দ্য জেলাস টাইপ – আওকো মাতসুদা

দ্য জেলাস টাইপ
মূল-আওকো মাতসুদা
ভাষান্তর: অরণ্য পাশা
(লেখক পরিচিতি:আওকো মাতসুদা (Aoko Matsuda) একজন জাপানি লেখক ও অনুবাদক, যিনি সমসাময়িক জাপানি সাহিত্যে নারীবাদী ও ফ্যান্টাসি উপাদানের জন্য পরিচিত। ১৯৭৯ সালে জন্ম নেওয়া মাতসুদা কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেন। তার লেখা ছোটগল্প ও উপন্যাসগুলো জাপানের আধুনিক সমাজ, নারীর অভিজ্ঞতা ও জাদুবাস্তবতার সংমিশ্রণে সমৃদ্ধ। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ Where the Wild Ladies Are (২০১৬) জাপানি লোককথার আধুনিক রূপান্তর, যা নারীর শক্তিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে। মাতসুদা ইংরেজি থেকে জাপানিতে অনুবাদের কাজও করেন। তার লেখনী আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত, যা আধুনিক জাপানি সাহিত্যের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। দ্য জেলাটিাইপ গল্পটি এ বই থেকে নেয়া )
তুমি মেয়ে সেই ধরনের মানুষ, যে প্রিয় মানুষকে ভালোবাসে। আবার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে সন্দেহও করে। তোমার স্বামী একটু অদ্ভুত আচরণ করলেই তোমার বুকের ভেতর আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। একবার রাগ চেপে বসলে, তুমি আর নিজেকে সামলাতে পারো না।আর যখন সেই আগুন জ্বলে ওঠে, তখন চারপাশের ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ডাল ঘুটনির পর্যন্ত ব্যবহার শুরু কওে ! তুমি ছুঁড়তে থাকো,একটার পর একটা। থামার নাম নেই।যদি এই রাগ-ঈর্ষা শুরু হয় শোবার ঢ়রে, তবে প্রথম শিকার হয় বালিশ! প্রথমেই স্বামীর বালিশটা তুলে নিও।)
কিন্তু সেটি হাতে নিয়েই হঠাৎ একটা পুরোনো স্মৃতি ঝাঁপিয়ে পড়ে মনে। তখন তুমি কিশোরী। স্কুলের শি¶া সফরে গিয়েছিলে। রাত হলে সব বান্ধবীরা মিলে বিশাল ঘরে, আর শুরু হয়েছিল এক দুর্দান্ত বালিশ যুদ্ধ।
তুমি দম নিয়ে বালিশ ছুঁড়ে মারো! ঘরটা বেশ ছোট, কিন্তু তাতে কী? হাত ঘুরিয়ে জোরে ছুড়তেই বালিশ গিয়ে লাগে স্বামীর মুখে। তারপর অসহায়ের মতো বালিশটি মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু স্বামী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। স্কুলের বান্ধবীদের মতো সে পাল্টা ছুঁড়ে মারে না, চিৎকার করে না, এমনকি সামান্য হতভম্বও হয় না!
মজা পাচ্ছো না।
তুমি এবার নিজের বালিশ ছুঁড়ো। আরও জোরে! কিন্তু সেটাও ঠান্ডা, প্রাণহীন হয়ে তার শরীর স্পর্শ করে, তারপর মেঝেতে পড়ে থাকে। যেন একেবারে পরিত্যক্ত, অবহেলিত। তোমার মনের ভিতরে তখন যেন আরও বড়ো ঝড় উঠে। অথচ, স্বামী নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি। যেন সে জানেই না, ভালোবাসার এক রূপ এই ঈর্ষাও।
মেঝেতে পড়ে থাকা ওই দুই বালিশের দৃশ্য তোমার বুকের ভেতর একটা তীব্র সত্য ঢুকিয়ে দেয়,তোমার জীবনের সেরা দিনগুলো বহু বছর আগেই ফুরিয়ে গেছে।
সেই স্কুল পিকনিকের কথা মনে পড়ে যায়। তখনকার বালিশগুলো আজকের মতো হালকা আর ফাঁপা ছিল না। ওগুলো ছিল নারিকেল ছোল দিয়ে ঠাসা, ভারী, শক্ত। একবার ছুঁড়ে মারলে যেন ¶েপণাস্ত্রের মতো ধাক্কা লাগত। লেসের কারুকাজে ঘেরা, ছোট ছোট হাস্যকর ফুলের নকশা করা বালিশগুলো হাতে তুলে নিয়েছিলে তুমি আর তোমার বান্ধবীরা। তারপর অন্ধকারে শুরু হয়েছিল এক দুঃসাহসিক বালিশ যুদ্ধ!
তোমরা একে অপরের দিকে সেই ভারী বালিশ ছুঁড়ে মারছিলে। যেন যুদ্ধ¶েত্রের বোমা! পুরো ঘরজুড়ে বিছানো ছিল ফুতোন, প্রায় কোনো ফাঁকও ছিল না। তোমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলে। এতটাই যে, শেষ পর্যন্ত দম নেয়া দায় হয়ে গিয়েছিল। চুলের গোছা মুখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। ঘামে ভিজে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল তোমার স্পোর্টস কিট। যার ওপর স্পষ্ট করে লেখা ছিল তোমার নাম।
একবার তো কী করলে,একদম মুখের ওপর বালিশের সরাসরি আঘাত! সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ছিটকে পড়লে। আর নাক দিয়ে গরম রক্ত গলগল করে গড়িয়ে এলো। সেই নরম, ফুলেল নকশার বালিশকভার মুহূর্তের মধ্যেই ভিজে গেল উজ্জ্বল লাল রঙে।
কিন্তু এই দুটো বালিশ,নির্বিকার, মেঝেতে স্থির পড়ে থাকা,তোমার কৈশোরের সেই বালিশগুলোর মতো একটুও নয়! ওগুলো ছিল ভারী, শক্ত, ছুঁড়ে মারলেই একটা বিস্ফোরণের মতো অনুভূতি হত। আর এগুলো? নিখুঁত পরিমাণে প্রিমিয়াম গুজ ডাউন দিয়ে ভর্তি, তুলোর মতো নরম, যেন স্বর্গের মেঘের একটা টুকরো।
এগুলো তোমার বিয়ের উপহার, তোমার আর তোমার স্বামীর নামের প্রথম অ¶র লাল-নীল সূচিকর্মে বাঁধানো।
কিন্তু যখন এগুলো ছুঁড়ো, মনে হয় যেন বাতাসের চেয়েও হালকা। যেন এরা নিজে থেকেই উড়তে পারে, পাখা মেলে আকাশে উঠে যেতে পারে। আর তখনই তোমার মনে ঝটকা দিয়ে বসে,এই বালিশগুলো ছোঁড়ার জন্য আদৌ ভালো নয়!
একটা বিরক্তিকর, নির্বোধ সত্য বারবার তোমাকে আঘাত করে। প্রতিবার রাগে ফেটে পড়লেই তুমি ভাবো, ‘কালই কিছু ভারী বালিশ কিনতে হবে, যেন সত্যিকারের অস্ত্রের মতো কাজে আসে!’ কিন্তু যেই রাগ মিলিয়ে যায়, এই ভাবনাটাও ধোঁয়ার মতো উবে যায়।
এখনও বালিশের নরম, নির্বিষ আচরণে বিরক্ত হয়ে তুমি একবার ডান পা, একবার বাঁ পা তুলে জোরে ঝাড়া দাও। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের চপ্পলগুলো মিসাইলের মতো ছিটকে যায়, একেবারে স্বামীর মুখের দিকে দিকে!
আর এই চপ্পলগুলোর নাকের অংশ? ওগুলো একটু বেশি তী¶্ণ, একটু বেশি ধারালো। তাই আঘাত করে স্বামীর মুখে।
‘আউচ!’ স্বামী আর্তনাদ করে, যখন এক চপ্পল তার পায়ের শিনে আছড়ে পড়ে।
‘আউচ বলছো?’ তোমার ভেতর ঈর্ষার আগুন আরও বেড়ে যায়।
এই সামান্য ‘আউচ’ যেন তোমার জ্বলতে থাকা আগুনে আরও তেল ঢেলে দিল।
এখন তুমি সম্পূর্ণ পাগলী, রাগে ফুঁসতে থাকা দাবানলের মতো আগুন বালিকা!
তুমি এবার পাশে রাখা ছোট্ট পেপারব্যাক বইটা তুলে নাও। তারপর সেটাও ছুঁড়ে দাও স্বামীর দিকে। কিন্তু বইটা এতটাই পাতলা, এতটাই হালকা যে, সেটার আঘাত একেবারেই তুচ্ছ,শুধু বাতাস কেটে গিয়ে পড়ে। তবু এতে একটা কাজ হয়,তোমার স্বামী বুঝতে পারে, তুমি এখনো রাগের রাজ্যে রাজসিংহাসনের রাণী।
তুমি ভাবো, বোকামি করেছো! শোবার পাশে সবসময় একটা ভারী হার্ডকভার বই রাখা দরকার। এমন কিছু যা সত্যিকারের অস্ত্রের মতো কাজ করবে। সম্ভব হলে একটা এনসাইক্লোপিডিয়া, বরং দুইটা! তাহলে দু’হাতে ধরে একটার পর একটা ছুঁড়ে মারা যেত। ভাবতেই তোমার রক্তে উত্তেজনা খেলে যায়।
কিন্তু বই ছোড়ার চাইতে আরও বড় কিছু দরকার। তুমি হাত পিছিয়ে নিয়ে এক ঝটকায় বেডসাইড টেবিলের ওপর সারি করে রাখা ছবির ফ্রেমগুলোর দিকে আঘাত করো!
তোমাদের বিয়ের ছবি, মধুচন্দ্রিমায় কোয়ালা কোলে তোলা হাস্যোজ্জ্বল ছবি। আরও কত শত স্মৃতির মুহূর্ত,সব কাচ আর রুপালি ফ্রেমে বাঁধানো। টেবিলের ওপর গড়িয়ে পড়ে, ছিটকে যায়।
যদি মেঝে কাঠের পারকেট হত, তাহলে হয়তো একেবারে বিকট শব্দে ভেঙে পড়ত। কিন্তু নরম কার্পেটে পড়েও নাটকীয় কিছু ঘটে। ফ্রেমের প্লাস্টিকের পেছনের অংশগুলো চৌচির হয়ে যায়, ছোট ছোট টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে যায় চারদিকে।
এটাকে তুমি একধরনের বিজয় বলতেই পারো!
কিন্তু সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দেয় স্বামীর চোখের সেই দৃষ্টি। এক মুহূর্তের জন্য হলেও, সেখানে ভয় ফুটে ওঠে! সে হতবাক হয়ে ভাঙা টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর তুমি দাঁড়িয়ে থাকো, রাগের দাবানলে জ্বলতে থাকা এক গ্রেনেড বিস্ফোরণের মতো!
তুমি এখন ভয়ঙ্কর এক সংকল্প নিয়ে চারপাশে চোখ বুলাও,পরবর্তী অস্ত্র খোঁজার জন্য। কিন্তু হতাশ হতে হয়। এই শোবার ঘর আসলে কোনো যুদ্ধ¶েত্রের অস্ত্রাগার নয়।
কারণ বাস্তবিকভাবে, তুমি বেশ গোছানো স্বভাবের। অগোছালো ঘর তোমার সহ্য হয় না। বরং সেটা তোমার মেজাজ আরও খারাপ করে দেয়। আরেকটা কারণও আছে,একবার একটা ম্যাগাজিনে পড়েছিলে, “স্বামীকে বশে আনবেন কীভাবে?” শিরোনামের একটা নিবন্ধ।
যেখানে বলা হয়েছিল, অতিরিক্ত জিনিসপত্র সরিয়ে রাখলে পুরুষেরা শোবার ঘরে বেশি মনোযোগ দিতে পারে। তারপর থেকেই তুমি যেন আরও বেশি কড়াকড়ি আরোপ করেছো।ঘর রাখতে হবে গোছানো, নিখুঁত, নিখাদ, ঝকঝকে!
কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা তোমার বিপ¶ে গেছে। হাতের কাছে ছোড়ার মতো তেমন কিছুই নেই! তাই তুমি এক ঝাঁপ দিয়ে এগিয়ে যাও,নিশানা এবার পর্দা! একটা গর্জন বেরিয়ে আসে তোমার কণ্ঠ থেকে,“আরে এ!”একেবারে বাঘিনীর মতো!
সমস্ত শক্তি দিয়ে তুমি পর্দা চেপে ধরো, আর এক ঝটকায় ছিঁড়ে নামিয়ে ফেলো। রেল থেকে বেরিয়ে আসে, টেনে আনতে আনতে মেঝেতে ফেলে দাও এক বিকট শব্দে! এই পর্দাগুলোর কাপড় শুধু আলো প্রতিরোধী নয়, আগুন প্রতিরোধীও! তাই রাগের এই দহন সত্ত্বেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই,এগুলোতে আগুন লাগবে না।
একটা পর্দা মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই তুমি পরেরটার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ো। আগের মতোই এক দুর্দান্ত টান, এক ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ।
সব কিছু শেষ হয়ে গেলে, তুমি দাঁড়িয়ে থাকো ঠিক যেন একা মোজেস, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পর্দার সমুদ্র বিভক্ত করে রাখা এক দুর্র্ধষ অবতার।
ঘরের কোণে সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তোমার স্বামী হতভম্ব দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এক নিঃশব্দ বিস্ময় তার চোখে। কিন্তু যখন তুমি মুখ ঘুরিয়ে তার চোখের দিকে তাকাও, সে তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
তোমার ঈর্ষার দহন এতটুকুও ম্লান হয়নি। বরং মনে হচ্ছে, তুমি আরও কিছু করতে চাইছো, আরও কিছু ধ্বংস করতে চাইছো। কিন্তু ঘরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সবকিছুই হয় ছোঁড়া হয়ে গেছে, নয়তো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে।
তাই, তুমি আর কিছু করতে না পেরে, নিজের ভিতরের জমে থাকা সমস্ত হতাশা, ¶োভ আর ব্যথা এক প্রবল আর্তনাদে ছেড়ে দাও। তোমার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠে, মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ে তিক্ত অভিযোগের কথার বন্যা। তারপর সেইসব শব্দ আর বাক্যের মাঝে ডুবে গিয়ে তুমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকো,একটা বাচ্চা মেয়ের মতো, যার খেলনা কেউ কেড়ে নিয়েছে।
যখন আশপাশে ধ্বংস করার মতো কিছু থাকে না, তখন শুধু মনের ভেতর জমে থাকা দুঃখ উগরে দেওয়াই একমাত্র উপায়। আর তুমি বুঝে যাও,শোবার ঘর মোটেও ঈর্ষায় পুড়বার জন্য আদর্শ জায়গা নয়!
অবশ্যই, রান্নাঘরই সবচেয়ে ভালো!
যখন সৌভাগ্যক্রমে তুমি সেখানে ঈর্ষায় উন্মত্ত হয়ে ওঠো, তখন তোমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রীতিমতো এক দেবদূতের মতো দীপ্তিময়! কারণ ওখানে হাতে পাবার মতো অনেক কিছু আছে,প্লেট, কাপ, স্টিলের পাত্রৃ সত্যিকারের যুদ্ধের ময়দান!
তুমি শুরু করো সেই সস্তার থালাবাসন দিয়ে,যেগুলো কিনেছিলে একশো ইয়েনের দোকান থেকে। ছোট ছোট সাদা প্লেট, যেগুলোর গায়ে নীলচে মাছ আঁকা, যেন কোনো অমনোযোগী শিল্পীর হাত থেকে বেরিয়েছে। সেই বিখ্যাত রামেন বাটি,যেটা সবার বাড়িতেই কমবেশি থাকে। চারপাশে এঁকে দেওয়া ড্রাগনের ঘূর্ণি। বড় প্লেটগুলোতে বেগুন আর টমেটোর নকশা করা। যেন এক অবাস্তব রঙের খেলা।
একটা মগ, যার একমাত্র বৈশিষ্ট্য তার চটকদার উজ্জ্বল হলুদ রং। আর সেই মসৃণ, মোটা, মাটির প্রলেপদেওয়া ।
প্রতিবার যখন একশো ইয়েনের দোকানে যাও, তখনই এসব সিরামিক কিনে আনো। কেনাকাটার সময় এগুলোর দিকে তাকানোও লাগে না,সরাসরি ঝুড়িতে ভরো। কারণ তোমার জানা আছে, এদের পরিণতি কেবল টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া।
যত বেশি সংগ্রহ, তত বেশি অস্ত্র। তুমি ছোঁড়ো। তুমি ছুঁড়ো। তুমি আছড়ে ফেলো।
বিস্ফোরণ!
একটার পর একটা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। রান্নাঘরের মেঝেতে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে, যেন যুদ্ধের পর বৃষ্টির মতো ঝরে পড়া শত্রুর অস্ত্রের ভগ্নাংশ।
চারপাশে ভাঙা চীনামাটির ধুলো উড়তে থাকে, বাতাসে একরকম কাচের ঝংকার মিশে যায়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ধারালো টুকরোগুলো তোমার বাহুতে, তোমার পায়ে ছেঁটে দেয়, হালকা কেটে যায় চামড়া। কিন্তু তুমি পাত্তাই দাও না!
রক্ত?
এটা তো যোদ্ধার সম্মানসূচক চিহ্ন!
তুমি যুদ্ধ¶েত্রের সৈনিক, তোমার হাতে ছোঁড়া প্রতিটি থালা, প্রতিটি মগ একেকটি অস্ত্র। আর যখন চামড়ার উপর লাল রক্ত ফোঁটা ফোঁটা বেরিয়ে আসে, তখন সেটাই যেন পুরো দৃশ্যটাকে আরও নাটকীয়, আরও মহিমাময় করে তোলে।
সস্তার থালাবাসন যখন একটার পর একটা ধুলোয় মিশে যায়, তখন বুঝতে পারো,সময় এসেছে ধ্বংসযজ্ঞের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার! এবার তুমি হাত বাড়াও মাঝারি মানের সংগ্রহের দিকে। আইকিয়ার সেই ধূসর নীলচে প্লেট, যা একসময় বেশ এলিগ্যান্ট মনে হয়েছিল। মুজির সাদা, নিখুঁত কার্যকরী সিরিজ,যা কিনেছিলে একরকম গর্ব নিয়েই।
এগুলোও আজ বিসর্জন দেওয়ার জন্যই আছে!
তুমি ছোঁড়ো! থালা, ছোট বাটি, বড় বাটি, চায়ের কাপ, তোমার হাতে যা আসে, সব ছুঁড়ে দাও! কোনো পার্থক্য করো না। যা সামনে পাও, তাই আছড়ে ফেলো।
ভাঙুক, না ভাঙুক, তাতে কিছু যায় আসে না!
একটা চকচকে বার্নিশ করা কাঠের বাটি মেঝেতে আছড়ে পড়ে, কিন্তু ভাঙে না। বরং সেটা লিনোলিয়ামের ওপর দিয়ে গড়িয়ে করিডোরের দিকে ছুটতে থাকে। একেবারে শৈশবের ঘুর্ণায়মান লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে!
কিন্তু, কিছু জিনিস আছে যেগুলো ছোঁড়া যায় না।
তোমার নোরিটাকে চায়ের কাপের সেট? অসম্ভব! ওগুলো তো মহামূল্যবান! আকাশছোঁয়া দাম দিয়েছিলে সেগুলোর জন্য। আর সেই জটিল কারুকার্যময় আরবি থালাবাসন? ওগুলোকে তো একেকটা রত্নের মতো সংগ্রহ করেছো, ধীরে ধীরে, নিখুঁত যত্নে।
তুমি যতই ঈর্ষায় পুড়ে যাও না কেন, তোমার বিচারবোধ তখনো এতটুকু অটুট থাকে। পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস আছে, যা ছোঁড়া চলে, আর কিছু আছে যা অস্পৃশ্য।
এই বিষয়ে তোমার সিদ্ধান্ত অটল, নির্ভুল!
এদিকে স্বামী?
সে তখন টেবিলের নিচে সেঁধিয়ে গেছে, পুরো শরীর কুঁকড়ে নিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে দু’হাতে। তুমি তাকে দেখেও না দেখার ভান করো। কারণ এই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এই যুদ্ধ ঈর্ষার, এবং তুমি এখনো তেতে আছো!
তুমি যখন ছোঁড়ার মতো সব কিছু শেষ করে ফেলো, তখন আর দেরি করো না। নিজের পোলকা-ডট অ্যাপ্রন ছিঁড়ে খুলে ফেলে দাও মেঝেতে। তারপর সেই কাপড়ের ওপর পদদলিত করো, যেন তাতে তোমার রাগ মিশে যায়। যেন সেটার ওপর দিয়ে চলা তোমার ঈর্ষার শেষ ধ্বংসযজ্ঞ।
এরপর তুমি এগিয়ে যাও সিঙ্কের দিকে, যেখানে বাসনপত্র পানিতে ডুবে আছে। দুই হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করো, তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে সটান আঘাত করো জলে! চারপাশে ছিটকে ওঠে রক্তের মতো লালচে জলের ফোঁটা, যেন এক ভয়াবহ যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন।
তোমার তৃষ্ণা তখনও মেটেনি। তুমি ফ্রিজের দরজা খুলে বরফের টুকরো টেনে আনো। তারপর সেটা মুখে পুরে দাঁত দিয়ে গুঁড়িয়ে ফেলো।কড়মড় করে।
বরফ ঠান্ডা, শক্ত,কিন্তু তাতে কী! তোমার রাগের আগুনের সামনে এই ঠান্ডা কিছুই না। রান্নাঘর কখনও রসদ ফুরিয়ে ফেলে না। এই জায়গা সবসময়ই তোমার ঈর্ষার আগুনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে!
তুমি এবার একটা বড়সড় ডাইকন (জাপানি মূলা) তুলে নাও। সেটা যেন এক বিশাল বেসবল ব্যাট!
তুমি সেটাকে বাতাসে ঘোরাও, যেন এক নিখুঁত আক্রমণের প্রস্তুতি।
তারপর পরবর্তী মুহূর্তেই, সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটাকে নামিয়ে আনো টেবিলের ওপর!
শ্র্যাক!
ডাইকনটা হয়তো তোমার ধারণার চেয়ে নরম ছিল। এক ঝটকায় সেটি ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে যায়, ঠিক যেন স্লো-মোশনের কোনো দৃশ্য। তবে এটা নষ্ট হবে না। তোমার মাথায় তখনই একটা বাস্তবিক চিন্তা খেলে যায়,আজ রাতের খাবারের জন্য এই টুকরোগুলো দারুণ হবে!
এরপর তুমি একটা কাঁচা স্কুইড (ইলিশ মাছের মতো এক ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী) তুলে নিও। শক্ত করে চেপে ধরো, যত¶ণ না সেটা থেকে শেষ বিন্দু কালি বের হয়ে আসে। এই মুহূর্তে, তুমি রাগের আগুনে জ্বলতে থাকলেও, মাথার মধ্যে অদ্ভুত প্রশান্ত একটা ভাবনা খেলে যায়,
“হুম, ডাইকন আর স্কুইড,এগুলো একসাথে মিশিয়ে দুর্দান্ত একটা ইকা-ডাইকন রান্না করা যাবে!”
তাহলে কি রাগ, ঈর্ষাও একধরনের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে আসে?
তুমি দাঁড়িয়ে থাকো রান্নাঘরের যুদ্ধ¶েত্রে, বাতাসে এখনও ঝুলে আছে ধ্বংসের রেশ। কিন্তু খাবারের পরিকল্পনা মাথায় আসতেই, তোমার ধ্বংসযজ্ঞে যেন এক অদ্ভুত পরিণতি আসে…
তোমার চোখ এবার পড়ে আপেলের কার্টন বাক্সের ওপর। তোমার মা-বাবা পাঠিয়েছিলেন। একেবারে তাদের নিজস্ব বাগান থেকে। তাজা আপেল। সেগুলা কাটার জন্য তুমি একটাও ছুরি খুঁজে বের করো না।
তোমার হাতই যথেষ্ট! তুমি আপেলগুলো একের পর এক দু’হাতে ধরে ছিঁড়ে ফেলো। শক্ত আঙুল দিয়ে তাদের মসৃণ, চকচকে খোসা ফাটিয়ে দাও। যেন কোনো যুদ্ধের ট্রফি ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছো!
পরে এসব দিয়ে জ্যাম বানানো যাবে। কিংবা পাই অথবা ম্যাকরনি স্যালাডে মেশানো যাবেৃ
আপেল আসলে চমৎকার, এতভাবে ব্যবহার করা যায়!
কিন্তু এখন তুমি শুধু এদের টুকরো টুকরো করার উন্মাদনাতেই মগ্ন। রান্নাঘরের যা কিছু ধ্বংস করা সম্ভব ছিল, তুমি তা করেছো।
এখন তুমি এসব গুছিয়ে ফেলবে। কিন্তু গুছানো মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয়। তুমি এখনো ঈর্ষার আগুনে জ্বলছো! তোমার ভেতরের তাণ্ডব এখনো থামেনি।মেঝের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা টুকরো-টাকরার ওপর দিয়ে নিষ্পেষিত পায়ের শব্দ তুলে হাঁটতে থাকো। প্রতিটা ছোট্ট ভাঙা কাচের টুকরো যেন কষ্টে চিৎকার করছে।
তুমি সেটা অনুভব করতে পারো।
এদের ব্যথা তোমার স্বামীর চেয়ে অনেক বেশি বোধগম্য। তার মন, তার চিন্তা তোমার কাছে আজও রহস্য। কিন্তু এই ভাঙাচোরা টুকরোগুলোর আর্তনাদ,তুমি জানো, বুঝতে পারো, এমনকি অনুভবও করো। এখনও তোমার রাগের নিয়ন্ত্রণে। তুমি গুছাতে শুরু করো,ঠিক যেন উন্মত্ততার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো কোনো মানুষ!
কোনো টুকরো বাদ দেবে না। সব কিছু পরিষ্কার হবে। নিখুঁতভাবে। তুমি একেকটা কণার খোঁজে মেঝে ঝুঁকে ঝুঁকে কাজ করো।
অ্যাপ্রনটা হাতে তুলে নিও, তারপর প্রতিটি ভাঁজ হাত দিয়ে মসৃণ করে দাও, যেন সেখানে কোনো ¶তচিহ্ন নেই, কোনো আক্রোশের ছাপ নেই। তুমি আইস কিউব ট্রে তুলে নিও, একে একে প্রতিটা খোপে যথাযথ মাত্রায় পানি ভরো। এক ফোঁটাও বেশি না, এক ফোঁটাও কম না।
তারপর সেটা তুলে সযত্নে রাখো ফ্রিজের নির্দিষ্ট জায়গায়। সবকিছু গুছিয়ে সুসজ্জিত করো।
স্কুলে টিফিনের সময় যখন তোমার ভালোবাসার মানুষটি অন্য মেয়েদের খেতে সাহায্য করত, তুমি এত জোরে মুঠো বেঁধে রাখতে যে তোমার হাতে থাকা বিস্কুট গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ত। সবাই বলত, “এখনও মুঠির নিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো আয়ত্ত হয়নি।”
খেলার সময়ে, যখন সে অন্যদের সঙ্গে মিলে সুউচ্চ বিল্ডিং-ব্লকের দুর্গ বানাত। তুমি হঠাৎ এক বিকট চিৎকার করে ছুটে গিয়ে তা ভেঙে ফেলতে। যেন কোনো নির্মম দেবতা তার সৃষ্টি ধ্বংস করছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ব্লকগুলোর স্পর্শ অনুভব করতে করতে তোমার মনে হলো, এগুলো যেন শাকসবজির টুকরার মতো। এক মুহূর্তের জন্য তোমার কল্পনায় এক বাটি সবজির ঝোলের ছবি ভেসে উঠল। তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
তোমার জীবনের প্রতিটি স্তরেই তোমার ঈর্ষা ছিল অসাধারণ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, তুমি এক চকমকে ঝলমলে বই থেকে অসংখ্য প্রেমের মন্ত্র উচ্চারণ করতে। কিন্তু বুঝতে পারলে যে সেগুলো কাজ করছে না। তখন বইটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললে। তোমার ঝোঁক চলে গেল কালো জাদুর দিকে। তোমার ঘরে সবসময় কিছু কিছু ভুডু পুতুল থাকত।
পাশের মন্দিরে শতবার গিয়েছিলে এই প্রার্থনা নিয়ে যে, যে ছেলেটিকে তুমি ভালোবাসো, সে যেন তার প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে ফেলে। এমনকি তুমি একবার নির্জন ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়, আরও গভীর আন্তরিকতা নিয়ে সেই একই প্রার্থনা করেছিলে।
মাধ্যমিক স্কুলে এক ছেলের প্রেমে পড়ে, তুমি তার ডায়েরি চুরি করেছিলে । স্নাতক হওয়া পর্যন্ত সেটি সর্বদা তোমার সঙ্গে রেখেছিলে। তোমার শরীরের উষ্ণতায় এর মলাট বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যে মেয়েকেই তার সঙ্গে কথা বলতে দেখতে, তুমি তার ওপর অভিশাপ দেওয়ার কাজে মনোনিবেশ করতে।
তুমি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলে শুধুমাত্র তার সঙ্গে একই উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আশায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তুমি সুযোগ পেলে, আর সে পেল না। তবুও, নতুন স্কুলে গিয়েও তোমার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটাই,সে নতুন নতুন কত মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে! প্রতিদিন শেষ ক্লাসের পর লুকিয়ে তার স্কুলের দিকে চলে যেতে। গোপনে তাকে পর্যবে¶ণ করা তোমার বিকেলের রুটিনে পরিণত হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার ঈর্ষা আরও নতুন মাত্রা পেল। যখন তোমার প্রেমিক তোমার পাঠানো একটি মেসেজের জবাব পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত দিল না, তখন এই ধাক্কায় তুমি এতটাই আঘাতপ্রাপ্ত হলে যে জ্বরে কাবু হয়ে পড়লে। যখন সে ফোন ধরত না, তুমি একের পর এক দু’মিনিট অন্তর ভয়েসমেল পাঠাতে থাকতে। ব্যাপারটা সহজ ছিল না,একটি মেসেজ পাঠিয়ে ফোন নামিয়ে রেখেই সঙ্গে সঙ্গে আবার ডায়াল করে আরেকটি রেকর্ড করেতে।
তার সাবেক প্রেমিকা সম্পর্কে জানার আকুলতা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, তুমি রাতারাতি বাসে উঠে বসলে তার শহরের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে পরিচিত-অপরিচিত লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করলে। তারা তোমাকে কোনো ব্যক্তিগত গোয়েন্দা ভেবে নিল। অল্প সময়ের মধ্যেই চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, তোমার প্রেমিক কোনো সন্দেহজনক কাজে জড়িয়ে পড়েছে!
তোমার বাইবেল ছিল গেঞ্জির উপাখ্যান। যে পুরুষের প্রেমে পড়তে, যে পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে,সবার জীবন হারাম কওে দিতে।একজনও বাদ যেত না।
যে পুরুষ তোমাকে বিয়ে করল, তার কাছে প্রতিটি দিন ছিল জীবন্ত নরক।
কিন্তু কেন বিয়ে করল সে?
স্পষ্ট ছিল শুরু থেকেই,তুমি কেমন মানুষ। যখন সে তোমার সামনে বসে ফোন চেক করত, তখন কি টের পেত না তোমার দৃষ্টি? সেই দৃষ্টি, যেন সরাসরি ওর বুকের ভেতর ছুরি বসিয়ে দিচ্ছে!
আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা?
এইসব কিছু করেও, গতকাল পর্যন্ত তুমি ভাবতেই পারোনি যে তুমি ঈর্ষাকাতর! টেলিভিশনে নাটক মুভিতে তো কত রকমের প্রেমিকা আর স্ত্রীদের দেখি,কেউ কেউ তো আরও পাগলাটে!
তাহলে?
তুমি ভেবেছিলে, এটাই স্বাভাবিক। প্রেম মানেই তো এমন হবে, ভালোবাসা মানেই তো এমন! কখনো ঈর্ষার বশে গাড়ির কাচে ঘুষি মেরেছ? হয়তো দিয়েছ।
নিজের হাতে স্বামীর জন্য সেলাই করা প্রায়-সম্পূর্ণ ইউকাতা এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলেছ?
হয়তো ছিঁড়েছ। স্বামীর জুতার ভেতর ছোট্ট একটা জিপিএস ট্যাকার ঢুকিয়ে দিয়েছ, লুকিয়ে?
হয়তো দিয়েছ।
তবে সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?
একজন ভালোবাসার মানুষের শরীর থেকে অপরিচিত নারীর গন্ধ পেলে সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত করার ¶মতা রাখা কি দোষের কিছু? তুমি তো ভেবেছিলে,এটাই প্রেম।এটাই ভালোবাসা।
তাই তো, গতকাল রাতের খাবারের পর যখন তোমার স্বামী হুট করে বলল, “আমি ডিভোর্স চাই,”
তোমার প্রথম প্রতিক্রিয়া কষ্ট নয়। চরম বিস্ময়! হতবাক হয়ে গেলে।
তোমার স্বামী দীর্ঘ¶ণ ধরে বলল,
তোমার ঈর্ষা, রাগ স্বাভাবিক নয়। তোমার মানসিক সমস্যা আছে। এটা আমাকে আতঙ্কিত করে।
আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
“এটা পাগলামি!”
কথা বলতে বলতে তার কণ্ঠ কাঁপছিল। সে যেন আর স্থির থাকতে পারছিল না।
একপর্যায়ে মাথা নামিয়ে দিল ডাইনিং টেবিলে।
একটা বড় টাওয়ার যেমন ধসে পড়ে, তেমনি। তারপর, চোখের জল আর থামল না।
তুমি খারাপ মানুষ নও। তোমার মন আসলে কোমল। তাই তো মুহূর্তেই অনুশোচনায় ডুবে গেলে।
এতদিন তো ভাবতেই পারোনি, তোমার আচরণ ভুল! একবারও মনে হয়নি, তোমার ভালোবাসা কারও জন্য বোঝা হতে পারে। তুমি কান্নাকাটি করলে।একটার পর একটা ¶মা চাইলে।
বারবার বললে, “আমি বদলে যাব। আর একটা সুযোগ দাও!”তোমার স্বামী নিঃশব্দে শুনল।
তারপর হালকা একটা হাসি দিল। একটা বীরের হাসি। কী যেন বলতে গিয়েও, শুধু বলল, “ঠিক আছে।”
চোখ মুছল। তবু, তার মুখে স্বস্তির ছাপ নেই।
দু’জনেই চুপচাপ বসে থাকলে। তোমার বানানো অ্যাপল পাই টুকরো করে খেতে লাগলে।
কিন্তু সেই স্বাদে মিশে ছিল কেমন যেন একটা অজানা কষ্ট।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে তুমি অনুভব করলে এক নতুন সতেজতা। মনে হলো, পুনর্জন্ম সম্ভব। তুমি ঠিক করলে,এবার তুমি বদলাবে।
তুমি হবে এক উদার, মহানুভব মানুষ,
যে কোনো ঈর্ষা করবে না। স্বামী যেমন আছে, তেমনই গ্রহণ করবে। তুমি নিজের সঙ্গে শপথ করলে।
কিন্তু…
এখানেই তো আসল কথা!
আমরা আজ তোমার কাছে এসেছি এই প্রশ্নটা তুলতেই,কেন তুমি হঠাৎ এত সাধারণ এক কাজ করলে?
কেন তুমি অনুতাপ করলে? ভাবো তো!
যে মোবাইলে সন্দেহজনক মেসেজ আসে,সে কি দোষী নয়?
যে পকেটে অচেনা মদ বার-এর ম্যাচবক্স রাখে,সে কি নিষ্পাপ?
ভ্যালেন্টাইনসে দামি চকলেট নিয়ে আসে,কিন্তু তা তোমার জন্য কিনা, তাও জানে না!
তাহলে?
যদি সে তোমার মনে সন্দেহ জাগিয়ে তোলে, তবে দোষ তোমার, নাকি তার?
এখন বলো,
তুমি কেন তাকে সহজে ¶মা করলে? তুমি কেন নিজেকে বদলাতে চাও? তুমি তো ভুল কিছু করোনি!
তোমার দোষ নেই। দোষী সেই। যে প্রতারণার ছায়া, আলামত সৃষ্টি করে।
তাই বলছি, ঈর্ষাকে দমন কোরো না। ঈর্ষা তোমার পরিচয়। এটাই তোমার শক্তি।এটাকে সহজে ছেড়ে দিও না!
তুমি হয়তো এখনও বুঝতে পারোনি, কিন্তু তোমার ঈর্ষা এক অসাধারণ প্রতিভা। তুমি তোমার চারপাশের বোকার দল আর তাদের উপদেশ শুনতে যেয়ো না। তারা কিছুই বোঝে না। তোমার দাঁত-নখ ফেলে দেওয়ার কোনো দরকার নেই। তুমি যদি নিজেকে নরম করে ফেলো, তাহলে সেটাই হবে পৃথিবীর আসল ¶তি।
তোমার স্বামী যদি তার এই ছটফটে, সন্দেহজনক আচরণ চালিয়ে যায়,তাহলে তুমিও তাকে নরক দেখিয়ে যাও। তার জীবন হারাম করে দাও।
আবার যদি ডিভোর্সের কথা তোলে? তবে খুঁজে বের করো তার দুর্বলতা। যেখানে তার ঢাল সবচেয়ে পাতলা,
সেখানেই আঘাত হানো। ব্ল্যাকমেইল করো!
যদি প্রয়োজন হয়, আমরা তোমার জন্য সেই দুর্বল জায়গা খুঁজে দেব।খুঁজতে বেশি সময় লাগবে না, আমরা নিশ্চিত! আর একটা কথা, তোমার ঈর্ষা আজও তরুণের মতো তীব্র।এটাই তোমার আসল শক্তি! বয়স হলে মানুষের মন নরম হয়ে যায়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ধীর, ম্লান হয়ে যায়। অনেক নারী তাদের স্বামীদের দিকে না তাকিয়ে, টিভির নায়কদের প্রেমে পড়ে।
কেন জানো?
ওরা স্বপ্নের জগত তৈরি করে দেয়।
একটা সুন্দর, নিখুঁত কল্পনার প্রেম। তাতে দোষ নেই। কিন্তু তুমি অন্যরকম। তুমি বাস্তবের প্রেমে দগ্ধ হওয়া নারী। তোমার প্রেম স্বপ্ন নয়,আগুন! তাই ঈর্ষাকে ছাড়তে যেয়ো না।এটাই তোমার পরিচয়। তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ, এই শহরের রাস্তায় কত বিবাহিত দম্পতি হাঁটছে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ নিয়ে।
বছর বদলায়, যুগ বদলায়, কিন্তু একটা সাধারণ দাম্পত্যের পথ কখনও বদলায় না। কিন্তু তুমি? তুমি কখনো হার মানোনি। তোমার ঈর্ষা আজও নবীন কুঁড়ির মতো সতেজ।
আমাদের পরিসংখ্যান বলছে, তুমি এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। এক অপূর্ব ব্যতিক্রম। সবার চেয়ে আলাদা
বড় কোনো পরিবর্তন না এলে, আমরা বিশ্বাস করি,তোমার ঈর্ষার শক্তি তোমাকে এক শতাব্দী ধরে জ্বালিয়ে রাখবে। তবে, আমাদের কিছুটা অভাব আছে তোমার মতো প্রাণশক্তির মানুষের। তাই, আমরা চাই,
তুমি এর আগেই আমাদের কাছে চলে আসো। যত দ্রুত সম্ভব!
প্রতিবছর অতৃপ্ত আত্মার সংখ্যা কমছে। সবাই এত বুদ্ধিমান, এত সংযত, কিন্তু তুমি জানো? সাধারণ মানুষ মরলে তারা সহজেই স্বর্গে চলে যায়। ভুলে যেয়ো না, ভূত হওয়া যায় না এমনি এমনি! যার হৃদয়ে তীব্র ঈর্ষা নেই, যন্ত্রণার আগুন নেই,সে ছাইয়ের মতো উড়ে চলে যায় অদৃশ্য স্বর্গলোকে।
আর আমরা? আমরা তাদের দেখে বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। এমনকি মাঝে মাঝে মনে হয়, ওদের ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করি, “তোমরা কি সত্যি এমন নিষ্প্রাণ হতে চাও?”
আজকের দুনিয়ায় ঈর্ষা আর উন্মত্ত প্রেম খারাপ বলে চিহ্নিত হচ্ছে! এগুলোকে প্রতিভা নয়, দোষ হিসেবে দেখা হচ্ছে! আর এর ফলে কি হচ্ছে জানো? তোমার মতো প্রতিভাবান মানুষ কমে আসছে! এসব কথা বলা চক্র ভয়ংকর। পরিস্থিতি গুরুতর। তোমার মতো মানুষের জন্য আমরা অপে¶া করছি। সত্যি বলতে কী, এটা স্বীকার করাটা আমাদের জন্য কিছুটা লজ্জার।
তাও বলি আমাদেও মত অতৃপ্ত ভূতের দলে এখন মানুষের অভাব চরমে! এবং, যদি তুমি আমাদের সঙ্গে যোগ দাও, তাহলে এর চেয়ে আনন্দের কিছু হবে না! তোমার মতো এক অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তির
কোনো প্রশি¶ণের প্রয়োজন নেই। তুমি তো জন্মগতভাবেই তৈরি! আমরা চাই, তুমি অবিলম্বে আমাদের দলে আসো। আমরা জানি, তুমি কতদূর যেতে পারো।তোমার ¶মতা কতটা বিস্ময়কর! তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা অসীম।
তোমার জন্য আমাদের মঞ্চ প্রস্তুত। তুমি যখন পরলোক জগতে পা রাখবে,তখন তোমার জন্য থাকবে নানান বিকল্প পথ।
তুমি কেমন ভূত হতে চাও,
কোথায় আবির্ভূত হতে চাও,
কীভাবে মানুষের মনে দাগ কাটতে চাও,
সব ব্যবস্থা আমাদের আছে!
তাই, যখনই তোমার সময় হবে,
তুমি আমাদের সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ করবে।
আমরা অপক্ষোয় থাকব।
শুরু করলে আর নতুন করে কিছু ভাববার প্রয়োজন নেই। জেগে থাকো, হাঁটো কিংবা বিড়ি খাও…
Ismat Shilpi2025-03-30T20:27:10+00:00March 30, 2025|
কুন্টার মুক্তির আনন্দ
Sumon Biplob2025-03-30T10:38:17+00:00March 30, 2025|
গঙ্গা পাড়ের বৃত্তান্ত
Priyojit Ghosh2025-03-29T12:19:22+00:00March 29, 2025|
আমি ও জ্যোতি পোদ্দার
Jyuti Podder2025-03-30T09:42:15+00:00March 29, 2025|
চন্দ্রাগিরি
Sumanta Gupta2025-03-28T21:29:59+00:00March 28, 2025|
হোয়াইট আর্কেডিয়া এবং মেথুকীর গল্প
Syed Mahmud2025-03-28T21:30:01+00:00March 28, 2025|