আয়না এবং ইত্যাদি
সুরঞ্জন দত্ত চৌধুরী
নার্সিসাস ছিল “আপন রূপে পাগলপারা” । সরোবরের জলের কিনারায় বসে থাকতো ঝুঁকে স্থির নিশ্চল জলতলের উপর দৃষ্টি পেতে । নিজের রূপে নিজেই আত্মহারা । প্রকৃতি তার অবয়বে ব্রহ্মান্ডের সমস্ত নান্দনিক উপাদান সংগ্রহ করে সাজিয়ে দিয়েছিল তার দেহ। অজস্র নারী তাকে পাবার আকাঙ্খায় নিজেদের নৈবেদ্য সাজিয়ে নিবেদন করতো । সেসবে তার মন নেই। সরোবরের তীরে জলের প্রতিফলনে নিজের রূপ দেখে নিজেই মগ্ন। আমৃত্যু বসে রইল নিজেকেই নিষ্পলক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে করতে মরণকে আলিঙ্গন করলো। আর সেই স্থানেই উঁকি দিল একটি ফুল গাছের চারা আর সেই গাছের ফুলই হল নার্সিসাস ফুল । এ গল্প গ্রীক পুরাণের । সেই শিকারীর সময় কোন আয়না থাকলে হয়ত বা সে তার গৃহে শুয়ে বসেই নিজের রূপ উপভোগ করতে পারতো , আমৃত্যু সরোবরের তীরে কাল কাটাতে হতনা।
মোহিনী ঊর্বশী মেনকা রম্ভা , ভারতীয় পুরাণের সুন্দরীরা আকাশে তাদের প্রতিবিম্ব দেখত । পুরাণ বর্ণিত কত সুরাসুর তাদের পাবার জন্য সংগ্রামেও লিপ্ত হত ।
মিশরসম্রাট দ্বিতীয় রামেসিসের সম্রাজ্ঞী নেফারতারি ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী । তিনি নিজেকে দেখতেন ধাতুমুকুরে অথবা বিশেষ একধরনের উজ্জ্বল প্রস্তর-তলে। ঐতিহাসিক চরিত্র হেলেনের রূপে আকৃষ্ট নৃপতি তো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেও পিছপা হয়নি । ভারতসম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি তো রাণী পদ্মাবতীর রূপের কথা শুনেই চিতোর দূর্গ অবরোধ করে বসে রইল শুধু একবার দেখার জন্য; শেষে রাণীর ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই প্রতিবিম্ব প্রাসাদের পরিখার জলে প্রতিফলিত ছবি দেখেই তাকে ফিরতে হয়েছিল। সেই ঘর সেই আয়না দেখে এসেছি আমি নিজে দুবার আর কল্পনা করেছি , ভাগ্যিস সে যুগে জন্মাইনি তাহলে রাজপুত প্রহরীর উদ্ধত কৃপাণের এক কোপে আমার পিতৃদত্ত মুন্ডু টিই হারাতে হত মহারাণীর কক্ষে অনুপ্রবেশের অপরাধে । ঐ রূপসীদের রূপচর্চা করাতো দাসীরা , একজন সামনে ধরে রাখত দর্পণ । ধাতু নির্মিত দর্পন , তার মধ্যেই প্রতিফলিত হত তাদের প্রতিচ্ছবি। প্রস্তরযুগের সুন্দরীরা প্রস্তর খন্ডেই দর্পনের কাজ সেরে নিতেন । এন্ড্রোমেডার ক্ষেত্রেও অনুরূপ সংবাদ পাই আমরা । অজন্তা গুহার চিত্রকলায়, ইলোরার ভাস্কর্যেও দেখি দর্পনের ব্যবহার । আম্রপালী ! আহা নামেই মধুক্ষরণ, অসংখ্য রাজন্যবর্গ , অমাত্যকুল, ধনাঢ্য বণিক তাদের রত্নভান্ডার তার পদপ্রান্তে ঢেলে দিত ক্ষণিকের সঙ্গলাভের জন্য। তার চিত্রায়নেও দেখি অসংখ্য সেবিকা তার রুপচর্চায় নিয়োজিত , সামনে দর্পন ধরে থাকে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখার জন্য । এসব তো গেল রূপচর্চায় দর্পনের ইতিবৃত্ত ।
স্বয়ং সূর্য সারারাত তার নিজের রূপচর্চা করে তার চন্দ্রমুকুরে , নিজেকে সারা রাত ধরে দেখে বিভিন্ন কৌণিক অবস্থানের রূপ লক্ষ্য করে ।
স্ফটিক আবিস্কারের আগে পর্যন্ত বিভিন্ন স্বচ্ছ তল ব্যবহৃত হত প্রতিচ্ছবির প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত করার জন্য। এখন আমরা ব্যবহার করি কাঁচের আয়না । কিন্তু এ-ও তো ক্রমাগত এর উপযোগিতা হারাচ্ছে । এই আয়না তো শুধু দেখাতে পারে একটি মানুষের বহিরঙ্গের রূপ। ভিতরের কোন প্রতিবিম্বই প্রতিফলিত করতে অক্ষম । বাইরেটা তো দেখছি বহুকাল। অবশ্য বিজ্ঞানীরা দেহের ভিতরের অঙ্গাংশ গুলির ছবি তুলতে পারে নানা প্রয়োজনে, বিশেষত চিকিৎসার জন্য । সে-ও নাহয় হল। অর্থাৎ, যা পঞ্চেন্দ্রীয় গ্রাহ্য তাই আংশিক জোড়াতালি দিয়ে আয়নাগুলি দেখাতে পারে। এতোকাল তো হয়ে গেল ,। বিজ্ঞান তো মহাকাশ জয়ের বিজয়ী বীর । কিন্তু কৈ, আমার চিন্তার ছবি ? সে তো দেখা যায়না আয়নায় ? আমার অতীতের ঘটনাবলী , আমার ভবিষ্যতের চলমান ছবি এসব তো দেখার মত আয়না আবিস্কারই হলনা ? কতদিন আর শুধু বাইরের ছবি দেখিয়ে তুষ্ট রাখবে এই আয়না ?
জন্মের পরই অনেক মানুষ তার সন্তানের ভবিষ্যত জানার জন্য ছোটে সব অদ্ভুত গাণিতিকের কাছে । তারা কি এক অংকে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থানের নিশানা দেখে জাতকের ভবিষ্যত গণনা করে দেয়, বলে দেয় , কি কি ঘটন ঘটার সম্ভাবনা আছে এই জাতকের । অনেকেই বিশ্বাস করে । আবার শুণেছি হাতের রেখা পর্যবেক্ষন করেও নাকি গণৎকারেরা ভুত ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে । আমার মনে হয়েছে এগুলিতে কোন বিজ্ঞান নেই, যা আছে তা হল খানিকটা ডিডাক্টিভ লজিকের মত। এই হলে এই হয় , উদাহরনের বিজ্ঞান !! ( আমার নিজের পরিবারে এসব প্রায় সকলেই ভুল প্রমাণিত হয়ে হয়ে আমাদের প্রজন্মে বর্তমান্র বর্জিত)।
এখন বিজ্ঞানীদের উঠেপড়ে সাধনা করার সময় এমন এক আয়না আবিস্কারের জন্য যার সামনে দাঁড়ালে আমি কেবল আমার তাৎক্ষনিক স্থিরচিত্রই নয় , ইচ্ছা করলে আমার অতীতের স্পষ্ট চলচ্ছবি দেখতে পাবো। ঘটনা , দুর্ঘটনা , মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ঘটনাবলি সব স্পষ্ট দেখা যায়। অতীতের অনেক ঘটনাই আমরা ভুলে যাই, আবার অনেক কিছুই গোপন কুঠুরিতে ঢূকিয়ে কুলুপ এঁটে রাখি। তাহলে আমরা প্রধান মন্ত্রীর আয়নাটি সংগ্রহ করেও দেখে নিতে পারি, কোন চিন্তাগুলি আসল কোনগুলি নকল। স্বামী স্ত্রী , প্রেমিক প্রেমিকা র আয়নাগুলি কত উপকারী হবে ভেবে আমি খুবই উত্তেজিত বোধ করি।
আসলে আমি চাই এমন আয়না , যা মানুষের চিন্তার ছবিকে প্রতিফলিত করতে পারবে । কেবল পলকের স্থির চিত্রে আর সন্তুষ্ট থাকতে হবেনা ।
শেষ পর্ব
সত্যি সত্যিই যদি এমন আয়না থাকতো, তবে মানুষ তো একে অন্যকেই দোষী করে, নিজের দুর্বলতা , নিজের দোষ ত্রুটি লুকিয়ে রেখে সকল দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দেয় । এই যে এত ছাড়াছাড়ি, এর জন্য একে অন্যকেই শুধু দায়ী করে । কত সুবিধা হত বিচারপতিদের, ব্যক্তিগত আয়না আনিয়ে নিয়ে তাঁরা দেখে অতি অল্প সময়েই রায় দিয়ে দিতে পারতেন কার ত্রুটির পাল্লা বেশী ভারী। ন্যায় অন্যায় বিচার সহজেই হতে পারত । এবং সবাই জানত, আমি যা করি , যা ভাবি, যা করবো বলে ভাবি সবই গ্রন্থিত , না , আয়নাস্থিত হয়ে যেত এবং তা ডিলিট করার পাসওয়ার্ড থাকত একমাত্র বিচারপতিদের কাছেই গচ্ছিত ।
আমি বেশ কিছু জীবনী ও আত্মজীবনী পড়েছি ছাত্রজীবন থেকেই। বিদ্যাসাগর , বিবেকানন্দ সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে হাল আমলের মৌলানা আবুল কালাম আজাদ , মুজাফফর আহমেদ , বঙ্গবন্ধু মুজিবর, মায় জ্যোতি বসু মশায়দের । আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় মহাপুরুষ এবং বড় বড় মানুষের দোষ ধরতে নেই , তাঁদের গুণ গুলিকেই পাথেয় কর । আর ধর্মগুরুদের কথা তো বলেই দেয়া হয় , “ওঁয়ারা যা বলেন তাহাই অনুসরণ কর , যাহা করেন তাহা করিওনা ।“ “King Can Do No Wrong” । ব্যক্তিগতভাবে আমি কি ভাবি বা না ভাবি তাতে ঐ সকল বড় বড় মানুষের কিছুই যায় আসেনা । কিন্তু গান্ধিজী, নবাব সলিমুল্লাহ, মায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীদের হাঁচি কাশিতেই আমাদের জীবন মরন । এঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব আয়নাগুলি যদি থাকত, একটু দেখেই নিতে পারা যেত, আসলে এঁরা কি বলেছেন বা বলেছিলেন আর কি করেছেন বা করেছিলেন । কিংবা বেঁচেবর্তে যারা আছেন তাঁরা কি বলেছিলেন আর এখন কি ভাবছেন আর করছেন । এতে তো আতংকিত হবার কোন কারনই নেই , কারন সবাই তো আমরা সৎ চিন্তা করি , সৎ কর্ম করি , এবং সদ্ভাবনায় ভাবিত থাকি । অন্তত দাবি তো করি যে আমার কোন দোষ নেই, “ যত দোষ নন্দ ঘোষ” ।
আমাদের পাড়ার একটা সত্যি ঘটনা দিয়ে আমার এই ঘাসবিচুলি শেষ করবো । ধরা যাক একজনের নাম বিশু, আরেকজনের নাম মিতা । বিশু মধ্যবিত্তঘরের বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র । কলেজ প্রায় অতিক্রম করতে চলেছে । অপূর্ব সুন্দরী জমিদারকন্যা মিতা দুবছরের জুনিয়ার , স্কুলেই । বিশুর সুঠাম অবয়ব ,বাবরী চুল, আর তুখোড় মেধায় আকৃষ্ট মিতা । দিব্যি চলছিল গোপনের ক্ষণিক দেখা , স্বর্ণচাঁপার সুগন্ধী মাখা মিতার সান্নিধ্যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা বিশু দিন দিন তার কৃতিত্বের মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে লেখাপড়ায় । স্বর্ণপদকে আলমারী সেজে উঠছে তার বাড়িতে । শেষ স্বর্ণপদকটি সে লুকিয়ে মিতার হাতে গুঁজে দিয়ে বাড়ীতে অভিভাবকদের মিথ্যে বলেছিল, পরে দেবে । জমিদারী কৌলীণ্যে আরেক ধনাঢ্য ব্যক্তির পুত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল । অবাক বান্ধবীরা জিজ্ঞেস করেছিল, কি রে ? বিশুদার কি হবে । উত্তরে মিতা বলেছিল,” ও-ই তো অন্য একজনের সাথে ফষ্টী নষ্টী করছিল ।“ কি ঘেন্না কি ঘেন্না, আর বিশ্বাস রাখা যায় ? বিস্মিত হয়ে বান্ধবীরা মুখ চাওয়া চাওয়ী করছিল, কারন এই অভিযোগটি তো বিশুদা-ই আনতে পারত। সোমনাথ দা-র সাথে ……।
পরে দীর্ঘ কুড়ি বছর বিশু পাগলা মিতার বাড়ির সামনের পথে দুবেলা যাতায়াত করত , আর বিড় বিড় করে অনুচ্চ কন্ঠে মিতা মিতা বলে ডাক পাঠাতো । বাড়িতে দুবেলা খাবার টেবিলে তার নির্দিষ্ট বসার চেয়ারের পাশে আরেকটি চেয়ার পেতে একটি খাবার সাজানো প্লেট দিতে হত , নাহলে খাওয়ানো যেতনা । আর কিচ্ছুটি কাউকে বলতনা । না, পাগলামীর কোন চিহ্নই আর কিছু ছিলনা আমৃত্যু ।
এ তো দেখা আমার ।
আচ্ছা ভাবুন তো যদি একখানা সেই আয়না যদি থাকত, বিশু পাগলা হয়ত বিশ্বনাথ বিজ্ঞানী কোন আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগারে তার স্থান নির্দিষ্ট থাকত তখন সে দেখতে পেত মিতা আসলে তার ভালোবাসার আধার হিসেবে যোগ্যই ছিলনা । মানসিক বিকলন থেকে হয়ত সে রক্ষা পেত ।
সে দিন একদিন আসবেই । সেই আয়না আমরা একদিন পাবোই এবং মানবসমাজ সেই দিন এক পরিচ্ছন্ন সমাজে পরিণত হবে ।