চারুমা

চারুমা
বিবিকা দেব
মধ্যরাতে মেঘেদের ডাকাডাকি। বৃষ্টির বর্ষণ যে শুরু হলো থামার উপায় নেই। ছলকে ছলকে বিজলীর নাচন। মেঘের গর্জনকে বাঘের গর্জন মনে হচ্ছে। থেমে থেমে একটু গর্জে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ার তালে। বৃষ্টি সব কিছু ভিজিয়ে একেবারে জুবুথুবু করে রেখেছে। তাল, নারকেল, সুপারি, কচি জাম্বুরা গাছ এমনকি বুড়ো বরই গাছটা পর্যন্ত সবাইকে একেবারে নুয়ে রেখেছে। টুপ টুপ করে গা বেয়ে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে তুলশি তলায়। তাকেও একেবারে বিধ্বস্ত করেছে। ছনের চাউনি রান্নাঘরটা ভিজে ভিজে নেতিয়ে পড়েছে। তাতেও বৃষ্টি গড়িয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। আর বড় ঘরে টিনের চালের উপর বৃষ্টির বাজনা বেঁজে যাচ্ছে। কখনো ঝম ঝমিয়ে কখনো মিহি তরঙ্গে। বেলা বাড়ার সাথে বৃষ্টির মাত্রা কমতে থাকে। সবে মুড়িসহ সাথে নারকেল নিয়ে বসেছি খাওয়ার জন্য। এই একটু আগে যাকে কুড়িয়ে আনলাম বৃষ্টি উপেক্ষা করে। বর্ষার দিনে দারুণ খেতে লাগে।
এমন সময় চারুর মা উপস্থিত। তাকিয়ে দেখলাম মাথাভর্তি সাদা চুলের উপর বৃষ্টির ফোটা আটকে আছে। গায়ে জড়ানো সাদা থান কাপড় ভিজে একাকার। পায়ে বৃষ্টিতে ভেজা কাদা। ঝুলে পড়া চামড়ায় বৃষ্টিতে মাখামাখি। একটু ফিকে হেসে বললো মা আমায় একটু সুপারি দিবি। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি বয়সের ভাড়ে শরীরটা ছোট হয়ে গেছে। একটা দাঁতও মুখে লেগে নেই। সব পড়ে গেছে। কিন্তু কুঁজো হয়নি। ভাসা ভাসা চোখ দুটো অতৃপ্তির ঘোলা জল। মা প্রতিদিন দুটো সুপারি রেখে দেয় চারুর মায়ের জন্য। নিয়ম করে আসে সকালে নতুবা বিকেলে যখন রোদ হেলে পড়ে তখন। আমাদের অবশ্যই সুপারি বাগান নেই। ঘরের পেছনের দিকে আবার দক্ষিণ পূর্ব দিকে বেশ কয়েকটা গাছ। সব মিলিয়ে দশ থেকে পনেরটা সুপারি গাছ আছে। মা অল্প কিছু বিক্রি করে তাতে আমাদের খাতা কলমের কিছু টাকার যোগান হয়। আর কিছু সুপারি পানিতে ভিজিয়ে রাখে মাটির পাতিলে। তার থেকে প্রতিদিন দুটো করে চারুর মা ভাগ পায়। মাঝে মাঝে পানসহ খুশি মনে জড়ানো থানের আঁচলে বেঁধে হাঁটে আপন মনে। কিছু আর্শিবাদ তখন আমাদের কুঁড়েঘরের চালে ছায়া হয়ে ঘিরে থাকে।
এই চারুর মায়ের ছিল বাড়ন্ত সংসার। স্বামী ছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। তিন ফসলের আবাদি ও অনাবাদি কয়েক শতক জমি। পাকা বাড়ী, সামনে মাছভর্তি পুকুর। সোনালী ধানের গোলা। আম কাঁঠালের বাগান। বাড়ীর পাশে বিভিন্ন রকম শাক সবজির বাগান। কোন কিছুর কমতি ছিল না। শুধু সন্তানের অভাব ছিল। পর পর চার পাঁচটা সন্তানের জন্ম হলো। একে একে সবাই ক্ষণজন্মা। এই সন্তানের কষ্ট চিকিৎসক স্বামীকে তাড়িয়ে বেড়াত। নিজে চিকিৎসক হয়েও অথচ সন্তানের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আগে মৃত্যু হয়। চারু তাদের প্রথম সন্তান। তিন মাসের আয়ুষ্কালে সংসার ছিল সোনায় সোহাগা। ধবেধবে ফর্সা গায়ের রঙ। ঘন কালো মাথার চুল। ফাল্গুনের ঝকঝকে এক সকালে চারুর জন্ম। তার বাবা প্রথম দিন মেয়ের মুখ দেখে নাম রেখেছে চারুলতা। কাল বৈশাখীর তাণ্ডবের মতো নিউমোনিয়া চারুর ভেতর তাণ্ডব চালিয়ে নিঃপ্রাণ করে তবে বিদায় নিয়েছে।
তারপর থেকে একে একে এলো আর কয়েক দিন থেকে যথা নিয়মে বিদায় নিল। অনেক কষ্টে ছয় নম্বর মেয়েটা বেঁচে আছে। নাম গীতা। এখনো বেঁচে আছে। শ্বশুর বাড়ীতে স্বামী সন্তান নিয়ে ভালো আছে। বাবার মৃত্যুর সময় এসেছিল। তার পর আসা যাওয়া একদম ক্ষীণ হয়ে গেছে। আসবেই বা কি করে, নিজের বলতে কিছুই নেই। ভাইবোন কেউ নেই, বাবা নেই, মা আছে কিন্তু বর্তমানে অন্যের আশ্রয়ে বেঁচে আছে। বাবা যখন বেঁচে ছিলো নিজের মেয়ের থেকে বেশী ভাইপোকে ভালোবাসেন। মেয়ের পড়ালেখা না হোক। কিন্তু ভাইপোর পড়ালেখা নিজ দায়িত্বে চালিয়ে গেছে। বিধবা ভাইয়ের স্ত্রী। সন্তানকে কোন অভাব বুঝতে দেয়নি। নিজের কোন ছেলে সন্তান না থাকায় ভাইপোকে নিজের সন্তানের চেয়ে বেশী যত্ন করেছে।
এক শীতের সকালে দেখেছি খুব পাতলা একটা সোয়েটার গায়ে দিয়ে কুয়াশাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে আসছে চারুর মা। পা বরাবরই সারা বছর জুড়ে খালি। আমি কোন দিন দেখিনি চারুর মায়ের পায়ে স্যান্ডল। শিশিরে ভেজা পা। তাতে শুকনো খড় কিংবা শিরিষ গাছের হলুদ পাতা জড়িয়ে থাকতো সব সময়। মাঝে মাঝে ভাবনা মধ্যে ভাবি চারুর মায়ের লেপ তোষক অথবা শীতের কম্বল আছে। গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। ছোট ছিলাম তাই সাহসে পেরে উঠতে পারেনি। ওদের বাড়ী বেশ কয়েক বার শিউলী ফুল কুড়াতে গিয়েছি। মাটির উপর, সবুজ পাতার উপর, দূর্বাঘাসের উপর, মন্দিরের চালে, সিঁড়ির উপর শিউলী ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। বেতের ঝুড়িতে সব ফুল কুড়িয়ে দিয়ে নিজের ছোট হাতে অল্প নিয়ে খুশি মনে বাড়ীতে ফিরে আসি। তখনো দেখেছি চারুর মা ঝরা পাতা কুড়িয়ে স্তুপ করেছে। রোদ উঠলে শুকিয়ে বস্তায় ভরে রাখে। আশে পাশে ঝাড়ু দেয়া নিয়ম করে প্রতিদিনের কাজ। কোন সময় জিজ্ঞেস করা হয়নি দুপুরের ভাতের সাথে কি খেয়েছে সবজি নাকি মাছ। শুধু প্রতিদিন নিয়ম করে আসতো দুটো সুপারির জন্য।
একদিন নিজেকে প্রশ্ন করি যাদের পাকা বাড়ী, আম, কাঁঠাল, লিচু, সুপারি, নারকেল এবং তেজপাতাসহ আরও অসংখ্য গাছ আছে। তাহলে চারুর মা দুটো সুপারির খোঁজে কেন আসতো। তাদের তো বাগান আছে। সব কিছু আছে কিন্তু অন্যের অধীনে। কোন গাছের কত নারকেল, কত গাছের কতগুলো সুপারি সবই হিসেব করা। সবই বিক্রির জন্য। এমন কি গাছের ঝরাপাতা বিক্রি হয় তিনশত টাকায়। গ্রামের কিছু গরীব মানুষ এইসব পাতা কিনে যাদের গাছ নেই। এই পাতাতে ভাত রান্না হয়। তরকারি কিংবা মাছ রান্না হয়। এই পাতার আগুনের আঁচে অভাব গুলো ফুটতে থাকে টকবগিয়ে। আবার কারো প্রতিহিংসা জেগে উঠে সেই আঁচে।
চারুর মা, মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আর কোন ভাই বোন না থাকায় অনেক সম্পদের অধিকারী। মৃত্যুর আগে সমস্ত কাগজপত্র দলিল মেয়ের হাতে তুলে দেয়। চারুর মায়ের অবস্থাও অনুরূপ একই। কোন ছেলে না থাকায় বাবার বাড়ীর সম্পত্তি ও নিজের স্বামীর সমস্ত সম্পত্তি সেই ভাইপোর অধিনে। সেই ভাইপো গ্রামের নামকরা হেডমাস্টার। বিয়ে করেছে বিত্তশালীর মেয়েকে। ঘরভর্তি ছেলে মেয়ে। চারুর বাবা মৃত্যুর আগে ভাইপোকে বলে ছিলো তোর ছেলে হলে আমার ভিটে বাড়ীতে থাকতে দিও। কাকার কথা রেখেছিলো সেই ভাইপো। বড় ছেলে পাকাপাকি ভাবে বর্তমানে সেই ঘরে থাকে। চারুর মায়ের বাবার বাড়ীর সম্পত্তি আসা যাওয়া করে রাখাটা মুশকিল ঠেকল ভাইপোর কাছে। মানুষ লাগিয়ে এক সময় সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়। সেই থেকে চারুর মায়ের নাড়ীর টান চিহ্ন হলো আজীবনের জন্য। কোন সময় চারুর মা জানতে চায়নি বাবার বাড়ীর জমি বিক্রির টাকা দিয়ে কি করছে। নিজের দুবেলা ভাত তার বছরে দুটো কাপড় দেয় এমন আশ্রয় দাতার মুখের উপর কোন দিন কথা বলতে পারেনি।
নিজের মেয়েকে দেখে না অনেক দিন। মেয়ের কথা আজকাল বেশি মনে পড়ে। মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। সেই কবে এসেছিলো একবার চৈত্রমাসে বাসন্তী পূজার সময়। নাতীটা একটু বড় হয়েছে। হাতে কোন টাকা নেই মেয়েকে দেখতে যাবে। গাড়ী ভাড়ার টাকা সংকটে মেয়ের বাড়ী যাওয়া হয় না।
আজ দুই দিন হলো চারুর মা আসছে না। আমাদের সকালটা উসখুশ করতে থাকে। নিয়মিত যে মানুষ দুটো সুপারির খোঁজে আসে। সেই মানুষটা আসছে না দেখে আমি উদ্ধিগ্ন হয়ে আছি। চারুর মায়ের সাদা থানে জড়ানো ছোট শরীরটার মধ্যে চোখ দুটোতে ছলছল করে জলের ঢেউ আমি উপলদ্ধি করেছি প্রতিনিয়ত। কয়েক দিন কেটেছে এভাবে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়েছে সবাই। পরের দিন সকাল বেলা চারুর মা উপস্থিত খালী পায়ে। কোন সময় না আসার সঠিক ব্যাখা কেউ পায়নি। কাউকে জানায়নি নিজের সুপ্ত বেদনার কথা। শুধু ধীর পায়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একা।
অভাবকে বিতাড়িত করে স্বচ্ছলতাকে ফিরিয়ে আনতে গ্রাম ছেড়ে এক বৃষ্টিমুখর দিনে আমিও পাড়ি দিয়েছি শহুরে জীবনে। তখনো আমাদের কুঁড়েঘরের চালে বৃষ্টির ফোটা জমে জমে তাতে অভাব আর কষ্টগুলো মিশে থাকে ঘন হয়ে। সেদিন কাকিমার চোখে জল জমে ছিল চারুর মায়ের মতো। যে কাকিমা মৃত সন্তানের কষ্ট ভুলেছে আমাকে পেয়ে। যার কুঁড়েঘরে ছিল অগাধ ভালোবাসায় ভরা। তাতে আমার বেড়ে ওঠা। আসা যাওয়া ছিল প্রাণবন্ত।
নতুন চাকরি জীবন। নতুন মানুষের সাথে আলাপের স্বাদ। ঝকঝকে পরিবেশ। নতুন নিয়ম শৃঙ্খলা সারাদিনের কাজের ব্যস্ততা, রাতে ফিরে এসে নিজেই রান্না করা। রান্না বলতে ভাত আর আলু সিদ্ধ ছিল রোজকার তালিকা। তাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া আবার সকাল বেলা বের হয়ে যাওয়া। সবকিছু ভালোই লাগছিল। এই ব্যস্ততার ফাঁকফোকরে সময় গলিয়ে বছরের পর বছর পার হয়ে গেছে।
বেমালুম ভুলে গেছি চারুর মায়ের কথা। এমনি এক বৃষ্টির দিনে আমার মা এসেছে নতুন বাসায়। মায়ের সাদা চুলের ফাঁকে আটকে আছে বৃষ্টির ফোঁটা। সঙ্গে ছাতা ছিল না তাই। হয়তো নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। আলাপচারিতার ফাঁকে মাকে জিজ্ঞেস করি চারুর মা কেমন আছে। উত্তরে মেঘ জমেছিল মায়ের মুখে। চারুর মা মারা গেছেন বছর পার হয়ে গেছে। শুনে মাকে বুঝতে দেইনি সুপ্ত একটা কষ্ট আমার ভেতর বয়ে যাচ্ছে। চাকরি ইস্তফা দিয়েছি অনেক দিন হলো। নতুন বাসার সামনে আম, নারকেল, পেয়ারা, জাম্বুরা ও বেশ কয়েকটা সুপারি গাছ আছে। প্রত্যেকটা সুপারি গাছে সুপারি থাকে। বর্ষা শুরু হয়েছে কখনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। আবার কখনো সারারাত ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তাতে রাস্তায় জমে বৃষ্টির পানি। এমন বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় হঠাৎ আবারো মনে পড়ে গেল চারুর মায়ের কথা। যার চোখের ভেতর জল জমা ছিল। তাতে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা জলে মিশে ঘন হয়ে ছিল।
অনুসূয়া চলে যাবার পর
Syed Mahmud2025-05-16T16:33:04+00:00May 14, 2025|
সম্পাদকের কথা-(মাকে নিয়ে চিঠি)
Ismat Shilpi2025-05-11T17:55:08+00:00May 11, 2025|
তোমার নৃত্যের তালেই আমি বাঁধা মা
Abhra Barua2025-05-11T17:04:20+00:00May 11, 2025|
অব্যক্ত উক্তি মায়ের প্রতি
Mahbub Islam2025-05-11T16:40:39+00:00May 11, 2025|
মা দিবসে – মায়ের কাছে চিঠি
Sushanta Halder2025-05-11T16:32:01+00:00May 11, 2025|