আমার ডেল্টা প্রেম
(রোগশয্যার পাঁচালি)
লুকোচুরির ছোঁয়াছুঁয়ির কাহিনী – ৩য় পর্ব
আবার আমি নিজেকেই আবিষ্কার করি ১৯৩৮ এর আগ্রাসী জাপানীদের বিরুদ্ধে লড়াকু চীনের শানবেই প্রদেশে অগ্রবর্তী অষ্টম বাহিনীর দুর্মর গতিতে জাপানী শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে এগিয়ে যাবার পথে আহতের তাঁবুতে আমি শয়ান।
আমার শরীর কোন দিনই বেশ শক্ত পোক্ত পেশীবহুল শালপ্রাংশু পুরুষোচিত নয়। ছোট থেকেই খুব কায়িক পরিশ্রম, শক্তি প্রয়োগের কাজ আমি করতে পারিনা। বলা ভাল একটু নরম সরম কৃশকায় গড়ণের। কাজেই আমাকে শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে নিতে হত। দৈহিক শক্তির অভাব আমাকে বুদ্ধি প্রয়োগে বাধ্যগত ভাবেই বেশী ক্রিয়াশীল করে রাখতে হয়েছে। কিন্তু একটা কথা আমার কেন জানিনা মনে হত, রোগশোক আমার খুব একটা হবেনা। বড় দেহ, বড় রোগ। আমার ছোট দেহ, রোগও ছোট। কিন্তু মজা হল, ছোট থেকেই মৃত্যুবাহনে কালরোগ বেশ কয়েকবার এসেছে, আমার দেহকান্তির রং মলিন করেছে, আমার জন্মগত কুঞ্চিত কেশগুচ্ছ বিরল করেছে, বেঁচে উঠেছি বার বার সেবা, ওষুধ এবং সহ্যশক্তির জেরে। বোধ হয় সে জন্যেই মনে মনে একটা সুপ্ত আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে যে আমি রোগজয়ী, কোন দৈহিক রোগ আমাকে সহজে কাবু করতে পারবেনা।
বাড়ি থেকে যেতে যেতে পুত্র পুত্রবধুর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছিলাম আমাকে নিয়ে এই যে জীবনে প্রথম হাসপাতালে যাচ্ছে, ওরা কি ভাবছে। নানা কথা ভেসে আসছিল মনে। জন্ম, বেড়েওঠা পড়াশোণা, বিয়ে, সংসার আমাদের ছোটখাট বিবাদ বিসংবাদ, আঁকড়ে থাকা, এইসব খুঁটিনাটি। এরা কি ভাবছে ওদের মায়ের মতই আমাকেও আর ফিরিয়ে আনতে পারবেনা? কিন্তু মজার বিষয় আমার নিজের কখনো মনেই হয়নি যে এই জ্বর কাশি দুর্বলতার কাছে হার মেনে আমি আর ফিরতে পারবোনা। ভিকি বোধ হয় নিজের মনকেই সাহস দেবার জন্য বারেবারেই বলে উঠছিল, জ্যেঠু, আমিই তোমাকে এসে নিয়ে যাবো, দু তিন দিনের তো মামলা।
গাড়ির শার্শী খোলা। সুন্দর হাওয়া ই এম বাই পাসের চওড়া রাস্তার। আমার মনে গুণ গুণ করছে আমার একটি প্রিয় গানঃ
“বিরস দিন
বিরল কাজ
প্রবল বিদ্রোহে,
এসেছ প্রেম
এসেছ আজ
কি মহা সমারোহে.. “
প্রেম এখানে রোগ হয়ে হাজির। আচ্ছা আমার কি করোনা হল? ঐ যে আজকাল কি বলে, ওমিক্রন? জানিনা। টেলিফোনে হাসপাতাল বলেছে, গেলে টেষ্ট করে ওরা ঠিক করবে। আমার কিন্তু মনে হচ্ছিল, বাপুহে জীবনে বহু বহুবার শুকনো কাশি জ্বর সর্দিতে ভুগে সাবু বার্লি খেয়েছি, লক্ষণ সব একই, যে নামেই সাজাওনা কেন, আমার ভোগান্তি একই রকম। তোমরা সব জব্বর জব্বর নাম দিতে বেশ ভারী গুরুগম্ভীর ভাব সাব করো আজকাল। নামের বাহার। বলতে পারা যায়, ওহ আমি “মাল্টিডালিয়া ক্রিসেন্থিমাইম” (স্বকপোলকল্পিত নামকরণ) অসুখে ভুগে উঠলাম, শ্রোতারা বৈঠকে চোখ গোল্গোল করে তাকিয়ে থাকবে, বেশী খাতির করবে। আসলে তো সর্দি হাঁচি জ্বর। একটা বেশ আত্মপ্রসাদ পাওয়া যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে সুসজ্জিত ইমার্জেন্সীর টেবিল কাম খাটে আমাকে শুইয়ে দিল তিন চারজন পুরুষ মহিলা। শরীরটার শীত লাগছে এই প্রথম। একটা সাদা চাদর, তার উপর ব্ল্যাংকেট দিলে চাপিয়ে। তবু শীত। তারা একযোগে অভ্যস্ত দক্ষতায় আমার বাঁ হাতের তালুর পিঠে ইঞ্জেকশাণের ছুঁচ ফুটিয়ে স্থায়ী চ্যানেন করে বেঁধেছেঁদে রাখল, একটা খাড়া দন্ড মাথার কাছে, তা থেকে ঝুলিয়ে দিল দুটি বড় ছোট বোতল, পলিথিনের সরু পাইপ চ্যানেলের সাথে দিল জুড়ে। নাকে অক্সিজেনের মাস্ক। উত্যাদি ইত্যাদি। আমি মনে করছি, তাহলে বেশ সাজুগুজু করেই এসেছেন তিনি, নইলে আমার এত সাজসজ্জা কেন? নিজেকে বেশ মহাকাশচারীর মত দেখতে লাগছে। আত্মপ্রসাদ ভোগ করে নিলাম ক্ষণিকের তরে।
ঘন ঘন রক্ত নিতে লাগল, তাৎক্ষণিক নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। বুঝলাম, ওরা মহামতি অতিমারী কেই খুঁজছে।
তাহলে সত্যিই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল !
দরজায় উঁকি দিচ্ছে কয়েকটি উৎকণ্ঠ, সন্ত্রস্ত অসহায় মুখ। কাৎ হয়ে দেখছি টেবিলে শুয়ে। পুত্র, কন্যা পুত্রবধু জামাতা বাবাজীবন, রথের সারথী ভিকি।
আমি সমর্পিত প্রাণে ঘরের সিলিং এ পাঁচ বছর আগে আমাকে ছেড়ে যাওয়া তার মুখের ছবি খুঁজছি। বুঝলাম রোগের সাথে আমার দ্বৈরথের শিঙা বেজে উঠল।
কিছুক্ষন বাদেই আমার শয্যা চলমান হল, দুজন সামনে পিছনে টানা ঠেলা করে ভিতরে কোথায় নিয়ে চলল, পাশে পাশে উদগ্রীব ভেঙে পড়া স্নায়ুকে শক্ত করে হাত নাড়াচ্ছে আমার আত্মজরা, যেন বলছে, বাইরে আছি, এইত একটু পরেই নিয়ে যাবো তোমাকে ফিরিয়ে। আই সি ইউ এর প্রশস্ত প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে গেল।
আমাকে একটি পর্দার আড়ালে তিন দিক ঘেরা রুমের শয্যায় তুলে শুইয়ে দিয়ে টানা টেবিল- খাট টি নিয়ে বেরিয়ে গেল বাহকরা।
সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার ঝিমধরা আলোয় অনেকেই চলাফেরা করছে। প্লেনের আইলের মতন লম্বা পথের দুই ধারে ছয়টি বিছানায় আমরা ছয়জন, ঠাহর করে দেখলাম। আমার শরীরকে ওরা আগেই ওদের ইউনিফর্ম দিয়ে ঢেকেছে। কোন শব্দ নেই, অথচ বেশ কিছু মহিলা পুরুষ ত্র্যস্তপদে ঘন ঘন যাতায়াত করছে, এ রোগী ওরোগীর কাছে। কত কি যে করছেন ওরা। ওষুধ, ইঞ্জেজশান, ড্রিপের বোতল অজস্র তরল ওষুধ ঝোলানো রোগীর পাশে পাশে, চ্যানেলে অনবরত স্রোতের মত শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। তারা চলাফেরা করছেন। যেন একটা সম্মীলিত কোরিওগ্রাফি। কোন শব্দ নেই, ওলিম্পিকে দেখা সিনক্রোনাইজড ওয়াটার সুইমিং কাম ডলফিন ডান্স।
হঠাৎ যেন নৈঃশব্দের এক তীব্র চিৎকারে কম্বুধ্বনি , ” নো পাসারান”। আমি যেন ১৯৩৬ সালের স্পেনের গৃহযুদ্ধের এক অস্থায়ী টেন্টে অপারেশান টেবিলে শুয়ে, আহত আমাকে এই মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে মেকশিফট থিয়েটারেই রক্ত দিয়ে তাজা করে রাইফেল কাঁধে বের করে দেবে ডাক্তারেরা। পশ্চাদপসরন নয় কিছুতেই। শত্রুকে এগোতে দেয়া চলবেনা। আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে। মৃত্যুর সমস্ত শস্ত্রকে ভোঁতা করে, তার বিষ তীর গুলিকে নির্বিষ করে জীবনের জয়পথে বিজয়ের ধ্বজা নিয়ে রথের ঘর্ঘর ধ্বনিতে চতুর্দিক প্রকম্পিত করে তুলতে হবে জীবনের জয়গান। আধো ছায়ায় চলমান নার্স, সাপোর্ট স্টাফদের চোয়াল শক্ত, দৃষ্টি ব্ল্যাক প্যান্থারদের মত জ্বলজ্বলে তীক্ষ্ণ । আমার গলা শুকনো, অস্পষ্ট শব্দ, জল, অমনি যেন একটা ছায়াকৃতি কায়া হয়ে,মৃদু আদুরে কন্ঠে, “বাবা, এই নাও, একটু হাঁ কর। ” সস্নেহে এক হাত দিয়ে মাথাটি তুলে আরেক হাতে মেজার গ্লাসে জল খাইয়ে দিল। মেয়েগুলো সব মা হয়ে গেল, লোকগুলো সব বাবা, আমরা সব শিশু সন্তান।
প্রত্যেকের চলাফেরা, দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল, দক্ষতা ক্ষিপ্রতায় এক শপথ, মৃত্যুর থাবাকে গুঁড়িয়ে জীবন ছিনিয়ে নিয়ে রাখতেই হবে। এই যেন তাদের পণ, এই শপথেই তারা আত্মবিশ্বাসী।
আবার আমি নিজেকেই আবিষ্কার করি ১৯৩৮ এর আগ্রাসী জাপানীদের বিরুদ্ধে লড়াকু চীনের শানবেই প্রদেশে অগ্রবর্তী অষ্টম বাহিনীর দুর্মর গতিতে জাপানী শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে এগিয়ে যাবার পথে আহতের তাঁবুতে আমি শয়ান। আমার ক্ষত সারিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করিয়ে, চলমান রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতিতে তাজা করে ফরোয়ার্ড মার্চে পা মেলানোর জন্য তৈরি করার ব্যবস্থা হচ্ছে। সেখানেও কমরেড নর্মান বেথুন, আমার পাশে।
আমার এই আই সি ইউ তে নারী পুরুষ সকলেই যেন এক একজন ডা. নর্মান বেথুন। স্যাক্রেড হার্ট হাসপাতালের প্রধান সার্জেন, চলমান রক্ত সঞ্চালনের ব্যবহারিক প্রয়োগকারি বিপ্লবী ডাক্তার। যেখানে জীবনের মুক্তির সংগ্রাম, সেখানেই ছুটে বেড়াচ্ছে সে। আজ এখানে সে বহুতে আবির্ভূত। ভাবছি আর শক্ত হচ্ছি, আত্মবিশ্বাস বেড়েই চলল আমার। আমি মৃত্যুঞ্জয়ী হবই।