পরনির্ভরশীল, আত্ম-নির্ভরশীল এবং পরস্পর নির্ভরশীল-সরদার আরিফ উদ্দিন

By Published On: July 11, 2021Views: 714

পরনির্ভরশীল, আত্ম-নির্ভরশীল এবং পরস্পর নির্ভরশীল
(Independent, Independent and Inter-Independent)

 

পরনির্ভরশীলতা (Dependency), আত্ম-নির্ভরশীলতা (Independency) এবং পরস্পর নির্ভরশীলতা (Inter-dependency), এই তিনটি শব্দ নিয়ে প্রায়শই এক ধরনের গোলক ধাধায় পড়ি আমরা। প্রথম শব্দ দুটি নিয়ে খুব স্বচ্ছ ধারনা থাকলেও শেষেরটি আমরা একেবারেই ভাবি না, ভাবতে চাই না কিংবা ভাবতে দেয়া হয় না। মূলত: তিনটি শব্দের মধ্যে পারস্পরিক একটা সম্পর্ক আছে।

প্রকৃতির নিয়মের মধ্যেও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সূত্রটি আছে। আমরা পানিচক্র কিংবা খাদ্যচক্রের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, একে অপরের উপর কিভাবে পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল থাকে। প্রকৃতির কোন উপাদানই আত্ম-নির্ভরশীল থাকে না। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ব্যাপারটি যখন আমাদের চিন্তা ও প্রজ্ঞার মধ্যে থাকে না, তখন মনে করতে থাকি পকেটে টাকা থাকলে কিংবা হ্যান্ডসাম ব্যাংক ব্যালেন্স থাকলেই আমার খাদ্যের নিরাপত্তা হবে, আবাসস্থলের নিরাপত্তা হবে ইত্যাদি। কিন্তু একজন কৃষকের উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমেই কেবল আমাদের খাদ্যের নিরাপত্তা হতে পারে। শুধুমাত্র টাকা হলেই খাদ্যের নিশ্চয়তা হবে না।

সাধারনভাবে আমরা মনে করি, প্রথম শব্দটি অর্থাৎ নির্ভরশীলতা খুব খারাপ। এক ধরনের অকর্মন্যতা এবং হীনমন্যতার কারনে মানুষ পরনির্ভরশীল থাকে অন্যের উপর। ফলে যত দ্রুত সম্ভব অন্যের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আত্ন-নির্ভর হওয়া খুব জরুরী। আমরা সারাক্ষন একে অপরকে তাগাদা দিতে থাকি আত্ম-নির্ভরশীল হবার জন্য। মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ঘিরেই পরনির্ভরশীলতা এবং আত্ম-নির্ভরশীলতার ধারনা মন ও মগজে কাজ করে। সেটা একদিকে নিঃসন্দেহে ভালো চিন্তা কিন্তু নির্ভরতা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও আরো নানাভাবে হতে পারে। অর্থনীতি সবসময়েই পরিমানগত দিকের প্রতি নজর দেয় কিন্তু জীবনের পরিমানগত দিক ছাড়াও আরেকটি গুণগত দিক আছে। জীবন তখনই জীবন্ত হয়ে ওঠে যখন তা নানা সম্পর্কের জালে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে। ফলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পরিমানগত দিক ভাবলে চলে না, তাকে গুনগত মানেও উত্তির্ন হতে হয়। শুধুমাত্র আত্ম-নির্ভরশীল শব্দ দ্বারা সম্পর্কের বাঁধন টিকিয়ে রাখা যায় না। তখন প্রয়োজন হয় পারস্পরিক নির্ভরশীলতা।

মূলত শব্দ তিনটি একেকটি স্তরকে ইঙ্গিত করে। পরস্পর নির্ভরশীলতা হলো সর্বোচ্চ স্তর, প্রজ্ঞার স্তর। পরনির্ভরশীলতা থেকে পরের স্তরে আত্ম-নির্ভরশীল হয় এবং তারও পরের স্তরে গিয়ে পরস্পর নির্ভরশীল হয়। কিন্তু আমরা পারিবারিক, সামাজিক কিংবা একাডেমীকভাবে কেবল প্রথম দুটোই শিখি, পরের স্তরে যাবার জন্য আর কোন দীক্ষা নিই না বা দেয়া হয় না। ফলে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখা করার চেষ্টা করবো। অর্থনীতির বাইরে গিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করলে দ্রুত বোঝা যাবে।

মানুষের জীবন চক্রের কথাই ভাবা যাক, জন্মের পর একটি শিশু বাবা মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে নানা ভাবে। তার বেড়ে উঠার জন্য বাবা মা’ই একমাত্র ভরসা। সে তখন চূড়ান্ত মাত্রায় নির্ভরশীল থাকে। এটাকে আমরা প্রাকৃতিক নিয়ম হিসেবেই মেনে নিই এবং সবার জন্যই এটা প্রযোজ্য। ধীরে ধীরে শিশুটি অন্যান্য মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানের উপরও নির্ভরশীল হয়ে উঠে। তারও পরে, সে নানাবিধ প্রয়োজনে ধীরে ধীরে আত্ম-নির্ভরশীল হয়ে উঠে এমনকি এক সময় অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী কিংবা আত্ম-নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। আমরা তাকে বাহবা দিই। পরের স্তরে যাবার জন্য আর খুব বেশী তাগাদা দিই না। প্রজ্ঞার স্তরে যাবার জন্য কোন শিক্ষা আগেও দিইনি, এখনো দিই না। ফলে পরিবারের কাঠামোতে একসময় সে যাদের উপর নির্ভরশীল ছিল, এখন যেহেতু আত্ম-নির্ভরশীল হয়ে গেছে তাই আর তাদের খুব একটা প্রয়োজন মনে করে না মানসিকভাবে। কেউ কেউ আবেগীয়ভাবে তাদের তখনো শ্রদ্ধা, সম্মান করে থাকে। কিন্তু এখানে একটা পারস্পরিক নির্ভরশীলতা যদি থাকতো অর্থাৎ প্রবীণের বাস্তব অভিজ্ঞতা, জীবন থেকে শেখা, তার নিরন্তর সংগ্রামের ফসল যদি নবীন নিতে পারতো আবার প্রবীন যদি নবীন থেকে বর্তমান প্রজন্মের চাওয়া পাওয়া, হিসেব নিকেষ, প্রযুক্তিগত জ্ঞান ইত্যাদি নিতে পারতো তাহলে উভয়ে সমৃদ্ধ হতে পারতো। এভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি হত, একে অপরের প্রতি যোগ্য সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখাতে পারতো। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নিজেদেরকে নিজেদের প্রয়োজনেই এক অদৃশ্য বাঁধনে বেঁধে রাখতো, আইন করে বা জবরদস্তি করে কিছুই করতে হতো না।

প্রকৃতির নিয়মের মধ্যেও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সূত্রটি আছে। আমরা পানিচক্র কিংবা খাদ্যচক্রের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, একে অপরের উপর কিভাবে পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল থাকে। প্রকৃতির কোন উপাদানই আত্ম-নির্ভরশীল থাকে না। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ব্যাপারটি যখন আমাদের চিন্তা ও প্রজ্ঞার মধ্যে থাকে না, তখন মনে করতে থাকি পকেটে টাকা থাকলে কিংবা হ্যান্ডসাম ব্যাংক ব্যালেন্স থাকলেই আমার খাদ্যের নিরাপত্তা হবে, আবাসস্থলের নিরাপত্তা হবে ইত্যাদি। কিন্তু একজন কৃষকের উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমেই কেবল আমাদের খাদ্যের নিরাপত্তা হতে পারে। শুধুমাত্র টাকা হলেই খাদ্যের নিশ্চয়তা হবে না। আমি এবং একজন কৃষক, আমরা পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল। এই পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীলতার ব্যাপারটি যদি আমাদের মনে থাকা দরকার। তবেই আমরা একে অপরের পেশাকে সম্মান জানাতে পারবো, শ্রদ্ধা করতে পারবো। আত্ম-নির্ভরশীল চিন্তা সব সময় ইগো’র জন্ম দেয় এবং অন্যকে ছোট করতে শেখায়। বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য আরো কিছু উদাহরন দেয়া যাক—

জনস্বাস্থ্য নৃবিজ্ঞানী এবং সামাজিক উন্নয়ন কর্মী হিসেবে, পেশাগত কারনেই আমাকে নানান দেশে মাঝে মাঝেই যেতে হয়। একবার জাপানের টোকিও শহরে যেতে হয়েছিল পাবলিক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা এবং গভর্নেন্স এর উপর এক সেমিনারে অংশগ্রহনের জন্য। সেখানে এক হাসপাতাল ভিজিট করে দেখলাম একই হাসপাতালে এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, আকু পাংচার সহ প্রায় সকল ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। পেশাগতভাবে একেক বিষয়ের বিশেষজ্ঞগন অন্য পেশার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে থাকেন, রোগীদেরকে এক ইউনিট থেকে অন্য ইউনিটে রেফার করা হয়। ইন্ডীয়াতে দেখেছি, শত শত আয়ুর্বেদ এবং ইউনানী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। একই হাসপাতালে এলোপ্যাথিক এবং ইউনানী আয়র্বেদ কাজ করছে। থাইল্যান্ডে দেখেছি সকল ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা একই হাসপাতালে। এমনকি অনেক উন্নত দেশ, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড সেখানেও দেখেছি পেশাগতভাবে এক সাবজেক্ট কিভাবে অন্য সাবজেক্ট এর উপর পারস্পরিক নির্ভরশীল থেকে কাজ করে। আমাদের দেশে এমনটা ভাবা যায়? এখানে এলোপ্যাথিক বিশেষজ্ঞগন মনে করেন হোমিওপ্যাথিক কোন বিজ্ঞানই নয় আবার হোমিপ্যাথিকগন মনে করেন আয়র্বেদ কিংবা ইউনানী কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানের মধ্যেই পড়ে না। সকলে নিজ নিজ পেশায় বা বিদ্যায় আত্ম-নির্ভরশীল, অন্যের উপর তাদের নির্ভর না করলেও চলবে। ফলে একে অপরকে কিংবা অপরের জ্ঞানকে তুচ্ছ জ্ঞান করে চলে। আত্ম-নির্ভরশীল স্তর থেকে তাদের আর পারস্পরিক নির্ভরশীল স্তর অর্থাৎ প্রজ্ঞার স্তরে যাওয়া হয়না।

পেশাগতভাবে আমরা ভাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগন একাডেমীক ভাবে গুনী, অসাধারন জ্ঞানের অধিকারী কিন্তু তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বা মাঠ-অভিজ্ঞতা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগন ভাবেন একজন উন্নয়নকর্মীর মাঠ-অভিজ্ঞতা থাকলেও তার কোন একাডেমীক ভিত্তি থাকে না। ফার্মাসিস্ট ভাবেন সমাজ বিজ্ঞানী কিছুই জানেন না, সমাজ বিজ্ঞানী ভাবেন একজন ইতিহাসবিদ এর তেমন কোন অবদান নেই সমাজে। একজন কর্পোরেট এক্সপার্ট ভাবতে থাকে, কবি যে কবিতা লিখেন তার কোনই অবয়ব নেই, কোনই প্রয়োজন নেই, শুধু শুধুই সময়ের অপচয়। এভাবে একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকি মুলত আত্ম-নির্ভরশীলতার চর্চা এবং ধারনা থেকেই। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা কিভাবে একে অপরকে সমৃদ্ধ করতে পারে সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারনা থাকে না বলেই পরিবার থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রর সকল প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সকল মানুষের মধ্যেই অরাজকতা দেখা যায়। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ধারনাটি না থাকার কারনে সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক প্রতিষ্ঠান (পরিবার) এর দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যেও নানা জটিলতা দেখা যায়। আধুনিক কালে আমরা জোরে দিচ্ছি নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং তার অর্থনৈতিকভাবে আত্ম-নির্ভরশীলতার উপর। নিঃসন্দেহে তা খুব জরুরী কিন্তু একইভাবে জরুরী সবাইকে পরবর্তী স্তর অর্থাৎ পারস্পরিক নির্ভরশীলতা স্তরে, প্রজ্ঞার স্তরে উন্নীত করা । জীবন তখনই জীবন্ত হয়ে উঠবে এবং সম্পর্কগুলো একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকবে। তথা সর্বক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন।

 

সরদার আরিফ উদ্দিন
উন্নয়ন পরামর্শদাতা
নৃবিজ্ঞানী

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop