়েছে কিনা।আমি বলছি না। কিছুই হয়নি।ঠিক আছে যাবো।
মা বললো, আমি জোড় করছি না।তোমার যদি ইচ্ছে না হয় যেও না। কারণ মা বুঝে, আমি বিনা কারণে স্কুল মিস করি না।
সব গুছিয়ে দেয় মা। কিন্তু মাকেও বলতে পারছি না, রাশিদের কথা। বারবার মনে পড়ছে রাশিদের কথা। রাশিদের আত্মার কণ্ঠস্বর। তার মৃত্যুর পূর্বের অব্যক্ত কথা। কী সাংঘাতিক!
মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বাসার দরজার থেকে বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি।টিভিতে কত মুভি দেখেছি।ভূতেরমুভি,হরর মুভি, থ্রিলার মুভি,সাইন্স ফিকশনের মুভি।ভাবতাম এইসব শুধু ছবি। বাস্তবতা কম।
পৃথিবীতে দৈত্য দানব বলতে কিছু নেই। নেই কোনো ভূত পেত্নী। আত্না বা অশীরিরি কিছু নেই। সেই মৃত রাশিদের আত্না কিনা ভর করলো আমার উপর। ভাবতেই পারছি না।নাকি আমার মনের গন্ডোগোল। নাকি অবচেতন মনে মস্তিষ্কের কোনো খেলা। রাশিদ কি মারা যায়নি? আমরাই তাকে মেরে ফেলেছি।
ও কোমায় ছিল।ডাক্তাররাতো বোঝার কথা। সে মরবে না বাঁচবে। সে কী করে জানে। তবে মৃত্যুর জন্য সে কেনো আমাদের দায়ী করছে। ওর কথায় তো, তাই মনে হচ্ছে। আমি ওর প্রিয় বন্ধু। আমিতোরাশিদকে মারা দূরের কথা, কোনদিন রাশিদ মারা যাবে তা কল্পনা ও করিনি। ভাবতে ভাবতে স্কুলের গেইটে চলে এলাম। হঠাৎ একটা ডাক শুনলাম। অনেকটা রাশিদের ডাকের মত। এই জাহিন!জাহিন! আমি ডাকের উৎস খুঁজতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। দৌঁড়ে এসে তাসিফ বলল,এই জাহিন, কেমন আছিস?
আমি কী করে বলি যে,ভালো নেই। শুকনো একটা হাসি দিয়ে ভালো লাগার মতো অভিনয়ের সুরে বললাম,ভালো আছি। তুই?
তাসিফ বলল,ভালো আছি।
কথার পিঠে কথা বলে চমক দিয়ে বলল, একটা খবর জানিস?
“কী খবর? ”
“সোহেল,ঐ যে মেসি, নেইমার।”
কী হয়েছে? ওর কোন খারাপ কিছু নয় তো?
“খারাপ না, ভালো কিনা জানি না। তবে…”
“তবে কী?”
“চল ক্লাসে। ওর মুখ থেকে সব শুনবি।”
আ¯েত্ম আ¯েত্ম ক্লাসে যাচ্ছি।রম্নমে ঢুকতে ঢুকতে দেখি,কয়েকজন বন্ধু ঘিরে রেখেছে সোহেলকে। ভীড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই বন্ধুরা বলল, এইতো জাহিন এসেছে।
আমি বললাম,কী হয়েছে?
আরিফ বলল, সোহেল প্রথম থেকেই বলল। তাসফি বলল, সোহেল এদিকে আয় তো। সোহেল উঠে। আমরা ও উঠি।
আরিফ বলল,চল টিফিন রম্নমে চল। চল তো জাহিন,ওর ঘটনাটা শুনি।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে। কোন ঘটনা। ক্লাসের অনেকেই দেখি খুব কৌতূহলী। হাতের ঘড়িতে দেখে নিলাম। হাতে এখনো ২৫ মিনিট সময় আছে অ্যাসেম্বিলি হতে। টিফিন রমে গিয়ে সবাই বসলাম। আরিফ বলল, সোহেল,এবার বল দেখি।
৪
সোহেল বলছে, বিগত দেড় বছর আগে আমার দাদা মারা যায়। যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তাম তখন। তোরা তো জানিস?
আমি বললাম,হ্যাঁ জানি।
“কিন্তু কী করে মারা গেছে সেটা তো জানিস না।”
“কেনো, তোর দাদা মারা যাওয়ার সময় বয়স হয়েছিল?৬৮ বছর। বার্ধক্য জনিত কারণে বয়স হয়েছে তাই মারা গেছে।”
সোহেল একটা মুখে ভেংচি কেটে বলল, কচু জানিস। যা মনে হবে, এমনি কিন্তু খুব বাজে ও খারাপ ভাবে।
কচু মানে,আরিফ বলল।
কচু মানে হল তোরা কিছুই জানিস না। ওনাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
আমি বললাম,কীভাবে? কে বা কারা মেরেছ? তুই জানলি কেমন করে?
“আমার দাদা সরকারি চাকরি করতেন। দাদার ছিল দুই মেয়ে,দুই ছেলে। দাদী আমার জন্মের আগে ক্যান্সারে মারা যায়। দাদা অনেকটা একা হয়ে যায়।চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর, যা টাকা পেয়েছে,তা শুধু নিজের কাছে না রেখে, একটা জায়গায় বাড়ি তৈরি করে। পাঁচ তলা ভবন। আমার বাবা চাচা ও ফুফুদের জন্য।
যে বাড়িতে আমরা এখন থাকি। সেই পাঁচতলা বাড়িটা। দাদার অবসর কাটতো আমাদের সাথে আর কাজিনদের সাথে। সেখানেই সমস্যা শুরম্ন।”
কী সমস্যা? অনিক বলল?
“সমস্যা হল, আমাদের সাথে দাদা খেলুক বা মিশুক তা যেমন বাবা মা চাইতেন না, তেমনি চায়তো না চাচা চাচীও।”
তোর ফুফিরা?
ফুফুরা ছিল শ্বশুর বাড়িতে। সেখান থেকে সব সময় আসা দেখাশোনা করা সম্ভব হতো না। আর দাদাওচাইতেন না মেয়েদের বাড়িতে গিয়ে বোঝা হতে।দু’জন ফুফিও শ্বশুর বাড়িতে ভালো ছিলেন না। অনেক কষ্টে ছিল, ফুফারা তত ভালো ছিল না । নানান অযুহাতে ফুফুদের জ্বালাতন করতো। আমার বাবা আর চাচার মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে নানান সময় ঝগড়া লেগে থাকতো। দুজনের কথা, এ বাড়ির অংশ শুধু তাদের দুজনের। দাদার মেয়ে মানে, আমার ফুফিরা কিছু পাবে না। দাদা এটা মানতো না। আইনগতভাবে আমার দাদার মেয়েরা যেন না ঠকে তাই ফুফিদের আমার বাবা ও চাচার সম্পত্তি ভাগ করে ডিড করে দেয়।
তারপর!
এটা নিয়ে বাবা চাচা সব সময় ঝগড়া করতো। একে অপরের উপর দোষ চাপাত। কেউ কারো কথা বুঝতে চায়ত না।পারিবারিক অশাšিত্ম লেগে থাকতো। আমার মা, চাচীও এই সম্পত্তির জন্য গায়ে পরে ঝগড়া করত। প্রায় সময় ঝগড়া লেগে যেত। নানান কথায় বাবার কান ভারী করতো।একবার কী হয়,জানিস?
আরে!না বললে,কী করে জানবো?
“দাদার ভীষণ অসুখ।কাশি ও জ্বর। শোয়া থেকে উঠতে পারে না। সাথে বমি।দাদা আমাকে আর আমার চাচাতো ভাই নিরবকে ডাকে। কিন্তু মা চাচী যেতে দিত না। দাদা বাবাকে চাচাকেও ডাকতো। তারাও পাত্তা দিত না। বলতো,এগুলো দাদার অভিনয়।”
অভিনয় কেনো বলল, তোর বাবা চাচারা?
আর বলিস না। সম্পত্তির ঝামেলায় নিজের বাবাকেও বিশ্বাস করতো না।দাদাকে ফেলে রাখতো,পাঁচ তলার এক আবদ্ধ রম্নমে। যেখানে খুব গরম। টপ ফ্লোর হলে যা হয়।কোনো ওষুধ তো দূরের কথা,সামান্য খাবারও দিত না।না খেয়ে । ওষুধ না পেয়ে একা একা দাদা কান্না করত অসহায় শিশুর মতো। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর বাসায় না গিয়ে, আমি গেলাম দাদার রম্নমে।দাদার এই অবস্থা দেখে চোখের পানি এসে গেল। দাদা আমাকে বুকে জড়িয়ে বলল, কেঁদো না দাদা ভাই।বলল, আমার একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে পারবে?
আমি বললাম,বলো দাদু ভাই কী কাজ? তোমার মা-বাবা যেন না জানে। জানলে তোমাকে বকা দিবে।আমি বললাম, ঠিক আছে দাদা ভাই,জানবে না।আমি তখন ডান পাশে বসেই দাদুর মাথায় হাত দিয়ে দেখি প্রচন্ড জ্বর। জ্বরে শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। বললাম,দাদু তাড়াতাড়ি বলো। মা দেখলে পিঠের চামড়া রাখবে না।
শোনো দাদাভাই, এই কাগজটা আমাদের পাশের বাড়ির সেলিম মিয়াকে দেবে। কী লেখা আছে দাদু এতে আমি জানতে চাই। তুমি যাও দাদু,পরে বলব। আমি দ্রম্নত কাগজটিনিয়ে সবার অগোচরে সেলিম দাদুদের বাড়িতে যাই। সেলিম দাদুর হাতে দিয়ে বললাম, আমার দাদুভাই দিয়েছে। কাগজটা দিয়ে আর দেরি করিনি। বাসায় ফিরে আসি।
মা দরজা খুলে বলল, এত দেরি কেন?
আমি মাকে মিথ্যা বলেছি। মা পায়ে খুব ব্যাথা হলো হঠাৎ। তাই ধীরে ধীরে আসতে হয়েছে।
মা’র কী উৎকন্ঠা! কই দেখি বাবা?
আমি ভান করে বললাম, না না তেমন কিছু না।
ভেতর থেকে বাবা বলল, কে এসেছে?
মা বলল, সোহেল।
কী হয়েছে?
দেখতো,ওর পায়ে নাকি খুব ব্যাথা।
সাথে সাথে বাবা চলে এসে বলল,কই? সোহেল, দেখি তো!কীভাবে ব্যাথা পেলে। কোথাও পড়ে গিয়ে আঘাত পাওনি তো!
বাবার এমন আদর আহ্লাদে আমার মনে প্রশ্নের ঝড় তোলে। ভাবছি,বাবা আজ যে তুমি আমাকে এমন করছো,তাতো আমার দাদু ভাইও তোমাকে করেছে।অনেক আদর যত্নে বড়ো করেছে।অথচ আজ তুমি দাদুর কোনো খবরও নিচ্ছ না।সাহস হয়নি বাবাকে তা বলার।
আমি বললাম,না বাবা।তেমন কিছু না।টিফিনে খেলতে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। তখন বাবা মা দুজনই বলছে, বারবার বলেছি,টিফিনে দৌড়াদৌড়ি করবে না। খেলবে না। কথা তো শুনবে না, তাই এমন।ভেতরে ঢুকলাম।হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচলাম আজ।অšত্মত দাদা ভাইয়ের জন্য একটা কিছু করতে পেরেছি। হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খেতে বসলাম,বসতে বসতে বলছি, বাবা।
বাবা বলল,কী সোহেল বলো,ব্যাথা কমেছে?
আমি বললাম,হ্যাঁ বাবা। একটু কমেছে।আচ্ছা বাবা,দাদার খাবার দিয়েছ?
মা হঠাৎ রেগে মেখে বলল,তা তোমার ভাবতে হবে না।ভাত খাও।
বাবা বলল, তোমার চাচাদের ভাত দেওয়ার কথা।
না বাবা! নিরব বলল।
আমি বললাম,নিরবটা আবার কে?
“আমার চাচার ছেলে”
নিরব বলল,চাচা নাকি ঢাকায়। দাদাকে নিরবের মা তেমন কিছু দেয়নি। দুপুরের বাসি ভাত,বাসি তরকারি দিয়ে খাবার দেয়।তাও নষ্ট।খেলে বমি আসবে এমন খাবার দেয়।
বাবা এবার ধমকের সুরে, নিরবের বাবা মা তোমার দাদাকে কী দিল না দিল,তার তোমার জানার দরকার কী? সেটা তাদের বিষয়। সম্পত্তি দেওয়ার সময় তোমার দাদার খেয়াল ছিল না,এমন হবে।
মনের জোড় নিয়ে, সাহস করে বাবাকে বললাম,দাদা তো তোমাকে ও সম্পত্তি দিয়েছে।দাদার তো খুব অসুখ।তুমি ও তো ভালো কিছু করতে পারো। ডাক্তার দেখাতে পারো, ঔষধ এনে দিতে পার। খোঁজ খবর নিতে পারো। দাদা তো তোমারও বাবা। পাশে মাও ছিল। মা তো তেলে বেগুনে রেগে বলল,দেখো সোহেলের বাবা। তোমার বাপ তোমার ছেলের মাথাও খেয়েছে। তোমার ভাই,ভাইয়ের ছেলে আর তোমার বাবা সবাই নিশ্চয় সোহেলকে বুঝিয়েছে।
বাবা বলল, তোমার দাদা এ বাড়ি বানোনোর সময় সবকিছু আমি করেছি। আর আমাকে দিয়েছে খারাপ অংশ এবং কম।তোমার চাচা ছিল বাইরে।আমি এসব দেখতে টেকতে পারবো না।তোমার চাচা জানে।যখন আমার ভাত খাওয়ানোর সময়, তখন আমি দেখবো। তুমি বড়দের কথায় নাক গলাবে না।তোমার কাজ লেখাপড়া। তা তাই করো। বেশি কথা বলবে না।আমি মাথা নিচু করে রাখি।
তারপর আমি জানতে চাই?
কথা শেষ হলো না। ঘন্টা বেজে গেলো। ক্লাস শুরম্ন হবে।
“ফাহিম বলল,ঠিক আছে চল,সবাই ক্লাসে যায়।টিফিন ছুটিতে সব শুনবো।
“আমাদের টিফিন ছুটি প্রায় ৪০ মিনিট। দ্রম্নত টিফিন শেষ করে এবার বসলাম,স্কুলের পুকুরের ঘাটে। ফাহিম খুব এক্সাইটেড, শোনার জন্য।আমার ভেতরে রাশিদের কথাগুলো কিলবিল করছে বলার জন্য। সোহেল বলল, কিছুক্ষণ পর দাদার বন্ধু সেলিম মিয়া এসে দাদাকে নিয়ে গেল। শুনেছি,সেলিম মিয়া দাদুর বাল্যবন্ধু। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে। লেখাপড়া করেছে। চাকরি দুজন ভিন্ন জায়গাতে করলেও, যোগাযোগ হত নিয়মিত। এই সেলিম মিয়া দাদুকে খুব বারণ করেছিল, বাড়ি না বানাতে।হাতে টাকাগুলো রাখতে। কিন্তু দাদু শোনেনি। দাদু ভেবেছে, নিজের সšত্মানদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান করে দিয়ে যাবে। দাদা এটা ভাবেনি,সšত্মানদের জন্য নিরাপন স্থান রাখতে গিয়ে,নিজেই অনিরাপদ, আশ্রয়হীন হয়ে পড়বেন।
সেলিম মিয়া দাদুকে মেডিকেলে ভর্তি করালেন।সেবাযত্ন দিয়ে বন্ধুকে সুস্থ করে তুললেন। প্রায় এক সপ্তাহ দাদু মেডিকেলে ছিল। দুঃখের বিষয় কি জানিস?
“কী?”
আমার বাবা-মা। চাচা-চাচী। এমন কি ফুফিরাও দাদুকে একটু দেখতে পর্যšত্মযায়নি। দাদাকে আমি খুব মনে প্রাণে ভালবাসতাম। তাই গোপনে দুদিন হাসপাতালে দাদুকে দেখতে গিয়ে, এসব জানতে পারি। দাদু বলতো, সোহেল তুমি আমার আদরের সোনা ভাই। তোমার বাবা-মা শুনলে তোমাকে বকা দিবে। আমি দাদুকে বলেছি, কেউ জানবে না। দাদু মাঝেমধ্যে বলতো, বাবা মা’র কথা শুনতে, বাবা মাকে কষ্ট না দিতে,লেখাপড়া করতে। এসব শুনে আমার চোখে পানি এসে যেত। দাদু বুঝতে পারতো,আমাকে বুকে জড়িয়ে দাদুও কান্না করত।আমি বলতাম, তোমার ছেলে মেয়েরা কি তোমার কথা শুনেছে? তোমাকে কষ্ট দেয়নি? মানুষ শত্রম্নকেও তো অসুখেরসময় দেখতে আসে।
দাদু বলতো, এসব কথা বলতে নেই দাদুভাই। কেউ খারাপ হলে তোমাকে খারাপ হতে হবে এমন তো কথা নেই? কষ্ট দিলেও তো ওরা আমার সšত্মান।দাদুর এমন মহানুভবতা দেখে আমি অবাক হতাম। এত কষ্টের পরও ভাবছে সšত্মানদের কথা।
ঠিক আছে বলে, কান্না লুকিয়ে, কৃত্রিম হাসি দিয়ে দাদুকে খুশি করার চেষ্টা করতাম। এভাবে দাদুকে দুইদিন দেখতে গিয়েছি। দাদু আবার বাসায় ফিরবে। পাঁচ তলার সেই নির্জন গরম কক্ষে থাকবে। কিন্তু না।
কিন্তু নাকী?
সেলিম মিয়া দাদু, দাদুকে সাফ জানিয়ে দেয়। তুমি যদি এ অমানুষ ছেলেমেয়েদের বিল্ডিংয়ে যাও তাহলে তোমার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। দাদু সেলিম মিয়াকে বলতো, এসব কথা বলিস না বন্ধু। আমার ছেলেমেয়েরা বুঝতেছে না আজ। কাল ঠিকই বুঝবে।
সেলিম মিয়া বলল, তোমার এসব ফালতু কথা আমাকে বলবে না। তোমার ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে কী পেয়েছ। একটাও মানুষ হয়নি। হয়েছে অমানুষ। বদের হাড্ডি। দেখতো,এই একটা সপ্তাহে কোনো গুণধর সšত্মান এসেছে তোমাকে দেখতে। শুধু লেখাপড়া করালে হয় না। ওরা মানুষ হিসেবে ভালো হতে পারেনি।
যে লেখাপড়া একজন মানুষকে প্রকৃত ভালো মানুষ বানাতে না পারে সেই লেখাপড়া মূল্যহীন।
দাদু চুপ করে থাকে।কাতর কন্ঠে দাদু বলছে, আমি এখন কোথায় থাকবো?
সেলিম মিয়া বলল,আমার কাছে থাকবে।তুমি আমার ছোটবেলার বন্ধু। তোমাকে আমি রাখতে পারব।আর আমার তো ছেলে নেই।আছে দুই মেয়ে তারা খুব ভালো। প্রতিমুহূর্তে আমার খবর নেয়।তোকে কখনো ফেলে দেবে না। দাদু বললো, না সেলিম।আমি তোর বাসায় যেতে পারবো না। আমার আত্নসম্মানে বাঁধবে। তোর আত্নীয় মেয়েরা কী বলবে? না বন্ধু আমি যেতে পারব না। সেলিম মিয়া রেগে গেলেন, কই ছিল তোমার আত¥সম্মান? গত সাত দিনে যে একজন ছেলে মেয়ে তোমাকে একদিনের জন্য ও দেখতে আসেনি। কোথায় ছিল তখন তোমার আত্নসম্মান?যখন তোমার ছেলেরা পঁচা বাসি তরকারির খাবার খেতে দেয়। যখন তাদের সাথে না রেখে, অস্বাস্থ্যকর নোংরা একটা কক্ষে রাখে। তারপরেও সে বাসায় তুমি যাবে?
দাদু বলল, যাব। কিন্তু আমি তোমার বাসায় থাকব না।
সেলিম মিয়া বলল, বন্ধু ছোটবেলায় তুই না হলে আমি লেখাপড়া করতে পারতাম না। আমার বাবা গরিব ছিল বলে,কলম খাতা কিনে দিতে পারেনি। তুই সব দিতি।পারেনি কোন প্রাইভেট পড়তে।তুই আমাকে সব বুঝিয়ে দিতি।তুই না হলে আজ আমার, এই উন্নতি, চাকুরি কিছুই হতো না। আর এমন একজন বন্ধুকে আমি এভাবে কষ্ট পেতে দিতে পারি না। কেঁদে ফেলে সেলিম মিয়া। আমাকে একটু হলেও দয়া কর। একটু ঋণশোধ করতে দে বন্ধু। পিস্নজ বন্ধু। তুই না করিস না। অথচ দাদুর এক কথা, যাবে না সেলিম মিয়ার বাসায়। পঁচা দম বন্ধ ঘরে ধুকে ধুকে মরবে। তবু যাবে না। মরবে তবু আত¥সম্মান কমে এমন কাজ করবে না। সেলিম মিয়ার কাকুতি মিনতি সত্বেও যায় নি দাদু।
আচ্ছা সোহেল, তুই এসব কিভাবে জানলি?তোকে তো যেতে দিত না দাদুর কাছে। হ্যাঁ।
কিন্তু আমি দাদুকে খুব ভালবাসতাম। তাই যেকোনো ছলে বলে কৌশলে দাদুর কাছে যেতাম। দাদু সব বলতো আমাকে। আমার কান্না পেত। আমার কিছু করার ছিল না।
তারপর?
দাদুতো সেলিম দাদুর বাড়ি যাবে না। সেলিম মিয়া বলল, তোকে আমি সে বাড়িতে কোনো মতে পাঠাবো না।
হঠাৎ দাদু বলল, একটা কাজ করতে পারবে বন্ধু।
সেলিম মিয়া একথা শুনে খুশি হয়ে যায়। ভাবলো এবার নিশ্চয় বলবে, ওনার সাথে যাবে। বলল, কী বন্ধু বল, বল?
আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আয়।
সেলিম মিয়ার মাথায়যেন আকাশ ভেঙে পড়ল ।বলল, না। আমি তোর বন্ধু হয়ে এই কাজ করতে পারবো না।দাদু বললো, কিছু হবে না। আমি জীবনে অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছি। শেষ জীবন না হয় কষ্ট করে বাঁচবো। সšত্মানদের জন্য অনেক কিছু করেছি। কী হবে আর। কয়দিনই আর বাঁচব।
তারপর দাদু হাসপাতাল থেকে, সোজা বৃদ্ধাশ্রমে। নিয়মিত যেতেন সেলিম মিয়া সেখানে। দাদুর সব যত্নআত্নি তিনিই করতেন।আমিও যেতাম মাঝে মাঝে। একদিন!
একদিন কী?
একদিন বাবা-মা চাচা-চাচী জানতে পারল, দাদু বৃদ্ধাশ্রমে। মা তো বলেই ফেলল, আপদ বিদায় হয়েছে। বাবা কিছুই বলল না। আমি বললাম,মা এমন কথা বলবে না। মা আমাকে গাল ধরে টেনে বলে, ইশ! দাদুর জন্য দরদ উথলে উঠছে দেখছি। কিছু না বলে আমি নিজের রম্নমে চলে যাই। এর বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ দাদু মারা যায়।
কী বলছিস সোহেল?
হ্যাঁ।
বৃদ্ধাশ্রমের বাথরম্নমে পরে আঘাত পায়। সেলিম মিয়া খরব পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন দুদিন পর রোগে শোকে কষ্টে দাদু মারা যায়। সেলিম মিয়া, দাদুর লাশ নিয়ে আসে আমাদের বাড়িতে। মা, চাচী মায়া কান্না করে। আমার গা জ্বলে যাচ্ছে ঘৃণায়। দুচোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। অথচ দাদুর ছেলেরা তা দেখে কিন্তু কেউ কিছু বলল না।বাবার জন্য সামান্য চোখের পানিও ছিল না। এমন খারাপ বাবা মার সšত্মান আমি।
তোর ফুফুরা আসেনি?
এসেছে তাও দায় সারতে। একটু আধটু কানছে ফুফিরা। বাবা চাচা কান্না তো দূরের কথা এমন ভাব যেন, বাবা চাচা এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছে। কিন্তু লাশ দাফন করার জন্য কোন উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে না। আশেপাশের মানুষ জন নানান কথা বলছে। শেষে সেই সেলিম দাদুই দাদুর লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে।
তারপর!
আর কয় মিনিট আছে দেখতো। ঘন্টা বাজলে ক্লাসে যেতে হবে।
ফাহিম ঘড়ি দেখে বলে, আরও দশ মিনিট আছে।
সোহেল বলল, গত পরশু হঠাৎ আমার ঘরে রাত তখন দেড়টা। দেখি সাদা পাঞ্জাবি পরে দাদু আমায় ডাকছে। ঘুমের চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে দেখি,দাদা কোথাও নেই। বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
মানে!
মানে অদৃশ্য হয়ে গেছে দাদু। কিন্তু কথা বলছে।
আমাকে বলছে, সোহেল! এই সোহেল! কী করছো, ওঠো? আমি উঠে বসতেই বলল, তোমরা তো আমাকে বাঁচতে দিলে না।
দাদু! তুমি না মৃত?
হ্যাঁ, দাদুভাই।
এটা আমার আত্মা-অদৃশ্য আত্মা। মানুষ মরে যায়। আত্মা মরে না। আর তা থাকে পৃথিবীতে মহাশূন্যে। আর দেহ থাকে মাটির নিচে। সেখানে দেহ শেষ হয়ে যায়। আত্মা অমর। আত্মা থাকে সবার আশে পাশে। আমি ভয় পেয়ে যাই। বুক ধড়ফড় করে ওঠে। ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকে। মৃত মানুষের আত্মার সাথে কথা বলছি।তখন এ কথা শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার।
ভয়ে কাঁপতে থাকি।দাদু বলছে, ভয় পেয়ো না।দাদুভাই আমি তোমার কিছুই করব না। তুমি আমার ভালো দাদুভাই।
আমি একটু সাহস করে বললাম, তুমি কেন এসেছ? দাদু বললো, প্রতিশোধ নিতে।
কীসের প্রতিশোধ?
যারা আমাকে বাঁচতে দেয়নি, যাদের জন্য সারা জীবনটাই উৎসর্গ করলাম, তাদের প্রতিশোধ নেবো।
“বাবা চাচাদের?”
দাদুর কণ্ঠস্বর বলল, ঠিক ধরেছো। তাদের প্রতিশোধ নেবো।
আমি বললাম, না। দাদু এমন করো না। জীবিত থাকতে তোমাকে এত কষ্ট দেওয়ার পরেও, কিছু করোনি। ¶মা করে দিতে। অভিশাপ দাওনি। বুঝবে একদিন এমন বলতে।
শোন দাদুভাই, আমি ছিলাম মানবিক মানুষ। ছিল আবেগ বিবেক। কিন্তু এখন আমি আর মানুষ নয়। মৃত। মৃত মানুষের কোন আবেগ বিবেক নেই। আমি প্রতিশোধ নেব।
দাদু ওরা তো তোমারই ছেলে। ওরা একদিন তাদের ভুল বুঝতে পারবে। তুমি তো তা বলেছিলে। আর এখন কি বলছো এসব।
দাদুর আত্মা বলছে,ওদের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমি এসেছি। মানুষ হলে সে তার কর্মফল ভোগ করতেই হবে। তবে তা আমি করবো না। আমি শুধু দূর থেকে দেখব। আর অট্টহাসিতে উল্লাস করবো। হা হা হা … করে দাদুর আত্মা হাসছে। ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি কে করবে?
দাদুর কণ্ঠস্বর বলল, তুমি করবে আর নিরব করবে।
আমি বললাম,মানে?
দাদুর কণ্ঠস্বর বলল, মানে সোজা। ওরা মানে, তোমার বাবা, তোমার চাচা আমাকে যা যা কষ্ট দিয়েছে, তুমি আর নিরব, তোমার বাবা ও চাচাকে তাতা করবে। ওরা যেদিন আমার মত বয়স্ক হবে, ঠিক তখনই তা করবে।
আমি বললাম, না দাদু আমি করবো না।
দাদর আত্মা বলল, তুমি যদি না করো তবে আমি? বলেই
“কী দাদু,আমি”
“আমি ওদের বাঁচতে দেব না”
“মেরে ফেলবে?”
দাদর আত্মা বলল, ঠিক তাই।
আমি বললাম, না ওদের মেরো না।
দাদু বলল, ওরা আমার সাথে যা যা করেছে, তোমরাও তা তা করবেই। সেটাই হবে প্রকৃতির প্রতিশোধ।
আমি বললাম, ঠিক আমিও তা তা করব। কষ্ট দেবো। তখন তুমি মানে, তোমার আত্মা শান্তি পাবে।
দাদুর কণ্ঠস্বর বলল, ঠিক ধরেছ।
আমি বললাম, কিন্তু দাদু?
কিন্তু কী দাদু?
কী করে, কেমন করে দেব। তাহলে তো এভাবে চলতে থাকবে। আমি আমার বাবা মাকে কষ্ট দিলে, আমার ছেলেমেয়েরাও তো আমাদেরকে কষ্ট দেবে। আচ্ছা তুমি কি তোমার বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছিলে? যা তুমি আমার বাবা-মার কাছে পেয়েছ?
দাদুর আত্মা এবার চুপ হয়ে গেল। আমি বলছি,কী হয়েছে? কথা বলছো না কেন? বলো,বলো।আমি ঠিক বলিনি?
কিছু¶ণ পর বলল, দাদু ঠিক বলেছ। তুমি খুবই বুদ্ধিমান, মেধাবী। আমার ভালো লাগছে যে, যা আমার ছেলেরা পারেনি। তা আমার দাদুভাই পারবে।
একটু থেমে দাদুর কণ্ঠস্বর আবার বলল, আমি ছিলাম আমার বাবা মা’র একমাত্র সন্তান। আমি যখন তিন বছরের,তখন আমার বাবা মারা যায়। বাবাকে সেবা করার সুযোগও পায় নি।কিন্তু যতদিন আমার মা ছিল মাকে কখনো কষ্ট দেয় নি।
আমি বললাম, দাদু এমন না।
দাদর কণ্ঠস্বর বলল, কেমন?
এই সমাজ, স্বার্থ, লোভ মানুষকে খারাপ করে তোলে। ওরা সুশি¶া পায়নি, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে যে শি¶া অর্জন করেছে তা তাদের ভালো মানুষ বানাতে পারেনি। দেখো না দাদা, আমাদের দেশে কত মানুষ কেউ ডাক্তার, কেউ ইনজিনিয়ার, কেউ পুলিশ, কেউ অফিসার, কেউ সচিব, কেউ শিক্ষক, কেউ বুদ্ধিজীবি, কেউ নেতা, কেউ মন্ত্রী, কেউ ব্যবসায়ী,কেউ ধনী, কেউ সম্পদশালী, কিন্তু কয়জন ভালো মানুষ? জানো আমাদের দেশে, আমাদের পৃথিবীতে দরকার ভালো মানুষ, আদর্শবান মানুষ। যারা বলবে না মিথ্যা, করবে না প্রতারণা, কাউকে ঠকাবে না, দূর্নীতি করবে না। দেশকে ভালোবাসবে। মানুষকে ভালোবাসবে। মহানুভব, সহমর্মী মানুষ হবে। দাদু বলল, চমৎকার। যা আমি আমার ছেলেমেয়েদের কাছে পায়নি। তা আমার দাদু ভাইয়ের কাছে পেয়েছি । আমি এখন শান্তি পাবো। আমি বলি, দাদু আমার বাবা মানে, তোমার ছেলেও তাই। কিন্তু আমি বড় হয়ে ভালো মানুষ হতে চেষ্টা করব। যা তুমি জীবিত থাকতে আমাকে বলেছ, কত কষ্ট করেছ। তবুও বাবা চাচাদের অভিশাপ দাও নি।
দাদুর আত্মা আবার অট্টহাসিতে মেতে ওঠে।
আমি বলছি, দাদা তুমি এমন হাসছো কেন?
দাদুর আত্মা বলছে, আমার ভালো লাগছে। আমার বংশে তুমি বড় হয়েছো।যা যা তোমার বাবা চাচাদের কাছে পায়নি।
আমি বললাম, দাদা দেখো ওরা ভুল করেছে ঠিক। কিন্তু আমি মানুষ হয়ে, আমার বাবা মাকে কষ্ট দেব না, শুধু বাবা মাকে কেন, আমি মানুষ হিসেবে অন্য মানুষকে কষ্ট দেবো না। কিন্তু প্রকৃতি তাদেরও ¶মা করবে না। প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম। তারা তাদের ভুলের মাশুল দিবে। কোনো না কোনো ভাবে তার ফল ভোগ করবে।
চমৎকার বলেছ দাদুভাই।
আমি বলে যাচ্ছি। তবে আবার আসবো যেদিন, দেখবো প্রকৃতি ঠিকই তার প্রতিশোধ নেবে।
শোন দাদু!
কিন্তু দাদু আর শুনলো না। অদৃশ্য হয়ে গেল। সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি।
“তারপর”
তারপর কী, সকালে ঘুম ভাঙে। কিন্তু আমি স্কুলে আসতে চায়নি। মাপাঠিয়েছে।বাবা হঠাৎ বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। বমি করছে। প্রচন্ড পেট ব্যথা, কোমর ব্যথা। বাবাকে রেখে আসতে ইচ্ছে হয়নি। বলতেও পারিনি। দাদুর আত্মার সাথে কথা বলার কথা। জানিনা বাবার এখন কী অবস্থা। টেনশন হচ্ছে। টুনটুন করে ঘন্টা কানে আসে। টিফিন পিরিয়ড শেষ। সবাই ক্লাসে গেলাম। অথচ ঘটনার রেশ রয়ে গেল।
ভয়ে কাঁপতে থাকি।দাদু বলছে, ভয় পেয়ো না।দাদুভাই আমি তোমার কিছুই করব না। তুমি আমার ভালো দাদুভাই।
আমি একটু সাহস করে বললাম, তুমি কেন এসেছ? দাদু বললো, প্রতিশোধ নিতে।
কীসের প্রতিশোধ?
যারা আমাকে বাঁচতে দেয়নি, যাদের জন্য সারা জীবনটাই উৎসর্গ করলাম, তাদের প্রতিশোধ নেবো।
“বাবা চাচাদের?”
দাদুর কণ্ঠস্বর বলল, ঠিক ধরেছো। তাদের প্রতিশোধ নেবো।
আমি বললাম, না। দাদু এমন করো না। জীবিত থাকতে তোমাকে এত কষ্ট দেওয়ার পরেও, কিছু করোনি। ক্ষমা করে দিতে। অভিশাপ দাওনি। বুঝবে একদিন এমন বলতে।
শোন দাদুভাই, আমি ছিলাম মানবিক মানুষ। ছিল আবেগ বিবেক। কিন্তু এখন আমি আর মানুষ নয়। মৃত। মৃত মানুষের কোন আবেগ বিবেক নেই। আমি প্রতিশোধ নেব।
দাদু ওরা তো তোমারই ছেলে। ওরা একদিন তাদের ভুল বুঝতে পারবে। তুমি তো তা বলেছিলে। আর এখন কি বলছো এসব।
দাদুর আত¥া বলছে,ওদের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমি এসেছি। মানুষ হলে সে তার কর্মফল ভোগ করতেই হবে। তবে তা আমি করবো না। আমি শুধু দূর থেকে দেখব। আর অট্টহাসিতে উলস্নাস করবো। হা হা হা … করে দাদুর আত¥া হাসছে। ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি কে করবে?
দাদুর কণ্ঠস্বর বলল, তুমি করবে আর নিরব করবে।
আমি বললাম,মানে?
দাদুর কণ্ঠস্বর বলল, মানে সোজা। ওরা মানে, তোমার বাবা, তোমার চাচা আমাকে যা যা কষ্ট দিয়েছে, তুমি আর নিরব, তোমার বাবা ও চাচাকে তাতা করবে। ওরা যেদিন আমার মত বয়স্ক হবে, ঠিক তখনই তা করবে।
আমি বললাম, না দাদু আমি করবো না।
দাদর আত¥া বলল, তুমি যদি না করো তবে আমি? বলেই
“কী দাদু,আমি”
“আমি ওদের বাঁচতে দেব না”
“মেরে ফেলবে?”
দাদর আত¥া বলল, ঠিক তাই।
আমি বললাম, না ওদের মেরো না।
দাদু বলল, ওরা আমার সাথে যা যা করেছে, তোমরাও তা তা করবেই। সেটাই হবে প্রকৃতির প্রতিশোধ।
আমি বললাম, ঠিক আমিও তা তা করব। কষ্ট দেবো। তখন তুমি মানে, তোমার আত¥া শাšিত্ম পাবে।
দাদুর কণ্ঠস্বর বলল, ঠিক ধরেছ।
আমি বললাম, কিন্তু দাদু?
কিন্তু কী দাদু?
কী করে, কেমন করে দেব। তাহলে তো এভাবে চলতে থাকবে। আমি আমার বাবা মাকে কষ্ট দিলে, আমার ছেলেমেয়েরাও তো আমাদেরকে কষ্ট দেবে। আচ্ছা তুমি কি তোমার বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছিলে? যা তুমি আমার বাবা-মার কাছে পেয়েছ?
দাদুর আত¥া এবার চুপ হয়ে গেল। আমি বলছি,কী হয়েছে? কথা বলছো না কেন? বলো,বলো।আমি ঠিক বলিনি?
কিছুক্ষণ পর বলল, দাদু ঠিক বলেছ। তুমি খুবই বুদ্ধিমান, মেধাবী। আমার ভালো লাগছে যে, যা আমার ছেলেরা পারেনি। তা আমার দাদুভাই পারবে।
একটু থেমে দাদুর কণ্ঠস্বর আবার বলল, আমি ছিলাম আমার বাবা মা’র একমাত্র সšত্মান। আমি যখন তিন বছরের,তখন আমার বাবা মারা যায়। বাবাকে সেবা করার সুযোগও পায় নি।কিন্তু যতদিন আমার মা ছিল মাকে কখনো কষ্ট দেয় নি।
আমি বললাম, দাদু এমন না।
দাদর কণ্ঠস্বর বলল, কেমন?
এই সমাজ, স্বার্থ, লোভ মানুষকে খারাপ করে তোলে। ওরা সুশিক্ষা পায়নি, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে যে শিক্ষা অর্জন করেছে তা তাদের ভালো মানুষ বানাতে পারেনি। দেখো না দাদা, আমাদের দেশে কত মানুষ কেউ ডাক্তার, কেউ ইনজিনিয়ার, কেউ পুলিশ, কেউ অফিসার, কেউ সচিব, কেউ শিড়্গক, কেউ বুদ্ধিজীবি, কেউ নেতা, কেউ মন্ত্রী, কেউ ব্যবসায়ী,কেউ ধনী, কেউ সম্পদশালী, কিন্তু কয়জন ভালো মানুষ? জানো আমাদের দেশে, আমাদের পৃথিবীতে দরকার ভালো মানুষ, আদর্শবান মানুষ। যারা বলবে না মিথ্যা, করবে না প্রতারণা, কাউকে ঠকাবে না, দূর্নীতি করবে না। দেশকে ভালোবাসবে। মানুষকে ভালোবাসবে। মহানুভব, সহমর্মী মানুষ হবে। দাদু বলল, চমৎকার। যা আমি আমার ছেলেমেয়েদের কাছে পায়নি। তা আমার দাদু ভাইয়ের কাছে পেয়েছি । আমি এখন শাšিত্ম পাবো। আমি বলি, দাদু আমার বাবা মানে, তোমার ছেলেও তাই। কিন্তু আমি বড় হয়ে ভালো মানুষ হতে চেষ্টা করব। যা তুমি জীবিত থাকতে আমাকে বলেছ, কত কষ্ট করেছ। তবুও বাবা চাচাদের অভিশাপ দাও নি।
দাদুর আত্মা আবার অট্টহাসিতে মেতে ওঠে।
আমি বলছি, দাদা তুমি এমন হাসছো কেন?
দাদুর আত¥া বলছে, আমার ভালো লাগছে। আমার বংশে তুমি বড় হয়েছো।যা যা তোমার বাবা চাচাদের কাছে পায়নি।
আমি বললাম, দাদা দেখো ওরা ভুল করেছে ঠিক। কিন্তু আমি মানুষ হয়ে, আমার বাবা মাকে কষ্ট দেব না, শুধু বাবা মাকে কেন, আমি মানুষ হিসেবে অন্য মানুষকে কষ্ট দেবো না। কিন্তু প্রকৃতি তাদেরও ক্ষমা করবে না। প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম। তারা তাদের ভুলের মাশুল দিবে। কোনো না কোনো ভাবে তার ফল ভোগ করবে।
চমৎকার বলেছ দাদুভাই।
আমি বলে যাচ্ছি। তবে আবার আসবো যেদিন, দেখবো প্রকৃতি ঠিকই তার প্রতিশোধ নেবে।
শোন দাদু!
কিন্তু দাদু আর শুনলো না। অদৃশ্য হয়ে গেল। সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি।
“তারপর”
তারপর কী, সকালে ঘুম ভাঙে। কিন্তু আমি স্কুলে আসতে চায়নি। মাপাঠিয়েছে।বাবা হঠাৎ বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। বমি করছে। প্রচন্ড পেট ব্যথা, কোমর ব্যথা। বাবাকে রেখে আসতে ইচ্ছে হয়নি। বলতেও পারিনি। দাদুর আত্মার সাথে কথা বলার কথা। জানিনা বাবার এখন কী অবস্থা। টেনশন হচ্ছে। টুনটুন করে ঘন্টা কানে আসে। টিফিন পিরিয়ড শেষ। সবাই ক্লাসে গেলাম। অথচ ঘটনার রেশ রয়ে গেল।
৫
ছুটির পর বাসায় ফিরতে ফিরতে বন্ধু রাশিদের কথা বললাম। সবাই অবাক হল। জানিনা আজ রাতেকিছু হয় কিনা।
প্রতিদিনের মতো আজও ঘুমাতে যাব।
বাবা বলল, জাহিন! তুমি কি কোন বিষয় নিয়ে টেনশনে আছো?
আমি বললাম না তো।
বাবা বলল, মনে হচ্ছে তুমি কোন বিষয় নিয়ে টেনশনে আছ। জেনে রেখো, মানুষের মুখ মনের আয়না। আয়নায় যেমন নিজেকে দেখা যায়, তেমনি তোমার মনের ছবি দেখা যায় তোমার মুখের অবয়বে।
“না বাবা”। কিছু হলে আমি তোমাকে বলবো। ভাবছি,বাবারা কিভাবে ছেলেদের মুখে দেখে মনের কথা বুঝতে পারে।
বাবা বলল, দেখো কোন কিছু লুকাবে না। মনে কোনো প্রশ্ন এলে, কোন সমস্যায় থাকলে, তা আলোচনা করে সমাধান করা যায়।
না বাবা, “তেমন কিছু না।”
বাবা ঠিক আছে বলে, চলো ঘুমাতে যায়।
বাবার কাছ থেকে যতই লুকাই না কেন, নিজের কাছ থেকে তো লুকাতে পারছিনা। রাশিদের কথা, সোহেলের দাদুর কথা। মৃত আত্মা নাকি অন্য কিছু। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন তা আর মনে নেই।
ঘুম ভাঙে, যখন বাবা ডাকে জাহিন ওঠো।স্কুলে যাবে।
চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে পড়ি। কিন্তু সেই রাশিদের মৃত আত্মা আজতো আসেনি, কথাও বলেনি। অথচ আমি অপে¶া করেছি। প্রতিদিনের মতো স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। যেতে যেতে যত প্রশ্ন মাথায়, উত্তর মিলছে না।
স্কুল গেইটে সোহেল,ফাহিমের সাথে দেখা। ওরা খুব উত্তেজিত। বললো জাহিন।
আজকে কি তোর সেই বন্ধু রাশিদের মৃত আত্নার সাথে কথা হয়েছে?
না রে! বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
সোহেলকে উদ্দেশ্য করে বললাম, তোর কি খবর? তোর দাদু আর কিছু বলেছে?
সোহেল বলল,না তো।
ফাহিম বলে, কিরে মৃত আত্মাগুলো সত্যি মরে গেছে।
আরিফ বললো, তাইতো মনে হচ্ছে।
সবাই হো হো করে হেসে উঠি।
৬
ঠিক দু’দিন পরের ঘটনা।
সবাই আমরা ক্লাসে। গণিত স্যার বিদায় নেয়ার পর,লাস্ট ব্যাঞ্চের নিশান ফাস্ট বেঞ্চে এসে বলল, জাহিন তোর সাথে একটা কথা আছে।
বললাম,কি হয়েছে নিশান? বল।
আরে! সেটা এক লম্বা কাহিনী।
মানে!
তোর সাথে একটু পরামর্শ করতে চাইছি।
কী পরামর্শ?
গত পরশু রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তোকে গতকাল বলতে চেয়েছি।কিন্তু বলতে পারিনি।
আজ বলবো কিনা,তাও দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছি।গণিত স্যারের ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারিনি। কাউকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনা মনে।
আমি বললাম,সিরিয়াস কিছু?
হ্যাঁ।
বিলাস স্যার ক্লাসে ঢুকতেই,নিশান লাস্ট বেঞ্চে চলে যায়।কথা শেষ হলো না।
টিফিন পিরিয়ডেও কথা বলা গেল না।
প্রধান শি¶ক শি¶ার্থীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ছুটির দিনগুলোতে শরীরকে যত্ন ও বেশি বেশি পানি পান করার কথা বলেন। স্কুল ছুটির পর নিশানকে বলি,তুই কি বলতে চেয়েছিলি?
না রে! আজ আমার কাজ আছে। বাবা দ্রুত বাড়িতে যেতে বলেছে। কাল স্কুলে এক ঘন্টা আগে আসবো। তোরাও আসিস।তখন বলব সব।
পরদিন
নিশান আগেভাগে এসে স্কুলের পুকুর ঘাটে বসে। আমি আর ফাহিমও আসি। পরে এলো আরিফ। সবার মনে কোনো কথা নেই,টানটান উত্তেজনা এমন একটা ভাব। যেন অনন্ত রহস্য লুকিয়ে রেখেছে নিশান। একটা একটা কথায় সে রহস্য উন্মোচিত হবে।
থমথমে ভাব,ফাহিম বোমা ফাটালো একটা। জানিস, গতরাতে আমাদের বাড়িতে কি হয়েছে? আমরা প্ল্যান মত বসে আছি, নিশানের ঘটনা শোনার জন্য। সবাই চমকে উঠি।ঘটনার পর ঘটনা। ঘটনা ঘটায় না। ঘটছে আর ঘটছে। কেমনে মৃত মানুষের যন্ত্রণায় অস্থির, তার ওপর বন্ধুদের ঘটনা।
এটাও কি সেই মৃত মানুষের আত্নার ঘটনা?
আরিফ বলল, তোর আবার কি হলো ফাহিম।শুনতে এসেছি নিশানের কথা। রাখ নিশানের কথা পরে শুনবো। ফাহিম কি বলে দেখি।
আরিফ বলছে না। ফাহিমের কথা পরে শুনবো। আগে নিশানের কথা শুনি।
কারটা আগে শুনবো, কারটা পরে শুনবো এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় স্কুল পুকুর ঘাটে আমাদের সাথে যোগ দেয় তাসিফ ও অনিম।
কি নিয়ে কথা হচ্ছিল,অনিম বলল। অনিম নিশানের কথা জানে না। তাসিফ বলে, বস আগে। কী কথা হচ্ছে একটু পরে জানতে পারবি।
আমি বললাম, দেখ এমন করলে কারো কথাই শোনা হবে না। সময় অলরেডি ১৫ মিনিট শেষ। বাকি আছে ৪৫ মিনিট।
পরে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, আগে নিশানের কথা শুনবে। ও যেহেতু আগে বলেছে, ওরই অগ্রাধিকার।আমি বললাম ফাহিম, তোর কথা শুনব টিফিনের সময় এবং ছুটির পর। ওকে বলে সবাই সায় দিল। ফাহিম একটা শুকনো হাসি দিয়ে নিশানকে উদ্দেশ্য করে বলে, বলুন আপনার স্বপ্নের রহস্যময় কথাগুলো।
নিশান বলতে শুরু করে। সবাই আমরা তীর্থের কাকের মত বসে আছি।
নিশানবলল, জানিস?
তাসিফ এয়ার্কি করে বলছে,আরে! না বললে জানবো কী করে।
আমি বললাম, এমন করিস না তো, শুনতে দে।
“আমি স্বপ্নে দেখি, একদিন হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়। আমি স্কুল থেকে ফিরছি। বাতাসের জোরে আমার ছাতাটা উড়ে যায়। আমি ছাতার পিছু ছুটছি। ছাতাটা ধরতে ধরতে করেকোনমতে ধরতে পারছিলাম না। যেই হাতের নিকটে আসে,আবার সেই বাতাস অনেকদূর নিয়ে যায়। ইতোমধ্যে আমি ঝড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছি। রাস্তাঘাটে তেমন কাউকে দেখছি না। কোথাও কেউ নেই আমার সাথে। হঠাৎ মহাসড়কের উপরে ছাতাটা স্থির হয়। কিন্তু ঝড় থামেনি। অঝরে বৃষ্টি পড়ছে।অথচ ছাতা থেমে গেছে। আমি যে ছাতা নেব ভাবছি, সে রাস্তার এক পাশ থেকে একটা ট্রাক, অপর দিক থেকে একটা কার্ভাডভ্যান দ্রুতগতিতে আসছে। আমি যদি ছাতাটা নিতে যাই, নিশ্চিত মৃত্যু। আর না হলে ছাতা শেষ। তখন ভাবছিলাম, জীবন বাঁচাবো না ছাতা ।
আরিফ ধৈর্য ধরতে পারছে না। খুব উত্তেজনায় বলছে, কী করলি?
“আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে আছি। ছাতা নেওয়ার চেষ্টা করলাম না। কিন্তু কার্ভাডভ্যানটি মূল সড়ক থেকে ধেয়ে আসছে আমার দিকে।আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। রাস্তার পাশে একটা খাল। খাল ভর্তি পানি। আমি আবার সাঁতার জানিনা। অপরপাশ থেকে অন্য একটা ট্রাকও দেখি আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমার পেছনে খাল। সামনে মহাসড়ক। মহাসড়কে ছাতা। ডান ওবামে রাস্তার পাশ। ডানে গেলে ট্রাক, বামে গেলে কার্ভাডভ্যান।নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে, স্থির দাঁড়িয়ে আছি।দেখি কার্ভাডভ্যানের ধাক্কায় আমি খালের পানিতে পড়ে বলছি,বাঁচাও বাঁচাও।
” আমার বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শোনে ঘুম থেকে বাবা-মা দুজনে ওঠে “
বাবা বলছে, কী হয়েছে নিশান?
মাও বলছে, কী হয়েছে? তুমি বাঁচাও!বাঁচাও !বলছ কেন?
দেয়ালের ঘড়িতে দেখি, তখন রাত ৩টা ১৫ মিনিট।
বললাম, আমি স্বপ্নে দেখি,আমিঅ্যাক্সিডেন্ট করেছি। পড়ে গেছি খালে।তাই বলছি বাঁচাও বাঁচাও।
বাবা চুপচাপ কিছু বলছে না। মা বললো, স্বপ্ন তো স্বপ্নই। তুমি দিনে হয়তো এমন কিছু ভেবেছ। দোয়া কালাম পরে ঘুমাও। মাও কি সব দোয়া পড়ে আমাকে ফুঁ দেয়।
বাবা মার কথায় শুয়ে গেলেও,কোনমতে ঘুম আসছে না।
নির্ঘুম রাতের শেষে স্কুলে এলে, তোদের সাথে পরামর্শ নেব ভেবেছি।কিন্তু আমি শেষমেষ………..
কিন্তু কী নিশান?
কিন্তু গতরাতে স্বপ্নে দেখি,অন্য এক আশ্চার্য ঘটনা।
তাসিফ বলল, দ্রুত বল কী সে ঘটনা।
নিশান আবার শুরু করে।
“তাও একই রকম স্কুলে আসার জন্য বাড়ি থেকে বের হলাম। দেখি প্রচন্ড বৃষ্টি। ঝড়ো হাওয়া বা তুফান নেই। ধীরে ধীরে হাঁটছি।তবুও ভিজে যাচ্ছি।হঠাৎ দেখি আমি স্কুলের পথে যাচ্ছি না। অজানা, অচেনা কোন বনের ভেতর যাচ্ছি।আমার সামনে একজন অদ্ভুত মানুষ। সাধারণ মানুষের মতো না। দেখতে অনেকটা লম্বা। কালো এক ধরনের পোষাকে শরীর ঢাকা। হাতগুলো সাদা। মুখ নেই। চোখ দুটো বড় বড়। সিংহের চোখের মত।চোখ দিয়ে এক ধরনের লাভা বের হচ্ছে।সাদা সাদা হাত দুটি অনেক লম্বা। কোন কথাই বলছে না। বলবেই বা কেমন করে। তার মুখ তো আমি দেখছি না। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছি।এমনিতে বৃষ্টি,তার উপরে মনে হচ্ছে,আমার মাথার উপর থেকে পা পর্যন্ত বরফ শীতল হয়ে গেছে। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। লোকটি ধীরে ধীরে আমার খুব কাছে আসে। আমি ভয়ে, কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি পেছনের দিকে উল্টো হাঁটছি।লোকটি যতই আমার সামনে আসছে আমি ততই পেছনে যাচ্ছি। যে পেছনে ফেলে দৌড় দেবো ভেবেছি,সেই পেছনে দেখতেই দেখি,সেই লোকটি পেছনেও।ঠিক একই ধরনের দুজন লোক। একজন সামনে,একজন পেছনে। বনের মধ্যে ডানে বা বামে যাব, তেমন রাস্তা থাকলেও, একই ধরনের দু’জন অদ্ভুত মানুষ দেখে হাত পা থরথর করে কাঁপতে থাকে।বৃষ্টির মধ্যে শরীরের লোমগুলো খাড়া হয়ে যায়। বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল,বুঝতেছি না কী করবো। কী করা উচিত।লোক দুটি কিছুই বলছে না। কিছু না হলেও, ভাবছি ডান দিকে বনের ভেতর দৌড়ে পালিয়ে যাব। দেখি,সেই দিক থেকে একই লোক আসছে। এবার বামদিক যেতে মনস্থির করছি। সেই দিকে একই অদ্ভুত লোক আসছে। আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকি। ঐ গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের গত পরশুর স্বপ্নের মত।চোখ বন্ধ করে রাখি।কিছু¶ণ পর দেখি কোনোসাড়া শব্দ নেই।থেমে গেছে বৃষ্টিও। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলেছি, দেখি আমাকে বৃত্তের মতো ঘিরে রেখেছে অনেকগুলো অদ্ভুত একইরকম মানুষ।বোঝার কোন উপায় নেই,কোনটা কে।সবাই হুবহু একই ধরনের। কেউ কোনো কথা বলছে না। ক্লোন মানুষের মতো।”
ফাহিমের চোখে মুখে এক ধরনের উৎকণ্ঠ বলে, তখন কী করলি নিশান?
নিশান বলছে, যেখানে আমাকে ঘিরে রাখে সেটা বনের কোনো পথ নয়। আমি চোখ বন্ধ করেছিলাম। যেখানে ছিলাম সেখানে আমি নেই। অর্থাৎ এখানে কীভাবে এলাম বুঝতে পারেনি। কেউ আমাকে ধরেনি। ছুঁয়ে দেখেনি।এখানে কিভাবে আসলাম,অদ্ভুত। অদ্ভুতুরে সুন্দর জায়গা। চারদিকে পাহাড়।কোনো কোনো পাহাড় থেকে পানি ঝড়ছে।ঝরণা মতো কিন্তু পানিলাল রঙের ।লাল পানি দেখে আমার মনে হচ্ছে, রক্ত নদী। রক্ত নদীতে অন্য এক ধরনের প্রাণী খেলা করছে। তারা ছোট ছোট বাচ্চাদের মতো বেঁটে।সাত আট বছরের বাচ্চাদের মতো। অথচ ওরা বাচ্চা না। বড় মানুষ বেটে হলে যেমন হয়,ঠিক তেমনি। ওদের সবকিছু সাদা। ওদের মুখ আছে। কেউ কথা বলছে না। আপন মনে খেলছে রক্ত নদীতে। আমাকে ঘিরে রেখেছে কালো মানুষ, সাদা হাতে চর্তুদিকে।যেন জমজ বা ক্লোন প্রকৃতির মানুষ।
কী করবো আমি বুঝে উঠতে পারছি না। পালানোর পথ বন্ধ। আর জায়গাটাও আমি চিনি না। অজানা অচেনা একটি স্থান। হঠাৎ দেখি,আকাশ থেকে উড়ে যেন কী একটা নামছে। অদ্ভুত এই মানুষগুলো, ওদের নামার জন্য পথ ছেড়ে দেয়। গোলাকার বৃত্তের মাঝখানে আমি। চতুর্দিকে দেখি একই দূরত্বে প্রসারিত হয়ে বৃত্ত বড় হতে থাকে। ধীরে ধীরে আমার সামনে নামে। এটা আবার কী। এই অচেনা স্থানে এটা আমি কী দেখছি।
অনিম বলল, কী সেটা?
আরিফ বললো, তোরা এত অধৈর্য কেন?
সময় আর ৮মিনিট বাকি। ক্লাসে যেতে হবে।
ওকে শেষ করতে দে।
ঠিক আছে বাবা,বলতো নিশান।
নিশান আবার শুরু করে। যেটা নামে সেটা একটা মহিলা। মহিলা আমাদের চারপাশে থাকা,আট দশজন,মা,বোন,চাচি,খালা মামিদের মত।
মহিলাটি বলল,তুমি নিশান।তাই না?
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম হ্যাঁ।
তোমার বাবা গাড়ি চালক?
হ্যাঁ।
তুমি নবম শ্রেণীতে পড়ো?
হ্যাঁ।
ঘরে মা আছে আর বড় বোন আছে। তাই না?
হ্যাঁ।
বড় বোন টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ নিজে চালায়। কিছু টাকা তোমার পড়ালেখা ও সংসারের খরচ করে।
হ্যাঁ।
তোমার বাবা বেশি পড়ালেখা করেনি? অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত?
হ্যাঁ।
তোমরা তেমন ধনী ওনা,একদম গরীবও না।
হ্যাঁ।
আরিফ বলল, তুই শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করেছিস।আর কিছু বলতে পারিস নি?
“আরে! ভয়ে আমার জান যাবার অবস্থা। আর আমাকে কোন কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে না। “
“এরপর”
এরপরও একই প্রশ্ন।
বলল, তোমার বাবা কাভার ভ্যান চালায়?
হ্যাঁ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম,চট্টগ্রাম-কক্সবাজার,ঢাকা-রাজশাহী সহ অন্যান্য জেলায়?
হ্যাঁ।
তোমার বাবা বাসায় কম থাকে?
হ্যাঁ।
গাড়ি নিয়ে যেখানে যায় সেখানে থাকে?
হ্যাঁ।
গত তিন মাস আগে প্রায় ২০ দিন বাড়ি আসেনি?
হ্যাঁ।
তখন তোমার মা খুব চিন্তিত ছিল?
হ্যাঁ।
এর চেয়ে বেশি কিছু জানো,কেন আসেনি?
না।
তাসিফ বলল,বাহ। সুন্দর তো! হ্যাঁ থেকে এবার না’তে।
তারপর!
মা কিছু বলেনি?
না।
একদম কোন কিছু বলেনি?
না।
তুমি কিছু জানতে না?
না।
জানতে চাও নি?
না।
বাবা এতদিন কেন বাড়ি আসেনি জানতে চাও নি?
না।
গড।বেরি গুড। তুমি ভালো ছেলে?
না।
না কেন?
এতক্ষণে তিনি হ্যাঁ তে আসলেন। না থেকে বের হয়ে এলেন।
“কারণ আমি স্টুডেন্ট হিসেবে এতো ভালো না। “
“যে ছাত্র হিসেবে ভালো না সে মানুষ হিসেবে ভালো হতে পারে?”
জানি না।
আবার না’তে।আরিফ বলল।
স্কুল শুরুর ঘন্টা বাজে।
ওহ সিট! তাসিফ বলে, ঘটনা শেষ হল না।
চল চল ক্লাসে।টিফিনের শুনবো।
ওকে ঠিক আছে।
৭
ক্লাসে কারো মন নেই। ব্যাপারটা ল¶্য করলেন জমির স্যার। বারবার দেখছেন, আমরাও বসেছি,প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাঞ্চে। একে অপরের চোখাচোখি। কখন ক্লাস শেষ হবে সে অপেক্ষা। অন্য দিনে সময় দ্রুত শেষ হয়। আজ যেন শেষই হচ্ছে না সেই প্রথম পিরিয়ড। মনে হচ্ছে এক বছর।
হঠাৎ,জমির স্যার,জাহিন! তোমরা কী ভাবছো? আমাকে বলতে পারো। কোনো সমস্যা?
না স্যার! কিছুই না। প্রশ্নটা এমন,তোমরা! মানে অনেক জন।
স্যার!
জমির স্যার বলল, তুমি।আরিফ,নিশান,অনিম,সোহেল,আর আসিফ। কোন সমস্যা হলে স্যারকে বলতে পারো।
জমির স্যার এমনইতে আমাদের শ্রেণি শি¶ক। বকা দিয়ে বললেন, কোন সমস্যা নেই তাহলে?
আমি বললাম, না স্যার।
মাঝে মাঝে ভাবি স্যারেরা কিভাবে বুঝেন এত কিছু।আমরা যে রহস্যময়তায় ঘেরা সময় পার করছি।জানিনা, শেষ কোথায়।
জমির স্যার বলল, ঠিক আছে। ক্লাসে মনোযোগ দাও।
ওকে স্যার বলে,বসি।
স্যার আবার পড়াতে শুরু করলেন।
টিফিনে সবাই বসলাম, টিফিন রুমে।আমি বললাম, নিশান শুরু কর।
হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু কর। বললো,আরিফ,অনিম,সোহেল।
নিশান বলছে,তারপর!
“জানো না কেনো?” অচিন পুরির মহিলাটা বললো।
আমি বললাম “তাও জানি না।
কী জানি না রে, আরিফ বলল।
নিশান বলল, দুর বোকা। আমাকে যে বলল, যে ছাত্র হিসেবে ভালো সে মানুষ হিসেবে ভালো না ও হতে পারে।
ও আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার বুঝেছি।
মহিলাটি বললেন,ঠিক আছে। জানতে হবে না।
তোমার বাবা গত তিন মাস আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গাড়ি নিয়ে আসার সময় একটা এক্সিডেন্ট করে।দ্রুত গাড়ি চালিয়ে আসার সময় এক ৪০বছরের মহিলাকে ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে মহিলাটি মারা যায়।
কী বলছেন,এসব?
সত্যি বলছি।তারপর তোমার বাবা এক্সিডেন্টে মেরেছে তো মেরেছে। গাড়ি থামিয়ে সামান্য দেখেওনি।বরং দ্রুত গাড়ি চালিয়ে পালাতে চেষ্টা করে।কিন্তু কিছু দূর যেতে না যেতে দুজন ট্রাফিকপুলিশ মোটর সাইকেল চালিয়ে তোমার বাবার গাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামাতে বাধ্য করে।
তোমার বাবা বুঝতে পারে গাড়ি খেকে নেমে পালাতে চেষ্টা করলে,পুলিশ ধাওয়া দিয়ে ধরে।তখন তোমার বাবার পকেটে ভাড়া বাবদ ২০,০০০টাকা ছিল।তা পুলিশকে দিতে চাইলো।এক পুলিশ অন্য পুলিশের দিকে তাকায়। টাকা নিবে কিনা নিবেনা।তত¶ণে অনেক মানুষ জড়ো হয়।আর মহাসড়ক হওয়াতে পেছনে অনেক গাড়ির জটলা তৈরি হয়। পুলিশ গাড়ি সরিয়ে গাড়ি চলাচলের রাস্তা তৈরি করে দেয়। মামলা হয় তোমার বাবার নামে।ধরে থানায় নিয়ে যায়।তোমার বাবা জামিন নিতে উকিল নিয়োগ দেয়। উকিল প্রমাণ করে,তোমার বাবা ইচ্ছে করে মারেনি ওই মহিলাকে। তাই বিশ দিন জেলে থাকতে হয়।তারপর জামিন পায়।
কিন্তু!
কিন্তু কী?
তোমার বাবা যে অন্যায় করেছে,তার কথা তোমরা জানতে না।দোষ ছিল তোমার বাবার।ঘুম চোখে গাড়ি চালাতে গিয়ে, আর দ্রুত চালাতে গিয়ে ঐ মহিলাকে মেরে দেয়। ঐ মহিলার কোনো দোষ ছিল না।ঐ মহিলার দুটো ছেলে আছে।একটা তোমার বয়সি,আরেকটা চারবছরের।যদি সেটা তোমার মা হতো,তোমার কেমন লাগতো?
ভালো লাগত না।
শুধু ভালো লাগত তাই না?
না।আরো অনেক কিছু। কষ্ট পেতাম।আমাদের দেখা শোনার কেউ থাকতো না।জীবনটা অসহায় মনে হতো। মা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সন্তানের জীবনে। আমি বললাম।
শুধু তাই না?
“কী তাহলে?”
যে মহিলাটি মারা যায়, তার স্বামী ছেলেদের দেখাশোনা করার জন্য আরকটি বিয়ে করে।
কিন্তু!
কিন্তু কী?
যাকে বিয়ে করে,ছেলেদের দেখাশোনা করার জন্য, উল্টো ঐ মহিলা ছেলে দুটোর উপর শুরু করে অত্যাচার,নির্যাতন।ঠিক মতো খেতে দেয় না।তাদের বাবার কাছে,নানা অজুহাতে সত্য-মিথ্যা বলে। কান ভারী করে তোলে।ফলে,ঐ মহিলার কথা বিশ্বাস করে ছেলেদের বাবাও ছেলেদের মারধরসহ নানা কষ্ট দেয়। ইতোমধ্যে বড় ছেলেটির পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। ছোট্ট ছেলেটিও সারা¶ণ ভয়ে ভয়ে থাকে। শুধু তোমার বাবা ভুলের কারণে।
আমি তো এসবের কিছুই জানি না।
তোমাকে বলেনি।কিন্তু তোমার মা জানে।
আমার বাবা এমন,আমার জানা ছিল না।
শুনবে,যে মহিলাটি মারা গেছে,সে কে?
আচ্ছা। তবে আগে আপনি বলুন? আপনি এত কিছু জানলেন কীভাবে?যা আমিও জানি না।
মহিলাটি বলল,জানি জানি।আমরা সব জানি।
এখন বলুন, কে সেই মহিলা?
ওমনি বললেন,আমি সেই মহিলা।যাকে তোমার বাবা মেরে ফেলেছে।
জানিস? নিশান বলল।
“কী”? অনিম জানতে চায়।
আমি ভয়ে কান্না শুরু করেছি। আমি এত¶ণ জানতাম না ওনি মৃত মানুষ। মানে মৃত মহিলার সাথে কথা বলছি।আমার কান্না দেখে মহিলা বলছে,তুমি তো ভয়ে কাঁদছ। কিন্তু আমার ছেলে দুইটা প্রতিনিয়ত নানান ভাবে, অত্যাচারে, নির্যাতনে কাঁদছে। তাদের দেখার কেউ নেই।
তুমি বলতে পারবে? তাদের কী হবে?সারা জীবন ওদের মায়ের অভাব পূরণ হবে না। ওরা হতে পারবে না ভালো মানুষ। জীবন অতিষ্ঠ হয়ে, নিজেদের হীনমন্যতায় অন্য ধরণের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
আচ্ছা। আমাকে কেন ধরে আনলেন? আমার তো কোন দোষ নেই।
মহিলাটি বলল,ঠিক বলেছ। তোমার কোন দোষ নেই। দোষ তো আমারও ছিল না। তবু কেন আমাকে মরতে হলো। দোষ তো আমার ছেলেদেরও ছিল না। ওদেরও তো কষ্ট করতে হচ্ছে।কষ্ট করতে হবে জীবন ভর। কী দোষ করেছি আমরা। তোমার বাবা যদি দেখে শুনে গাড়ি চালাত। আজ এতগুলো মানুষ কেউ কষ্ট পেতো না।
আমি সাহস করে বললাম, তাহলে কী আমাকেও মেরে ফেলবেন। মেরে প্রতিশোধ নিবেন?
মহিলাটি অট্টহাসি দিল। বলল, হ্যাঁ। আমি তোমাকে মেরে আমার ছেলেদের কষ্টের প্রতিশোধ নেব। কঠিন আমি। প্রতিশোধ নেব। আমাকে হত্যার প্রতিশোধ তোমাকে মেরেই নেব। তবেই আমার আত্মা শান্তি পাবে।তোমার বাবা-মাকে ছেলে হারানোর কষ্ট দেবো। কষ্ট পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরবে। তার এ শান্তি তাকে তিলে তিলে পেতেই হবে। সে শাস্তি পাবে, কঠিন শাস্তি।
আমি বলছি ,প্লিজ!
নো প্লিজ!
এখানে যারা দেখছ ,তারা সবাই মানুষ।পৃথিবীতে যাদের অন্যায়ভাবে, একজন মানুষ অন্য মানুষকে মেরেছে,তারা ওই রক্তের ঝরনা দেখছ,তারা পৃথিবীতে শিশু ছিল। তাদের বিনা কারণে অবহেলায় মারা হয়েছে। যারা দেখেছ কালো দেহ ও সাদা হাতের প্রাণী,তারাও মানুষ। তারাও হত্যার স্বীকার।অন্যায় ভাবে কেউ মারা গেছে গুলিতে,কেউ পানিতে,কেউ আগুনে, কেউ এক্সিড্যান্টে।কেউ অন্যের দেয়া কষ্টে,কেউ অসুখে,কেউ অযত্ন অবহেলায় । এটা হলো মৃত মানুষের সভ্যতা।আত্মার পৃথিবী। এসব হলো মানুষের আত্মা। আত্মার ছায়া। কেউ কোনো অন্যায় করেনি। বিনা কারণে এসব নিরঅপরাধ মানুষদের মারা হয়েছে , এখানে তারা। তারা নিঃশব্দে বলছে প্রতিশোধ। প্রতিশোধ নাও। আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার যারা কেড়ে নিয়েছে, তাদের ও পৃথিবীতে বাঁচার কোনো অধিকার নেই। কঠিন প্রতিশোধ, আত্মার প্রতিশোধ।
প্লিজ! আমাকে মেরো না। আমি ও কোনো দোষ করিনি। দোষ করেছে আমার বাবা। আমাকে কেনো শান্তি পেতে হবে। বলতে বলতে দেখি মহিলাটি উড়ে চলে গেল।আর কালো দেহ সাদা হাত ওয়ালা লম্বা মানুষগুলো আমাকে চতুর্দিকে ঘিরে ধরেছে। চিৎকার দিয়ে বলছি, মেরো না। প্লিজ ! আমাকে মেরোনা।
ঘুম ভাঙতে দেখি,মা।মা বলছে,কি হয়েছে নিশান? কি বলছিস মেরো না। তখনই মনে পড়ে, আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি। মাকে বলেছি,স্বপ্ন দেখেছি মনে হয়। বললাম, বাবা কই?
মা বললো, গাড়ি নিয়ে রাজশাহী গেছে।
তাসিফ বলে কী সাংঘাতিক! সবাইচল ক্লাসে। সবাই ক্লাসে যাই। স্কুল ছুটির পর আর বসা হয়নি।
৮
ছুটির পর সবাই একসাথে আসছি।ফাহিম বলল, আমার কথা শুনলে অবাক হবি আরও বেশি । ভাবতেই পাড়বি না কতটা বিপদজনক। কতটা ভয়ংকর।
কাল বলব। আমি নিশানকে বললাম, তোর বাবা মাকে বলেছিস স্বপ্নের কথা?
না বলিনি।
“কি সিদ্ধান্ত নিলি” বলবি?
কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না বলে, তোদের সাথে শেয়ার করেছি। কি করবো বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, দেখা যাক। আরো কিছুদিন অপে¶া করি।
আরিফবলল,অপে¶া করতে করতে আমরা যদি মৃত মানুষের সভ্যতায় পৌঁছে যায়।
আমি বললাম, দূর পাগল, এসব বলিস না।
মনে শুধু নিশানের কথা। বার বার ভাবনাজুড়ে উঁকি দিচ্ছে। মনে পড়ছে সোহেলের কথা। মনে পড়ছে রাশিদের কথা। পড়ালেখায় কোন মতে মন বসছে না। ঘুমাতে গেলাম, রাত প্রায় ১১টায়। কিন্তু আজ ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ করছি।হঠাৎ সেই রাশিদের কন্ঠ।কী করে জাহিন,সোহেল ও নিশানের কথায় ভাবনায় পড়ে গেলি। অবাক হচ্ছিস। তাই না? কী রে। কথা বলছিস না কেনো? ঠিক বলেনি। ভাবছিস। তাই না?
তুমি মৃত আত্মা। তুমি কিভাবে জানলে?
জানি জানি। আমরা সব জানি।
আচ্ছা,রাশিদ,তুমি বার বার আমাকে কেন বিরক্ত করছ?
“বিরক্ত করছি কই। মানুষ কারণে অকারণে কত ভাবে মানুষকে মারছে। সন্ত্রাসীরা টাকা পয়সার জন্য মারছে।রাজনৈতিক নেতারা মতবিরোধ দেখা দিলে মারছে। বিভিন্ন রোগের ভুল চিকিৎসায় মারছে।
আত্নীয় স্বজনরা সম্পত্তির লোভে মারছে। ভাই ভাইকে মারছে।বাবা মাকে মারছে। মা বাবাকে মারছে। বন্ধু বন্ধুকে মারছে। কথায় কথায় কথা কাটাকাটিতে মারছে। দেশে কারণে-অকারণে যুদ্ধে মানুষ মারছে। মানুষ ক্ষুধা দারিদ্রে মরছে। অপমানে মরছে। লজ্জ্বায় মরছে। কাজে মারছে অকাজে মরছে। স্টোক এ মরছে । হার্ডএ্যাটাকে মরছে। কত ভাবে মরছে তার শেষ নেই।
“এতে আমার কী করার আছে।”
অনেক কিছু করার আছে। থামাতে হবে এই অপমৃত্যু ও অনাকাক্সি¶ত মৃত্যু।
নতুব…
তোমাকে আমি!
আমাকে কী করবে,নতুবাকী? মেরে ফেলবে। মারো। আসো। মৃত আত্মায় পরিণত করো।
রাশিদের আত্মা বলল, তোমাকে আমি মেরে ফেলব। তখন তোমার বাবা মা বুঝবে, ছেলে হারানো কী কষ্ট।
আমি এবার ভয় পেয়ে যাই। রাশিদ,প্লিজ আমাকে মেরো না। আমার তো কোনো দোষ নাই। বাবা নড়েচড়ে ওঠে। আমি শুয়ে পড়ি। রাশিদের কন্ঠ মানে আত্মাার কন্ঠ আর শুনতে পাইনি।
৯
সকালে ঘুম ভাঙে। কিন্তু একি দেখেছি।সবার মত স্বপ্ন,নাকি অন্য কিছু। দেখছি এক নদীর তীরে আমরা ফুটবল খেলছি।আমি ফাহিম,আসিফ,সোহেল,আরিফ ও অনিম আরো বন্ধুরা। বিপক্ষে দলে আছে, রাশিদ,নিতাই,রবিন,জাহান,রনি,যারা আগের স্কুলে পড়তাম। খেলাতে তুমুল লড়াই। চারদিকে উৎসুক মানুষ দেখতে খেলা।আমরা এক গোলে এগিয়ে আছি।খেলার হাফ টাইম চলছে।দেখি, রাশিদ কী যেন বুঝাচ্ছে। রেফারির হুইসেল দিল।
শুরু হল দ্বিতীয়ার্ধের খেলা।পায়ে পায়ে বল।হঠাৎ,রাশিদ জোড়ে একটা শর্ট মারে।বল গিয়ে পড়ে নদীতে।অন্য কোনোফুটবল না থাকায়, আমরা সবাই নদীর পারে একেক জন একজনকে বলছি,বল নিতে। নদীতে নামতে।কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না।
আমার পেছনে ছিল রাশিদ।দিল এক ধাক্কা। আমি পড়ে গেলাম নদীতে। জানিনা সাঁতার।আমি পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি।চিৎকার করে বলছি,বাঁচাও!বাঁচাও!বাঁচাও!অথচ সবাই নদীর পাড়ে বলছে,বলটা দাও।কেউ আমাকে বাঁচাতে আসছে না।রাশিদ অট্টহাসি হাসি হাসছে।দেখছি,তার সাথে সবাই অট্টহাসিতে মেতে উঠেছে।আমি হাত নাড়ছি। পায়ে মাটি পাচ্ছি না। ডুবে যাচ্ছি পানিতে।বন্ধ হয়ে আসছে নি:শ্বাস।পানি ঢুকে যাচ্ছে মুখে কানে। ঘিরে ধরে আমাকে বিচিত্র সব প্রাণী।বলছে,স্বাগতম। এটা মৃত মানুষের সভ্যতা।আজ থেকে তুমিও আমাদের দলে। আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তাদের অদ্ভুত অট্টহাসিতে কান ফেটে যাচ্ছে।”
কী করবো বুঝে উঠতে পাড়ছি না। এমন ভাবে মৃত মানুষের আত্মা আমার আর আমার বন্ধুদের পেছনে লাগল কেনো ভাবছি। এর একটা শেষ দেখতে চাই। বাবা, মা, স্যারদের অথবা কোনো ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা যেতে পাড়ে।
১০
স্কুলে যেতেই পথের মধ্যেই দেখা হয়,ফাহিম ও অনিমের সাথে। বললাম রাশিদ ও খেলার কথা। বললাম,পানিতে ডুবে যাওয়ার কথা।
অনিম বলল,ফাহিম আজকে তোর কথা শুনবো। শুনব, যদি সব ঘটনা এক হয়। তবে ভাববার বিষয়। টিঁফিনে সবাই বসলাম,টিফিন রুমে ফাহিমের কথা শুনতে।ফাহিম বলতে শুরু করে।
“গতবছর আমার খালু হাসনাত সাহেব, চাকুরি করতেন একটি ব্যাংকে,অফিসার হিসেবে। হঠাৎ একদিন হালকা জ্বর,গা ব্যাথা ও কাশিতে আক্রান্ত হয়।সর্দি, কাশি,জ্বর ভেবে পাশের ফার্মেসী থেকে ঔষধ এনে খায়।কিন্তু ভালো হচ্ছে না। বাড়তে থাকে কাশি।সাথে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট। ”
“শুনছিস সবাই”
হ্যাঁ, শুনছি তো,অনিম বলল।
ফাহিম আবার বলতে শুরু করে।
“এর পরের ঘটনা বলার আগে,কয়েকটা কথা বলি।আমার মা’রা দুই বোন।আমার মা বড়,খালামনি আমার মায়ের ছোট।বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর। কিন্তু ওনাদের কোন সন্তান নাই। আমরা তিন ভাই বোন। আমার ভাই মাহিন ও বোন বহ্নি।খালু চাকরি করতে গেলে,খালামনি একা। তাই,খালা যাতে একা থাকতে না হয়,তাই খালু সিদ্ধান্ত নেন, আমাদের সাথে খালামণিকে রাখবেন। আমার বাবা-মাও রাজি হয়ে যায়।খালা খালুর কোনো সন্তান না থাকায়,আমাদের তিন ভাই বোনকে খুব ¯্ন্েলহ করতেন। বিশেষ করে আমাকে খুব ভালবাসতেন।আমি যা চাইতাম তা খালু এনে দিত। আমার বাবার পড়ে খালুই আমার খুব আপন ছিল।আমি খালুকে খুব ভালো ভালোবাসতাম।
এবার মূল কথা শোন,আমি যেখানে ছিলাম।
“খালুর অসুখ যখন কমছে না,আমরা ওনাকে মানে হাসনাত চৌধুরী খালুকে একটি মেডিকেলে ভর্তি করালাম। ডাক্তারেরা নানা ধরনের টেস্ট দিল। সাথে করোনারও টেস্ট দিলাম। দুর্ভাগ্য, খালুর করোনা ধরা পড়ল। মানে,খালু করোনা আক্রান্ত। ডাক্তারেরা করোনার চিকিৎসা দিতে শুরু করেন,কিন্তু না।উনার অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। আমার বাবা বললেন, আইসিইউতে দিতে। ডাক্তারেরা তাই করলেন। আইসিইউ তে চিকিৎসা দিচ্ছেন। প্রায় সপ্তাহখানেক পর খালু,আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।”
আমরা এই মৃত্যু কোন মতে মেনে নিতে পারছি না। বিশেষ করে আমি। আমি সেই কী কান্না।একজন বাবার মত প্রিয় মানুষকে হারালাম।খালামনির মুখের দিকে তাকানো যায় না। মা বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বুঝাতে পারছে না।খালামনির পৃথিবীতে আমরা ছাড়া আর কেউ রইল না।আমার নানা নানীর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। শুধু দুজন কন্যা ছিল।মা আর খালামনি।খালুর দিকের আত্নীয়স্বজনরা ছিল। তারা খালুকে দাফন করলেন। আমরাও খালুকে ধীরে ধীরে ভুলে যেতে শুরু করি।এভাবে দিন যায়,রাত আসে।খালামনি আছে আমাদের সাথে। কিন্তু!
সোহেল বলে,কিন্তু আবার কী?
কিন্তু গত পরশু দিন সকালে ঘুম খেকে উঠে দেখি,অঝোর ধারায় খালামনি কাঁদছে।বাবা মা আমরা ভয় পেয়ে যায়। মা বাবা জিজ্ঞেস করছে,কী হয়েছে বোন? বাবা জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে ঝিনু?অথচ,খালামনি কোনো উত্তর দিচ্ছে না।কাঁদছে তো কাঁদছে। সেদিন খুব মনে খারাপ হয়।তার তিন চার ঘন্টা পর খালামনি মাকে বলছে,আপা,গতরাতে আমি হাসনাতকে স্বপ্নে দেখি। আমার স্বপ্নে এসেছে।
মা বলল,কী বলছিস?
হ্যাঁ আপা।সত্যি বলছি। আমার চোখে একটু ঘুম লেগে এসছিল।হঠাৎ,দেখি দরজা ফাঁক করে বলছে,ঝিনু,এই ঝিনু।সেই আগের ডাক।আমি থমকে যায়।বিছানা থেকে উঠে বসি।দেখি সাদা একটা শার্ট পড়ে আমার পাশে এসে বসে বলছে,কেমন আছো ঝিনু?
আমি বললাম, ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?হাসনাত বললো,ভালো নেই।
কেন ভালো নেই জানতে চাইলে বলল,আমার কত ইচ্ছে ছিল।পূরণহলো না। আমার কত স্বপ্ন ছিল। পূরণ হলো না।
খালা বলছে,কেন?
খালু উত্তর দেয়,যদি আমাদের একটা সন্ত্বান থাকতো,কত ভালো হতো। তাকে লেখাপড়া করাতে পারতাম,বড় একজন মানুষ হতো। তোমার কোনো দুঃখ থাকতো না। কিন্তু তা হলো না।
খালামনি বলছে,এটা নিয়ে দুঃখ করছো কেন? পৃথিবীতে কত মানুষের সন্ত্বান নেই। আমার কোনো দুঃখ নেই।খালু বলছে,না ঝিনু।আজ তুমি একা। অন্তত তোমাকে একা থাকতে হতো না।খালামনি কেঁদে কেঁদে বলে,তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে?
খালু বলছে,আমারকী করার ছিল।ভেবেছিলাম সামান্য জ্বর কাশি।এত ভয়ংকর করোনা ভাইরাস। তা তো জানা ছিল না।
তুমি তো ফার্মেসী থেকে ঔষধ খেয়েছ।
হ্যা।ঁ এটাই ছিল আমার মারাত্নক ভূল।কোনো অসুখ হলে,তাকে অবহেলা করা উচিত না। আর ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধ খাওয়া ঠিক না।
খালামনি বলছে,তা তো জানতে।কিন্তু শোনো নি। যা হোক এখন তো কিছু করার নেই।
আমার আরো স্বপ্ন ছিল। আমার আরো ইচ্ছা ছিল।একটা বাড়ি করব। তাও করা হয়নি। ইচ্ছে ছিল, টাকার অভাবে যেসব ছেলে মেয়েরা খেতে পারে না, পড়ালেখা করতে পারে না, চিকিৎসা সেবা পায় না, তাদের জন্য একটা সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান করব। কোনটা আমাকে হতে দিল না। ইচ্ছে ছিল আমি তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করব। তাও হলো না।খালামনি তখন বলছে,মানুষের এক জনমে সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। আমি চেষ্টা করব একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান করতে। তোমার রেখে যাওয়া অর্থ সম্পদ দিয়ে শি¶া, চিকিৎসা ও খাদ্যের জন্য যে শিশুরা মানুষ হতে পারছে না,তাদের জন্য কিছু করবো।
খালু তখন বলল,সত্যি তুমি করবে?
খালামনি বলল,অবশ্যই।খালু তখন খালামনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,ভালো থেকো।আমি যাচ্ছি।আবার আসব।
এটা শেষ করে খালামণি আমার কাঁদছে আর কাঁদছে।মা বার বার সান্তনা দিচ্ছে। বলছে, ঠিক আছে বোন।আমি তোকে সাহায্য করবো,হাসনাতের স্বপ্ন পূরণে। আমি আড়াল থেকে সব শুনছিলাম।
আরিফ বলল, এতে এমন কী? এটা তো স্বাভাবিক।
ফাহিম বলল,হ্যাঁ।এই পর্যন্ত স্বাভাবিক। গতকাল রাতে আমি স্বপ্নে দেখি। দেখে, খালু আমাকে নিয়ে স্কুল থেকে বাসায় আসছে। খালুর স্বপ্নের কথাগুলো বলতেই,আমি বলি তুমি খালামণিকে যা বলেছ সব শুনেছি আমি। আমিও খালামণিকে সাহায্য করবো। রাস্তাঘাটে যে সব ছেলেমেয়েদের পিতা মাতা নেই,পথশিশু তাদের খাদ্য চিকিৎসা ও শি¶ার ব্যবস্থা করে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো।
খালু বলে উঠলেন, সাবাস! এইতো আমাদের ফাহিম।
কিন্তু কিছুদূর যেতে একদল ছেলে। ছয় জন । বয়স পনেরো বা ষোলো হবে। রাস্তার পাশে কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। অপর পাশ থেকে স্কুল ফেরা মেয়েদের নানা কথা বলছে।বাজে কমেন্ট করছে।খালু এগিয়ে যায়। খালু মানা করছে।এসব ভালো না। এসব ইফটিজিং।পথে কাউকে উত্তক্ত করা খারাপ কাজ। তোমরা সিগারেট খাচ্ছ কেন? তাদের একজন বলল, এই তুই কে আমাদের এসব বলার। আরেকজন বলে আমি তোর খাই! আরেকজন বলল, আমাদের যা ইচ্ছে তাই করব। আপনি যানতো মুরব্বি মানুষ। চলে যান,ছেলে নিয়ে বাসায় যাচ্ছেন যান।আমাদের কাজে নাক গলাতে আসবেন না।
খালুর মাথা গরম হয়। ঠাঁস করে একটা থাপ্পড় মেরে দেয় একজনকে। বলে, আমি তোমার বাপের বয়সি। বাপের বয়সি মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় শেখোনি? রাস্তায় এমন অসভ্যতা করার সাহস কোথায় পেয়েছ?
একজন দেখি ফোন বের করে।এই বড় ভাইকে কল দেয়।শালারে আজ শেষ করুম।দুজন আশে পাশের থেকে লাঠি ইট নিয়ে আসে। একজন পকেট থেকে ছুরি নিয়ে খালুর দিকে তেড়ে আসে। খালু বলে, খবরদার। ভালো হবে না।
এবার আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। গেলাম খালুকে মারতে আসা ওদের সামনে। বলছি,পা এগুবে না।
একজন বলল,পিচ্ছি সরে দাঁড়া।না হয়,তোরে শেষ করে দিমু।খালু বলে, ফাহিম চলো। এরা কিশোর গ্যাং। ওদের হিতাহিত জ্ঞান নেই। খারাপ ছেলে।
আমি বলি, না খালু।তোমার যেন কিছু না হয়। খালু আমার এক হাত ধরে পেছনে টানে। আমি সামনে । এর মধ্যে একজন এসে লাঠি দিয়ে আমাকে মাথায় আঘাত করে।অপর জন ছুরি দিয়ে পেটে মারবে।আমি হাত দিয়ে র¶া পেতে হাতে লেগে যায়। পড়ে যায় মাটিতে।ওরা,চল!চল,পালা! পালা বলে পালিয়ে যায়। আমি আর কিছু বলতে পারি না।ভোরে ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে। মা ও খালামনিকে খুলে বলি।
দুদিন পর সোহেল,তাসিফ,ও অনিম,নিশান, আরিফ,ফাহিম আর আমি স্কুল ছুটির পর বসলাম।আমি বললাম,কার কী অবস্থা? গত দুইদিন শুক্র শনি আমাদের দেখা হয়নি।কার কী অবস্থা খোঁজ নেওয়া যায়নি।
সোহেল,কী আর খবর?
আত্মার যন্ত্রণায় বাঁচতে আছি।গত দুই দিন ও দাদা মৃত আত্মা বলছে,প্রতিশোধ নিতে।ঠিক তাই হলো। বাবা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। অল্পের জন্য বেঁচে গেল। ডান পা ভেঙে গেছে।ফেকচার হয়েছে।ভালো করতে সময় লাগবে।
আমি বললাম, এখন কোথায়?
বাড়িতে।তবে ঢাকায় হাসপাতালে নিতে হবে। এক্ম-রে করে ডাক্তার বলেছে,ভালো হবে তবে সময় লাগবে। কত দিন?
তা জানি না। হয়তো ছয় মাস বা এক বছর। আরিফ বলল, তোর দাদুর আত্মার প্রতিশোধ।
সোহেল বলল,হয়তো তাই। নয়তো না। অন্য কেনো কিছু।এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে।
আমি বললাম, ঠিক বিশ্বাস অবিশ্বাসের উপর। তাসিফ তোর কী খবর? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তাসিফ বলে,তোর বন্ধু রাশিদ আর কিছু কী বলল?
আমি বললাম, আগে তোর টা শুনি।
অনিম,আরিফ, সোহেল,ফাহিম,তুই বল জাহিন।
“ঠিক আছে,শোন”
রাশিদ আমাকে খেলার মাঠে ধাক্কা দিয়ে যখন নদীতে ফেলে দেয়। এটা মনে আছে। বলেছিলাম না?”
হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে।সবাই বলে উঠে।
গতরাতে রাশিদের আত্মা আসে,বলে জাহিন কেমন লেগেছিল?
আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি।বলেছি,প্লিজ! রাশিদ আমাকে মেরো না।আমার বাবা মায়ের অনেক বড় স্বপ্ন।আমি একজন ভালো মানুষ হবো। দেশের ও মানুষের সেবা করবো।
রাশিদ বললো,অকালে মরলে কেমন লাগে তাহলেধ বুঝলি?
হ্যাঁ,বুঝেছি।
তুই বড় হয়ে,এইসব অপমৃত্যু বন্ধ হতে সাহায্য করবি।
“আমি বললাম, করবো,অবশ্যই করবো”
রাশিদের আত্মা বললো,কথাটা যেন মনে থাকে।আমি যাচ্ছি। তবে আবার আসবো অন্য কোন একদিন।
“শুনলি তো আমার কথা “,
“এবার তাসিফ বল”।
না না। নিশানের কথা শুনি।জাহিন বলল।
ঘটনা আমি আর চেপে রাখতে পারলাম না। বাবা মাকে বললাম।
বাবা বললো,সত্যি নিশান।কিন্তু ইচ্ছাকৃত নয়।
তোমাকে বলিনি ভয়ে,তুমি হয়তো খারাপ ভাববে তাই।
আমি বললাম, দেখো বাবা পৃথিবীতে ল¶ ল¶ ড্রাইভার আছে। অনেক অ্যাক্সিডেন্ট করে। কিন্তু এমন ঘটনা মেনে নেয়া যায়না। ঐ মহিলার অবস্থায় যদি আমার মা হতো, কী করতে?
বাবা বলল, হ্যাঁ।তোমাদের অবস্থাও কেমন হতো। তবে আমি কথা দিচ্ছি, এখন থেকে আমি সাবধানে গাড়ি চালাবো। আমি তার শান্তিও পেয়েছি।
বাবার আত্মস্বীকার আমার ভালো লেগেছে। তবে সেই মহিলা রাতে এসে বলতো,নিশান আমি চাই আমার ছেলে মেয়েদের মত কারো যেন এমন না হয়।
আমি বললাম ঠিক আছে। তাই হবে।
১১
সবাই বলল, ফাহিম বল তো কী খবর।
আমি পড়ছি ঘরে একা একা। রাত ৯:৩০ মিনিট হবে জানালায়, খালুর আত্না বললো,ফাহিম,এই ফাহিম!আমি ভাবলাম বাবা ডাকছে। চারদিকে তাকাই। কিন্তু কাউকে দেখছি না।আমায় দেখি,অদৃশ্য কন্ঠস্বর বলল,আমি তোমার খালু। আমি মৃত। আমি আত্মা। আমরা মাটির নিচে কবরস্থ হয়ে থাকি।আমাদের আত্মা বাতাসে থাকে। পৃথিবী জুড়ে বাতাসে থাকে ঘুরে বেড়ায়।এক সময় পৃথিবী হবে মৃত মানুষের সভ্যতা।
আমি বললাম, খালু কেমন করে?
খালুর আচ্ছা বলল, যেমন বইতে পড়েছ, সিন্ধু সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা ও মহেঞ্জদারো সভ্যতা।একসময় আসবে হয়তো ২০ হাজার ৩০ হাজার বছর পর।পৃথিবী হবে মৃত মানুষের সভ্যতা। আমাদের কথাগুলো থাকবে বাতাসে।আর মিশরের মমির কথা শোনো নি?
আমি বললাম, শুনেছি।
সেই রকম মমির মত আবিস্কৃত হবে। এক এক সভ্যতা,আত্মাপুরী । মৃত নগরী। মৃত সভ্যতা।
“খালু”
বলো ফাহিম।
আমার বন্ধুরা সবাই ভয়ে আছি। কোন না কোন ভয়ে থাকি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। মৃত মানুষদের আত্মা নানান কথা কাজে।
খালুর আত্মা বলে,ভয়ের কিছু নেই। আমি চাই পৃথিবী সুন্দর হোক। তবে তা তোমাদের হাতে।
আমি বললাম, হ্যাঁ খালু।আমি আর খালা তোমার স্বপ্ন পূরণ করব।
শুরু করলে আর নতুন করে কিছু ভাববার প্রয়োজন নেই। জেগে থাকো, হাঁটো কিংবা বিড়ি খাও…
Ismat Shilpi2025-03-30T20:27:10+00:00March 30, 2025|
কুন্টার মুক্তির আনন্দ
Sumon Biplob2025-03-30T10:38:17+00:00March 30, 2025|
গঙ্গা পাড়ের বৃত্তান্ত
Priyojit Ghosh2025-03-29T12:19:22+00:00March 29, 2025|
আমি ও জ্যোতি পোদ্দার
Jyuti Podder2025-03-30T09:42:15+00:00March 29, 2025|
চন্দ্রাগিরি
Sumanta Gupta2025-03-28T21:29:59+00:00March 28, 2025|
হোয়াইট আর্কেডিয়া এবং মেথুকীর গল্প
Syed Mahmud2025-03-28T21:30:01+00:00March 28, 2025|