পত্রলিপি

পত্রলিপি
ইসমত শিল্পী
১.
মা,
কখনোই কোনো স্বপ্ন দেখি নি আমি। স্বপ্নের মতো করে আসেনি কোনো কিছুই। কিন্তু তুমি আসো, স্বপ্নে। বাস্তবে। চাওয়ায় না পাওয়ায় প্রায়ই তোমার মুখ ভাসে।কিন্তু ছুঁয়ে দেখতি পারি না কিছুতেই। চাওয়ার প্রকার আছে, আকার নেই। না পাওয়ার উপঢৌকন সাজিয়ে জীবন কে যাপনের জন্য অপেক্ষা নামের টার্মিনালে বসিয়ে রাখা। এখানে একা একটা শুকতারা জ্বলছে, একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে সময়। এখানে পোষণ করার মতো কয়েকজন চরিত্র কাল্পনিক অস্তিত্বের কথা বলে যায়। কিছুই পাবো না জেনেও কিছু কথা ও কাজের সাথে পাকাপোক্ত লেগে থাকতে পারি।
এই যে লেগে আছি- এটুকুই প্রাপ্তি। আমার কাছে আমার সামান্য স্বীকৃতি। আর কেউ তা দিক- না দিক, আমি আমার কাজ ও কথায় ভীষণ তৃপ্ত। কারণ আমি জানি, অল্প চাইলে প্রাপ্তির পরিমাণ বেশি থাকে। এইসব তাল-বেতাল কথা তোমার সাথেই বলা যায়। আর কেউ শুনবে না। এই শহরের অনেক কাজ। অনেক ব্যস্ততা। অনেক তাড়া রাস্তা ঘাটের। তা হোক আমরা কথা বলি, রাত গড়িয়ে যায়। যে কোন সময় ভেঙে পড়তে পারে কথার দেয়াল। জেনেও কথা বলি। তুমি চলে গেছো, কথোপকথনের পথ ক্ষীণ হয়েছে বহু আগেই। পথ বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়েছে বৈচিত্রতা। ঋতু-হারা প্রকৃতির মতো বেঁচে আছে।
গলার কাছে কী একটা আটকে থাকে রোজ। এ শহর চেনা যত, অচেনাও তত। রোজ সকালে যে দিনটা শুরু হয়, এঁকেবেঁকে চলতে থাকে। রোজ বিকেলে সে ফেরার রাস্তা ভোলে। এলোমেলো স্বপ্নচারণ, অসমান দ্বন্দ্ব ভীড় করে। চাঁদ গলে পড়ার আশ্চর্য মুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছে হয়। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলোর মুল্য কতোখানি সেটা আমি কিভাবে যেন বুঝে গেছি। ভুলে গেছি, ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নিতে হয়। বসতে হয় ছায়ায়। ভূতগ্রস্ত মানুষ নিজের ছায়ার ভিতরে ঘুরে বেড়ায়, আলোর দিকে পিঠ করে বসে। এসব বিষাদ নয়, বোঝাতে আরো এক হাজার শব্দের অপচয় ভালো লাগেনা আর। তুমি কোনদিন বুঝবে কথা বলার ক্লান্তি কীভাবে একটা মানুষকে চাঁদের উল্টোপিঠে বসিয়ে গড়িয়ে দেয়। আর কোনো মেঘের ঘাটে গড়াতে গড়াতে গিয়ে ঠেকলে নতুন এক দিন তৈরি হয়, যার আকাঙ্ক্ষা নেই অথচ পূর্ণতা আছে । সব গল্পের শেষ নেই, অসম্পূর্ণতাও এক রকমের গ্রহণযোগ্য সমাপ্তি। আমাদের জীবনগুলো সেইসব হলদেটে প্রমাণ ধরে রাখে মলাটে। হাসির বাইরের একটা ম্রিয়মান মুখ আছে যেখানে তেলচিটে চাদর বদলাতে ইচ্ছে করে না, কেবল পাশ ফিরে ঘুমোতে ইচ্ছে করে। আলোর আড়ালে সাদা চোখে সন্ধেটুকু ধরা পড়ে স্নিগ্ধতায়। কথা বলা একটা উপকরণ, যাকে বাদ দিয়েও দিব্যি চুপচাপ চলতে পারে জীবন। মন্ত্র ছাড়া কি পুজো হয়না ? হয়। রাত আর দিনের মধ্যে ঝুলে থাকা প্রশ্নচিহ্নদের অগ্রাহ্য করতে শিখে যায় জীবন। যত নিস্তব্ধতা, তত পাখিরা বন্ধু হয়, গাছগাছালি হাত বাড়ায়, মেঘ-বৃষ্টি হাত ধরাধরি করে হাঁটে। মানুষ নিজে এত কথা বলে, তাই পৃথিবীর নাড়ির স্পন্দন সে প্রতিদিন খোয়াতে থাকে, আয়নায় ছবি পড়ে না, ছায়ারা দানবিক হয়ে ওঠে। অনির্দিষ্ট চিন্তার পথে ঠিক স্টপেজে নামা যায়না। অনেক আগে বদলে যায় পথ। ভিড় রাস্তায় একলা, নির্জনতা তৈরি হয়। শহরের আলো জ্বলে ওঠে, নিজের ভিতরে উড়ুক্কু পাখিকে কবেই ঘুম পাড়িয়েছি আমি। এখন আলোর দিকে পিঠ, ঔজ্জ্বল্যের থেকে মুখ ঘুরিয়ে চাঁদ কাঁধে করে সবুজ অন্ধকারে হাঁটা। জোনাকির আলোতে বাজি রেখেছি সুখ। কিন্তু জোনাকি কোথায় !
আচ্ছা, জোনাক না থাক। তুমি রাজেস্বরী। তাই থাকো। আমরা কথা বলতে থাকি, রাত গড়িয়ে চলে।
বিষাদের স্তরগুলো পুরোনো কাঁঠের মতো পোক্ত হয়ে ওঠে আজকাল। ক্রমেই ভারি হয়, আটকে ধরে গলা।অথচ কী অবলিলায় হেসে উড়িয়ে দিতে চেয়েছি জীবন! পোড়া কাঠের কয়লার স্তুপে বসেও হাসা যায়; বিষাদকে মামুলি ভেবেই হেসেছি। সে হাসির মর্ম হাসিই জানে, আর কেউ নয়। সবকিছুর মর্ম সবাই জানবে এমন তো নয়! জানবার দরকারই বা কি? অথচ এইসব মামুলি বিষাদ পুরো জীবনকে গিলে খাচ্ছে। ইদানিং সারাক্ষণ মগজে আটকে থাকে কিছু প্রতারণার দৃশ্যচিত্র। অনেক দৃশ্যই এড়িয়ে চলার আগ্রাণ চেষ্টা করি। এখন যেনো কিছুই পারি না।শক্তির শক্তি ক্ষয় হয়- এ তো আমরা জানিই।
রাতের দীর্ঘশ্বস ভারি হয়, বড় হয় রাত। রাত মানে তো কয়েকটি প্রহর মাত্র! আর আগে মধ্যরাত খুব প্রিয় ছিলো। শব্দরা ঘিরে ধরতো মধ্যপ্রহরে। আমরা বৈঠকে মেতে উঠতাম। শব্দের সঙ্গে প্রেম ঘনিষ্ঠ হতো। ভালোবাসা জমতো। আড্ডা বসতো বেশ। এখন মধ্যরাত অবধি নিঃশ্বাসের সঙ্গে রেষারেষি। আমি জিততে না চাইলেও নিঃশ্বাস হেরে যেতে চায় না বলেই ভীষণ বেদনা হয়। বেদনা লম্বা হলে দুঃখবোধ ঘিরে ধরে। দুঃখের সাথে কিছু ছায়া। ছায়াও স্পষ্ট হয়, এখন বুঝি। ছায়া আবছায়ার অদৃশ্য যুদ্ধে ছায়ার জয় হয়। ক্লান্ত প্রহর গড়িয়ে পড়ে সুতানুলি সাপের উপর। সে চমকায়, ছোবল তোলে! কার দিকে! আমার দিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি; অপরাধ কি আমার? বিশ্বাসে অপরাধ হয়, তাও এখন নতুন করে বুঝেছি। সময় কতকিছুই বোঝায়। কত অজানাকে জানিয়ে দেয়! এইসব সময়কে দুঃসময় বলতে ইচ্ছে করে না। সময়ের নিজস্ব হিসাব আছে, দায়ও আছে। সত্যকে অস্বীকার করার দায় সময় নেয় না। মানুষ সেই দায় অনেক আগেই নিয়ে নিয়েছে। তবু মানুষকে ঘিরেই বাস, মানুষ নিয়েই আমরা তৈরি করি প্রেমোপখ্যান, কল্পিত প্রাসাদ। হরবোলা মানুষকে মানুষ হয়েও চিনতে পারি নি আজও। মধ্যরাত আমাকে সেগুলোই জানায়। শেখায়। আমার আর শেখার সময় নাই, সবিনয়ে জানিয়ে যাচ্ছি প্রায়ই। বলছি- ছুটি চাই, ছুটি চাই। ছুটি দাও, ওহে হরবোলা জীবন!
ছায়াঘেরা মধ্যরাত সদ্যজাত শিশুর মতো কাঁদে; ছুটি দেয় না কিছুতেই। আমি তিন থেকে চারটা কলম বদলাই।আঁকতে পারি না শব্দের সঠিক ছবি। আমার খুব কষ্ট হয়, বেদনা তৈরি হয়। নিঃশ্বাস আটকে আসে। আবার কলম বদলাই। আলাদা রঙের কলম খুঁজি। শব্দগুলো পোড়া কাঁঠের কান্না বুকে নিয়ে অপেক্ষা করে, বড্ড ভালোবেসে। কোনো প্রতারণা ছোঁয় না ওদের।
মধ্যরাত ও ছায়ার শব্দকে ঘিরে একটিই ছায়া থাকার কথা ছিলো। আমার নিঃশ্বাস এখনও কি তার জন্যে বেঁচে আছে? যে কিনা বিশ্বাসই করেনি এই খচিত শব্দকে। তবুও অপেক্ষা কেনো বাঁচার; কার জন্যে…
মা,
বেশ কিছুদিন থেকে কোথাও প্রাণ পাই না। মনোসংযোগ পাই না কিছুতে। ভালো লাগে না কিছু করতে। কথা বলতে ভালো লাগে না। গান শুনতেও না। কারনে অকারনে অভিমন্যু আসে না। অভিমানের নাম দিলাম অভিমুন্য! সে থাকুক অন্তরের গভীরে। পুড়ুক ভেতরের নদীতে। এলোমেলো বাতাসে না উড়লেই ভালো। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যেন আমি নাই। আমাকেই আমি চিনি না এখন। আলোর মাঝে তলিয়ে যাই। অথবা হারিয়ে যাওয়া মেঘপুঞ্জ ছুঁতে পারি নি বলেই রয়ে যাওয়া এভাবে, এখানে। আমার কি এরকম থাকার কথা ছিলো!
এলোমেলো মন খারাপ হলে, কারোর সাথে কথা না বলে, ফুটপাতে এলোমেলোভাবে হেঁটে বেড়াই। নাড়ী থেকে শুরু হয়ে পেটের ভেতর দিয়ে বুক বরাবর উঠে আসে কষ্টের দল। বুকের ভেতর শূন্যতা আর পাথর মিলত জলীয় বাষ্প- গলা আটকে ধরে! আটকে ধরে চোখ, গড়িয়ে যেতে পারে না। তোমার জন্য জান কাঁদে…
তুমি ভালো থেকো। আমি বেঁচে আছি। বাঁচার তাগিদেই যে বেঁচে থাকতে হয়, তা তো তুমি জানো!
-ইতি তোমার অনেক আদরের ‘আমি’।
২.
অথচ চমৎকার পত্রমিতালী হতে পারতো মায়া ও মানুষে, হলো না। আমি তো মায়ার চাষবাস নিয়েই ফুরিয়ে যাই, বারবার। ফুরিয়ে গেলেই অভাব হয়, প্রয়োজন বোঝা যায়। নিজের ভেতরে নিজের অভাববোধ জাগে। অথচ কতবার চেয়েছি, জন্মের ঋণশোধে যাবতীয় শব্দ অকুণ্ঠ তুলে দেবো তোমার কাছে। মায়াময় শব্দগুচ্ছ গাঁথা চোখ অপেক্ষারত। মনে আছে- সেই সন্ধেয়, তুমি হাত বাড়ালে সংকোচে, ঈষৎ হাসিতে ঠোঁট হলো পেটানো কমলার রঙ। শেষবার তুমি-আমি সল্টলেকের রাস্তায়; যে চোখে তাকালে সভয়ে, আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি তোমার হাত ? ভয় কেনো ? কেউ কি ছাড়ে সজ্ঞানে; নিবিড় আনন্দ, আশ্রয় ? প্রাপ্তির হিসেব যেখানে শূন্য, স্পর্শ সেখানে প্রাণাধিক !
বোঝোনি কি? জরায়ুর গা ঘেষে তাবৎ জলের সাথে ভাসতে চেয়েছি আজীবন, জানাতে পারি নি। তোমার তারুণ্য দিয়ে পুষেছিলে এক কন্যা শিশু, সে এখন স্রোতের উপরে ভেসে থাকতে পারঙ্গম। জানো তো ? সাঁতারের চাইতে ভেসে থাকতে পারা অনেক কঠিন। অনবরত সত্য-সঙ্গে নিঃসঙ্গ থেকেছি আমি, বোঝোনি কেনো ? তুমি তো জানো, নিঃসঙ্গে মৃত্যুর দূরত্বকেও তাৎক্ষণিক মৃত্যু মনে হয় ! তাইতো আতকে উঠেছিলে ওমন, খোলামেলা দুপরের পরে, সল্টলেকে ! জানি তো, চায়ে তোমার ভালোলাগা আছে ঢের ! আঙুল টলকে উঠতেই বড্ড ভয় পেয়েছিলে অজান্তে; হাত বাড়াতে পারো নি নিসঙ্কোচে, আমার দিকে। ভেবে দেখো, আমি তো আছি তোমার যৌবন হতে, রোদের উত্তাপ সয়ে শতাধিক শ’য়ে ! নিষ্ঠুর অ্যালঝাইমার তোমার মস্তিষ্কের কোষ খেয়ে নিচ্ছে দ্রুত। তুমি নিঃসঙ্গতায় বন্ধ চোখে অন্ধ; আনিদ্রায় নিদ্রাহত থাকো প্রায়। আমি তো জেনেছি সেই কবে, তুমি ছাড়া আর কোনো ছায়া নেই, নেই বৃক্ষ সতেজ বরণ। শিশু থেকে তোমার যৌবন করেছি গ্রাস; কী এক অপরাধবোধে মরে যাই সারারাত। আমিও ঘুমোতে পারি না মা !
আমি তো ছুটেই চলেছি অনাহুত; জীবনের ভ্রম আলিঙ্গনে। ছুঁয়ে দেখো, স্পর্শে শোধ করি জন্মের খানিক ঋণ। শিরদাঁড়া ভেঙ্গে আসে প্রতিক্ষণ; সাময়িক অ্যালঝাইমার ছোঁ মারে, ক্ষয় করে স্মৃতিবিন্যাস। বেঁচে আছি ? কেনো আছি ? প্রতিজ্ঞা করি, যৌবনের কোনো এক দিনে উঠোনে ধানের ছড়ায় পা জড়িয়ে রোদে পুড়বো। তোমার সোনালি হাতে সোনালি চুড়ির গোছায় ঝলসে যাওয়া রোদ। আঙুলের সাথে মিতালি করে আছে শরৎ; তোমার প্রিয় উপন্যাস ‘পথের দাবী’। কী অসামান্য বোধ; ভাবা যায় !
অথচ ভয়ংকর অ্যালঝাইমারের বিষ মেরে ফেলে রোদ ! স্মৃতিহীন হও; বড় হতে হতে ঘুরেফিরে শিশু হয়ে যাও তুমি ! আমি যেনো ‘মা’ হয়ে উঠি স্নেহকাল থেকে।
প্রতিজ্ঞা করি, দেখো- ফি-জন্ম আমিই তোমার ‘মা’ হব শেষে—!
বাবা
বাবা,
কিছু ক্ষয় নিয়ে তোমার কাছে গিয়েছিলাম – যাবতীয় বিশ্বাসকে উপঢৌকন করে। আশ্রয় হবে ভেবে। মা বাবা অথবা বন্ধু ছাড়াও আরেক আশ্রয় থাকে যার নাম বিশ্বাস। ঘরবাড়ি ছাড়াও বিশ্বাস বাঁচে, বিশ্বাস নিজেই তো একটা বিরাট আশ্রয়! অথচ আমার আশ্রয় হয়নি ওখানে। যখন টিনের চালের ঘর ছিলো তখন আশ্রয় চাইতে হয়নি। এখন চেয়েও হলো না! এই আক্ষেপ দানা বাঁধা পাথরের থেকেও ভারী, নাড়ানো যায় না। বুকের ভেতর চেঁপে থাকে আহর্নিশ।
আমাদের জীবনে সবথেকে বেশি পরিমাণে ধাক্কাগুলো আসে কাছের মানুষগুলোর কাছ থেকে; পরিবার থেকে। প্রত্যেকের প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় অবদানও পরিবারের। সে ছেলে হোক বা মেয়ে। আর সেই স্থানে শক্ত ভূমিকা বাবার।
সমাজের ভূমিকা পরে।সমাজের প্রতিষ্ঠাতা তো এককজন বাবা-ই। সামাজিকতা তাঁদেরই হাতে। পুত্রসন্তান কন্যাসন্তানের বৈষম্যটাও তাঁদের বিচারে। এই বৈষম্য ভাঙবে কে ? সম্ভব নয় ভাঙা? হয়তো না। এ বৈষম্য অন্তর্গত। একদমই ভেতরের।
মায়ের ভালোবাসা, দোয়া আর বাবার ভুমিকা; এ দু্ইই ব্যক্তির প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রবিন্দু। উল্টো হলেই ভেঙ্গে পড়া জীবন। সারা জীবন অ-জীবন হয়ে যাওয়া মানুষ; ঠিক আমার মতো—–
বাবা,
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে সৃষ্টি হয় প্রশ্ন। প্রশ্ন ক্ষত বিক্ষত করে দুপাশের দেয়াল। প্রশ্নকে সামনে নিয়েই এগোচ্ছি, এগোচ্ছি বিক্ষত বৃষ্টির ফোঁটা মাড়িয়ে। বৃষ্টির জলেও স্রোত বয় তা অঢেল হলে। চতুর্পাশ থেকে স্রোত এসে ধাক্কা দেয়। এসময়ে হাত পা ছেড়ে দিয়ে চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া কিচ্ছু করার থাকে না। যারা বাইরে থেকে ব্যাপারটা দেখে, তাদের কাছে বোকামি কিংবা নির্বুদ্ধিতা মনে হতে পারে। কিন্তু এমন স্রোতের মধ্যে পড়লে বোঝা যায়— অসহায়ত্ব কতখানি, তা কেমন।
বাবা,
অতীত মাঝে মধ্যে খুব মনে পড়ে। জেঁকে বসে বুকের উপর। সীমারের মতো। কণ্ঠ আটকে ধরে উদ্যোত তলোয়ার নিয়ে! এই বিরা পৃথিবীতে অতীতই শুধু ছেড়ে যায়নি আমায়। বড্ড আপন হয়ে আছে। এরকম একদিনের কথা প্রায়ই খুব মনে পড়ে। সেই রাতে বুকে বড্ড ব্যথা হলো, ছাড়ছে না কিছুতেই। বাম হাতের ব্যথা নাকি হৃৎপিন্ড নির্ভর ; এই ব্যথাটা ইদানিং প্রায়ই ভোগায়। বাম হাত সারারাত প্রায় অকেজো হয়েই ছিল- কোলের ভিতর। মধ্যরাত অবদি ভুলে থাকার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছি। খুব ভোরে ব্যথা আর অকেজো প্রায় হাত নিয়ে অস্বস্তিতে ঘুমটা চলে গেছে। সকালে সচারচর ফোন করো না, আজ যে ফোন করলে ! উতলা পরিচিত কন্ঠ- ” বাবু, শরীরটা ভাল আছে তো ?” প্রবল চেষ্টায় শক্ত কন্ঠে বলতে চাইলাম, হ্যা ভাল আছি। কিন্তু কয়েকবার এই একই প্রশ্ন করলে কেন বাবা ? আমি ফোনটা রেখে দিলাম। খানিক পরে আবার ফোন – সেই একই প্রশ্ন, খুব উদ্বিগ্নতা কন্ঠে – ” বাবু, তোমার শরীরটা খারাপ না তো ? গলাটা কেমন লাগছে যে !” আমি গলা শক্ত করে বলতে চাইলাম, না খারাপ নেই তো, ভাল আছি আমি।
চায়ের দোকানে তোমার আশেপাশে কত মানুষের কথার আওয়াজ। তাদের সবার খবর তোমার জানা চায়; তাদের অভাবের কথা, কষ্টের কথা, কত না পাওয়ার কথা। কিন্তু আমার কোন কথা তো বলিনি তোমাকে, তবু তুমি কি করে বুঝে নাও বাবা; এত না বলা কথা ? ভেতরের এই বন্ধ কুঠুরিতে কোন আওয়াজ হয়না কখনো। কিন্তু তুমি এমন করে কথা বললেই ভেতরে কি যেনো নড়ে চড়ে ওঠে। তখন টের পাই খুব, ভেতরে মমতা নামক বস্তুটা এখনো বেঁচে আছে ! এই বেঁচে থাকার অনেক কষ্ট যে বাবা। তা তোমাকে কোনদিন বলতে পারিনি।
বাবা,
কতদিন সেই পরিচিত কণ্ঠের জন্যে টানটান হয়ে আছে প্রাণ। যতবার ফোন আসে উদগ্রিব চোখে তাকায়, নাহ্ অচেনা নম্বর ভাসে। ‘বাবা’ লেখাটি আসে না কেনো? না আসুক। ফুরিয়ে গেছি আমি সময়ের ভীড়ে অসংখ্য অভিমানে অথবা অভিযোগের চাপে। তাও মেনে নিয়েছি এখন। কিন্তু আমার বাবার জন্যে আমার অনেক গর্ব হয়, আবার তখন আমার পড়ে থাকা প্রাণ কথা বলতে চায়। পা বাড়াই সামনে। প্রতিটা ফোনের শাব্দের সাথে সাথে তোমার কণ্ঠের অপেক্ষা করি।প্রতিনিয়ত কান পেতে রই —
– ইতি তোমার ফুরিয়ে যাওয়া আদরের কন্যা ‘শিল্পী’। বি.দ্র. : বাবা, একটা কথা ভীষণ ভাবে বলতে ইচ্ছে করে। কখনও বলা হয়নি। আমার হৃৎপিন্ডের সাথে তোমার কি গোপনে কথা হতো তখন? তা নাহলে আমার অসুখকে আমি বুঝতে চাই না, তুমি বুঝে ফেলতে কি করে? তুমি কি করে বুঝে ফেলতে আমার হৃৎপিণ্ডের ব্যথা! আবার তাই যদি হয়, তাহলে এখন যে ব্যথায় শুধু হৃৎপিণ্ড নয়, ফুসফুস, যকৃৎ, কণ্ঠ, হাত পা সারা শরীর যে ব্যথায় মরে যাচ্ছে। একবারও মনে হচ্ছে না কেনো?
ইসমত শিল্পী
সম্পাদক, নান্দিক
অনুসূয়া চলে যাবার পর
Syed Mahmud2025-05-16T16:33:04+00:00May 14, 2025|
সম্পাদকের কথা-(মাকে নিয়ে চিঠি)
Ismat Shilpi2025-05-11T17:55:08+00:00May 11, 2025|
তোমার নৃত্যের তালেই আমি বাঁধা মা
Abhra Barua2025-05-11T17:04:20+00:00May 11, 2025|
অব্যক্ত উক্তি মায়ের প্রতি
Mahbub Islam2025-05-11T16:40:39+00:00May 11, 2025|
মা দিবসে – মায়ের কাছে চিঠি
Sushanta Halder2025-05-11T16:32:01+00:00May 11, 2025|