মিথের পুনর্নির্মাণ : পিতা – শিল্পী এবং সন্ধিৎসু পরবর্তী প্রজন্মভাবনায় শামসুর রাহমান – অনীত রায়
মিথের পুনর্নির্মাণ : পিতা – শিল্পী এবং সন্ধিৎসু পরবর্তী প্রজন্মভাবনায় শামসুর রাহমান
অনীত রায়
ডেডেলাস ও ইকারুস গ্রিক পুরাণের দুই চরিত্র। ডেডেলাস গ্রিসের ক্রিট দ্বীপের একজন প্রখ্যাত স্থপতি এবং নির্মাণশিল্পী। ইকারুস তাঁর সন্তান। শিশুকাল থেকেই অজানার প্রতি আকর্ষণ, আকাশে ডানা মেলে দেওয়া, সূর্যকে জানা ছিল তাঁর অপার কৌতূহলের বিষয়। জ্ঞানপিপাসা মানেই অন্ধকারের মধ্যে ঝাঁপ দেওয়া। বিপদের ঝুঁকি সেখানে অনিবার্য।
সূর্যকে জানবেন ইকারুস। তাই বাবাকে বলেছিলেন পিঠে দুটো ডানা লাগিয়ে দেবার জন্য। ডানা বানিয়ে দিয়েছিলেন বাবা মোম আর পালক দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে সচেতন করে দিয়েছিলেন, ‘তুমি আকাশে ওড়ো কিন্তু সূর্যের কাছে যেও না কখনো।’আকাশে উড়বেন, অথচ সূর্যকে জানবার ইচ্ছাকে দমন করে রাখবেন, তা কী করে হয়! উড়তে উড়তেই একসময় পৌঁছে গেলেন সূর্যের কাছে। সূর্যকে জানতেই হবে তাঁকে।আমরা কি ভারতীয় ভাবনায় সূর্যেরও উপাস্য ভর্গোদেবকে জানবার জন্য ধ্যানমগ্ন হবার ইঙ্গিত পাচ্ছি! অথবা ইকারুসকে দেখতে পাচ্ছি রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে!ইকারুস বাবার তৈরি করে দেওয়া ডানায় ভর করে সূর্যকে ছুতে পারেন নি হয়তো, কিন্তু অসংখ্য ইকারুসের মনে সূর্যসন্ধিৎসার জন্ম দিয়ে গ্যাছেন।আর বাবা ডেডেলাস সন্তানের সন্ধিৎসায় একদিকে শঙ্কায় অন্যদিকে বিস্মিত আনন্দে তাকিয়ে থেকেছেন পরবর্তী প্রজন্মের সন্ধিৎসু হৃদয়ের দিকে।মিথ অর্থাৎ লোকপুরাণ পৃথিবীর সমস্ত দেশের এক একটি ঋদ্ধ সম্পদ। প্রতিটি দেশের নিজস্ব একটা সংস্কৃতিভাবনা দর্শন সেই দেশের মানুষের আচার-আচরণ জীবনধারণ পদ্ধতি বাবা-মা ছেলে মেয়ের সম্পর্ক ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে তাদের জীবনভাবনাকে প্রকাশিত করে। আমরা দেখেছি, গ্রিক পুরাণ মিশরীয় পুরাণ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান পুরাণ পারস্য পুরাণ, বিভিন্ন দেশের পুরান তাদের দেশের জল হাওয়া মাটি তাদের সংস্কৃতি সর্বোপরি তাদের জীবন ভাবনাকে কোন না কোন ভাবে প্রকাশ করে কখনো কখনো একটু ঋদ্ধ গল্পের মধ্যে দিয়ে, কখনো কখনো আপাত-অলৌকিক কোন গল্পের পরিকাঠামোর মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ জীবন ভাবনাকে প্রকাশ করে থাকে। গ্রিক পুরাণ এমনই একটি পুরাণ, যেখানে গ্রিস রোমান পারস্য মিশর, বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির ভাবনার আদান-প্রদান বিভিন্ন ভাবে মিশে রয়েছে। আমরা দেখেছি পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই প্রতিটি সমাজেই মানুষের মধ্যে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রবহমান রাখবার ইচ্ছে এবং নিজের সন্ধিৎসাকে সন্তানসন্ততির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বাসনা প্রতিটি পিতা-মাতার মধ্যেই থাকে।আমরা শামসুর রাহমানকে দেখেছি গ্রিক মিথ কে নতুন করে তৈরি করছেন। পিতা-সন্তান সম্পর্কের মধ্যে চিরন্তন যে একটি সম্পর্ক আছে সেই সম্পর্ক এখানে ধরেছেন কবি ‘ডেডেলাস’ এবং ‘ইকারুসের আকাশ’ এই দুটি কবিতার মধ্যে দিয়ে। আমরা দেখছি একজন শিল্পী, তিনি আবার পিতা এবং স্থপতি, সেই পিতা এবং স্থপতির মনের মধ্যে শিল্পীসত্তা চিরন্তন, সেই সত্তাটিকে তিনি প্রবহমাণ করতে চাইছেন তাঁর সন্তানের মধ্যে। আমরা প্রত্যেকেই জানি, পিতা তাঁর সাধ্যমত তাঁর শিল্প-সংস্কৃতির চেতনা তাঁর সন্তান-সন্ততির মধ্যে দেখতে চান কখনো প্রত্যক্ষ কখনও পরোক্ষভাবে। ইকারুসের মধ্যে শিল্পীসত্তা যেমন করে দেখতে চেয়েছিলেন ডেডেলাস তাঁর সন্তানের মধ্যে। আবার এটাও তিনি খুব ভালো করেই জানতেন যে, যে কোনো মানুষকেই শিল্প-সংস্কৃতির পথে যদি এগিয়ে যেতে হয়, তাহলে তাকে পার হতে হয় অনেক বাধা বিপত্তি। শিল্প-সংস্কৃতিকে জানা মানেই সত্যকে জানা, আর সত্যকে জানা মানেই হচ্ছে সূর্যের মতো কঠোর কঠিন একটা সত্যের মুখোমুখি হওয়া। এই কথা জানেন বলেই শিল্পী পিতা যখন সন্তানের মধ্যে তাঁর সংস্কৃতিচেতনা প্রবাহিত করে দিতে চাইছেন সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে সচেতন করে দেওয়ার মানসিকতাও কাজ করছে। অর্থাৎ যেন এ কথাই বলে দেওয়া, তোমাকে সত্যকে জানতে হবে, সত্যকে জানতে হলে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে, আর কঠিন পথ পাড়ি দিতে হলে তোমাকে প্রতি মুহূর্তে সচেতন থাকতে হবে, বিনষ্টির সম্ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবার সচেতন প্রয়াসও পেতে হবে। আমরা যখন কবিতার প্রথমেই ডেডেলাসের জবানিতে শুনি :
না, আমি বিলাপ করব না তার জন্য, যে আমার
নিজের একান্ত অংশ, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ; যাকে আমি
দেখেছি উঠোনে হাঁটি – হাঁটি পা – পা হেঁটে যেতে
আনন্দের মতো বহুবার।
অথবা যখন বলেন :
না, আমি বিলাপ করব না তার জন্য, স্মৃতি যার
মোমের মতন গলে আমার সত্তায়, চেতনায়।
সর্বদা সতর্ক আমি, বিপদের গন্ধ সিদ্ধ, তাই
বুঝিয়েছিলাম তাকে সাবধানী হতে,
যেন সে না যায় উড়ে পেরিয়ে বিপদসীমা কখনো আকাশে।
এই অংশটুকু ভালো করে লক্ষ করলেই আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি,ডেডেলাস একদিকে শিল্পী আর একদিকে তাঁর মধ্যে কাজ করছে পিতৃহৃদয়। শিল্পীমন চাইছে , তাঁর সন্তান এগিয়ে যাবে শিল্পের সন্ধানে শিল্পেও গড়ার লক্ষ্যে, তখন সে সন্ধিৎসু হবে, আর পিতৃহৃদয় চাইছে, শিল্প করতে গিয়ে তাকে যেন জীবনের ঝুঁকি নিতে না হইয়। সেই জন্য তাকে প্রতিমুহূর্তে সতর্ক করে দিতেও চাইছেন। এইখানে ডেডেলাসের পিতৃসত্তা কীভাবে কাজ করে এবং পিতৃসত্তা আর শিল্পীসত্তার দ্বান্দ্বিকতা, শিল্পের নান্দনিকতা, নানারকম দিকগুলোও তিনি ধরিয়ে দিতে চান। তিনি বলছেন যে, যে শিল্পী সন্ধিৎসু সন্তান তাঁর পিঠে শিশু হিশেবে বসেছে ক্ষুদে অশ্বারোহীর মতো। তাঁর সান্নিধ্যেই বেড়ে উঠেছে সেই শিশুকাল থেকেই, কখনও কখনও এই শিশুর মধ্যেই তিনি দেখেছেন একটা সন্ধিৎসু মন, একটা শিল্পচেতনার মানসিকতা। এই মানসিকতা গড়ে উঠেছে কেমনভাবে সেই প্রক্রিয়াটাও ধরাচ্ছেন শামসুর রহমান। বলছেন :
কোন কোন দিন স্থাপত্যের গূঢ় সূত্র-বিষয়ক চিন্তার সময়
অকস্মাত্ দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে আমার শয্যার পাশে
সুকান্ত তরুণ;
ইকারুস, ইকারুস বলে ডাকলেই উজ্জীবিত
দেবে সাড়া।।
কী আশ্চর্য রকমভাবে শামসুর রাহমান একদিকে পিতৃসত্তা আরেকদিকে সেই পিতৃসত্তার সঙ্গে সন্তানের সত্তা, তাদের সহমর্মিতাকে ধরিয়ে তুলছে সেই শিশু। তখনও তার মধ্যে হয়ত তেমন কোনো চেতনার বিকাশ হয় নি, অথচ এই শিশুর মধ্যেই শিশুমন এবং শিল্পীসত্তা যে কাজ করছে, সেটা শামসুর রাহমান আশ্চর্যভাবে ধরিয়ে দিয়েছেন ঐ কথাগুলোর মধ্যে। ইকারুস ইকারুস বলে ডাকলেই উজ্জীবিত দেবে সাড়া, কিন্তু তিনি ভালো করেই জানেন ডেডেলাস একজন পিতা। এখানে শামসুর রাহমান এবং ডেডেলাস যেন একাত্ম হয়ে যাচ্ছেন। শামসুর রহমান যেমন করে বোঝেন তাঁর সন্তানের বিপন্নতার কথা ডেডেলাসরূপী শামসুর রহমানও যেন বোঝেন ঠিক তেমন করেই। তাই বলে উঠছেন :
না, আমি বিলাপ করব না তার জন্য, স্মৃতি যার
মোমের মতো গলে আমার সত্তায়, চেতনায়
ডেডেলাস যেমন করে তাঁর সন্তানের মধ্যে স্বপ্ন গড়ে দিয়েছিলেন ঠিক সেই রকমই শামসুর রাহমান যেন তার সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে স্বপ্ন দেখার জন্য ডানা মেলে ওড়বার স্বপ্নটাকে ধরিয়ে দিতে চাইছেন। এই ভাবনা সঞ্চারিত হয়েছে কবিতাটির মধ্যে আর শামসুর রাহমান পিতৃহৃদয় থেকেই জানেন যে, পরবর্তী প্রজন্ম আরো নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার দিকেই এগিয়ে যাবে। তাই সেখানে পিতার সাবধান বাণী বা চেতাবনি থাকলেও সন্তান তার নিজের মত করে সামনে এগিয়ে যাবার পথ খুঁজবেই। তাই শামসুর রাহমানের ডেডেলাস বলেন :
বুঝিয়েছিলাম তাকে সাবধানী হতে,
যেন সে না যায় পেরিয়ে বিপদসীমা কখনো আকাশে।
কিন্তু পিতা ডেডেলাস এ কথাও জানেন :
কিন্তু সে তরুণ চটপটে, ঝকঝকে, ব্যগ্র, অস্থির, উজ্জ্বল,
যখন মেলল পাখা আমার শিল্পের ভরসায়,
গেল উড়ে ঊর্ধ্বে, আরও উর্দ্ধে বহুদূরে,
সূর্যের অনেক কাছে প্রকৃত শিল্পীর মতো সব
বাধা, সর্তকতা
নিমিষে পেছনে ফেলে, আমি
শঙ্কিত অথচ মুগ্ধ রইলাম চেয়ে
তার দিকে, দেখলাম তাকে
পরিণাম বিষয়ে কেমন
উদাসীন, ক্রূর রৌদ্র-ঝলসিত, সাহসী, স্বাধীন
কী রকম অবাক লাগছে না, যেখানে বাবা সন্তানকে দেখছেন একেবারে বিপদের সামনে পড়তে যাচ্ছে সে, সূর্যের তীব্র আগুনে তার পাখা গলে যাবে, অথচ তার জানার ইচ্ছের জন্য বাবা হিশেবে চরম একটা আনন্দ উপভোগ করছেন অথচ আশঙ্কিতও তিনি। এই যে পিতা এবং পরবর্তী প্রজন্ম, সন্তান-সন্ততি, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক, সম্পর্কের প্রবহমানতা, এই ব্যাপারগুলোকে আশ্চর্য ধরেছেন শামসুর রাহমান। এখানে আশ্চর্য আরো কতগুলো বিষয় লক্ষ করবার মতো। একজন শিল্পীকে যেমন প্রকৃতিগত দিক থেকে অনেক বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়, সেই সতর্কতার সঙ্গে সঙ্গে বস্তু জগতের মোহ থেকেও সরে থাকতে হয়, এই কথাটুকু তিনি ধরিয়ে দিচ্ছেন কবিতার কতগুলো কথার মধ্যে দিয়ে।
আমাদের মনে পড়ছে, যেখানে বলছেন :
আস্তে আস্তে মনে পড়ে
নানা কথা, মনে পড়ে বাসগৃহ, বহু দূরে ফেলে আসা কত
স্থাপত্যের কথা আর নারীর প্রণয়। মনে পড়ে,
আমার সন্তান যেন পাখির বাসার খোঁজে কখনো কখনো
দেখতো উৎসুক চেয়ে আমার নিজের
বাটালি ছেনির চঞ্চলতা।
লক্ষ করার বিষয় যে, পিতা শিল্প করছেন, শিল্পী-পিতাকে দেখছেন সন্তান, শিল্পী তার কর্মতৎপরতা, কাজের একাগ্রতা, সেই সমস্ত কিছুকেই যেন আত্মস্থ করছে। কারণ এই আত্মস্থতা নতুন করে ডেডেলাসের মনের মধ্যে সন্তানের প্রতি, পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি, তীব্র রকম একটা ভালোলাগার বোধের জন্ম দিচ্ছে।
আমার প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের লেখা দুটো কবিতা পর পর রাখলাম।
‘ইকারুসের আকাশ’ – যেখানে একজন শিল্পীবিজ্ঞানীর অজানাকে জানবার অদম্য কৌতূহলকে ধরা হয়েছে।
তারপরেই রেখেছি ‘ডেডেলাস’ – সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায় যুগপৎ আনন্দ-শঙ্কিত হৃদয়ের
চিরন্তন পিতৃহৃদয় এবং অপার সন্ধিৎসু সন্তানের প্রতি গভীর সম্ভ্রম।
আজ ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বইমেলার শেষ দিন
nandik2025-02-27T20:34:32+00:00February 27, 2025|
আমি তোমার আঘাত হতে চাই
Sudipto Mahmud2025-02-20T20:03:41+00:00February 20, 2025|
“বেদনা আমার গতিপথের লাল গালিচা” – সুদীপ্ত মাহমুদ
Sudipto Mahmud2025-02-19T19:05:38+00:00February 19, 2025|
ধ্রুব এষ: ৩৫ বছরে এঁকেছেন ২৫ হাজার বইয়ের প্রচ্ছদ!
nandik2025-01-17T08:23:56+00:00January 17, 2025|
যৌনতা’র ইতি-যৌনযুদ্ধ ও সমাপ্তি (গল্প ০১)
Sudipto Mahmud2025-01-01T12:15:18+00:00January 1, 2025|
আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস ২০২৪
nandik2024-12-15T17:59:11+00:00December 15, 2024|
Nandik Shop
260.00৳Original price was: 260.00৳.250.00৳Current price is: 250.00৳.4% Off