আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতায়

By Published On: March 25, 2025Views: 18

আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতায়
এস ডি সুব্রত

বাংলা সাহিত্যের  এক অভিমানী কবি আল মাহমুদ । পুরো নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ । সাহিত্য জগতে আল মাহমুদ নামে পরিচিত । আল মাহমুদের ডাক নাম ছিল পিয়ারু। কবি আল মাহমুদের পূর্ব পুরুষগণ  ইসলাম প্রচারক দলের সাথে বাংলাদেশে আসেন ফিরোজ শাহের সিলেট ও উত্তর কুমিল্লা দখলেরেও দুইশত বছর পর । কাইতলার মীরদের একটি শাখায় জন্ম কবি আল মাহমুদের । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল মোল্লা বাড়িতে কবি আল মাহমুদের জন্ম ‌ । বাবার নাম মীর আব্দুর রব এবং মায়ের নাম রওশন আরা মীর। আল মাহমুদের দাদা মীর আব্দুল ওহাব ছিলেন কবি যিনি আরবি ফারসি ভাষায় পন্ডিত । লিখতেন জারি গান । আল মাহমুদের মা ছিলেন সিলেট শায়েস্তাগঞ্জ এলাকার এক  জোরদারের মেয়ে । দাদীর পান খাওয়া লাল ঠোঁট আর তাঁর মুখ নিঃসৃত অনন্য সব রুপকথা শুনে শুনে বড় হয়েছেন কবি আল মাহমুদ । 

বৈচিত্র‍্যময় ছিল কবি আল মাহমুদের  জীবন। কখনো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন, কখনো প্রুফ রিডার ছিলেন, কখনো কবিতা লিখে গেছেন নিরন্তর। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। আঠারো  বছর বয়স ১৯৫৪ সালে লেখালেখির সূত্র ধরে কবি ঢাকা আসেন। তখন থেকেই তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। আজীবন আত্মপ্রত্যয়ী কবি ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা করে একের পর এক সাফল্য লাভ করতে থাকেন। কবি নিজেই বর্ণনা করেছেন সে অভিজ্ঞতা। এক সাক্ষাৎকারে গ্রাম থেকে শহরে আসা নিয়ে কবি বলেন- “আমি ঢাকায় এসেছিলাম খদ্দরের পিরহান গায়ে, পরনে খদ্দরের পায়জামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল, বগলের নিচে গোলাপফুল আঁকা ভাঙা সুটকেস নিয়ে। এসেছিলাম অবশ্যই কবি হতে। আজ অনেক বছর শহরে আছি। আমার সুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী, পাখি, পতঙ্গ, নৌকা, নর-নারীসহ বহমান আস্ত এক বাংলাদেশ। যেমন, জাদুকররা তাঁদের দ্রষ্টব্য দেখান। আমার ভাঙা সুটকেস থেকে জাতিকে দেখিয়েছি। আমি এখনো এই শহরেই আছি। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমার বন্ধুদের বগলের নিচে থাকতো সিলেক্টেড পয়েমস জাতীয় ইউরোপের নানা ভাষার নানা কাব্যগ্রন্থ। আমি যেমন আমার ভাঙা সুটকেস থেকে আমার জিনিস বের করে দেখিয়েছি তারাও তাঁদের বগলের নিচের পুঁজি থেকে নানা ভেলকি দেখিয়েছেন। এখনো আমি এই শহরেই আছি। আমার সেসব বন্ধুদের সৌভাগ্য হয়নি। এই মহানগরীতে তাঁদের নাম তরুণরা উচ্চারণ করেন না।”

ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকা এবং কলকাতার ‘নতুন সাহিত্য’, ‘চতুষ্কোণ’; বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে । দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন।  ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘লোক-লোকান্তর’ সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, যুদ্ধের পরে ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। মূলত এই সময় তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। স্বাধীনতা পরবর্তি সময় এক বছরের জন্য একবার জেল খাটেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতায়   ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদী নির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। আল মাহমুদ ছিলেন যৌবন ও প্রেমের কবি।

কবি তাঁর কবিতায় যে মৌলিকত্ব, ক্ষমতা ও শক্তির সাথে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের লোকসত্ত্বাকে ধারন করেছেন, তা আর কোনো কবির পক্ষেই সম্ভব হয় নি। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক, সমালোচক শিবনারায়ণ রায় বলেছিলেন, “বাংলা কবিতায় নতুন সম্ভাবনা এনেছেন আল মাহমুদ, পশ্চিম বাংলার কবিরা যা পারেনি তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন।”

“অথচ ঘুমের মধ্যে কারা যেনো, মানুষ না জ্বীন
আমার কবিতা পড়ে বলে ওঠে আমিন, আমিন।”
-আল মাহমুদ ।

১৯৯৩ সালে বের হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’।  ইসলামি আদর্শের প্রতিফলন ঘটতে থাকে তাঁর লেখায়। ফলে এক শ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী মহল তাঁর সমালোচনায় মেতে ওঠে। ইসলামি রাজনীতির দিকেও কবি কিছুটা ঝুঁকে পড়েন। ফলে তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে সেদিকে কবির ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তিনি আপন জগতে সমানতালে চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁর সৃষ্টিযজ্ঞ। কবি অবজ্ঞাভরে বলেছিলেন, “দাড়ি রাখলে আর ধর্মভীরু হলেই যদি কেউ মৌলবাদী হয়; তবে অবশ্যই আমি মৌলবাদী!”স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় আত্মপরিচয় গড়ে তোলার একেবারে নেপথ্যের কয়েকজন মানুষের কথা যদি বলতে হয়, তবে তাদের ভেতর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আল মাহমুদের নাম রাখতেই হবে। 

তবে এই কবি যেন কিছুটা অবহেলিত! কবির প্রাপ্য সম্মানের অনেকটাই হয়তো তিনি পান নি; অন্তত – কবির ধারণা এমনই। তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘সাহসের সমাচার’ গ্রন্থে তিনি বারবার এই কথাটাই বলেছেন।

“তোমরা আমাকে বোঝোনি। আমি বলি না বুঝবে না, বুঝবে। তবে তখন আমি আর থাকবো না। তবে এটা মনে রেখো, বাংলা সাহিত্যে যারা কিছু করতে চাও, আমাকে তোমার পাঠ করতেই হবে। এটা আমার আত্মবিশ্বাস।” এক সাক্ষাৎকারে কবি অভিমান করে বলেছিলেন, “আমার কাঁধে বিরাট সংসার। আমার রোজগার দিয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করতে হয়েছে। ভালো কোনো চাকরি আমাকে কেউ দেয়নি। প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে। নানা ধরনের গদ্য লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করতে পারলাম না। বন্ধুদের, কবিদের দেওয়া মানসিক চাপ উপেক্ষা করে সমাজে জায়গা করে নিতে হয়েছে আমাকে। কেউ কোনো স্পেস আমাকে দিতে চায়নি। অনেক ধাক্কা খেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জেলও খেটেছি। আমাকে বলো, একজন কবি আর কী কী করতে পারে? আমাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়নি। এখন কোনো কিছুতেই আমার আর আফসোস নেই।” সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা – স্বাধীনতা পদক তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। তবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন কবি। কবি আল মাহমুদ। একটি নাম, একটি ইতিহাস! আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে! সোনালি কাবিন, লোক-লোকান্তর, বখতিয়ারের ঘোড়া, কালের কলস, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, পাখির কাছে ফুলের কাছে, কাবিলের বোনের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন  অনন্তকাল ধরে আমাদের বাংলা সাহিত্যের আকাশে ।

0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments