সে ও তার শুয়োর (পর্ব-৫) – জাহিদ সোহাগ
নীরার মা/খালা বা মাগীটা ঠিকই একদিন তাদের বাসায় এসে হাজির।
দেখে মনে হয় তার উপর দিয়ে বড় রকমের একটা ঝড় বয়ে গেছে। শুকিয়ে কাঠ। বাম নাকের ফুটোর মধ্য দিয়ে একটি স্যালাইনের ইঞ্চি চারেক নল বেরিয়ে এসেছে।
তারা প্রস্তুত ছিলো উনি এই বাসায় এলে আক্ষরিক অর্থেই ঝাটাপেটা করবে। কিন্তু তার অসহায় দীন দশা দেখে তাকে ভেতরে বসতে দেয়। সে তার চিকিৎসা জনিত কাগজপত্র দেখায়। খাদ্যনালীতে ক্যান্সার। খাবার ব্লেন্ড করে ছেকে নাকের নল দিয়ে একটু একটু করে সিরিঞ্জ দিয়ে নিতে হয়।
নীরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার বিলাপের ভেতর যেটুকু কথার চূর্ণ ঝরে পড়ে তাতে সে যেন নিজেকেই এর জন্য দায়ী করছে।
সে তার স্বভাবসুলভ ‘দেখা যাক’ বলে তাদের আস্বস্ত করে, ‘তবে উনি সুস্থ থাকলে তোমার দেখভাল করতে পারতো।’
তিনি ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে ঘরের ভেতর টানানো দড়ির উপর রাখতে রাখতে বলেন, কোনো ওল্ড হোমে থাকতে পারলেও হতো। কিন্তু এই অবস্থায় ওরা রাখবে কিনা?
দুই রুমের ছোট্ট বাসায় তার জায়গা হয়ে যায়, বা জায়গা করে নিতে হয়। তবে তাকে নিয়ে ঘন ঘন হাসপাতালে যাওয়ায় ওরা দুজনেই হতোদ্যম, বিরক্ত। এই বোঝা তারা টানতে পারছে না। নীরা তার ভারী তলপেট নিয়ে প্রায়ই বিছানায় পড়ে থাকে, সেও তার পরিবর্তিত শরীর ও মন নিয়ে এখনো কোনো কাজে স্থির হতে পারেনি। ওনার যা টাকাপয়সা আছে তাতে কিছু দূর চালিয়ে নেওয়া যাবে যাওয়া যাবে। কিন্তু নিয়ে যাওয়া আসা করাটাই বড় সমস্যা।
এরইমধ্যে তার শরীরের আরো অবনতি হতে থাকে। বিছানায় শুয়ে বাথরুম করা ছাড়া তার উপায় থাকে না। নীরা বলেছিল যখন চাপবে তখন যেন জানায়, কিন্তু সেই অনুভূতিও প্রায় তার নেই।
তার তদারকি করার জন্য রাখা একজন বুয়া কদিন ধোয়া মোছার কাজ করে আর ফেরেনি। কাজের চেয়ে তার গজ গজ বেশি, হিজড়ার মার কাম করুম না।
একদিন রাতে, নীরা ঘুমিয়ে পড়লে বসার ঘরে স্টিলের কিছু পড়ার শব্দে সে উঠে গিয়ে দেখে একটা গ্লাস গড়াচ্ছে ফ্লোরে। সে গ্লাসটা তুলে তার বিছানার কাছে রাখা চেয়ারে রেখে মশারি তুলে দেখে সে চেয়ে আছে।
সে তার হাত চেপে ধরে বলে, আমরা একটা কথা রাখবা?
রাখবো না কেনো? আপনার সব কথাই তো রাখছি।
আমারে মাইরা এই নরক থেইকা বাঁচাও।
তাই বলে একটা জ্যান্ত মানুষকে মারবো? তাছাড়া আপনি তো সুস্থ হয়ে যাবেন।
না না, আমি আর ভালো হমু না। মরণই আমার চিকিৎসা। এইটাই এখন বাকি আছে। তুমি নীরারে কইয়ো না। না জানাইয়া মাইরা ফালাও।
এইসব চিন্তা কইরেন না, মৃত্যু আপনাআপনিই আপনার কাছে চলে আসবে।
তিনি শোয়া থেকে ওঠার চেষ্টা করলে তাকে ধরে খাটের সঙ্গে বালিশে ঠেস দিয়ে বসায়।
আমার একটা ইচ্ছা রাখবা?
রাখবো না কেনো, রাখছিই তো।
সে তার কাঁধের উপর হাত রেখে বলে, তুমি আমারে যতই ঘৃণা করো, করো কিনা জানি না– তার ফুপিয়ে ওঠা কান্নায় কথাটা ভিজে যায়, তিনি কথা আবার বলেন।
সে ঠিক বুঝতে পারছে না তিনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, সে বলে, না ঘৃণা করবো কেনো? আপনার সঙ্গে কি আমার ঘৃণার সম্পর্ক?
তিনি তাকে বুকের মধ্যে চেপে রেখে জমানো অশ্রুটুকু শেষ করে নিজের মধ্যে উষ্ণতা অনুভব করেন। ফিসফিস করে বলেন, ‘আমারে একটু আদর করবা?’ একজন মরণাপন্ন মানুষকে কীভাবে আদর করতে হয় বা করা যায় তা সে বুঝে উঠতে না উঠতে সে টের পায় তার হাত উষ্ণ হয়ে উঠেছে। নিজের ভেতরের অস্বস্তি সে আপ্রাণ চাপা দিয়ে রাখছে, তার মনে হচ্ছে এই রাতই বুঝি তার ভোরহীন রয়ে যাবে। সে নিজেকে তার ইচ্ছায় ছেড়ে দিতে পারে, চায়ও, কিন্তু শরীর জানে মনের ভেতরে কী ঘটছে, শরীর সাড়া দেয় না। তবু শরীরকে বাধ্য করা যায়, বাধ্য হয়।
যুক্তি দিয়ে বিচার করলে তার মৃত্যু তার জন্য তো অবশ্যই নিদানের পথ, সবার জন্যই তা ভালো।
সে নীরা পাশে শুতে গিয়ে দেখে নীরা জেগে আছে।
ওই ঘরে গিয়েছিলে?
হুম।
কী অবস্থা?
সে নীরাকে জানায় তার ইচ্ছার কথা। নীরা কথাটা শুনে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে, কী এক অজ্ঞাত জটিল সম্পর্কে সে তার সঙ্গে জড়ানো।
সে নারীর মতামত আদায়ের চেষ্টা করে কিন্তু নীরা তার নিজের নীরবতা লঙ্ঘন করতে পারে না।
সে একটা ছক এঁকে রেখেছিল আগেই। নাকের নলের ভেতর কড়া ঘুমের ওষুধ গোলানো পানি দিয়ে দিলেই তার শরীরমনের শান্তি।
সে বাড়িওয়ালেকে মরণাপন্ন মানুষটির কথা জানিয়েছিল এবং মৃত্যু হলে পরবর্তি সৎকারের উপায় সম্পর্কেও জানতে চায়।
বাড়িওয়ালা জানায়, মসজিদে মুর্দা গোসলের ব্যবস্থা আছে। আর ট্যাকা দিলে কবর দেওয়ানোরও ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বুঝলেন, আসল কাজ হইলো গিয়া মরা। আপনে জোগাড়যন্ত কইরা রাখলেন, দেখলেন হ্যেয় দুই তিন পাঁচ বচ্ছরও বাইচ্যা রইছে।
তা তো বাঁচতেই পারে। যার যতটুকু হায়াত আছে, সে সেটুকু দুনিয়ায় খরচ করবে না?
এই পোরথেম আমার ঘরে আজরাইল ঢুকবো। মনে ভাবছিলাম, আপনেরে কই হ্যারে অন্য কোথাও লইয়া যান, হেইখানে গিয়া হে মরুক। আবার চিন্তা করলাম আজরাইলের কাছে কি আমার নাম ঠিকানা নাই?
সেটাই।
বাড়িওয়ালা তার হাত চেপে ধরে বলে, আপনে চিন্তা কইরেন না। আমারে সবসময় পাইবেন। মুর্দার খেদমত করতে পারলে সোওয়াব হইবো।
বাড়িওয়ালার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখের পানি সংবরণ করে। হাতের তালু দিয়ে দুই চোখ রগড়ে চোখ দুটো করমোচার মতো লাল করে ফেলে।