মা বুঝি এমনই
বাসার তাসাউফ
আমার বাবা ছিল কৃষক। কৃষকের পরিবারে একটা সাধারণ বিষয়ের নাম অভাব। অভাবের কারণে কখনো কখনো আমাদের ঘরে রান্না হতো দিন ও রাতে শুধু একবার। তারপর পরিবারের সব সদস্যকে ভাগ করে খাওয়াতেন। আম্মার ভাগে ভাত থাকত না। পাতিলের তলানিতে পড়ে থাকা ছেঁচাপোড়া ভাতগুলো চামচ দিয়ে তুলে খেতে গিয়েও না খেয়ে আবার পাতিলেই রেখে দিতেন। সকালে আব্বা চাল কিনে আনতে না পারলে তো চুলোয় আগুন জ্বলবে না। তখন কোনো সন্তান ভাত খেতে চাইলে পাতিলের তলানিতে পড়ে থাকা সেই ভাতগুলো দিতে পারবেÑ এই ভেবে ভাতগুলো না খেয়ে আম্মা পানি খেয়ে পেট ভরে নিতেন। এভাবে বেশির ভাগ রাতেই আম্মা পানি খেয়ে ঘুমাতেন। ভাইবোন, আব্বা-আম্মা মিলে তখন আমাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা নয়জন। প্রতিদিন তিন-চার সের চাল লাগত। কিন্তু আব্বা এত চাল কিনে আনতে পারতেন না। বড়জোর দুই সের কিংবা আড়াই সের চাল কেনার টাকা যোগাড় করতে পারতেন। এজন্য আমার বড় ভাই-বোনেরা একবেলা খেয়ে দিন পার করে দিত। কিন্তু আমি পেট ভরে খেতে না পারলে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যেতাম। তাই বলে আমি যে খুব পেটুক ছিলাম, অনেক ভাত খেতাম তা কিন্তু নয়। ছোটবেলায় আমার খাওয়া-দাওয়ার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। বরং অনিহা ছিল। খেতে চাইতাম না। না খেয়ে দিনভর খেলায় মেতে থাকতাম। আম্মা খাওয়াতে চাইলে দৌড়ে পালাতাম। এজন্য আম্মা খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে আমার পেছনে পেছনে সারাবাড়ি ছুটে ছুটে খাওয়াতেন। তবে খাওয়ায় আমার অনিহা থাকলেও মাঝেমধ্যে আচমকা আম্মার কাছে ভাত চেয়ে বসতাম। তখন আম্মা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়তেন। এতদিন পর একটা কথা ভেবে আমাকে রীতিমতো অবাক হতে হয়। সেই সময় যখনই আমি খেতে চাইতাম তখনই আম্মা প্লেট ভরে ভাত এনে আমাকে খেতে দিতেন। যেদিন আব্বা এক সের চাল আনতেন সেদিনও আমি প্লেট ভরে ভাত পেতাম, যেদিন চাল আনতে পারতেন না সেদিনও পেতাম। আমি ভাত চাইলেই আম্মা কোথা থেকে প্লেট ভরে ভাত আর মুরগির ডিম ভেজে মেখে আমার সামনে হাজির করতেন? পরে জেনেছিলাম, দিনের পর দিন আম্মা ভাত না খেয়ে আমার জন্য রেখে দিতেন। শুধু আম্মা না, বড় বোনেরাও কম খেয়ে প্লেট থেকে তুলে তুলে আমার জন্য ভাত রেখে দিত। আমার জন্য আম্মা যে না খেয়ে প্লেট থেকে ভাত তুলে রাখতেন সেই কথা এখনো ভুলতে পারিনি।
মনে পড়ে আব্বা ও আম্মার এক রাতের কথোপথন-
আব্বা: ‘তুমি ভাত খাইছো?’
আম্মা: ‘এই ত এক্ষুনেই খাইয়া উটলাম।’
আব্বা: ‘এতো তাড়াতাড়ি খাইলা ক্যামনে?’
আম্মা: ‘মাইয়া মাইনসের বেশি দেরি কইরা ভাত খাওন ঠিক না।’
আব্বা: ‘থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল যে শিকায় তুইল্যা থুইছ সেখানে তো ভাত খাওয়ার কোনো চিহ্ন নাই।’
আম্মা চুপ। কোনো কথা নেই মুখে।
আব্বা: ‘এমন কইরা না খাইয়া আর কম খাইয়া কতদিন কাটাইছো?’
আম্মা: ‘ছেলেমেয়েরা বড় অইতাছে, তাদের বেশি ভাত খাওন দরকার। আমি মা, আমার একটু কম খাইলেও চলে।’
আব্বার আর কোনো কথা বলেননি, বলতে পারেননি। যে রাতে এই ঘটনাটা ঘটেছিল সেই রাতে আমাদের ছনের ঘরের ভেতরে কেরোসিন তেল পুড়ে পুড়ে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা মাটির প্রদীপের আবছা আলোতেও আব্বার চোখের কোণ বেয়ে পড়া জলের ফোঁটাগুলো স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম। তখন আব্বার চোখের জল আমার বুকের ভেতরে বয়ে দিয়েছিল বিশীর্ণ এক ব্যথার নহর। আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল তার মতো এমন অসহায় মানুষ পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয়টি নেই।
আব্বা যে আম্মাকে দুইবেলা ঠিকমতো ভাত খাওয়াতে পারেননিÑ এ নিয়ে আম্মা কখনো কোনো অভিযোগ-অনুযোগ করেননি। বরং আব্বা কষ্ট পাবে বলে আম্মা এসব বিষয় গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন প্রাণপণে। আম্মা না খেয়েই যে খাওয়ার অভিনয় করতেন, আমরা তা ধরতে পারিনি। একটু বড় হওয়ার র্পল আম্মা যখন গল্পচ্ছলে এসব কথা আমাদের কাছে বলেছেন, তখন বুঝেছিলাম। আম্মা যদি না বলতেন তাহলে হয়তো কখনো বুঝতেও পারতাম না আমাদের লালন-পালন করতে গিয়ে তিনি কত কষ্ট করেছেন। আম্মার মুখে কথাটা শুনে মনে হয়েছিল, রূপকথার গল্পের কোনো দুঃখি পরিবারের কাহিনি শুনছি।
মায়েরা কি এমনই হয়ে থাকে? কেবল সয়ে যাওয়াই কি তাদের কাজ?