বাবা,
কিছু ক্ষয় নিয়ে তোমার কাছে গিয়েছিলাম – যাবতীয় বিশ্বাসকে উপঢৌকন করে। আশ্রয় হবে ভেবে। মা বাবা অথবা বন্ধু ছাড়াও আরেক আশ্রয় থাকে যার নাম বিশ্বাস। ঘরবাড়ি ছাড়াও বিশ্বাস বাঁচে, বিশ্বাস নিজেই তো একটা বিরাট আশ্রয়! অথচ আমার আশ্রয় হয়নি ওখানে। যখন টিনের চালের ঘর ছিলো তখন আশ্রয় চাইতে হয়নি। এখন চেয়েও হলো না! এই আক্ষেপ দানা বাঁধা পাথরের থেকেও ভারী, নাড়ানো যায় না। বুকের ভেতর চেঁপে থাকে আহর্নিশ।
আমাদের জীবনে সবথেকে বেশি পরিমাণে ধাক্কাগুলো আসে কাছের মানুষগুলোর কাছ থেকে; পরিবার থেকে। প্রত্যেকের প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় অবদানও পরিবারের। সে ছেলে হোক বা মেয়ে। আর সেই স্থানে শক্ত ভূমিকা বাবার।
সমাজের ভূমিকা পরে।সমাজের প্রতিষ্ঠাতা তো এককজন বাবা-ই। সামাজিকতা তাঁদেরই হাতে। পুত্রসন্তান কন্যাসন্তানের বৈষম্যটাও তাঁদের বিচারে। এই বৈষম্য ভাঙবে কে ? সম্ভব নয় ভাঙা? হয়তো না। এ বৈষম্য অন্তর্গত। একদমই ভেতরের।
মায়ের ভালোবাসা, দোয়া আর বাবার ভুমিকা; এ দু্ইই ব্যক্তির প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রবিন্দু। উল্টো হলেই ভেঙ্গে পড়া জীবন। সারা জীবন অ-জীবন হয়ে যাওয়া মানুষ; ঠিক আমার মতো—–
বাবা,
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে সৃষ্টি হয় কতক প্রশ্ন। প্রশ্ন ক্ষত বিক্ষত করে দুপাশের দেয়াল। প্রশ্নকে সামনে নিয়েই এগোচ্ছি, এগোচ্ছি বিক্ষত বৃষ্টির ফোঁটা মাড়িয়ে। বৃষ্টির জলেও স্রোত বয় তা অঢেল হলে। চতুর্পাশ থেকে স্রোত এসে ধাক্কা দেয়। এসময়ে হাত পা ছেড়ে দিয়ে চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া কিচ্ছু করার থাকে না। যারা বাইরে থেকে ব্যাপারটা দেখে, তাদের কাছে বোকামি কিংবা নির্বুদ্ধিতা মনে হতে পারে। কিন্তু এমন স্রোতের মধ্যে পড়লে বোঝা যায়— অসহায়ত্ব কতখানি, তা কেমন।
বাবা,
অতীত মাঝে মধ্যে খুব মনে পড়ে। জেঁকে বসে বুকের উপর। সীমারের মতো। কণ্ঠ আটকে ধরে উদ্যোত তলোয়ার নিয়ে! এই বিরাট পৃথিবীতে অতীতই শুধু ছেড়ে যায়নি আমায়। বড্ড আপন হয়ে আছে। এরকম একদিনের কথা প্রায়ই খুব মনে পড়ে। সেই রাতে বুকে বড্ড ব্যথা হলো, ছাড়ছে না কিছুতেই। বাম হাতের ব্যথা নাকি হৃৎপিন্ড নির্ভর ; এই ব্যথাটা ইদানিং প্রায়ই ভোগায়। বাম হাত সারারাত প্রায় অকেজো হয়েই ছিল- কোলের ভিতর। মধ্যরাত অবদি ভুলে থাকার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছি। খুব ভোরে ব্যথা আর অকেজো প্রায় হাত নিয়ে অস্বস্তিতে ঘুমটা চলে গেছে। সকালে সচারচর ফোন করো না, আজ যে ফোন করলে ! উতলা পরিচিত কন্ঠ-
” বাবু, শরীরটা ভাল আছে তো ?” প্রবল চেষ্টায় শক্ত কন্ঠে বলতে চাইলাম, হ্যা ভাল আছি। কিন্তু কয়েকবার এই একই প্রশ্ন করলে কেন বাবা ? আমি ফোনটা রেখে দিলাম। খানিক পরে আবার ফোন – সেই একই প্রশ্ন, খুব উদ্বিগ্নতা কন্ঠে – ” বাবু, তোমার শরীরটা খারাপ না তো ? গলাটা কেমন লাগছে যে !” আমি গলা শক্ত করে বলতে চাইলাম, না খারাপ নেই তো, ভাল আছি আমি।
চায়ের দোকানে তোমার আশেপাশে কত মানুষের কথার আওয়াজ। তাদের সবার খবর তোমার জানা চায়; তাদের অভাবের কথা, কষ্টের কথা, কত না পাওয়ার কথা। কিন্তু আমার কোন কথা তো বলিনি তোমাকে, তবু তুমি কি করে বুঝে নাও বাবা; এত না বলা কথা ? ভেতরের এই বন্ধ কুঠুরিতে কোন আওয়াজ হয়না কখনো। কিন্তু তুমি এমন করে কথা বললেই ভেতরে কি যেনো নড়ে চড়ে ওঠে। তখন টের পাই খুব, ভেতরে মমতা নামক বস্তুটা এখনো বেঁচে আছে ! এই বেঁচে থাকার অনেক কষ্ট যে বাবা। তা তোমাকে কোনদিন বলতে পারিনি।
বাবা,
কতদিন সেই পরিচিত কণ্ঠের জন্যে টানটান হয়ে আছে প্রাণ। যতবার ফোন আসে উদগ্রিব চোখে তাকাই, নাহ্ অচেনা নম্বর ভাসে। ‘বাবা’ লেখাটি আসে না কেনো? না আসুক। ফুরিয়ে গেছি আমি সময়ের ভীড়ে অসংখ্য অভিমানে অথবা অভিযোগের চাপে। তাও মেনে নিয়েছি এখন। কিন্তু আমার বাবার জন্যে আমার অনেক গর্ব হয়, আবার তখন আমার পড়ে থাকা প্রাণ কথা বলতে চায়। পা বাড়াই সামনে। প্রতিটা ফোনের শাব্দের সাথে সাথে তোমার কণ্ঠের অপেক্ষা করি।প্রতিনিয়ত কান পেতে রই —
— ইতি
তোমার ফুরিয়ে যাওয়া আদরের কন্যা ‘শিল্পী’।
বি.দ্র. : বাবা, একটা কথা ভীষণ ভাবে বলতে ইচ্ছে করে। কখনও বলা হয়নি। আমার হৃৎপিন্ডের সাথে তোমাদের কি গোপনে কথা হতো? না হলে আমার অসুখকে আমি বুঝতে চাই না, তোমরা বুঝে ফেলতে কি করে? তুমি কি করে বুঝে ফেলতে আমার হৃৎপিণ্ডের ব্যথা! আবার তাই যদি হয়, তাহলে এখন যে ব্যথায় শুধু হৃৎপিণ্ড নয়, ফুসফুস, যকৃৎ, কণ্ঠ, হাত পা সারা শরীর যে ব্যথায় মরে যাচ্ছে। একবারও মনে হচ্ছে না কেনো?