যোগ কি? যোগাসনের উপকার, নিয়ম এবং প্রকার –
যোগ শব্দের অর্থ মিলন, জীবাত্মা সাথে পরমাত্মার মিলন। যোগ চার প্রকার জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, ধ্যানযোগ আর কর্মযোগ ।
যোগাসনের আবির্ভাব ভারতবর্ষে বহু প্রাচীনকালে। সেই পুরাণের সময় থেকে ভারতবর্ষে যোগাসনের চর্চা চলছে। আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রায় নিজেকে সুস্থ রাখতে যোগাসনের কোনো বিকল্প নেই। তাই সারা বিশ্বে যোগাসনের চর্চা চলছে। ডাক্তারি শাস্ত্রে যোগাসনের উপকারিতাগুলিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু যোগব্যায়াম চর্চার জন্য এ সম্পর্কে সবকিছু সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন, যেমন- যোগাসনের নিয়ম, যোগাসন পদ্ধতি, যোগাসনের উপকারিতা, ইত্যাদি।
জ্ঞানযোগ (সংস্কৃত: ज्ञान योग): বা “শুদ্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে যোগস্থাপন” হল হিন্দু যোগ দর্শনের একটি বিভাগ। সংস্কৃত ভাষায় “জ্ঞান” শব্দের অর্থ “জানা”। জ্ঞানযোগ হল নাম ও রূপের বাইরে গিয়ে পরম সত্যকে উপলব্ধি। জ্ঞানযোগ অনুসারে, এই উপলব্ধির মাধ্যমে মোক্ষ লাভ সম্ভব।
ভক্তিযোগ (সংস্কৃত: भक्ति): হিন্দুধর্মে উপাসনা তথা আরাধনার একটি বিশেষ রীতি। পূজনীয় দেবতা বা ব্যক্তির প্রতি বিশেষ অনুরাগ বা প্রেমকেই ভক্তি বলা হয়। ঈশ্বরের নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের নামই ভক্তি। ভালবাসিয়া তাঁহাকে পাইবার উপায় হচ্ছে ভক্তিযোগ ।
ধ্যানযোগ বা রাজযোগ: মনকে একাগ্র করিয়া তাঁহকে প্রত্যক্ষ করিবার চেষ্টাই হচ্ছে ধ্যানযোগ বা রাজযোগ ।
কর্মযোগ: সকল কর্মের ফল ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সমর্পণ করিয়া, নিষ্কামভাবে কর্তব্য সম্পাদন দ্বারা তাঁহাকে লাভ করাকে বলে কর্মযোগ ।
সব যোগের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবাত্মায় পরমাত্মার মিলন। একমাত্র ঈশ্বরকে লাভ করা।
অনেকের মতে যোগ ব্যায়াম হল এমন এক চর্চা যার মাধ্যমে দেহের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঠিক চালনা, যোগাযোগ ও সুস্থতা বজায় থাকে।
যোগ ব্যায়াম হল জীবনের সাথে প্রকৃতির যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার একটি মাধ্যম। তাই বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি ও নিশ্বাস প্রশ্বাসের চালনা দ্বারা প্রকৃতির বাস্তবতাকে শরীরের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায়। যোগ ব্যায়ামের দ্বারা প্রত্যেটি ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে জগতের সাথে ঘনিষ্টতা আনা সম্ভব হয়। আত্মবিশ্বাস ও সাত্ত্বিকতা খুঁজে পাওয়ার জন্যে যোগাসন করা খুবই প্রয়োজনীয়।
যোগাসনের উপকারিতা –
মানসিক ও শারীরিক চাপ কমিয়ে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়ার জন্যে যোগাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যোগাসন নানারকম ভাবে আপনাকে উপকার প্রদান করতে পারে।
যোগাসনের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য উপকারিতা –
অভ্যন্তরীণ ভাবে স্বাস্থ্যের উপকারিতা প্রদান করতে যোগাসনের ভূমিকা প্রবল। রক্ত সঞ্চালন থেকে শুরু করে শরীরের যেকোনো ব্যাথা বা কষ্ট কমাতে যোগ ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। আপনি যদি নিয়ম করে যোগাসন চর্চা করেন তাহলে অনায়সে শরীরে পরিবর্তন অনুভব করতে পারবেন।
১. রক্ত সঞ্চালন:
যোগাসনের সাহায্যে শরীরে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি সঠিকভাবে প্রবেশ করে। তাই রক্ত সঞ্চালন সঠিকভাবে বজায় রাখা যায়। এর ফলে সমস্ত অঙ্গগুলি ঠিক করে কাজ করে ও ত্বকে ঔজ্জ্বল্য আসে।
২. উচ্চ রক্তচাপ কমাতে:
প্রতিদিন নিয়ম করে যোগাসন করলে রক্ত সঞ্চালন ও অক্সিজেনের সঠিক চালনা হওয়ার ফলে উচ্চ রক্তচাপ কমে আসে। এতে শরীর ঠাণ্ডা হয়।
৩. শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির সমস্যা কমাতে:
হাঁপানির টান বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকলে যোগাসন করার অভ্যেস করুন। এতে ফুসফুসের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে সঠিক ছন্দে আসে ও আরাম পাওয়া যায়।
৪. গ্যাসের জন্যে ভাল:
প্রতিদিন যোগাসন করলে হজম ক্ষমতা বেড়ে যায় যার ফলে গ্যাসের সমস্যা সহজে সমাধান হয়। এছাড়া পেটের অন্যান্য সমস্যাও নিরাময় হয়।
৫. ধৈর্য্য শক্তি বাড়ে:
শরীরের নানারকমের ব্যাথা কমানো ছাড়াও, মস্তিস্ক শান্ত করতে সাহায্য করে যোগাসন। এর ফলে ধৈর্য্য ক্ষমতা বাড়ে ও মনের শান্তি বজায় থাকে।
৬. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে:
যোগাসন অভ্যাসের সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার যোগাযোগ রয়েছে। যোগাসনের সাহায্যে শরীরের কোষগুলি নষ্ট হওয়া রোধ করা যায় ও শরীর ধীরে ধীরে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফিরে পায়।
৭. শরীরে শক্তি ও সতেজতা আসে:
যোগাসনের মাধ্যমে শরীর নতুন করে শক্তি সঞ্চারিত হয় যার ফলে সতেজতা ফিরে আসে।
৮. পাচনতন্ত্রের বিকাশ:
পাচনতন্ত্র যত সঠিকভাবে কাজ করবে, ওজন নিয়ন্ত্রণ করাও তত সহজ হবে। যোগাসন করার ফলে পাচনতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।
৯. ঘুম সঠিক হয়:
যোগাসনের মাধ্যমে মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা হয় যার ফলে মেজাজ শান্ত থাকে। এর জন্যে আপনি চাপমুক্ত থাকতে পারেন ও রাতে অনিদ্রার সমস্যা কেটে যায়।
১০. কোলেস্টরল কমে আসে:
যোগাসনের ফলে হার্টের স্বাস্থ্য ভাল থাকে ও রক্ত সঞ্চালন ভাল হয়। এই সব কিছুর কারণে কোলেস্টরল অনায়াসে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ও ভালো কোলেস্টরল উৎপন্ন করা যায়।
১১. শরীরে সোডিয়াম নিয়ন্ত্রণে থাকে:
সোডিয়ামের অভাবে শরীরে নানারকমের সমস্যা দেখা যায় যেমন রক্তচাপ কমে যাওয়া, থাইরয়েড, ইত্যাদি। যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে সোডিয়াম নিয়ন্ত্রণে থাকে ও নানারকমের শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায়।
১২. ট্রাইগ্লিসারাইড কমিয়ে আনা যায়:
ট্রাইগ্লিসারাইড শরীরে বেড়ে গেলে ডায়াবেটিসের সমস্যা দেখা দেয়। তাই আজকাল ডাক্তাররা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষদের বিশেষ ধরণের যোগাসন করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন যার ফলে ট্রাইগ্লিসারাইড কমে আসে।
১৩. লাল রক্তকণিকা বাড়াতে সাহায্য করে:
লাল রক্তকণিকার পরিমাণ সঠিক থাকা অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সঠিক থাকা। এর ফলে এনিমিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। যোগাসনের সাহায্যে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় ও লাল রক্তকণিকা বাড়তে শুরু করে।
১৪. হার্টের অসুস্থতা কমে:
যোগাসনের দ্বারা শরীরের অক্সিজেনেশন অর্থাৎ শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ ভালো হয় যার ফলে হার্টবিটের রেট সঠিক থাকে। ফলে নানারকমের রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
১৫. এস্থেমা:
যোগাসনের দ্বারা শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকে ফলে শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির সমস্যা দূর হলে ফুসফুস সহজে কাজ করতে সক্ষম হয়। এর ফলে এস্থেমা বা ব্রঙ্কাইটিসের মত নানা সমস্যা সেরে যায়।
১৬. আর্থারাইটিস:
যোগাসন নানা ভঙ্গি ও দৈহিক কেরামতির দ্বারা করা হয় যার ফলে হাড়ের অনেক সমস্যা কমে যায় ও হার শক্ত হয়। এর ফলে আর্থ্রাইটিসে ভোগা মানুষদের জন্যে এটি খুব উপকারী।
১৭. ক্যান্সার:
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে যোগাসন নিয়মিত করলে শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষ ধ্বংস হয় ও উন্নতমানের কোষ গঠিত হয়। এতে ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা অনেকটা কমে যায়।
১৮. মাইগ্রেনের জন্যে ভাল:
মাইগ্রেন বা সাইনাসের মত নানারকমের নার্ভের সমস্যার কারণ হল অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ক্লান্তি ও চিন্তা। প্রতিদিন যোগ ব্যায়াম করলে স্নায়ু শান্ত হয় ও মাইগ্রেনের ব্যাথা নিয়াময় হয়।
১৯. ব্রঙ্কাইটিসের জন্যে ভাল:
ঠাণ্ডা লেগে শ্বাসকষ্ট, বুকে কফ জমে গেলে বা ব্রঙ্কাইটিস হলে মন দিয়ে যোগাসন করুন। খুব শীঘ্র ফলাফল পাবেন। এমনকি, রোজ যোগাসনের অভ্যেস করলে যাদের ব্রঙ্কাইটিসের ধাঁচ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এর প্রবণতা অনেকটা কমে আসে।
২০. কোষ্টকাঠিন্য:
নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করলে শরীরের নিচের অংশে দারুন চাপ পরে ও পাচনতন্ত্র সঠিক হয়। এর ফলে কোষ্টকাঠিন্য রোধ করা যায়।
২১. বন্ধ্যাত্ব বা রজোবন্ধ:
বন্ধ্যাত্বের কারণে যারা সন্তান জন্ম দিতে পারেনা, তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় যোগাসন খুব ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে থাকে। এমন অনেক যোগাসন আছে যা নিয়মিত করার ফলে বন্ধ্যাত্বের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া মহিলাদের রজোবন্ধ হওয়ার ফলে যেসব শারীরিক বা মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, সেগুলিও অনায়াসে সেরে যায়।
২২. সাইনাস বা অন্যান্য এলার্জি:
বায়ু দূষণ বা অন্যান্য যে কোনো কারণে আজকাল প্রায় সকলেরই সাইনাস বা এলার্জির সমস্যা দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রাণায়াম বা যোগাসন গুরুত্ব সহকারে করলে অনেকটা আরাম ও মুক্তি পাওয়া যায়।
২৩. পিঠে ব্যাথা কমায়:
পিঠে ব্যাথা কমাতে দারুণ উপকারিতা প্রদান করে যোগাসন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট পিঠ সোজা করে পদ্মাসন করলে খুব শিগ্রই পিঠের ব্যাথার উপশম হয়।
যোগাসনের বাহ্যিক স্বাস্থ্য উপকারিতা –
অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যের জন্যে যোগাসনের উপকারিতা তো আপনি এমনিতেই বুঝতে পারবেন। তবে যোগাসনের উপকারিতা বাহ্যিকভাবেও শরীরে নানারকমভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
১. দ্রুত বার্ধক্য থামায়:
বয়স বাড়লেই যে শরীরে বার্ধক্যর ছাপ আসতে হবে তা নয়। যোগাসনের মাধ্যমে শরীরে ডিটক্সিফিকেশন করা যায় যার ফলে বার্ধক্য শরীরে ছাপ ফেলে না। যোগাসনের ফলে মানসিক চাপও কম হয় যা মনকেও সতেজ রাখতে সাহায্য করে।
২. শক্তি প্রদান করে:
যোগাসন করলে শরীরের সবকটি অংশে সঠিকভাবে অক্সিজেন পৌঁছায়, ফলে শরীরে শক্তি থাকে ও কর্মক্ষমতা বজায় থাকে।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণ করে:
যোগাসনের ফলে পাচনতন্ত্র ভালো হয় ফলে ওজন কমে।
৪. শরীরের যাবতীয় কার্যকারিতা:
যোগাসনের অর্থ হল শরীরের সমস্ত অংশকে প্রকৃতির সাথে আত্মস্থ করা। এর ফলে শরীরের চালনা ও উৎফুল্লতা বজায় থাকে।
৫. শরীরকে ভেতর থেকে শক্ত রাখে:
শরীর ভেতর থেকে শক্ত থাকলে সবসময় সুস্থ থাকা যায়। এর ফলে শরীর নিজের ওজন ধরে রাখতে পারে এবং কোনোরকম ব্যাথা বা জ্বালা হলে নিজে থেকে সারিয়ে তুলতে পারে।
৬. মাংসপেশী টানটান করে:
প্রতিদিন যোগাসন করার ফলে শরীরের মাংসপেশি শক্ত পোক্ত হয় ও সুন্দরভাবে টানটান হয়ে যায় যা শারীরিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে।
৭. দেহের সহনশীলতা বাড়ায়:
শরীর ভেতর থেকে শক্তপোক্ত থাকলে শরীরের সহনশীলতা বাড়ে। এটি বিশেষ করে খেলোয়াড়দের জন্যে খুব প্রয়োজনীয়। যোগাসন শরীরের সহনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
যোগাসনের মানসিক স্বাস্থ্য উপকারিতা –
শরীর ও মনের মধ্যে একটি অসাধারণ যোগসূত্র তৈরী করে যোগাসন। এর ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যেও যোগাসনের উপকারিতা অতুলনীয়। দেখে নেওয়া যাক:
১. মেজাজ ফুরফুরে রাখে:
যোগাসন করলে শরীর ও মনে একটা আলাদা সতেজতা ও ঔজ্বল্ল্য ফুটে ওঠে যা খুব সহজেই মেজাজ ফুরফুরে করে রাখে।
২. মানসিক চাপ কমায়:
নিয়মিত যোগাসন করার ফলে মানসিক চাপ ও ক্লান্তিভাব নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে মানসিক চাপ কম হয়।
৩. উত্তেজনা কমায়:
নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঠিক নিয়ন্ত্রণের ফলে উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তা কমে আসে ও মন ভালো থাকে।
৪. বিষন্নতা কমায়:
মনের কষ্ট বা বিষন্নতা দূর করার অসাধারণ উপায় হল যোগাসন। বিষন্নতা বোধ করলে চোখ বন্ধ করে যোগাসন অভ্যাস করলে বিষন্নতা বোধ কমে।
৫. আত্মসংযমবোধ বাড়ায়:
জীবনে বেঁচে থাকার জন্য আত্মসংযমবোধ থাকা খুবই প্রয়োজনীয়। যোগাসনের মাধ্যমে মনের জোর বাড়ে ও তার সাথে আত্মসংযম বোধ বাড়ে।
৬. মনোযোগ বাড়ায়:
মাত্র আট সপ্তাহ যোগাসন চর্চা বা অনুশীলন করলেই মনোযোগিতা বাড়ে। এটি ছাত্রদের জন্য খুব উপযোগী।
৭. স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে তোলে:
যোগাসন করে শরীরে শান্তভাব কমে, মনোসংযোগ বাড়ে ফলে স্মৃতিশক্তি ও মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৮. নিখুঁতভাবে কাজ করার ক্ষমতা:
যোগাসন করার সময় আপনি যেভাবে নিখুঁত ভাবে প্রত্যেকটি নিয়ম ও পরামর্শ মেনে চলেন, তার জন্যে আপনার অন্যান্য জিনিস বা বিষয়ের প্রতিও এই একই রকমের নিখুঁতভাবে সবকিছু খোঁজার ও জানার ক্ষমতা বজায় থাকে।
৯. জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী:
প্রতিদিন যোগ ব্যায়াম অনুশীলন করার ফলে স্নায়ুগুলি সজাগ হয় ও শক্তিপ্রদানকারী হরমোন উৎপন্ন হয়। এর নেতিবাচক মনোভাব, বিষণ্নতা দূর হয়ে জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিশক্তি তৈরি হয় কাজের উদ্যম বাড়ে।U
যোগাসন কয় প্রকার
গোটা পৃথিবীতে মোট ১৪ রকমের যোগাসন চর্চা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ যোগাসন মোট ১৪ প্রকারের হয়ে থাকে:
১. হস্ত যোগাসন- এটি সাধারণত শরীরে স্বস্তি ও মস্তিস্ককে আরাম প্রদান করে থাকে। পিঠ টানটান করে সোজা হয়ে বসে হাত দুটো ওপর দিকে করে জড়ো করে এটি করা হয়ে থাকে।
২. আয়েঙ্গার যোগাসন- এতে পদ্মাসনকে বোঝানো হয়। মস্তিষ্কে শান্তি ও চাপ কমাতে এটি খুব কার্যকরী।
৩. কুন্ডলিনী যোগাসন- তন্ত্র ও ধ্যানের মাধ্যমে সাধনা করে নিজের অন্তরের কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগিয়ে তোলার নাম হল কুণ্ডলিনী যোগাসন। এর দ্বারা মনের জোর ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
৪. অষ্টাঙ্গনা যোগাসন- এই ধরণের যোগাসনে বেশ শারীরিক পরিচর্যা ও ব্যায়াম হয়ে থাকে। এতে ওজন কমানো ও নানারকমের শক্তি পরিচর্চযা করা যায়।
৫. বিনায়ক যোগাসন- এটি ভারতবর্ষের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে করা হয় যা বিশেষ করে বিনায়ক মহাবিদ্যালয় থেকে প্রচারিত।
৬. বিক্রম যোগাসন- এই যোগাসনে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি দ্বারা গভীর নিশ্বাস নিয়ে একটি গরম তাপমাত্রার ঘরে অনুশীলন করা হয়।
৭. হট যোগাসন- বিক্রম যোগাসনের মত হট যোগাসনও গরম তাপমাত্রায় করা হয়, কিন্তু তার জন্যে যে কোনো গরম তাপমাত্রার ঘর প্রয়োজন তা নাও হতে পারে।
৮. কৃপালু যোগাসন- এটি অনেকটা হাত যোগাসনের মত। কৃপালু যোগাসনে ভগবানকে স্মরণ করে সাধনা করা হয়।
৯. জীবমুক্তি যোগাসন- ভক্তি, অহিংসা ও ধ্যান বাড়ানোর জন্যে যেই শারীরিক, নৈতিক ও আধ্যাতিক যোগাসন করা হয় তাকে বলা হয় জীবনমুক্তি যোগাসন।
১০. ইন যোগাসন- এই যোগাসন একটু ধীর গতিতে অনেক্ষন সময় নিয়ে করা হয়।
১১. রেস্টোরেটিভ যোগাসন- নতুন করে নিজের দৈহিক ও মানসিক স্থিতিকে আবিষ্কার করে সেই পথে এগোনোর নাম হল রেস্টোরেটিভ যোগাসন।
১২. মাতৃত্ব পূর্ব যোগাসন- এই ধরণের যোগাসন গর্ভাবস্থার আগে বা গর্ভাবস্থার সময় করা হয় যার ফলে পরবর্তীকালে একটি সুস্থ সবল শিশু জন্মায় ও মায়ের শারীরিক অবস্থা ভাল থাকে।
১৩. অনুসরা যোগাসন- এই যোগাসনের মাধ্যমে আধ্যাতিক চিন্তাভাবনা বাড়িয়ে তোলা হয়।
১৪. অন্যান্য অদ্ভুত প্রকারের যোগাসন- এমন অনেক যোগাসন রয়েছে যা অন্যান্য যোগাসনের তুলনায় একটু অদ্ভুত কিন্তু বেশ প্রচলিত। যেমন মধু বা মোদের সাহায্যে যোগাসন, হাসি বা কান্নার মাধ্যমে যোগাসন, কোনো পশু বা পাখির সাহায্যে যোগাসন, ইত্যাদি।
যোগাসনের নিয়ম –
যোগাসন করার কিছু বিশেষ নিয়ম রয়েছে । নিচে প্রয়োজনীয় নিয়মগুলি বিস্তারিত ভাবে দেওয়া হল:
সঠিক পোশাক
ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোষাক পরে যোগাসন করতে হয়। তার সাথে অবশ্যই দরকার একটি যোগাসন করার ম্যাট যার ওপরে বসে অনুশীলন করতে হবে। যোগাসন সবসময় খালি পায়ে করা উচিত
খাওয়ার নিয়ম
খেয়াল রাখতে হবে যেন যোগাসন করার আগে পেট খালি থাকে। অর্থাৎ যোগাসন করার অন্তত ২ থেকে ৪ ঘণ্টা আগে খাবার খাওয়া যায় এবং হয়ে যাওয়া ২ ঘণ্টা পর খাওয়া যায়। না’হলে শরীরে অস্বস্তি হতে পারে।
নিঃশ্বাস প্রশ্বাস
যোগাসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ শেখার বিষয় হল নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল রাখা তাতে ফল পাওয়া যায়।
জোর না করা
জোর করে না করে ধীরে ধীরে করা উচিৎ নাহলে শরীরে ব্যাথা আরো বেড়ে যাবে।
ওজন কোনো বাধা নয়
অনেকের ধারণা, যোগাসন করতে গেলে খুব সাবলীল ও রোগ শরীর প্রয়োজন হয়। কিন্তু একথা একেবারে ভুল। আপনার ওজন যাই হোক না কেন, আপনি তা নিয়েই নিজের সুবিধা মত যোগাসন করতে পারেন।
যোগাসন করার সঠিক সময়-
বৈজ্ঞানিকভাবে যোগাসনের সঠিক সময় ভোর ৩:৪০। এছাড়া, সূর্য ওঠার সময় যোগাসন করা হল সব থেকে ভাল সময়। ভোরের শীতল ও সতেজ আবহাওয়ায় শ্বাস নিলে শরীর ও মন দুটিই সতেজ থাকে। এর ফলে আপনার সারাদিনের কাজকর্ম ভালোমত এগোবে।
সকালবেলায় মন মেজাজ সব থেকে ঠাণ্ডা ও শান্ত থাকে ও তার সাথে মস্তিস্ক পুরোপুরি সতেজ থাকে। ঘুম থেকে উঠে সকালের প্রাতঃকর্ম সেরে মুখ ধুয়ে যোগাসন শুরু করে দিন। ধীরে ধীরে মাংসপেশি গুলি টানটান করুন, দেখবেন শরীর হালকা হতে শুরু করেছে।প্রকৃতির সাথে আত্মস্ত হওয়ার সব থেকে পবিত্র ও ভাল সময় হল ভোরবেলা।
যোগব্যায়াম করার আগে নীচের বিষয়গুলি অবশ্যই দেখতে হবে:
পোশাক
যোগাসনের পোশাক হওয়া উচিত ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক। এর সাহায্যে আপনি যোগব্যায়ামের যেকোনো ভঙ্গি করতে পারবেন। এই সময় শরীরে কোনোরকম অলঙ্কার বা গয়না এবং চশমা পরে থাকবেন না।
সময়
ভোর ৫টা থেকে সকাল ৭টা হল যোগাসন করার সঠিক সময় কারণ এই সময় আপনি প্রকৃতির পবিত্র, শীতল ও পরিষ্কার বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারবেন। এর ফলে আপনার মন ও মেজাজ সারাদিন ফুরফুরে থাকবে।
যোগাসনের সঠিক পরিবেশ
ঘরে হোক বা বাইরে, কোনো পার্কে হোক বা সংস্থায়, দেখে নেবেন যেই জায়গায় আপনি যোগাসন করতে বসছে সেটি যেন শান্তিপূর্ণ ও পরিষ্কার হয়। এমন জায়গায় যোগাসন করবেন না যেখানে প্রচুর পরিমানে সূর্যের তাপ বা কনকনে ঠাণ্ডা থাকে।
যোগব্যায়ামের সময় মানসিক স্থিতি কেমন হওয়া উচিত –
একথা আগেই বলা হয়েছে যে যোগ ব্যায়াম হল মন ও শরীরের মিলিত হওয়ার একটি মাধ্যম যার দ্বারা প্রকৃতির সাথে আত্মস্ত হওয়া যায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই যোগাসন করার আগে মানসিক স্থিতির অবস্থা ভীষণভাবেই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা নেয়। যোগাসনের পূর্ব এই নিয়মগুলি অবশ্যই মনে রাখতে হবে:
যোগ ব্যায়াম করার আগে জীবনে চলা সমস্ত দুশ্চিন্তা বা নেতিবাচক চিন্তাগুলো দূরে রেখা শুধু ভালো চিন্তা করুন।
জোর করে শুধুমাত্র নিয়মিত যোগাসন করতে হবে বলেই যে যোগাসন করতে বসছেন সেটি করবেন না। মনের মধ্যে সম্পূর্ণ ইচ্ছে ও ভালো লাগা নিয়েই যোগাসন করতে বসুন।
তাড়াহুড়ো করে যোগ ব্যায়াম করবেন না। তাতে কোনো ফলাফল পাবেন না। ধীরে ধীরে নিশ্বাস প্রশ্বাস ফেলে যোগ ব্যায়াম করুন।
শরীর অসুস্থ বিপদ করলে যোগাসন করার প্রয়োজন নেই। সুস্থ শরীর ও মন যোগাসনের জন্যে খুব প্রয়োজনীয়।
যোগাসনের নিয়ম গুলি পর পর মেনে যোগ ব্যায়াম করুন। অর্থাৎ প্রথমে আসন করুন, তারপর প্রাণায়াম, তারপর ধ্যান এবপং অবশেষে যোগ নিদ্রা সেরে প্রস্থান করুন।
যোগাসন করার আরো কিছু টিপস
যোগাসন করে যাতে আপনি সম্পূর্ণ ইতিবাচক ফলাফল পান তার জন্যে আপনার কাছে রইলো আরো কিছু টিপস। আসুন দেখে নিন:
ভুল কারণে হঠাৎ করে ছেড়ে দেবেন না
খাওয়া দাওয়ার দিকে খেয়াল রাখুন
সাবধানতা:
যোগাসন করার সময় নিম্নলিখিত কিছু কিছু সাবধানতা অবশ্যই অবলম্বন করা উচিত:
শিক্ষক বা ডাক্তারের পরামর্শ
যোগব্যায়াম শুরু করতে যাওয়ার আগে আপনি কোনোরকম ডাক্তারের চিকিৎসার অধীনে থেকে থাকেন, তাঁর পরামর্শ নিয়ে নেবেন। আপনার শিক্ষক আপনার শরীরের গঠন ও ধাঁচ অনুযায়ী সব থেকে ভালো করে বলতে পারবেন যে আপনার ঠিক কোন কোন যোগ ব্যায়ামগুলো করা উচিত ও কোনগুলি নয়। অযথা ব্যায়ামের ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
গর্ভাবস্থা বা মাসিকের সময়
মাসিকের সময় অতিরিক্ত যোগাসন করা নিষেধ। যদি একান্তই করতে হয়, শুধুমাত্র আসন করে বসে সোজা হয়ে পিঠ ও কোমরে আরাম পাওয়া যায় এমন যোগাসনই করুন। আবার গর্ভাবস্থার সময় যদি মনে করে থাকেন যে যোগাসন করবেন তাহলে তার আগে ডাক্তারের সাথে ভাল করে পরামর্শ করুন। যদি আপনি আগে থেকে যোগাসন করে থাকেন ও জানতে পারেন যে আপনি গর্ভবতী, তাহলে নিজের শিক্ষককে আগে সেটা জানিয়ে দিন।
বয়স ও শরীরের দিকে খেয়াল রাখুন
যোগাসন করা যতই ভাল হোক না কেন, নিজের বয়স ও শরীরের অবস্থা লক্ষ্য রেখেই এগোনো উচিত। বয়স ও শরীর অনুযায়ী যেই যেই যোগ ব্যায়াম আপনার জন্যে ঠিক হবে, সেগুলির বাইরে কোনো কিছু করতে যাবেন না।
আজকের এই পোস্ট থেকে একথা নিশ্চিত যে যে কোনো মানুষের জন্যেই যোগাসনের ভূমিকা প্রচুর। তাই আজ থেকে যোগাসনের উপকারিতা পাওয়ার জন্যে আপনার শুরু করা উচিত যোগব্যায়াম। সাবধানতা ও নিয়ম মেনে চললে কোনো জিনিসই জীবনে থেমে থাকে না। তার ওপর যোগাসন করে যদি আপনি মন ও শরীর দুটির দিক থেকেই ভালো থাকতে পারেন তাহলে দেরি কিসের।
সায়মা সাফীজ সুমি
ফাউন্ডার প্রশান্তি
মেডিটেশন টিচার আর্ট অব লিভিং
রেইকি মাস্টার হিলার
স্বেচ্ছাসেবক অরিত্রী
স্বেচ্ছাসেবক ক্যান্সার পেসেন্ট এবং ক্যান্সার পরিবার
* সূত্র: অনলাইন