আজ কবি জুয়েল মোস্তাফিজ-এর জন্মদিন

By Published On: November 11, 2023

স্বপ্নগুলো আগে চলুক, আমি পরে যাবো…

কবি জুয়েল মোস্তাফিজের জন্ম ১২ নভেম্বর ১৯৮০, চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ‘জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয়’ (২০০৮), ‘ভাতের ভূগোল’ (২০১০), ‘দুধের পুকুরে ভাসছে কফিন’ (২০১৪) ও ‘হোয়াট আ বিউটিফুল ডেড বডি’ (২০২০) এবং প্রকাশনা সংস্থা বাতিঘর প্রকাশিত ‘আইসিইউ’। দর্শন গদ্যগ্রন্থ : ‘মেরাতুন্নেসা, মনমহাজনের কথা’ (২০১৫) প্রকাশিত হয়।

Poet Jewel Mostafiz
  • ‘জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয়’ থেকে পাঁচটি কবিতা :

১.
যেখানে ঘুমোতে হয় না ঠিক সেখানেই ঘুমানো গ্যালো। একটি কাগজের বাক্স, বাক্সের চার কোনায় চারটা নল, প্রত্যেক নলে গাঢ় অক্সিজেন ঢাললেই ঘুম আসে, খেটে খাওয়া ঘুমের বাড়ি গাড়ি নাই, ঘুমকেও অতি যতনে বাঁচতে হয়। আমাদের মতো জাগরী ঘুমের মানুষেরা সেই ঘুম পুষে রাখতে পারে না। দুঃখী মানুষেরা যেখানে ঘুমায়, সেখানেই চাঁদমারির বিছানা।
গল্পটা ফাঁদা যাক এবার, দরগাতলার আগুনে মানুষ পোড়ানো ভোর, প্রতিদিনের ভোর যথাসাধ্য বেলুন, বেলুনের উল্টো সোজা নেই, শুধুমাত্র ফুলে থাকা বেলুন। সুখী মানুষের অন্ধকারে দুঃখী মানুষের কোনো ঘুম আসবে না, আমরা তেলচিটে মানুষ পেটের খাবার জোটাতে গিয়ে রক্ত কালো হতে চলেছে, ঘুমের খরচ কোথায় জোটে; আর তাই তো আমরা ঘুমাতে যাই না চোখ বন্ধ করি, যারা সারারাত ঘুমাবে না বলে কৈবর্তপাড়ায় যৌনচক্রে পড়েছে, কেবল তাদের তালগাছের মতো ঘুম, আমরা বাকিতে কিনি।
গল্পটার শেষ অংশ কিন্তু এই রকম, ঘুমের ঘোড়া মারা যাবার পরই ঘুমের পাখি। নইলে কি স্বপ্ন দেখে এখান সেখান যাওয়া আসা? ঘুমের কল্যাণে তোমার বাড়িও যাওয়া যায়; কিন্তু ঘুমের ঘোড়ার আত্মার কথা ভেবে ঘুমের পাখি উড়ে যায় কুয়াশা গাছের ডালে, চাঁদ মাঠের জালে, এই জন্য ঘুমের গুরুত্ব পানসে। যাব না যাব না করে কতকাল গ্যালো, এটা কি কোনো গল্পের শেষ? আছে হয়তো রহস্য কিছু… ঘুমের ব্লেড ঘেমে উঠেছে এখন।

২.
মাটির ভেতর মাটিরা কি আরামে আছে! গাছের ভেতর একটা অদ্ভুত ফোঁকর থাকলেও আমরা দুঃখেই থাকি। আমাদের মাথার ভেতর হঠাৎ উদ্ভাবিত মৃত্যু। আমরা দৌড়াতে পারি না, কারণ আমাদের পা টুপি পরে থাকে। যাত্রার কিংবা সাকার্সের স্টেজের কাছে আমাদের মানায় ভালো, কিন্তু যাত্রা কিংবা স্টেজের বাঁশ খুঁটি আমাদের মানিয়ে নিতে পারে না। আমরা বড় বেশি হজম করতে যাই না, ফলে কবুতরের ভালোবাসা আমাদের পাঁজরে বাজিয়েছে অসময়ের ঘণ্টা। এই যে ধরুন, এত বছর ধরে সময় ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি না, এই ভেবে যে বসে আছি তা কিন্তু নয়, আমরা শাদা ঘড়ি, কালো ঘড়ি, কিংবা ইতিহাসের বিভিন্ন লাল ঘড়ির কাছে গিয়েছি, ভাঙা ঘড়ির পদতলে পূজো দিয়েছি তথাপি সময় ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আমাদের সাথে প্রায়শ কথা বলতো সময়ঘাতী লোকজন। তখন দেখতাম সময়ের সাথে ধুতুরা গাছের কথা হতো, আমরা জ্যামিতি বক্সের কাঠি দিয়ে ফোড়া ফাটিয়ে ছিলাম বলে জীবনের সকল দাগই বাঁকা; আচ্ছা বলুন তো দাগ বাঁকা হলে কি বাঁচা যায়? বাঁচার জন্য অন্তত সময়ের সোজা সোজা দাগ লাগে…

৩.
সব গল্পই তো শেষ। রাতের গল্পটা, দিনের গল্পটা, এমনকি শেষ গল্পটাও। ভুল গল্পটা শেষ হবে না জানতাম কিন্তু সে গল্পটাও শেষ। শেষ গল্পটা বেশ মজা করে বলছিল পানু কাকা, সে গল্পও শেষ। মৃত্যুর গল্প ধরেছিল সরেন ডোম, মরার বাড় বেড়েছে উত্তর পক্ষে গল্প নয় সত্যি, সত্যিটুকুও শেষ হয়েছে গতরাতে। দেখুন, সব শেষ বলে আপনার পাগলা চুলগুলো আর বাড়তে দেবেন না প্লিজ! বারো মণ গালি কিনতে গিয়েছিল ওই কার্তিকের পাগল, সেই গালির কিছু অংশ শেষ হয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। গতরাতে পাগলনামা পড়তে পড়তে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল, ঘুরবে না বলুন? এত ঘোড়া কীভাবে সামলানো যায়, ইতিহাস থেকে ঘোড়াগুলো পালিয়ে যাচ্ছে পালাতে পালাতে নিভে যাচ্ছে। বলে রাখলাম; আগামী বর্ষা থেকে ইতিহাসে আর কোনো ঘোড়া পাওয়া যাবে না। সব ঘোড়া পালিয়েছে ইতিহাসের পাতা থেকে, যুগের রক্ত থেকে। কী আশ্চর্য! শেষ হয়ে আসছে পুরনো রক্ত, নতুন রক্ত। আমি যদি ডাহুক কিংবা পরিত্যক্ত নারীর কথা বলি তবে আপনাদের মন কাঁদবে নিশ্চয়ই? তবে কাঁদুন একবার, ভিজে যান দ্রুতগামী নোঙর কিংবা ইঁদুরের মতো। শেষ হয়ে আসছে সকল গল্প, খালের গল্প, কালের গল্প। না না কালের ভেতর কোনো সাপ ঢুকেনি, দিব্যচোখের সরল দৃষ্টি আছে কালের পথে, দিব্যলোকের দৃষ্টি দেখতে অনেকখানি সাপের মতো, চেতনা বলতে যে ঝুমঝুমি বাজে আসলে তা কিছু নয় মেয়েটি পাগল হয়ে গিয়েছিল মাত্র; তার কান্নার গল্পটাও শেষ, তার কান্না থেকে তার কবর পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি কবে নাগাদ শেষ হবে এই ভেবে বসে আছি, বসে আছি আহত চাঁদ…

৪.
তোমাদের মতো গোছালো মাছের ঘর আমার নেই, পৃথিবীর প্রথম গান যেদিকে বেঁকে গেছে সেই দিকে আমার ভাঙা খাট আর ভাঙা বিছানা। তাই তো পথে পথে মাছওয়ালাদের দেখলেই আমি গোছালো শব্দের অর্থ বুঝি। অন্তত, যে মাছগুলো গান করে সে মাছের সময় বুঝি। বুঝতে বুঝতে মাছওয়ালা বেঁকে যায় ঘন গ্রামের দিকে, আমি বেঁকে যাই বাদুড়খানার দিকে। সাঁঝের বেলা বাদুড়ের ছেলেমেয়েরা মাদুর পেতে বসে, আমি কলাগাছের দিকে চেয়ে থাকি। কলাগাছের দুঃখটা শুনেছিলাম আইনাল হকের কাছে… যাক এসব, অনন্তের পথে তোমার কালো ব্লাউজই উজ্জ্বল… আমি গরিব মানুষ আমার ঘর বারো পথের বারোমাথায়।

৫.
পাখির ভালোবাসা দেখলাম আর কাঁদলাম। পাখিরা ভালোবাসবে এটা তো পূর্ব শর্ত ছিল? তবুও কাঁদলাম। আমি গরিব মানুষ দৌড় দিতে পারি না, তাই তো সাপ আমার আগে যায়, চুনারীপাড়া আমার আগে যায়, আগে চলে যায় মাটিবন্দি ঘুম। আরো পাখি পাখি করলে আরো কান্না আসে, পাখির আরো ভালোবাসা হয়। আমি কি পথের ভেতর করুণ বাঁশি, নইলে যে একটাই ঘুমে, ঘুম গ্যালো আগে আমি থাকলাম পিছে, বলুন দেখি এভাবে ঘুম হয়? এভাবে কি রাতের সন্ন্যাস বাঁচতে পারে? এইজন্য সব মিলিয়ে যা দাঁড়ায় তা হলো একপক্ষ মৃত্যু অন্যপক্ষে পাখির ভালোবাসা। একদিন সমস্ত অন্ধকার দাঁড়িয়ে গ্যালো রাতের বিরুদ্ধে। ধার করেছি নিঃশ্বাস, তা দিয়ে বেঁচেও আছি, কিন্তু ছোট ছোট হাতগুলো মৃত্যুর প্রসঙ্গ আনলো, মরতে পারাটা সত্যের মতো কিছু নয়, মিথ্যার মতো কিছু নয়। স্বপনে বপনে আমরা অনেক দেখি, হরেক রকম মৃত্যু আছে রাতের গভীরে। ছোট ছোট মৃত্যু দিয়েও বেঁচে থাকা যায়…
কোনটা বেশি জরুরি? বাঁচতে পারা নাকি পাখির ভালোবাসা। জরুরি আইন খুঁজে পাওয়া গ্যালো না। তাই তো অন্তিম অন্ধকারের কাছে রেখেছি জমা কোনটা জরুরি। জানি, তুমিই এই প্রশ্নের উত্তর জানো কিন্তু তোমাকে তো এই প্রশ্ন করিনি? যাই হোক, যা হোক, স্বপ্নগুলো আগে চলুক, আমি পরে যাবো…

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop