সুমন্দ

By Published On: March 27, 2025Views: 5

সুমন্দ
কেতন শেখ

—ঐ হারামজাদা … ঐ শালা বাঙ্গির পুত, রিকশা থামা ….

কর্কশ স্বরে বলা কথা। রাস্তায় কেউ এমন করে কথা বললে সবার দৃষ্টি সেখানেই যায়। এই কণ্ঠস্বর অবশ্য আকরামের পরিচিত না। খুব কাছের বন্ধুরাই আকরামকে বাঙ্গি বলে ডাকে। যেই কণ্ঠস্বরে ডাকা হচ্ছে সেটা কাছের বন্ধুদের কারও না। এই নাম পুরানা পল্টনের বালুর মাঠের বন্ধুদের দেয়া। মহল্লার সবাই আকরামের এই আড্ডার নাম জানতো। জুনিয়র ছেলেরাও মাঝেমধ্যে লুকিয়ে তাকে বাঙ্গি ভাই বলে ডেকে দৌড় দিতো।

বাঙ্গি নাম হওয়ার কারণটা অবশ্য খুব সামান্য বা তুচ্ছ নয়। কারণটা বেশ জোরালো। রোজার সময় একবার আকরামের বাবা আফতাব হোসেন ভারত থেকে বাঙ্গি এনে বাজারে সরবরাহ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সেই ব্যবসা হয়নি। প্রায় চল্লিশ টন বাঙ্গি আনার পর তার ক্রেতারা কেউই বাঙ্গি কিনতে রাজি হলো না। আফতাব হোসেন চল্লিশ টন বাঙ্গি বিক্রি করতে পারলেন না। এতো বাঙ্গি কোনো গুদামে রাখার মতো পুঁজিও তাঁর ছিলো না। তিনি মহল্লার ঘরে ঘরে পুরো রোজার মাসে বাঙ্গি বিলি করলেন। ইফতারের সময় ভিখিরিদের আস্ত বাঙ্গি দিতেন। ভিখিরিরা খুবই বিরক্ত হতো। কেউ কেউ বলতো, আস্তা বাঙ্গি কেমনে খামু, কাইটা দেন।

সেই বছরের এক রোজায় বাঙ্গি বিলি করে আফতাব হোসেন ফতুর হয়ে গেলেন। ধারকর্জ মেটাতে তখন তাঁর হিমশিম অবস্থা।

তাঁর চল্লিশটন বাঙ্গির প্রায় আর্ধেক বিলি করেছিলো আকরাম। তখন থেকেই বন্ধুমহলে আকরামের নাম বাঙ্গি আকরাম। এই নাম পরবর্তীতে বাঙ্গির পো, বাঙ্গির পুত, শালার পুত বাঙ্গি, হালার ঘরের হালা বাঙ্গি, বাঙ্গি হারামজাদা, বাঙ্গি মাদারচোদ ইত্যাদি সংস্করণে ডাকা হয়েছে।

আকরাম এসব নিয়ে তোয়াক্কা করেনি। যারা ওর বাঙ্গি নাম দিয়েছে, তারা ওর সেরা বন্ধু। কিন্তু মহল্লায় বন্ধু ছাড়াও অনেক সঙ্গিসাথী থাকে, যারা বন্ধুদের দেয়া নামে ওকে ডাকতো।কিন্তু তারা যখন রাস্তাঘাটে ওকে বাঙ্গি নামে ডাকাডাকি করতো, তখন আকরামের খুবই বিরক্তবোধ হতো।

আকরাম রিকশাঅলাকে থামতে বললো। রিকশা থেমেছে সলিমুল্লাহ রোডের মুখে। বিকেলের ভিড় চারদিকে। মোহাম্মদপুরের এই এলাকায় পল্টনের বন্ধুদের কারও থাকার কথা না। যদি থাকেও, বন্ধুদের কেউ এই এলাকায় আকরামকে দেখে বাঙ্গির পুত বলে ডাকাডাকি করবে না। বন্ধুরা বন্ধুদের মান সন্মান রাখতে জানে। তারা জানে যে পল্টনে যে বাঙ্গি সে মোহাম্মদপুরে বাঙ্গি না।

আজকে যে ডাকাডাকি করছে সে বন্ধুদের কেউ না। সে হয়তো সঙ্গিসাথীদের কেউ। হয়তো মাম্মিড্যাডি বয় ছিলো, বয়সের দোষে মহল্লায় কয়েকদিন আড্ডাবাজি করে এরপর পারিবারিক কারফিউর শিকার হয়েছে। এতো বছর পরে এসব ছেলে এমবিএ করে ভালো চাকরিবাকরি করে, ফ্ল্যাট জমি কেনে, পুতুল পুতুল টাইপ একটা মেয়েকে বিয়ে করে, পকেটে ক্রেডিট কার্ডের সংগ্রহ নিয়ে ব্যাংক লোনে কেনা গাড়ির পেছনের সীটে বসে ঘুরে বেড়ায়। এসব ছেলেরা অফিস শেষ করে বউয়ের ফরমাইশ অনুযায়ী সন্দেশ, পেস্ট্রি, চিকেন বন বা ছানামুখী কিনতে এই বেকারী সেই বেকারীতে যায়। বউয়ের ব্লাউজের দর্জির দোকানে ব্লাউজ সংগ্রহ করতে রাপা প্লাজা বা সোবহানবাগে যায়। হয়তো মোহাম্মদপুরের আশেপাশে সেরকম কোনো বেকারী বা দর্জির দোকান আছে। এসব খবর এদের কাছেই থাকে, আকরামের মতো ছেলের কাছে থাকে না।

আকরামের ধারণা ভুল ছিলো না। ঝকঝকে রূপোলী টয়োটা জি গাড়ির পেছনের দরজা খুলে স্যুট পরা যেই যুবক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে, তার নাম এজাজ আহমেদ।মহল্লায় তার কোড নাম ছিলো মদনা। সবাই ডাকতো এজাজ মদনা। কেউ তার উপরে বেশি রেগে গেলে ম এর জায়গায় সহজেই চো এসে যেতো। এজাজ মাম্মি ড্যাডি ছেলে না হলেও আকরামদের মূল বন্ধুবলয়ের কেউ ছিলো না। তাকে ডাকা হতো ক্রিকেট ব্যাটের জন্য। এজাজ অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে ছিলো। তার কাছে ছিলো ইংল্যান্ড থেকে আনা গ্রে নিকলস ব্যাট। সেই ব্যাট দিয়ে খেলার লোভে এজাজকে বন্ধুমহলে আনা হতো। এজাজের শর্ত একটাই ছিলো, ওপেনিং ব্যাটিং তাকে দিতে হবে।

এজাজের মতো ছেলেদের সাথে এখন আকরামের কোনো যোগাযোগ নেই। থাকার কথাও না। আকরাম বেকার। বি কম ডিগ্রি শেষ করেনি। কম্পিউটার কম্পোজ আর গ্রাফিক ডিজাইনের শর্ট কোর্স করেছে। সেটাও নামকরা কোনো জায়গা থেকে করেনি। এখন টিউশনি করে টুকটাক গ্রাফিক ডিজাইন বা কম্পিউটার কম্পোজের কাজ করে তার দিন চলে… বা চলে না। এর মধ্যে ও বিয়েও করেছে। ঝিকাতলায় টিনের চাল দেয়া এক কামরার একটা ঘরে ওদের সংসার। আইভি কাজ করে আড়ং-এ। সপ্তাহে ছয়দিন, সকাল দশটা থেকে রাত আটটা। এই সময়টায় আকরাম কাজ খোঁজে।একটা দুটা টিউশন, কোথাও কম্পিউটার কম্পোজের কাজ, ইন্টারনেট সেলস, পত্রিকা সরবরাহ, ই-ম্যাগ ডিজাইন। অভাবের তোড়ে আর অজস্র অপমানে খুব আপন বন্ধুদের সাথেই ওর যোগাযোগ করতে লজ্জা লাগে। এজাজের মতো কেতাদুরস্ত এককালীন সঙ্গির সাথে যোগাযোগ রাখার তো প্রশ্নই ওঠে না।

এজাজ ভিড়ের তোয়াক্কা করলো না। আকরামকে রিকশা থেকে নামতে দেখে স্বর উঁচিয়ে বললো, কি রে বাঙ্গির পুত বাঙ্গি, বন্ধুরে ভুইলা গেছোস হারামজাদা…

আকরাম এজাজকে দেখে অল্প হাসলো। এজাজের মতো ছেলেরা প্রচন্ড অহংকারী হয়। কেউ তাদের ভুলে যাবে সেটাও তাদের সহ্য হয় না। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই কারণে তারা কাউকে ভুলতেও পারে না।

—কি রে বাঙ্গি, হা কইরা কি দেখোস … এদিক আয় হারামীর পুত ….

সলিমুল্লাহ রোডের ঢোকার মুখে একটা ছোটোখাটো ভিড়। রিকশা সিএনজি মোটর সাইকেল সব মিলে ঘরঘর পি পোঁ শব্দ। আকরামের রিকশা আর এজাজের গাড়ির মধ্যে বেশি হলে পনেরো গজ দূরত্ব। কিন্তু ভিড়ের কারণে সেই দূরত্ব ঠেলে এজাজের গাড়ির দিকে যেতে ইচ্ছে করছে না। এসব ছেলের কাছে যাওয়া মানেই তাদের টাকাপয়সা আর কান্ডকীর্তির গল্প শোনা। ফ্ল্যাটের দাম কতো কোটি টাকা, জমির কিস্তি কতো, বাচ্চার স্কুলে কতো খরচ হয়, ব্যাংককের হলিডেতে কতো খরচ হয়েছে, কতো দামী মদ নিয়মিত খেতে হচ্ছে ….। এসব গল্পে আকরামের কোনো উত্সাহ নেই। ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে এসব গল্প শোনার মতো বেকুব আকরাম হতে চায় না।

আকরামকে অবাক করে এজাজ নিজেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো। এসে বললো, কি রে শালার পুত, বন্ধুর কাছে আসতে লজ্জা পাস?

রাস্তায় কোলাহল বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে যানবাহনের ভিড় বাড়ছে। আকরামের অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। অস্বস্তির কারণ রাস্তার ভিড় না, রিকশাঅলা। আকরামের কাছে রিকশা ভাড়া নেই। ওর যাওয়ার কথা বাবর রোডে, জয় ভাইয়ের অফিসে। জয় ভাই বলেছেন,‘রিকশা নিয়ে আয়, আমি ভাড়া দিয়ে দেবো’। এখন এই ভিড়ে রিকশা ধরে রাখা যাবে না। রিকশাঅলা বলবে, ভাড়া দিয়া দেন, এইখানে রিকশা নিয়া খারামু কই ?

রিকশাঅলা এমন কথা বলতেই পারে। তার এই কথা যুক্তিযুক্ত। দিনশেষে তাকেও রিকশার মালিককে হিসাব কিতাব দিতে হবে, পরিবারের জন্য বাজার সদাই করতে হবে। আর এই সময়ে সলিমুল্লাহ রোডের মোড়ে রিকশা নিয়ে অপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। এরকম মরিয়া পরিস্থিতিতে কেউ ভদ্রতার তোয়াক্কা করবে না, ভাড়া নিয়ে চলে যেতে চাইবে। রিকশাঅলা অবশ্য সেই সুযোগ পেলো না। এজাজ সহজ ভঙ্গিতে পকেট থেকে পন্চাশ টাকার নোট বের করে রিকশাঅলাকে দিয়ে বললো, যাও। স্যার আর যাবে না।

আকরামের অস্বস্তি বাড়ছে। এজাজের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে তার পরিকল্পনা লম্বা আড্ডার। জয় ভাইয়ের অফিসে যাওয়া খুবই জরুরী। তিনি কাজেই ডাকেন। কাজ শেষ করার পর সাথেসাথে টাকা দেন। এরকম মানুষ আজকাল পাওয়া যায় না। এজাজের সাথে বেহুদা আড্ডা দেয়ার চেয়ে জয় ভাইয়ের অফিসে যাওয়া অনেক ভালো। কিন্তু এখন হয়তো সেটা সম্ভব না। রিকশা সরে যাওয়ার পর এজাজ আকরামের কাঁধে হাত রেখে বললো, আয়, গাড়িতে ওঠ।

কোনো একটা কারণে আকরাম কিছু বলতে পারলো না। চুপচাপ এজাজের সাথে ভিড়ভাট্টা ঠেলে রাস্তার অন্যপাশে চলে এলো। রূপোলী টয়োটা জি গাড়ির ড্রাইভারের গায়ে ইউনিফর্ম, মাথায় টুপি। ঢাকা শহরে এই আভিজাত্য এখন হয় বিদেশী মিশনের নয়তো অত্যাধিক বিত্তশালী বা ক্ষমতাবানদের আছে। মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তের ড্রাইভার ইউনিফর্ম বা মাথায় টুপি পরে না। আকরামকে দেখে সেই ড্রাইভার হাসিমুখে দরজা খুলে বললো, স্যার স্লামালিকুম। আসেন। তাড়াতাড়ি বসেন, এইখানে সার্জেন্ট আছে।

আকরাম দেরী করলো না। টুপি ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভারের কথা অগ্রাহ্য করার মতো অবস্থা ওর নেই। আকরামের ধারণা এই ড্রাইভারের বেতন ওর ঘরের উপার্জনের চেয়েও বেশি। গাড়ির ভেতরটা বাইরের চেয়েও বাহারী। এজাজ নিশ্চই অনেক টাকাপয়সা করেছে। গাড়ির মেঝেতে নরম গালিচা, কেবিনের ছাদে তারার নকশা। সুগন্ধে ভুরভুর করছে সব। এজাজ অন্যপাশে বসে বললো, কি রে কবি, তোর খবর কি ? কথাবার্তা বন্ধ কেন?

—আরে নাহ … এমনি। গাড়ি দেখছি। সুন্দর গাড়ি।
—আরে এটা কিছুই না রে দোস্তো। আমার ভায়রা ভাই বিএমডব্লিউ কিনেছে। ঐটা দেখলে তুই আট্টাইশ হইয়া যাবি। পুরা প্লেনের বিজনেস ক্লাস। বিজনেস ক্লাস কেমন হয় জানিস ?

আকরাম কোনো ভনিতা করলো না। খুব সহজ স্বরে বললো, না, জানি না। বিজনেস ক্লাস তো দূরের কথা, আমি প্লেনেই উঠি নাই।

এজাজ অল্প হাসলো। এরপর বিড়বিড় করে বললো, হুম, আমিও সেটাই ভেবেছিলাম।

গাড়ি চলা শুরু করেছে। কোনদিকে সেটা অবশ্য আকরাম জানে না। এজাজকে বলা দরকার যে ওর বাবর রোডে যেতে হবে। কিন্তু এজাজের সাথে কথা বলতে আকরামের খুবই অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। অস্বস্তির কারণ বাহারী গাড়ি বা টুপি ইউনিফর্মের ড্রাইভার না। কারণ হচ্ছে এজাজকে তুমি বলবে নাকি তুই বলবে সেটা আকরাম বুঝে উঠতে পারছে না। মহল্লায় সবাই তুই তোকারিই করে। কিন্তু এতোদিন পরে বিজনেস ক্লাসের লোকজনকে ড্রাইভারের সামনে এতো অবলীলায় তুই করে ডাকা যায় না। সমাজের সম্বোধন তত্ত্ব সেটা সমর্থন করে না। বিত্ত সম্বোধনকে বদলে দিতে পারে। এই তত্ত্ব আকরামের অজানা নয়।

—তারপর কবি, তোর খবর বল। এখনও কবিতা টবিতা লিখিস, নাকি অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়েছে?

আকরাম অল্প হাসলো। গাড়ি আসাদ গেইটের কাছাকাছি এসেছে। এর মানে হচ্ছে বাবর রোডের উল্টোদিকে যাত্রা হচ্ছে। হোক। এজাজের সাথে গাড়িতে বসে এখন খুব একটা খারাপ লাগছে না। অনেকদিন পর কেউ আকরামকে কবি বলে ডেকেছে। হাজার লোকের ভিড়ে বাঙ্গি ডাকার কারণে যতোটুকু বিরক্তিবোধ হয়েছিলো তার অনেকটাই কবি ডাক শুনে কেটে গেছে। এজাজ মন্দ বলেনি, অভাবে কবি স্বভাবের অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। একটা সময় ছিলো যখন কবিতা লিখে বন্ধুমহলে পড়ে না শোনালে আকরামের ঘুম হতো না। সন্ধ্যার আড্ডা রাতের দিকে গেলেই কেউ না কেউ বলতো, কি রে বাঙ্গি, নতুন কি লিখলি, পড়ে শোনা।

আড্ডায় বসা অন্যদের দৃষ্টি তখন বদলে যেতো। এতোক্ষণের খিস্তিখেউরি আর চোগলামি করা, আড্ডার পাশ দিয়ে যাওয়া মহল্লার মেয়েদের দেখে মন্তব্য ছোঁড়া একদল কিশোর বা যুবক তখন আড্ডার বাইরের কোনো একান্ত ভাবনায় ডুবে যাওয়ার অদৃশ্য তাড়নায় মগ্ন।

প্রেমিকার অবহেলা, বাড়িতে বাবার গালিগালাজ বা অপমান, ক্লাসের ফেল লুকোনো লজ্জা, আর ধার বা বাকিতে খাওয়া সিগারেটের বোঝা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে থাকার লোভ তখন আকরামের চারপাশে বসা আট-দশ জোড়া চোখের দৃষ্টিতে। সেই দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আকরামের ছিলো না। ও পকেট থেকে কাগজ বের করে পড়া শুরু করতো।
‘অবুঝ ছিলো মন,
তোমার কাছেই ছুটতো সারাক্ষণ …
এক মুঠো রোদ আঁকড়ে ধরে
পৌঁছে দেয়ার অলীক বরে
হৃদয় আমার কাঁদতো যে রাতদিন,
তোমার অবহেলায় ছিলো
এই প্রেমিকের দুঃখগুলো
রোদটুকু এই শুকনো করে
অপেক্ষাতে গেলোই মরে
করলে না শোধ অবুঝ মনের
উষ্ণ জমাট ঋণ’।

আকরামের চারপাশে তখন পলক নামানো, স্থির, বা শূন্যে মেলা আট-দশ জোড়া তরুণ চোখ। জীবনের অনেক কিছুই সেসব চোখের অদেখা, অথচ অনেক অদেখার স্বপ্ন সেসব বন্ধ চোখের গোপন কুঠুরিতে। সেই আসরে, সেই ব্যর্থ, নিরর্থক অথচ স্বপ্নবাজ মনের মেলায় আকরাম বাঙ্গি আকরাম ছিলো না, আকরাম ছিলো কবি আকরাম। পৃথিবীর আর কোনো আসর বা আয়োজন কবি আকরামকে এভাবে ভালোবাসেনি।
গাড়ি আসাদ গেইট পার হয়ে ডানদিকে মোড় নিয়েছে। এজাজ আবার বললো, কি রে কবি, কথা টথা বল। আলাউলের রেস্টুরেন্টে তো আমরা যেতাম তোর কবিতা শোনার জন্য …
আকরাম সহজ স্বরে বললো, তুইও আমার কবিতা শুনতি ! তুই তো বলতি আমি খামাখাই কাব্য সাহিত্য করি …

—খামাখা করিস সেটা বলতাম না, বলতাম মেয়ে পটানোর জন্য করিস। আর বন্ধুদের আবেগে ডুবিয়ে মাগনা চা সিগারেট পেঁয়াজু খাওয়ার জন্য লিখিস …
—আমি জানি। তুই কোনোদিনই আমার কবিতা পছন্দ করতি না।
—ট্রু। কাব্যকথা আমার জিনিস না দোস্তো। এইসব আমি বুঝি কম। কিন্তু আমি আসাদের মতো ভড়ং করতাম না। সোজাসাপ্টা বলতাম, তোর কবিতা বুলশিট। এইসব কবিতা দিয়ে তোর জীবনে কিছু হবে না। আসাদ তো ভড়ং করতো। তোর কবিতা শুনে রুমি গালীবের আলাপ শুরু করতো। আমার মধ্যে এইসব আঁতলামী ছিলো না।
—কিন্তু তুই আমাকে কখনও কবি বলতি না। তুই আমাকে দোকানদার বলতি।
—দোকানদার না, তোকে আমি বাঙ্গি বলতাম। তোকে কবি বলার কোনো কারণ তখন ছিলো না। কারণ আমি কবিতা টবিতা বুঝতাম না।
আকরাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, তুই প্রায়ই বলতি আমি বালছাল লিখি। আমার লেখা নাকি গামছা কচলে আবেগের ঘাম বের করার মতো।
—বলেছিলাম এইসব … তখন বয়স কম ছিলো।
—এসব বলার জন্য তোর সাথে সুমনের হাতাহাতিও হয়েছে। সুমন যখন তোকে এসব বলতে মানা করতো, তুই আরও বাড়িয়ে বলতি। বাজে ভাষায় বলতি ….
এজাজ একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরপর শান্ত স্বরে বললো, ঠিক বলেছিস … হাতাহাতি হয়েছিলো। তোর লেখা নিয়ে আমি আজেবাজে অনেক কিছুই বলেছি। সেসব নিয়ে আমার আফসোসও আছে।
—আফসোসের কিছু নাই। তোর মনে যা ছিলো তুই বলেছিস। কিন্তু বাজে ভাষায় না বললে হাতাহাতি হতো না। ঠাট্টা মশকরা এক কথা। কিন্তু আমাদের অন্য বন্ধুরা আমার কাজের সন্মান করতো। তারা আমার কবিতা ভালোবাসতো। সেই ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ ছিলো না। তাদের সেই ভালোবাসাকে হেয় করা তোর উচিত হয়নি।
—আরে রাখ …. তখন বাচ্চা পোলাপান ছিলাম। এতোকিছু বুঝতাম না। বললাম তো, তখন যা করেছি সেসব নিয়ে এখন আফসোস আছে। আর কি বলবো … পা ধরে মাফ চাবো তোর কাছে?

গাড়ি এখন যানজটে। বাইরের ভিড়ের শব্দ জানালার কাঁচ ভেদ করে আসছে না। গাড়িতে ঠাণ্ডা স্বরে রবীন্দ্র সংগীত হচ্ছে। কিন্নরী কণ্ঠে কেউ গাইছে, সে কথা শুনিবে না কেহ আর, নিভৃত নির্জন চারিধার।

চারিধার পুরোপুরি নিভৃত নির্জন না হলেও আকরাম সেরকম কোনো কাল্পনিক আবেশে চোখ বন্ধ করলো। বন্ধ চোখে জীবনকে অনেক সহজ মনে হয়। খোলা চোখে যতো সমস্যা। এজাজ কাঁপা স্বরে বললো, তুই কি কবিতা লেখা বন্ধ করে দিয়েছিস?

—অভাবে স্বভাব কিছুটা হলেও নষ্ট হয়েছে। তবু লিখি … কিন্তু নিজের জন্য।
—কোথাও প্রকাশ করিস না?
—নাহ। আমি একটা আসরেই কবি ছিলাম। ঐ আসরের বাইরে আমি একটা বাঙ্গি। আর কিছু না।

এজাজ গম্ভীর স্বরে বললো, না রে …. তুই সত্যিকার কবি। তোর কবিতা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে দেয়। আমার মতো আবাল তোকে ভিড়ভাট্টায় বাঙ্গি বলে ডাকে, কারণ আমি তোর মতো মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারি না। কিন্তু আমি তোর প্রশংসাও করতে পারি না, আবার তোকে হিংসাও করতে পারি না।

আকরাম চোখ খুলে হেসে ফেললো। এজাজের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতেই বললো, প্রশংসা না করার ব্যাপারটা বুঝলাম। আমাকে হিংসা করার ব্যাপারটা ফালতু কথা। আমাকে তোর হিংসা করতে হবে কেন?

এজাজ সেই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বড় করে হাই তুলে চোখ বন্ধ করে ক্লান্ত স্বরে বললো, ঢাকা শহরের জ্যামে এসি গাড়িতে বসলে ঘুম ভালো হয়। তুইও ঘুমা। পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে এরপর গল্প করবো।

—এজাজ, আমার বাবর রোডে যাওয়া দরকার। একটা কাজ আছে।
—ঘুমা মাদারচোদ। কথা বলবি না। নিজে ঘুমা, আমারেও ঘুমাইতে দে। ঘুমের মধ্যে আমার বউ আমার স্বপ্নে আসবে। ডিসটার্ব করবি না।

আকরাম ‘ডিসটার্ব’ করলো না। কালো কাঁচের জানালা ভেদ করে বাইরের কোনো দৃশ্য স্পষ্ট দেখার উপায় নেই। কার্তিক মাসের সাপ্তাহিত অফিস ছুটির বিকেল। বাইরে যানবাহন আর বিপন্ন জনতার ভিড় ছাড়া দেখার মতো কোনো দৃশ্যও নেই। বিপন্ন জনতাকে দেখতে এখন ভালো লাগছে না। আকরামও চোখ বন্ধ করলো। গতরাতে মুড়ি আর গুড় খেতে হয়েছে। রান্না করার মতো কিছু ছিলো না। সকালে মধুর স্টল থেকে এক কাপ চা বাকিতে খেতে হয়েছে। মধুর স্টলে আকরামের বাকির খাতা আছে। সকালের চা বাকিতে খেতে ভালো লাগে না। কিন্তু এই শহরের বিপন্ন জীবন সেটা করতে বাধ্য করে। আইভি সকালে কিছু না খেয়েই কাজে চলে যায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা ছাড়া বাকি ছয়দিন সে রোজা রাখে। তার নাকি অনেক রোজা বাকি আছে। সারাবছর রোজা রাখলেও হবে না। আকরাম কিছু বলে না। মনের গভীরের কান্না লুকিয়ে আইভিকে দেখে। সুইডেনের এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর সাথে আইভির বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।

সেই বিয়েটা করলে আইভি বিদেশের শুদ্ধ বাতাসে খোলা বারান্দায় বসে সকালের খিদের আমেজে ঝকঝকে গ্লাসে ভরা কমলার রসে চুমুক দিতো। তার সামনে টেবিলে সাজানো থাকতো ক্রসোন্ট, চকোলেট বান, সেদ্ধ ডিম, এ্যারাবিকা বিনের ঘন খয়েরী কফি। আইভি সেই বিয়ে করেনি। বিয়ের দিন ঘর ছেড়ে চলে এসেছে আকরামে কাছে। সপ্তাহে ছয়দিন ক্বাজা রোজা রেখে সাত হাজার টাকা বেতনের চাকরি করছে।

চোখ বন্ধ অবস্থায় কতোক্ষণ কেটে গেছে সেটা আকরাম জানে না। গাড়ির ভেতরে মিহি একটা শীতল হাওয়া। আরামের সীট। রবীন্দ্র সংগীত এখনও চলছে। ‘ঐ জানালার কাছে বসে আছে করতলে রাখি মাথা’। বাইরের কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। এমন পরিবেশে চোখ বন্ধ করে শরীরকে বিশ্রাম দিলে ঘুম আসবেই। আকরামের অভুক্ত শরীরে হয়তো ক্লান্তির ঘুম ভর করে ছিলো। ঘুমেরই বা দোষ কি। রাতের অসুর অন্ধকারে মস্তিষ্কে জমাট অভাবের বোঝা যখন স্যাঁতসেতে বালিশে ভর করে, অনাদায়ী ঘুমও তখন শান্তির বিশ্রাম খোঁজে। আকরাম রাতে ঘুমকে বিশ্রাম দেয়, জেগে থাকে। ওর পাশে আইভি সত্যিই ঘুমোয় কি না সেটা আকরাম জানে না। কখনও জানতেও চায়নি।

কাঁধে কারো স্পর্শে আকরাম চোখ খুললো। গাড়ি থেমে আছে, কিন্তু ইন্জিন চলছে। ইন্জিনের সাথে খুব সম্ভবত এসিও চালু রাখা হয়েছে। গাড়ির ভেতরের হিম হিম ভাবটা এখনও একই রকম। এজাজ আকরামের কাঁধে হাত রেখেছে। তার স্বরে ক্লান্তি। ক্লান্তিমাখা স্বরেই বললো, কবি, জাগো। আমরা বনানী এসে গেছি।

—আমরা বনানী কেন এসেছি?
—বলবো। চা খাবি? তোর চোখমুখ শুকনা হয়ে আছে। চা নাস্তা খা।
কেউ কিছু খেতে বললে আকরাম মানা করে না। আহার হচ্ছে রিজিক। রিজিককে না বলতে নেই। আকরাম ক্লান্ত স্বরে বললো, চা নাস্তা কি গাড়িতে বসে খাবো?
—হ্যা। আমার ড্রাইভার ইদ্রিস চা নাস্তা আনতে গেছে।

চা নাস্তা খাওয়ার পর্ব শেষ হতে বেশি সময় লাগলো না। আকরাম যখন গাড়ি থেকে বের হলো, বনানী কবরস্থানে তখন সন্ধ্যা নামছে। ভিখিরিদের ভিড় কিছুটা হালকা তখন। এজাজ পাশে দাঁড়িয়ে বললো, এখানে যখনই আসি, তোর কথা মনে হয়।
আকরাম কিছু বুঝতে পারছে না। কেন যেন ওর মাথায় জয় ভাইয়ের বাবর রোডের বাসায় যাওয়ার কথাটা ঘুরছে। গাড়িতে এতোটা পথ আসা হলো, অথচ জয় ভাইকে ফোন করে কিছু বলা হয়নি। তিনি নিশ্চই অপেক্ষা করছেন। আকরাম বিড়বিড় করে বললো, আমার বাবর রোডে যাওয়া দরকার। তুই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন?

—তোকে এখানে আনার জন্য বেশ কয়েক মাস ধরে আমি চেষ্টা করছি। তোর ঘরবাড়ির ঠিকানা জানি না। মোবাইল নম্বরও কেউ জানে না। একে তাকে জিজ্ঞেস করে বের করেছি যে তুই আজকে বিকালে মোহাম্মদপুরের দিকে থাকবি।
—আমাকে এখানে আনার কারণটা কি বলবি?
—বলবো। কারণটা খুব স্বাভাবিক না, তাই তোকে এখানে এনেই বলতে হবে।

আকরামের অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। সন্ধ্যার আধো আলোতে কবরস্থানের সামনে হঠাত দেখা এককালীন সঙ্গির রহস্যপূর্ণ কথোপকথন স্বস্তির অনুভূতি দেয় না। এজাজের দৃষ্টি শূন্যে। কৈশোর বা যুবা বয়সে মহল্লার ক্রিকেট বা সান্ধ্যকালীন অলস আড্ডায় এজাজের এই দৃষ্টি আকরাম দেখেনি। ওকে অবাক করে দিয়েই এজাজ কাঁপা স্বরে কবিতা বলা শুরু করলো।

‘এমন প্রহর আসবে কখন তোমার আমার মনে,
একটা আকাশ মুক্ত হবে স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে।
এক ফালি মেঘ কান্না হয়ে থাকবে বুকের ভাঁজে,
সুমন্দ প্রেম ঝরবে শরত বৃষ্টি সুধার সাজে।

এজাজ কবিতার বাকিটা বললো না। বনানী কবরস্থানে এখন দিনের আলো নেই। কাছের কিছু ফেরিঅলাদের টুকরি বা দোকানে কূপিবাতি জ্বলছে। কূপির আলোতে আকরাম দেখলো মাথানীচু করে এজাজ নীরবে কাঁদছে। সেই কান্নায় কোনো কপটতা নেই, কোনো জৌলুস নেই। তার কান্নার ভঙ্গি স্কুলের ছেলেদের মতো। আকরাম এজাজের কাঁধে হাত রাখলো। এরপর নরম স্বরে বললো, কবিতার নাম সুমন্দ। আমার লেখা। তোর কি হয়েছে? আমার কবিতা পড়ে তুই কাঁদছিস কেন?
এজাজ ঠোঁট চেপে বড় করে নিশ্বাস ফেললো। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে ভারী কণ্ঠে বললো, সুমন্দ নামে তোর একটা কবিতার বই এসেছিলো।

—হুম। অনেক বছর আগে। সেটাই আমার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ। সেই বইয়ের একটা কবিতাই এটা। এই কবিতার নামেই বইটার নাম রেখেছিলাম।
—বইটা আমি কিনেছিলাম, বইমেলা থেকে। সেই বছর আমার বিয়ে হয়েছিলো। নাসরিনের সাথে। ওকে নিয়ে বইমেলায় গিয়েছিলাম। আমি জানতাম তোর বই এসেছে।
—ওহ আচ্ছা। ভাবী কেমন আছেন? তিনিও কি আমার কবিতা পড়েছেন?

এজাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। এরপর একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তুই কি এখন আর জলধি ব্লগে কবিতা লিখিস না?
—না। আগে লিখতাম। এখন সময় পাই না।
—নাসরিন তোর কবিতা প্রথম পড়েছিলো সেখানে। তখন থেকে সে তোর কবিতার পাগল। তোর কবিতা সে পছন্দ করে আমাদের বিয়ের আগের থেকেই। আমি সেটা জানতাম। তাই বইমেলা থেকে তাকে আমি তোর সুমন্দ বইটা কিনে দিয়েছিলাম।
—ওহ, আচ্ছা।

এজাজ আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। ও ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। আকরামের অস্বস্তিবোধ বাড়ছে। বনানী কবরস্থানের সামনে সন্ধ্যার এই ক্ষণে দাঁড়িয়ে কবিতা আর কবিতার জন্য বন্ধুপত্নীর মুগ্ধতার গল্প শুনতে ভালো লাগছে না। এজাজ হয়তো ওর অস্বস্তি টের পেলো। গলা খাকারি দিয়ে সহজ স্বরে বললো, নাসরিন বেঁচে নেই। দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগে গতবছর আমাদের ছেড়ে ও চলে গেছে। আমরা ওকে এখানে কবর দিয়েছি।

আকরাম কিছু বললো না। ওর নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। এজাজের কথা শুনে মন খারাপ লাগছে। এজাজ ভারী স্বরে বললো, নাসরিনের কবর হয়েছিলো শেষ বিকেলে। কবর দেয়ার পর সন্ধ্যা নেমেছিলো। অফিস শেষ করে প্রায়ই সন্ধ্যা নামার সময়টাতে আমি এখানে আসি। এখানে দাঁড়িয়ে ওর সাথে মনে মনে কথা বলি। ওকে তোর কবিতা পড়ে শোনাই।

—আমি কিছুই জানতাম না। আমি তোর কোনো খবর রাখিনি।
—আমার খবর তোর রাখার কথা না। পল্টনের কারো সাথেই আমার কোনো যোগাযোগ নেই।
—তোর জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে এজাজ।
—জানি। কিন্তু কষ্ট দেয়ার জন্য আমি তোকে এখানে নিয়ে আসিনি। আমার কোনো কষ্ট নেই যে আমি তোকে সেটার শেয়ার দেবো। আমি তোকে নিয়ে এসেছি নাসরিনের কষ্ট কমানোর জন্যে।

আকরাম কাঁপা স্বরে বললো, তাঁর সাথে আমার কখনও পরিচয় হয়নি।

—ভুল কথা। পরিচয় হয়েছে। বইমেলায় সে তোর সাথে দেখা করে সুমন্দ বইটাতে তোর অটোগ্রাফ নিয়েছে। তোর সাথে ছবিও তুলেছে।
—কিন্তু আমি জানতাম না যে তিনি তোর স্ত্রী। মানে … আমার মনে নেই যে তিনি আমার অটোগ্রাফ নিয়েছিলেন … কারণ আমি তো আর জানতাম না যে …
—তোর জানার কথা না। নাসরিন সেটা তোকে বলতো না। সেই পরিচয় তার দেয়ার কথা না।
—কেন? তিনি আমার বন্ধুর স্ত্রী, আমার কবিতা তিনি পছন্দ করেন। তিনি তোর কথা আমাকে বলতে পারতেন।

এজাজ শীতল স্বরে বললো, তুই আমাকে কখনও বন্ধু মনে করিসনি। আমি কখনোই তোর বন্ধু ছিলাম না।
আকরাম অন্যদিকে তাকালো। অন্ধকারে টিমটিমে কূপির আলো আর সেই আলোতে কিছু ছায়ামূর্তির নড়াচড়া ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। আকরাম সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বললো, আমাকে এখন যেতে হবে।

—যাবি। ইদ্রিস তোকে গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দেবে।
—তোর স্ত্রী বেঁচে নেই। অনেক কষ্ট নিয়ে তিনি অকালে চলে গেছেন। সেটার জন্য আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।

এজাজ তীক্ষ্ম স্বরে বললো, নাহ, তোর কোনো কষ্ট হচ্ছে না। তুই জাত কবি। জাত কবিদের এসব নিয়ে আত্মতুষ্টি হয়, কষ্ট হয় না।

—আমার সত্যিই মন খারাপ লাগছে। এতোদিন কেন তোদের সাথে যোগাযোগ রাখিনি সেটা ভেবে আফসোস হচ্ছে।

এজাজের দৃষ্টি নিরাবেগ। কিন্তু তার চোখ চকচক করছে। কণ্ঠস্বরে কান্নার ভাব। সেরকম স্বরেই সে আকরামকে বললো, নাসরিন যখন কেমো নিচ্ছিলো, রাতের পর রাত অসহ্য যণ্ত্রণায় সে ছটফট করতো। তার যণ্ত্রণা কমতো যখন আমি তোর সুমন্দ বই থেকে কবিতা পড়ে শোনাতাম।

আকরাম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে ও বুঝে উঠতে পারছে না। এই মুহূর্তে ওর কি করণীয় সেটাও ও জানে না। এজাজ কিছুক্ষণের জন্য কথা থামিয়েছিলো। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার কথা শুরু করলো।

—জীবনের শেষ দিনগুলোতে নাসরিন তোর সুমন্দ বইটা বুকে ধরে ঘুমাতো। হাসপাতালে ওর বেডের পাশে তোর বই রাখতে হতো। সুমন্দ বইটার বিয়াল্লিশটা কবিতা নাসরিনের মুখস্থ ছিলো। শুধু মুখস্থ না, সুমন্দ বা জলধি ব্লগে তোর লেখা সব শব্দ, ভাবনা, ছন্দ আর কাব্য নাসরিনের হৃত্স্পন্দনে আটকে ছিলো। কিন্তু তারপরও তোর বই আর ব্লগ দেখে পড়ার শখ ছিলো ওর। শখ নাকি ভালোবাসা, আমি জানি না। আমি নাসরিনের ভালোবাসা পাইনি। তোর কবিতারা ওর সত্যিকার ভালোবাসা পেয়েছে। একটা সময় ওর অসুখ যখন শেষ পর্যায়ে, বই হাতে নিয়ে বা আইপ্যাড ধরে ব্লগ পড়ার শক্তি ওর ছিলো না। ওর বিছানার পাশে বসে আমি রাত জাগতাম। কেমোর যণ্ত্রণায় কাতর হয়ে ও আমাকে বলতো, আমাকে কবিতা পড়ে শোনাও, প্লিজ …

আকরামের শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে ওর পা আটকে গেছে। পিঠের মাঝখানে একটা শীতল অথচ ভারী ঘামের স্রোত নামার অনুভূতি ও টের পাচ্ছে। এজাজ খুব সম্ভবত সেসব কিছুই জানে না। সে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বললো, আমি তোর কবিতা পড়ে নাসরিনকে শোনাতাম। আমাদের সংসারে সন্তান হয়নি। সন্তানকে গল্প বা ছড়া পড়ে ঘুম পাড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার নেই। কিন্তু আমি তোর কবিতা পড়ে আমার অসুস্থ স্ত্রীকে ঘুম পাড়াতাম। রাতে পর রাত মনের ভেতরে তোর জন্য ঘৃণা আর নাসরিনের জন্য প্রচণ্ড ভয় নিয়ে আমি তোর কবিতা পড়তাম। কেন জানিস… কারণ তোর কবিতা পড়ে নাসরিনকে ঘুম পাড়াতে আমার ভয় লাগতো। যদি সেই ঘুমের পরে ও আর না ওঠে? যদি ঘুমের মধ্যে ওর মৃত্যু হয়? যদি ওর জীবনে শোনা শেষ কথা তোর কথা হয়?

কার্তিক মাসের হিম হিম সন্ধ্যার অনিল আকরামের ক্লান্ত শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে। ওর চোখ ভেজা। বুকের ভেতরে একটু একটু করে কেঁপে কান্না জানান দিচ্ছে। আকরাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নাক মুছলো। এজাজের কথা শেষ হয়নি। হয়তো হবেও না। সে আবার কথা শুরু করলো।

—নাসরিন যেদিন মারা যায়, তার আগের রাতে অসহ্য যণ্ত্রণায় সে খুব বেশি কিছু বলতে পারেনি। ডিসেম্বর মাসের কুড়ি তারিখ। ওর হাত ধরে আমি বসে ছিলাম। মনে মনে সুরা পড়ছিলাম। নাসরিন আমাকে কাছে আসতে বললো। এরপর আমার কানে ফিসফিস করে বললো, এক ফালি মেঘ কান্না হয়ে থাকবে বুকের ভাঁজে, সুমন্দ প্রেম ঝরবে শরত বৃষ্টি সুধার সাজে।

আকরাম ভেজা কণ্ঠে বললো, তুই কেন আমাকে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য আসতে বলিসনি …..

এজাজ কিছু বললো না। পকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে নিলো, কিন্তু সিগারেট জ্বাললো না। আকরাম থেমে থেমে বললো, আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি বাসায় যাবো।

—নাসরিনের খুব ইচ্ছে ছিলো তোর সাথে দেখা করার। তোর মুখে তোর কবিতা শোনার। আমি সেটা হতে দেইনি। আমার তোকে হিংসে হতো। খুব ভয়ংকর হিংসে। নাসরিন যখন যণ্ত্রণায় ছটফট করতো আর তোর কবিতা শুনতে চাইতো, আমি তোর সুমন্দ বইটা খুলে কবিতা পড়তাম আর মনে মনে তোকে খুন করতে চাইতাম।

—আমাকে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য নিয়ে আসতি … এরপর আমাকে খুন করতি।

এজাজ লাইটার বের করে সিগারেট ধরালো। লম্বা করে সিগারেটে টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললো, সুমন্দ কবিতার বাকি লাইনগুলো বল তো … নাসরিনের খুব ইচ্ছে ছিলো তোর মুখে তোর কবিতা শোনার। আজ তুই ওর সেই ইচ্ছেটা পূরণ কর। —তিনি যখন বেঁচে ছিলেন, অসহ্য যণ্ত্রণায় কাতর হয়ে তিনি এই অনুরোধ রেখেছিলেন তোর কাছে। কারণ তার সব অনুরোধ তোর কাছে ছিলো, অন্য কারও কাছে ছিলো না। মৃত্যুর খুব কাছে এসেও তিনি ভালোবাসায় অটুট ছিলেন। তুই তখন কেন আমাকে আসতে বললি না? একবার কেন বললি না আয়, নাসরিনকে তোর কবিতা পড়ে শোনা।

এজাজের সিগারেট নিভে গেছে। সে নিভে যাওয়া সিগারেটে টান দেয়ার চেষ্টা করলো। এরপর শীতল স্বরে বললো, ভাব চোদাবি না। আমার জায়গায় তুই থাকলে তুইও সেই কাজ করতি না। অন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাব চোদানো সহজ। আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে অসুস্থ স্ত্রীর মৃত্যুশয্যায় তার ভালোবাসার কবিকে ডেকে আনা এতো সহজ না।

নাসরিনের আরেকটা ইচ্ছে ছিলো তার সাথে তোর অটোগ্রাফ দেয়া সুমন্দ বইটা যেন কবরে দেয়া হয়। সেটা সম্ভব হয়নি। সামাজিকভাবে সম্ভব হলেও আমি সেটা হতে দিতাম না। তোর মতো ভাবের সাগর আমার এই কষ্ট বুঝবে না। তোকে যেই কাজে আনা হয়েছে তুই সেটা কর। কবিতা পড়ে নাসরিনকে শোনা। সুমন্দ কবিতাটা ওর প্রিয় ছিলো। সেটা পড়ে শোনা।

আকরাম যখন বনানী কবরস্থানের পাশ দিয়ে একা হেঁটে বড় সড়কের দিকে যাচ্ছে, তখন সারা রাস্তায় হাজার হাজার যানবাহনের ভিড়। অনেক শব্দ চারদিকে। শশব্যস্ত মানুষ। অন্ধকারে কারো অভিব্যক্তি বুঝার উপায় নেই। আকরামের দৃষ্টি অবশ্য শূন্যে। অন্য কারও অভিব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখার মতো অবস্থায় ও নেই।

এজাজের অনুরোধ আকরাম রাখতে পারেনি। হয়তো এজাজ বা মহাকালের অন্যপাশের জগতে থাকা নাসরিন সেই কারণে কষ্ট পাবে। এই কষ্টের কোনো উপশম আকরামের জানা নেই। আকরামের মনের গভীরে অযুত কষ্টের স্তুপ। সেসব কষ্টে অবশ্য কোনো খেদ নেই। এজাজের কষ্টে খেদ আছে। খেদমাখা কষ্টের উপশম হয় না। কবরস্থানের সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া দূরুদ পড়তে হয়, কবিতা পড়তে হয় না। কবিতা পড়ার যখন সময় ছিলো, এজাজ তখন আকরামকে ডাকেনি। কারণ আকরামের কবিতার জন্য নাসরিনের নিখাদ ভালোবাসাকে এজাজ সহ্য করতে পারবে না। সেই ভালোবাসার অপরাধে এজাজ আকরামকে খুনও করতে পারবে না। এই দুইয়ের কোনোটারই ক্ষমতা এজাজের নেই। গাড়ি দিয়ে বাসায় নামানোর কথা বললেও এজাজ শেষ পর্যন্ত নিজের সেই ভদ্রতা রাখতে পারেনি। নাসরিনের শেষ ইচ্ছে পূরণ করার অনুরোধে না করায় এজাজ তার সেই ভদ্রতা ভুলে গেছে। আকরামকে এখন বনানী কাকলি মোড় থেকে হেঁটে ঝিকাতলা পৌঁছুতে হবে। সেটাতে আকরামের কোনো ক্লান্তি নেই। ক্লান্তি থাকলেও কিছু করার নেই। আকরাম একজন কবি। কবিকে হাজার ক্লান্তি আর অবহেলা ভুলে পথ চলতে হয়। সেই পথ যতোই অনিশ্চিত বা দূর্গম হোক, কবি হাঁটবেই।

5 1 vote
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments