ফুলিদের পদযাত্রা
টিবিতে কইতাছে কালকে গার্মেন্ডে হাজির না থাহলে চাহরি থাইকবো না।
ফুলি, ও মা ফুলি, ওড ওইড্যা পর।
পুবাল বাতাসে ফুলির সকালের ঘুমটা কেবল জেকে বসেছিলো ।
বাবার হাঁক ডাকে সে ওঠে আসে। চোখ মুছতে মুছতে ঘুম জড়ানো চোখে বাবার মুখের দিকে হা করে চেয়ে থাকে। ওর চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় !
কি কও বাজান ? খুল্ল্যা কও।
চোখে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে ফুলি ওর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফুলির বাবা বারিক মন্ডল ব্যস্ত হয়ে ওঠে –
হ মা, সত্ত কইতাছি। আফরুজালির দুকানে টিবিতে কইতাছে হুইন্যা আইলাম। হগ্গোলেই হাইড্ডা মেলা করতাছে। ল তৈয়ার হয়া ল।
ফুলি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সে তড়িঘড়ি রাতের কড়কড়া
একটা থালায় করে বাবার সামনে দেয়। থালায় রাতের রাধা পাট শাক আর একটু ডালও দেয়।
বারিক মন্ডল দেরি করে না। গেলাস থেকে ডান হাতে একটু জল নিয়ে তার পেছনের দিকে মাটির মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে হাত ধোয়ার কাজ সেরে নেয়। সে খাওয়া শুরু করে। মেয়েকে বলে –
তুইও চারটে খায়া ল।
ফুলি ব্যাগে তুলে রাখা এক সেট সেলোয়ার কামিজ বের করে। গত ঈদে বারো শ ‘ টাকায় কিনেছিলো । বাবাকে পেছোনে আড়াল করে প্রথমে পরনের জামা খুলে নতুন জামাটা পরে, তারপর সেলোয়ার খুলে নতুন সেলোয়ার পরে নেয়। মুখে একটু পাউডার মাখে। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগায়। চিরুনি দিয়ে চুলগুলোর এপাশ ওপাশ কয়েকটি লম্বা করে টান দেয়। ফুলির চুলগুলো প্রায় হাঁটু ছোঁয় ছোঁয়। মাঝ মাঝে সামলাতে কষ্ট হয় ওর।
যেটুকু কড়কড়া ভাত ছিলো সবটুকু বাবাকে দিয়ে দিয়েছে নিজের জন্যে কিছুই না রেখে। সে শুধু এক গেলাস জল খেয়ে নেয়।
বারিক মন্ডলের মা-মরা মেয়ে এই ফুলিই। ছয় বছর বয়সে ওর মা হাওয়া খাতুন দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। সরকার বাড়ির বর্গা করে, কায় কামলা দিয়ে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে ফুলিকে।
মেয়ের কথা ভেবে সারা জীবন একাই কাটিয়ে দিলো। বিয়ে সাদি আর করা হলো না।
দক্ষিণ পাড়ার নতু মন্ডল কতো পিড়াপিড়ি করেছে-
ল বারিক, ফতে পাগলিরে দিয়ে তরে বিয়া করায়ে দেই। পাগলির কাচা বয়স। শইল গতরও বালা। দেকতেও সোন্দর । দোষের মদ্দে সব কতা ভুল্যা যায়। তাই আগের সোয়ামি ছাইড়া দিছে।
নতু তার হলুদ দাঁতগুলো বের করে বাহারি হাসি হাসে। বারিক আকিজ বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বিড়িটা নতুর হাতে না দিয়ে ওর পায়ের কাছে সজোরে ছুড়ে মারে। নতু বিড়িটি হাতে তুলে নেয়।
বারিক হন হন করে বাড়ির পথ ধরে। বিড়িবিড় করে আওড়ায় –
না। বিয়ে আমি করুম না। মইরা গেলেও না।
সে নিজে নিজেই গড়গড় করতে থাকে।
নতু আর কথা বাড়ায় না। বারিকের ছুড়ে দেয়া বিড়িতে টান লাগায়। মুখে স্বগতোক্তি করে-
শালা, পাগলা ।
ফুলি যখন হয় তখন ওরা খুব খুশি হয়েছিলো। ফুলের মতো চেহারা নিয়ে জন্মেছিলো ফুলি। তাই হাওয়া খাতুন আদর করে নাম রেখেছিলো ফুলি।
বাপ বেটি তড়িঘড়ি পিরিচপুর মোড় আফরোজ আলীর দোকানের সামনে গিয়ে দেখে এক হাটের মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। বাস নাই, অটো নাই, রিকশা ভ্যান কিছুই নাই। একটা অটোবাইক এলে সবাই হুড়মুড় করে ওঠার চেষ্টা করে। মানুষের মাথা মানুষে ভাঙে। গড়খোলা,খামার পাড়া, মাধবপুর, লাউচাপড়া, মাটিফাটা,কর্ণঝুরা, চুকচুকি থেকে পিঁপড়ের জাঙ্গালের লাহান মানুষ আসতে আছে। বাট্টাজোরের মানুষও নুকাই বিল হয়ে সোজাসুজি পিরিচপুর এসে ওঠছে।
সবাই পায়ে হেঁটে।
সবার মনে একই ভয় আগামীকাল হাজির না থাকলে চাকুরি থাকবে না।
গার্মেন্টস মালিকরা পোশাককর্মীদের কুকুর বিড়ালের চেয়েও খারাপ চোখে দেখে। এরা রাত দুটা তিনটে পর্যন্ত শ্রমিকদের কাজ করাতে বাধ্য করে। নিয়ম অনুযায়ি যে অতিরিক্ত ভাতা তাদের প্রাপ্য তা তারা কখনোই পায় না। মালিকরা দেয় না। কথা না শুনলে চাকরি নট। মালিকরা কখনোই কারখানা আইন-১৯৬৫ অনুসরণ ও পরিপালন করে না।
ILO কনভেনশান এরা থোড়াই কেয়ার করে।
ফুলিরাও জানে হাজির না থাকলে সত্যি চাকুরি থাকবে না। এখন চাকুরি হারালে না খেয়ে থাকতে হবে। এই সুযোগটাই মালিকরা নিয়ে আসছে চার দশক ধরে।
হাওয়া খাতুন মারা যাওয়ার পর অসুখ বেসুখে বারিক অনেক কাবু হয়ে গেছে। এ জন্যে বর্গা চাষ করাও ছেড়ে দিয়েছে। ফুলি বেতন পায় আট হাজার টাকা, ওভার টাইম নিয়ে এগারো বারো হাজার পড়ে। এদিয়েই বাপ বেটির চলে যায়।
এবার এক বিঘা জমিও বন্ধকি রেখেছে ফুলি।
এই চাকুরি চলে গেলে আর কোনো উপায় থাকবে না। অগত্যা ফুলিরা হেঁটেই ঢাকার পথ ধরে ।
সবাই ঢাকার যাত্রী । সবাই পোশাক কর্মী।
এইডা কেমুন বিচার ! রাস্তায় এডা গাড়ি নাই। কালকেই হাজির থাকোন নাইগবো, তা না অইলে চাহরি থাইকবো না। এইডা এডা কতা ! কও দেহি। জ্বরে গাওডা পুইরা যাইতাছে।
এক মাঝবয়সী অসুস্থ মহিলা নিজে নিজে প্রলাপ বকছে।
বকশিগঞ্জ, কামালপুর, সানন্দা বাড়ি, ষাড়মারা, রাজীবপুর, রৌমারি, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধার মানুষও শ্রীবরদী হয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। ট্রেনও বন্ধ।
গাইবান্ধার কুলসুম নামের এক মেয়ে হোচট খেয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নোখ উল্টিয়ে ফেলেছে।
কলকল করে রক্ত পড়ছে । সে শ্রীবরদী হাসপাতালের সামনে মাটিতে ল্যাঠা দিয়ে বসে কান্না কাটি করছে। হাসপাতাল লক ডাউন। তাই পাশের ওষুধের দোকান থেকে একটু ডেটল, ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে নিয়ে একজনের কাঁধে হাত দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়েই হাঁটতে শুরু করে।
শেরপুরে খুবই কড়াকড়ি। একটা রিকশাও নেই। বারিক মনে করেছিলো শেরপুরে একটা হিল্লে হবে।
কিন্তু কোনো আশা নেই। সে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে –
এতো মানুষ পায়ে হাইট্যা কেমনে ঢাহায় যাইবো !
সে ঢাকা যাত্রীদের মিছিলের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে।
বারিকের কাছে শুধু বাপ বেটির গাড়ি ভাড়াটাই আছে। গত তিন মাস ধরে ফুলি বেতন পায় না। বিদেশে নাকি মাল নেয় না। কি সব কয় ফুলি।
চৈত্র মাসের উপড়ানো পাট শাকের মতো ফুলি নেতিয়ে পড়েছে। ও আর হাঁটতে পারছে না।
মেয়েকে নিয়ে বারিক একটি ছোট হোটেলে ঢুকে। বাপ বেটি কল চেপে মুখ ধোয়। এক পাশের বেঞ্চিতে বসে। চারটে রুটি আর পাতলা ডাল নিয়ে ওরা খায়। বারিক কয়েক গেলাস পানি ইচ্ছে করেই বেশি খায়। পেট ভরা থাকবে।
ফুলি আবার হাঁটতে শুরু করে। বারিক আর মেয়ের সাথে তাল মেলাতে পারে না। পেছোনের মানুষ সবাই ওদের পাশ কেটে সামনে চলে যায়।
রাস্তার দুই পাশে মানুষের মিছিল। মাঝখানে ফাঁকা। এজতেমার জামাত ভাঙলে যেমন মানুষের ঢল নামে তেমনি মা