ভিনসেন্ট ভ্যান গগ : জীবনের আড়ালে জীবনের গল্প

By Published On: October 30, 2023Views: 101

জীবিত অবস্থায় স্বীকৃতি না পাওয়া জগৎ বিখ্যাত কিংবদন্তী শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। এই চিত্রকার নিজের কীর্তিগাথার জয়জয়কার কিছুই নিজে দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই আত্মহত্যা করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। শুধুমাত্র আঁকার জন্যই বিখ্যাত নন, তিনি নিজের জীবনের সংগ্রামী লড়াইয়ের জন্যও পরিচিত। বিষণ্ণ এই জাদুকর বুক ভরা বিষাদ নিয়েও শিল্প সংস্কৃতিকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ কিছু উপহার। আজ আমরা তারই জীবনের কয়েকটি অজানা দিক সম্পর্কে জানব।

  • চিত্রকার হিসেবে পথ চলা

জীবনের ২৭ বছর বয়সে এসে ছবি আঁকা শুরু করেন ভ্যান গগ। ছবি আঁকার জন্য কারো কাছে হাতেখড়ি নেননি তিনি। অনেকটা সহজাতই ছিল ব্যাপারটি। শুরুর দিককার ছবিগুলোতে এতটা রঙ ব্যবহার করতেন না ভ্যান গগ। সমাজের নিদারুণ বাস্তবতা ও কঠিন বিষয়বস্তু উপস্থাপনই ছিল তাঁর আঁকার মূল উদ্দেশ্য। দরিদ্রতা, গরীব জীবনযাপন ভ্যান গগের প্রথম দিককার ছবিগুলোতে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। মূলত নিজের জীবনই তিনি ফুটিয়ে তুলতেন রঙ তুলি দিয়ে। পরবর্তীতে তাঁর ছবিগুলোতে রঙের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। মূলত সেই ছবিগুলোর জন্যই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ভিনসেন্ট।

  • পল গাউগুইন

আরেক বিখ্যাত চিত্রকার পল গাউগুইনের অনেক কাছের বন্ধু ছিলেন ভিনসেন্ট। ১৮৮৭ সালে প্যারিসে এই দুজনের প্রথম দেখা হয়। সেই থেকে এই দুজনে একসাথে অনেক ছবি এঁকেছেন। যদিও দুজনের আঁকার ধারা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার। ১৮৮৮ সালে নিজের ভাই থিও ভ্যান গগকে লেখা এক চিঠিতে ভিনসেন্ট জানিয়েছেন, তার আঁকার জগতে পলের অবদান অপরিসীম। ভিনসেন্টকে মুক্ত চিন্তা করতে শিখিয়েছেন পল, যা চিত্রকার হিসেবে তাকে আরও পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলে।

  • স্ট্যারি নাইট

তর্ক সাপেক্ষে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আঁকা শ্রেষ্ঠ ছবিটি স্ট্যারি নাইট। তবে মজার ব্যাপার হলো এই ছবিটি ভিনসেন্ট এঁকেছেন একটি আশ্রমে বসে। ১৮৮৮ সালে নিজের কান কাটা নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে স্বেচ্ছায় ফ্রান্সের সেইন্ট রেমি-ডি প্রদেশের এই আশ্রমে আসেন তিনি। বলা হয়ে থাকে ছবিটি ছিল ভ্যান গগের বিছানার পাশের জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া রাতের দৃশ্য। ১৯৪১ সাল থেকে এই ছবিটি মেট্রোপলিটন আর্টস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।

বিখ্যাত স্ট্যারি নাইট; Image Credit: History Archive/REX/Shutterstock.com
  • চিঠির মাঝে জীবন

ভিনসেন্ট ভ্যান গগের জানা অজানা নানা দিক উঠে এসেছে তার চিঠিগুলোর মাধ্যমে। ভিনসেন্টের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন তার ছোট ভাই থিও ভ্যান গগ, পল গাউগুইন ও আরেক চিত্রকার এমিলি বারটান্ড। নিজেদের মধ্যে প্রচুর চিঠি আদান-প্রদান করতেন তারা। নিজের জীবনে প্রায় ৮০০ এর মতো চিঠি লিখেছেন ভিনসেন্ট। এই চিঠিগুলোই পুরো বিশ্বকে জানিয়েছে ভ্যান গগের দুনিয়া সম্পর্কে। তবে সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছেন ছোট ভাই থিওকেই। তাদের মধ্যে প্রায় ৬০০ চিঠি আদানপ্রদান হয়েছিলো। থিও ভ্যান গগ সবগুলো চিঠি যত্ন করে রেখে দিলেও ভিনসেন্টের কাছে থিওর সব চিঠি পাওয়া যায়নি। এই চিঠিগুলোতে নিজেদের বন্ধুত্ব, ভিনসেন্টের শিল্পীভাবের চিন্তাধারা ও জগতের ধারণা পাওয়া যায়। দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর সবগুলো চিঠি সংগ্রহ করেন থিওর স্ত্রী জোয়ানা ভ্যান গগ। তারই সাহায্যে সেইসব চিঠিগুলো পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়। বেশিরভাগই প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালের পরে।

সানফ্লাওয়ার আঁকার সময়ে পল গাউগুইনের আঁকা ভিনসেন্টের পোট্রেইট; Image Credit: Pixels
  • চিত্রশিল্পী ভ্যান গগ

চিত্রকার হিসেবে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগে নানা ধরনের কাজে জড়িত ছিলেন তিনি। বলা বাহুল্য, কোনোটিতেই নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। স্কুল শিক্ষক হতে শুরু করে যাজক পর্যন্ত ছিলেন তিনি। ১৮৮০ সালে থিওকে একটি লেখা চিঠিতে সর্বপ্রথম নিজেকে চিত্রকার হিসেবে উপস্থাপন করেন শিল্পী ভ্যান। ছবি আঁকার জন্য শিল্পীসুলভ লক্ষ্যের জন্য তিনি পরবর্তীতে ঘুরে বেড়ান হল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ আরো অনেক জায়গায়।

অনেক দেরীতে ছবি আঁকা শুরু করলেও পরবর্তীতে ছবির পেছনে অনেক সময় দিয়েছেন তিনি। ভিনসেন্ট তার জীবনে এঁকেছেন প্রায় ২,১০০টি ছবি এঁকেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ৮৬০টি তৈলচিত্র। বেশিরভাগ ছবির কাজই সম্পন্ন করেছেন নিজের জীবনের শেষ দুই বছরে।

নিজের জীবনের অর্থনৈতিক সমস্যা ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকার পরেও ভ্যান গগ শেষ দুই বছরে যত ছবি এঁকেছেন তা অনেক চিত্রকারের পক্ষে সারাজীবন ধরেও আঁকা সম্ভব ছিলো না।

  • ৮২.৫ মিলিয়ন ডলারের ছবি

ভিনসেন্টের আঁকা সবচেয়ে দামী ছবিটি হচ্ছে ‘পোরট্রেইট অফ ডক্টর গ্যাচেট’। ১৮৯০ সালে আঁকা এই ছবিটি ঠিক একশ বছর পর ১৯৯০ সালে নিলামে ওঠানো হয়। সেই সময়ে ছবিটি বিক্রয় হয় ৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে, যেটি কি না পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবিগুলোর মধ্যেও একটি।

৮২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় হওয়া পোট্রেইট অফ ডক্টর গ্যাচেট; Image Credit: Mental floss
  • হতদরিদ্র জীবন

৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় হওয়া ছবি থাকলেও নিজের জীবনে পুরোটা সময়ই দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো ভ্যান গগকে। সত্যিকার অর্থে জীবদ্দশায় মাত্র একটি ছবিই বিক্রয় করতে পেরেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। রেড ভাইনইয়ার্ড নামের ছবিটিই ভিনসেন্টের নিজ হাতে বিক্রয় করে যাওয়া একমাত্র ছবি। আত্মহত্যা না করে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো নিজ চোখেই নিজের কীর্তির সম্মাননা দেখে যেতে পারতেন তিনি।

  • মানসিক অসুস্থতা

জীবনের বড় অংশে জুড়েই ভ্যান গগ মানসিক অসুস্থতায় ভুগেছিলেন। বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে দিন কাটিয়েছিলেন এই স্বনামধন্য চিত্রকার। পরবর্তীতে জানা যায়- দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা, মানসিক ভ্রান্তি জীবনের পুরাটা সময় লেগে ছিল ভিনসেন্টের পেছনে। আধুনিক সাইকিয়াট্রিস্টদের ধারণা তিনি স্কিৎজোফ্রেনিয়া, সিফিলিস, মৃগী রোগ ছাড়াও বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়াও টাকার অভাবে খাদ্যাভাবের জন্যও বেশ দুর্বল ছিলেন ভ্যান গগ। মূলত মানসিক ও শারীরিক দুভাবেই বেশ অসুস্থ ছিলেন এই চিত্রশিল্পী।

নিজ হাতে আঁকা নিজের ছবি; Image Credit: Marian bobby Evans/Liveout
  • কান কর্তন

এই গুণী শিল্পী নিজের কান নিজে কেটে ফেলেছিলেন! তবে ভ্যান গগের কান কাটা নিয়ে বেশ কিছু গল্প রয়েছে। তার মধ্যে জনপ্রিয় গল্পটি ছিল যে, পল গাউগুইনের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েই রেজর দিয়ে নিজের কান কেটে ফেলেন তিনি। পরবর্তীতে সেটি র‍্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে যৌনপল্লির এক মহিলার কাছে তা পাঠিয়ে দেন, যে মহিলার নিকট ভ্যান গগ ও পল গাউগুইন দুজনেরই যাতায়াত ছিল। আরেক ভাষ্যমতে, পল গাউগুইন নিজ হাতেই ভিনসেন্টের কান কেটে ফেলেন। তবে সেই কান কাটার ঘটনার পরই পল গাউগুইনের সাথে বন্ধুত্বের সমাপ্তি ঘটে তার। তাই সবার ধারণা, কান কর্তনের সাথে পল গাউগুইন সরাসরিই জড়িত।

বিখ্যাত সানফ্লাওয়ার ছবিটি; Image Credit: Art.com
  • আত্মহত্যা

১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই ভিনসেন্ট ভ্যান গগ নিজের বুকে নিজেই গুলি করে বসেন। এর দুদিন পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। বলা হয়, একটি গম ক্ষেতে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের বুকে গুলি চালান। গুলি করার আগ মুহূর্তে গমের ক্ষেতে বসেই ছবি আঁকছিলেন তিনি। গুলি করার পরেও তিনি পায়ে হেঁটে হেঁটে নিজ বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। সেখানে তাকে দুজন ডাক্তার দেখভাল শুরু করেন, কিন্তু দুদিন পর ২৯ জুলাই তিনি পরপারে পাড়ি জমান। ছোট ভাই থিও ভ্যান গগের ভাষ্যমতে, তাঁর জীবনের শেষ বাক্যটি ছিল ‘লা ত্রিসতেসে দুরেরা তৌজুরস’, যার ইংরেজিতে অনুবাদ ‘This sadness will last forever’।

এভাবেই এক কীর্তিমান দুঃখী শিল্পীর প্রয়াণ ঘটে।

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop