সে যেমন যেমন নারীকে হিপনোটাইজ করতে চেয়েছিল, তেমন না হলেও এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে; বাসায় গিয়ে ম্যাসাজ করার প্রস্তাবে সে রাজি হলে তার মনবাঞ্ছা পূরণ হয়।
তার উত্থিত লিঙ্গ দেখে নারীটি অবাক হয় ‘ওমা তোমার দেখি এটাও আছে?’
জ্বি ম্যাডাম, আমি একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ।
নারীটা তার উত্থিত অঙ্গটি মুঠোয় নিয়ে বলে, দেশের সব হিজড়াদের সঙ্গে সেক্স করেছো?
বললে বিশ্বাস করবেন কিনা– তাকে থামিয়ে দিয়ে না না বলো, বিশ্বাস না করলেও শুনতে তো দোষ নেই– সে বলে, আমি হিজড়া হলেও কখনও হিজড়া পাড়ায় থাকিনি। আর– নিজেকে লজ্জারাঙা করে বলে– আর আমি এখনও ঠিক এসব করিনি।
নারীটি ঠাট্টার হাসিতে বিছানায় হুটোপুটি খেয়ে বলে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছাই করছে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না। পরে এইডস বাধিয়ে বসি কিনা।
সে হাসলো।
তার মানে আমি নিজে এইডস নিয়ে ঘুরছি? বেশ। আপনি যেমন চান তেমনই করেই হবে।
তোমার কাছে কনডম আছে?
না, আমি তো কনডম নিয়ে ঘুরে বেড়াই না।
নারীটি বিছানা ছেড়ে উঠে ভেতরে গেল। সে ভাবলো এই অবস্থায় এসে কেউ থামে না, সেও হয়ত থামবে না।
নারীটি কনডমের প্যাকেট এনে বিছানায় ফেলে।
নাও এটা ব্যবহার করো।
সে নিজের অঙ্গের দিকে তাকিয়ে বলে, এতক্ষণেও কি সে জেগে থাকবে? তার উপর আবার এইডস রোগির খেতাব পেয়েছে।
নারীটি সহমর্তায় তার উরুতে হাত রেখে বলে, মাইন্ড করো না, আমি দুষ্টুমি করেছি।
সে প্রথাগত নারীর মতে বিছানায় শুয়ে নারীটিকে ইঙ্গিতে বলে, ‘আপনিই শুরু করুন।’
নারীটি তার কানের পাতায় ঠোঁটে রেখে বলে, ‘এখন থেকে আমরা বন্ধু, তুমি করে বলবে, হ্যাঁ?’
সে তার শরীর নারীটির আকাক্সক্ষার তলে মেলে ধরে। তার মনে পড়ে যায় খুশবন্ত সিংয়ের সেই মেথরিনীর কথা, যে মনিবের অনুরোধেও মনিবের উপরে ওঠে না। এতই শ্রদ্ধা তার।
শুরুটা তাদের ভালো হলেও মধ্যপথে, বলা যায় নারীটি তখন ফুরিয়েছে, সে নিচে থেকেই নিজেকে সক্রিয় রাখছে, তখন ডোরবেল বেজে ওঠে।
তারা তড়িতাহতের মতো ছিটকে পড়ে।
যে যার পোশাক দ্রুত পরে নেয়।
নারীটি দরজার ফুটোয় চোখ রেখে দেখে বাড়িওয়ালা।
তার হৃদকম্পন বেড়ে যায়।
দরজা খোলে।
বাড়িওয়ালা বলে, একটা হিজড়া উঠতে দেখলাম। আপনার ঘরে নি?
নারীটি ইতস্তত করে বলে, হ্যাঁ, ও পার্লারে কাজ করে। ওর ছুটির দিনে বাসায় বাসায় গিয়েও কাজ করে।
কই ডাকেন তো?
সে মাথার ওড়না পেচিয়ে নিজের স্তন দুটো সামনের দিকে যথসম্ভব ঠেলে উঁচু করে দাঁড়ায়।
বাড়িওয়ালা ধমক দিয়ে বলে, চুপচাপ কাম করে যাবি। কোনও রকম তাফালিং করলে মাইরা তোর তক্তা খুইলা ফালামু।
সে নীরব দাঁড়িয়ে তাতে সায় দেয়।
বাড়িওয়ালা যাবার সময় নারীটিকে বলে যায় অন্যকেউ যাতে বাসায় না ঢোকে, সে যেন হিজড়াটার চেহারা চিনে রাখে। এদের বিশ্বাস করা কঠিন।
নারীটির ছেলেমেলে স্কুলে যাবার পর ফোন পেয়েই সে রিকশা নেয়। প্রতিদিনই। শুরুতে বাইক চালালেও সে হিজড়া কিনা তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। সে নিজেও নিজেকে মেয়েদের পোশাকে, সাজ-সজ্জায় প্রায় নারীই করে ফেলেছে। কোমরে গুজে রাখতে অভ্যস্ত পিস্তলটিও বাইরে গেলে সঙ্গে থাকে না।
এমন একটি সম্পর্ক সে কৈশোরোত্তরেও জড়িয়েছিল, নারিন্দায়, নারীটি ঠিক প্রোষিতভর্তিকা নয়; মাকে ফাঁকি দিয়ে ভিসিয়ারে সিনেমা দেখার নেশা তাকে ওই বাড়িতে অন্তরীণ করে রেখেছে দিনের পর দিন। মা তার খোঁজ নেওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল।
একে তো ছেলে কবি হয়ে উঠছে, তার উপরে নিষিদ্ধ রাজনীতি; মা-ও ছিলেন গণসংগীতের দলে। বাঁধন ছেঁড়া এমন সন্তানের মৃতদেহ আবিষ্কার করাই ছিল তার জন্য বাস্তবতা। কিন্তু সেই যাত্রায় বেঁচে যায় প্রতিবেশিনীর দিনের বেলার ফাঁকা ঘরে নিজেকে নিজের যৌবনের রসে নিমজ্জিমত করে।
সিনেমা দেখায় তার সরল মন ছিলোও, সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল সেন– তখন ক্যাসেটের দোকানে বাংলা সিনেমা আর হিন্দি সিনেমা আর পর্নসিনেমার জন্য প্রসিদ্ধ– সে জোগাড় করে নিয়েছিল বার্গম্যান, গোদারও।
বাইরের দুনিয়া তখন থেকে তার ছোট হয়ে আসে।
প্রতিবেশিনীর অনুরোধে গীতমালা দেখতেও তার ভালো লাগতো।
সেদিনের স্মৃতি তার কাছে বেশ উজ্জ্বল, দিনেরবেলা, দরজা জানালা বন্ধ, টিউবলাইটের কড়া আলোয় তার নীল ম্যাক্সি চোখ অন্ধ করে দেবার মতো রাগী।
সে ড্রয়িংরুমে দেয়ালের দিকে ঝুঁকে নতুন বছরের ক্যালেন্ডারের পাতা দেখছিল, তিনি পেছন থেকে তার উপর দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে কোনো একটি সিনিওয়ারি দেখিয়ে বলছিল, একটা কত সুন্দর, না?
তার পিঠে স্তুনের মাখন গলে যাচ্ছিল, কানের কাছে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ এবং পরস্পরের হাতগুলো যেন শঙ্খলাগার মতো; মহূর্তের এই সময়টুকুতে তার শরীরের ভেতরে উপচে ওঠে সমস্ত ফেনা।
তার দিকে তাকিয়ে দেখে তার দুষ্টু হাসি উদাসীনতা ফুঁড়েও মেখে আছে ঠোঁটে।
পুরুষের রক্ত সেই হাসির অর্থ জানে।
বাসায় ফিরে এই প্রথম কি তার আত্মমৈথুন? তার ঠিক মনে পড়ে না, সন্ধ্যায় নিজের অজ্ঞাতেই যেন সে সেই বাসায় যায়; সন্ধ্যায় সাধারণত সে বন্ধুদের সঙ্গে বুড়িগঙ্গায় তামাকের সঙ্গে গাঁজা মিশিয়ে সিগারেটের ভেতর ঢুকিয়ে টানে। সেদিনও সে গিয়েছিল, তবে সন্ধ্যার অনেক আগে। পশ্চিমের রোদ কপালের উপর গলে পড়ছিল। সিগারেট জ্বালিয়ে মনে হলে এক বিষাদ সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সে সিগারেট দোকানদারের হাতে দিয়ে টানতে বলে বাসার দিকে হাঁটা দেয়। হেঁটে হেঁটে জগন্নাথের সামনে বাহাদুর শাহ্ পার্কের ভেতর ঢুকে ঘড়িতে চেয়ে দেখে তখনও পাঁচটা বাজেনি। ছিন্নমূল মানুষের মতো সেও বেদির কাছে শুয়ে ক্যাপ খুলে মুখের উপর দিয়ে রোদ ও মানুষের দৃষ্টি আড়াল করে।
কী এক অচেনা অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসে। চোখ বন্ধ করেও থাকতে পারছে না। সে লাফিয়ে উঠে, ভাবে, অন্তত সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়িতে গুলিস্তান টু জগন্নাথ দু-এক বার আসা যাওয়া করে সময়টা ফুরিয়ে দেয়া যায়।
তার মনে পড়ে যায় রজনী হত উতলা গল্পের কথা, বুদ্ধদেব বসুর, সেও কি সারাদিন টো টো করে শেষে দরজায় মাথা ঘুরে পড়ে থাকবে? যে বাড়িভর্তি তরুণীর ভেতর কোনো একজনের সঙ্গে রাত্রিবেলা সঙ্গম করে তাকে অচিহ্নিত করার বেদনায় লুটিয়ে পড়েছে।
সে কেনো লুটিয়ে পড়বে?
যে সম্ভবনা তার তৈরি হয়েছে তা তো তার দিক থেকেই ভুল বোঝায় পরিণত হতে পারে।
নারীটি তাকে কিশোর ভেবে শরীরের সঙ্গে শরীর লাগা নিয়ে তেমন নাও ভাবতে পারে। সে তো তাকে বলেওনি সন্ধ্যায় যেতে, মাগরিবেব পরপর, জমে ওঠা সন্ধ্যার আগেই?
শুধু বলেছি, ‘সন্ধ্যায় আসিস, তোর কাকু থাকবে না।’
এমন তো কতই বলেছে, চিটাগাং যাবে, এসে সিনেমা দেখিস।
এমন নির্দোষ আহ্বানও তো হতে পারে। অহেতুক সে কেন এমন উতলা হয়ে আছে? ঘোড়ার গন্ধের ভেতর, সহিসের চাবুকের সপাং সপাং নির্মমতার ভেতরে কেনই বা সে গুলিস্তান যাবে আর আসবে?