‘ফরিদপুইরা মাসি। গলা ধ্যরা কান্দে ঝোলা ছুঁব্যার দ্যায় না।’
এটি কোনো প্রবাদ না প্রবচন, গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি থেকে উদগত কোনো আপ্তবাক্য নাকি নেহায়েতই গ্রামের কোনো বয়োবৃদ্ধ মানুষের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত উক্তি তা আমার জানা নেই। শৈশবে আমি নানিজানের মুখে বিভিন্ন সময়ে এই কথাটি অসংখ্যবার শুনেছি এবং বহুবার শোনার ফলে কথাটি আমার স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে ছাপ ফেলে গেছে। এখন থেকে পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় আগে শোনা কথাটি পরিণত বয়সে এসে নিজের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। নানিজান সাধারণত তাঁর প্রতিবেশি, দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন অথবা স্বল্প পরিচিত সাহায্যপ্রার্থী যারা প্রয়োজনীয় স্বার্থ উদ্ধারের সাথে সাথেই চোখ পাল্টিয়ে ফেলতেন এবং নানিজানের নিজের কোনো সমস্যা সংকট দেখা দিলে ভুলেও খোঁজ-খবর নিতেন না অথবা তাঁর প্রয়োজনে যাদের টিকিটিরও নাগাল পাওয়া যেতো না তাদের সম্পর্কেই তিনি এই কথা বলতেন। এ ছাড়া ফরিদপুইরা মাসিদের আরো একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁরা নিজের দুঃখ—দুর্দশা—হতাশা—বঞ্চনার কথা আবেগঘন কণ্ঠে বর্ণানা করলেও নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য বা অন্তরের অন্তর্গত বিষয় কখনোই প্রকাশ করতেন না।
আমার একজন মাসি ছিলেন। তাঁর বাড়ি ফরিদপুর না বরিশাল তা কখনোই জানতে পারিনি। তিনি বয়সে আমার চেয়ে বড় জোর দু-চার বছরের বড় হলেও আমাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো, তবে কোনো এক দূরবর্তী আত্মীয়তার কারণে তাঁকে আমি মাসি ডাকতাম এবং তিনি আমাকে নাম ধরে ডাকতেন। সময়ের সাথে সাথে স্বভাবজাত কারণে তিনি ক্রমশ প্রকৃত অর্থেই ফরিদপুইরা মাসি হয়ে ওঠা পর্যন্ত আমাদের এই সম্পর্ক ছিল চমৎকার।
স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় তিনি শহরের বাইরে একটি গুরুত্বহীন এলাকায় তুলনামূলকভাবে কম ভাড়ায় দীনহীন এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর দুইকক্ষ বিশিষ্ট একটি ফ্লাটে একাই বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। বাসে, সিএনজি চালিত অটোরিকশা অথবা সাইকেল রিকশায় এবং শেষ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে বেশ কয়েকটি গলিঘুঁচির দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তার বাসায় যেতে হতো। তারপরেও বেশ কয়েকবার তাঁর বাসায় আমি আতিথ্য গ্রহণ করেছি। তার কারণ হয়তো, তাঁর রান্নার হাত ছিল ভালো এবং আমার যাবার কথা থাকলে তিনি ভালো-মন্দ রান্না করে খাওয়াতেন। আমি ত্রিশোত্তর বয়সেও ব্যাচেলার এবং মজ্জাগত ভাবে অগোছালো বাউণ্ডুলে টাইপের। তাই মাঝেমধ্যে অযাচিতভাবেই মাসির বাসায় হাজির হতাম। অনেকদিন পরে খেয়াল করে দেখেছি আমি নিজে থেকে না বললে মাসি কখনোই আমাকে ডেকে খাওয়াতেন না।
মাসি আসলে শুরু থেকেই ফরিদপুইরা মাসি ছিলেন, শুধু আমিই ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। কোনো ছোটখাটো সমস্যা হলে কিংবা টাকা পয়সার দরকার হলে তিনি নির্দ্বিধায় চেয়ে পাঠাতেন। তাঁর বার্তা পাঠাবার স্টাইলগুলো ছিল অভিনব, অনেক সময় চমকপ্রদ! যেমন অল্প পরিমানে টাকা পয়সার প্রয়োজন হলে লিখতেন, ‘বিপুল! তোর বিকাশে কি হাজার খানেক টাকা হবে? পাঠাতে পারবি?’ তবে বড় অংকের টাকার প্রয়োজন হলে লিখতেন, ‘চৌধুরি সাহেব! গরীব হলেও আমরা মানুষ। বাঁচতে হলে আমাদেরও টাকার প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে পনের হাজার টাকা পাঠাবেন।’ আমি দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় প্রতিবারই নির্দ্বিধায় মাসিকে তাঁর প্রয়োজন অনুসারে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছি, সেই ঋণ কবে তিনি পরিশোধ করবেন অথবা আদৌ কখনো করবেন কিনা তা নিয়েও কোনো প্রশ্ন করিনি।
দুই হাজার কুড়ি সালের মার্চ মাসে সারা দেশে যখন কোভিড-১৯ এর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল তখন মাসি একটা বড় রকমের বিপদে পড়েছিলেন। হঠাৎ করে দুদিনের জ্বরে তিনি যখন শয্যাগত তখনই তাঁর বাড়িওয়ালী করোনা আক্রান্ত সন্দেহে তাঁকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছিল। ২৭ শে মার্চ বিকেলের দিকে মাসির ফোন।
‘বিপুল আমি খুব বিপদে আছি রে। সকাল থেকে রীতিমতো ঝগড়া করে, দফায় দফায় অনেক ঝামেলার পরে বাড়িওয়ালী আমাকে লোকজন দিয়ে বাসা থেকে নামিয়ে পথে বের করে দিয়েছে। তার বিশ্বাস আমার করোনা পজিটিভ!’
‘তুমি এখন কোথায়?’
‘আমার ভাগ্নে মুস্তফা আছেনা, ওর এক বান্ধবীর বাসায়।’
‘তাহলে সমস্যা কোথায়! তুমি ওখানেই থেকে যাও।’
‘সমস্যা না থাকলে কি তোকে বলতাম! এখানে অবস্থা ভালো নয়। এক রুমের ফ্লাটে ওরা তিনজন, আমি একজন আবার ওর এক চাচা এসেছে গ্রাম থেকে।’
‘তুমি মুস্তফার ওখানে থেকে যেতে পারোনা?’ আমি একটু ভেবে বলি।
‘তাহলে তো ভালোই হতো। কিন্তু ওর বউ কিছুতেই রাজি না। বলেছে আমার বাসায় ছোট বাচ্চা। এর মধ্যে করোনা পেশেন্ট নিয়ে বিপদ বাড়াতে চাই না।’
‘এখন আমি কী করতে পারি বলো!’
‘তুই যদি মাসিকে বাঁচাতে চাস তাহলে কোথাও একটা থাকার ব্যবস্থা কর। তা-না হলে এবারে করোনাতেই মরবো মনে হয়।’
এাসি আমাকে বড় ধরনের চিন্তায় ফেলে দিয়ে লাইন কেটে দিলেন। আমি বড় আপার সাথে থাকি এবং তিনি এমনিতেই মাসিকে খুব একটা পছন্দ করেন না, এছাড়া করোনাকালে আমার বাইরে যাওয়া বা কারো সাথে মেলামেশার ব্যাপারেও তিনি ভীষণ সতর্ক। এদিকে মাসির অনুরোধ এড়ানোও আমার পক্ষে সহজ ছিল না। ভেবে দেখলাম আমার দূর সম্পর্কের মামাতো বোন সিতারাকে যদি রাজি করানো যায় তাহলে মাসি কিছুদিনের জন্যে দিব্যি ওখানে থেকে যেতে পারে।
সিতু আমার সমবয়েসী, একটা বেসরকারি সাহায্য সংস্থায় চাকরি করে, তিন রুমের একটা মাঝারি মানের ফ্লাটে একাই থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোবার পরপরই পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছিল। ওর কপাল খারাপ, বিয়ের তিন বছরের মধ্যে দুরারোগ্য মস্তিস্কের ক্যান্সারে স্বামীটা মারা গেছে। আর কখনোই বিয়ে করবেনা এমন কোনো পণ করে সে বসে নেই। তবে যতোদিন তা না হচ্ছে, ততোদিন একাকী স্বাধীন জীবন-যাপন করতে চায়। সিতারা নাকি অভিজ্ঞজনদের কাছে শুনেছে বিয়ে জিনিসটা যতোদূরে ঠেলে দেওয়া যায় ততোই ভালো। ওর ফ্লাটে আমার যাতায়াত আছে, তবে করোনার প্রকোপ শুরু হবার পরে তা একেবারেই বন্ধ। বোনটি আমার প্রস্তাবে রাজি হবে কিনা তা নিয়ে আমার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু কেন যেনো সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল এবং পরিচয় নিশ্চিত করার জন্যে বললো, ‘তুই কলম্বো না কাঠমান্ডু থাকার সময়ে যাকে একবার টাকা পাঠাতে বলেছিলি, ইনি তো তোর সেই মাসি?’
বললাম, ‘যাক চিনতে পেরেছিস তাহলে! কিছুদিনের জন্য চলে আসতে বলি! তুই কী বলিস?’
‘বলে দে। করোনার বিপদ তো আ রচিরদিন থাকবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিশ্চয়ই তার নিজের বাসায় চলে যাবে।’
সিতুর সম্মতি পেয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গেই মাসিকে চলে আসতে বললাম। তিনি পরদিন তার যৎসামান্য কাপড়-চোপড় এবং এক ভাগ্নেকে সঙ্গে করে সিতারার বাসায় উঠে পড়লেন। সন্ধ্যায় সিতুর ফোন।
‘বিপুল তোর মাসি তো একা আসেননি সঙ্গে আবার একজন সাগরেদ নিয়ে এসেছেন। ‘আমি মাসিকে ফোন করলাম। মাসির অজুহাত সব সময়েই প্রস্তুত। বললেন, ‘কী করবো বল! আমি তো রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। এতোদূর থেকে কেমন করে আসবো, তাই মুফতিকে নিয়ে এসেছি। ওই যে আমার বড় বোনের ছেলে, মুস্তফার ছোট। নেহায়েতই বাচ্চা মানুষ।’
‘তা বাচ্চামানুষ যখন আসতে পেরেছে, তখন চলেও যেতে পারবে নিশ্চয়ই।’
‘হঠাৎ করে লকডাউন দিয়েই তো সমস্যা করে ফেললো। এখন তো আর যেতে পারবেনা। লকডাউন উঠলেই চলে যাবে।’
আমার বলা উচিৎ ছিল, মুস্তফার বাসায় না হোক, তুমি তো তোমার বড় বোনের বাসাতেও থেকে যেতে পারতে। কিংবা ছেলেটা থাকায় সিতুর প্রাইভেসিরও তো সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আমি কিছু না বলে সিতারাকে মাসির কথার পুনরাবৃত্তি করে বললাম, ‘ছেলেটা তো নেহায়েতই বাচ্চা মানুষ। লকডাউন উঠে গেলেই চলে যাবে।’
সিতু কাজিন হলেও আমরা বন্ধুর মতো। সে হাসতে হাসতে বললো, ‘ছেলে মানুষ তো বটেই। তবে ছেলেটাকে বিয়ে দিলে শিগগিরই আর একটা ছেলেমানুষ তৈরি করে ফেলতে পারবে।’
পরদিন বিকেলেই মাসির ফোন। ‘বিপুল। আমি তো বাড়িওয়ালীর তাড়ায় বলা যায় কিছুই সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারিনি। আর মুফতি তো আমাকে পৌঁছে দিতে এসে আটকা পড়ে গেছে। বেচারা একেবারে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছে। ওর তো মেঝেতে ঘুমাবার মতো চাদর বালিশও নেই।’
‘তাহলে এখন কী করা যায় বলো?’
‘সম্ভব হলে তুই দুই একটা টি-শার্ট আর অন্তত একটা লুঙ্গি পাঠিয়ে দিস। টি-শার্টগুলো দরকার হলে আমিও পরতে পারবো।’
‘ঠিক আছে মাসি! দেখছি কী করা যায়! কিছু কাপড় চোপড় তো পাঠানো যায়, কিন্তু এই লকডাউনের মধ্যে পাঠাবার লোক পাওয়াই কঠিন।’
‘তোর অফিসে কতো লোকজন । একটা পিয়ন দারোয়ান কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিস। আর শোন, তোর বান্ধবী সিতু না ভীতু, সে মনে হয় আমরা আসাতে খুশি হতে পারেনি। তার কাছ থেকে কিছু চাইলে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। গোটা দুই চাদর অথবা কাঁথা পাঠালে খুব ভালো হতো রে।’
‘সিতু আমার বান্ধবী নয় মাসি, ও আমার বোন। যাই হোক, আজ তো আর কিছু পাঠাতে পারবো না। আগামীকাল সকালে পাঠাতে চেষ্টা করবো।’
‘চেষ্টা নয় বিপুল। বিপদের সময় এইটুকু সাহায্য তোর কাছে থেকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।’
পরদিন অফিসের পিওন সুজনকে ডেকে পাঠালাম। সে বেচারা নাকে মাস্ক, মাথায় হেলমেট, হাতে গ্লাভস লাগিয়ে এসে হাজির। বললো, ‘স্যার! আপনে না হইয়া এমডি সাহেব ডাকলেও আইতাম না।’
বললাম, ‘এসেই যখন পড়েছো, একটু কষ্ট করে সিতারা ম্যাডামের বাসায় কয়েকটা জিনিস পৌঁছে দিতে হবে।’
বড় আপাকে না জানিয়ে আমি যখন সুজনের হাতে দুজনের জামা-কাপড়—চাদর—বালিশ বুঝিয়ে দিচ্ছি ঠিক সেইসময় মাসির ফোন, ‘বিপুল, তোর সেই সুজন না দুর্জনকে পেয়েছিস?’
বললাম, ‘সুজন আমার সামনে। ওর হাতে তোমদের জন্যে কিছু জামা-কাপড় আর চাদর—বালিশ পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘খুব ভালো। তুই তো আমার জন্যে অনেক করেছিস। সম্ভব হলে ওর হাতে হাজার পাঁচেক টাকা পাঠিয়েদিস। আমি তো একেবারেই খালি হাতে বেরিয়েছি, বুঝতেই পারছিস।’
বুঝতে পারি বা না পারি সুজনের হাতে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিতে হলো।
করোনার দিন-রাত্রি সহজে পার হতে চায় না। প্রায় সকলেই গৃহবন্দী। আমি ঘরে বসে বই পড়ি, নেটওয়ার্ক থাকলেই উটিউবে বিদেশি ক্লাসিক দেখি, বেশিরভাগ সময় শুয়ে-বসে ঘুমিয়ে কাটাই। মুফতির বয়স কম, ঘরে একটানা থেকে কয়েক দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিল। ফলে মাঝে-মধ্যেই ‘ডিম কিনতে যাই’ ‘ঘরে তো আলু—পেঁয়াজ কিছুই নাই অথবা ‘মোড়ের চায়ের দোকানটা খুলেছে কিনা দেখে আসি আর খুলে থাকলে এক কাপ চা খেয়ে আসি এইসব বলে বাইরে চলে যায়। তার এ সব বিপজ্জনক কাজকর্ম খালার কাছে প্রশ্রয় পেলেও সিতারা বিরক্ত হয়, আমার কাছে অভিযোগ করে। মাসিকে বিষয়টা জানালে সে নির্বিকার নিরাসক্ত কণ্ঠে বললো, ‘লকডাউনটা একটু শিথিল হলেই ও চলে যাবে।’
মুফতি নিজেই একদিন আশুলিয়ায় ফিরে যাবার জন্যে বেরিয়ে পড়ে। সম্ভবত ঘরে তার চেয়ে বয়সে বড় দুই নারীর মাঝখানে পড়ে স্যান্ডউইচ জীবন এবং বাইরে করোনা সংক্রমণের ভয়, এই দুইয়ের মধ্যে সে করোনাকেই কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেছিল। কিন্তু মুফতির এই মুক্ত জীবনাচরণ আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের সাক্ষাৎ প্রতিনিধি পুলিশের মাঠপর্যায়ের টহলদারদের পছন্দ হয়নি। সেই কারণে সিদ্ধেশ্বরী থেকে বেরিয়ে গলিঘুঁচি দিয়ে মালিবাগ চৌধুরিপাড়া পর্যন্ত পৌঁছাতেই পুলিশের তাড়া এবং কয়েক ঘা লাঠির বাড়ি খেয়ে সে আবার সিতারার আশ্রয়ে ফিরে এসেছে। এরপরে অবশ্য বেশিদিন তাকে এই অবস্থায় থাকতে হয়নি, দিন দশেকের মধ্যেই জীবনযাত্রা মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল এবং প্রথম সুযোগেই মুফতি মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। তবে যাবার সময় সে তার খালা অর্থাৎ আমার মাসিকে সঙ্গে না নিয়ে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে ছুটে পালিয়েছে।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে করোনো পরীক্ষার ল্যাবরোটারি হিসাবে ভুয়া পরীক্ষা কেন্দ্র খুলে, মাস্ক, হ্যান্ড সেনিটাইজার এবং পিপিই বিক্রি করে, আই ইিউ সি সি ইউসহ হাসপাতালের সেবা দিয়ে কেউ কেউ লক্ষ কোটি টাকা কামিয়ে নিল। তবে বাড়ি বাড়ি খাবার সরবরাহকারী, লাশ পরিবহনের এ্যাম্বুলেন্স এবং দেশের কবরস্থানগুলোর গোরখোদকেরা যথেষ্ট আয় রোজগার করে সন্তুষ্ট হবার আগেই দেশের পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে গেল। লকডাউন উঠে গেলে মাসি তাঁর আশকোনার বাড়িতে চলে গেলেন। মাসির ইচ্ছে ছিল এবং পরিকল্পনাও ছিল শিগগিরই শহরের বাইরে থেকে একটু ভেতরের দিকে বসবাসযোগ্য এলাকায় চলে আসবেন।
মাসের শেষ ছুটির দিনে ঘুমটা যখন বেশ ঘন হয়ে জমাট বেঁধেছে তখন মাসির ফোন। হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতেনিতেই মাসির উত্তপ্ত কণ্ঠ, ‘বাড়িওয়ালারা যে কেমন খচ্চর হয়, তুই তো জানিস!’
‘জানবো না কেন! ঢাকা শহরে আমরাও তো ভাড়া বাড়িতেই থাকি। এখন তোমার কী সমস্যা বলো। ‘আমার কথায় তখনো ঘুমের রেশ। মাসি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আমার এদিকে বড় রকমের সমস্যা হয়ে গেছে, আর তুই এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস?’ ‘আহা তোমার কী হয়েছে বলবে তো?’
‘আজ ছুটির দিন, বাসার জিনিসপত্র ঢাকায় শিফট করবো বলে আমি মুফতি মুস্তফা দুই ভাইকে আসতে বলেছি। এদিকে বাড়িওয়ালী আমার জিনিসপত্র নামাতে দিচ্ছেনা।’
ঢাকার বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই ভাড়াটিয়াদের কেমন শারীরিক মানসিক চাপের মধ্যে রাখে তা সবারই জানা। কিন্তু কেউ বাড়ি ছাড়তে চাইলে সমস্যা হবে কেন! মাসির সাথে কথা বলে জানা গেল দু’ আড়াই মাসের মতো বাসায় না থাকলেও তিনমাসের পুরো ভাড়া না দিলে মালপত্র নামানো যাবেনা। মাসি সকাল থেকে তাঁর ভাই—বোন—ভাগ্নে, খালা—মামা এবং অতি অবশিষ্ট দুই একজন বন্ধ-ুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ করে টাকার কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরেই নাকি শেষ পর্যন্ত আমাকে ফোন করেছেন। তাঁর কথা বিশ্বাস করতে হলে বলতে হয়, আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার আর কেউ অবশিষ্ট নেই। অতএব তিন মাসের বারো হাজার করে ছত্রিশ হাজারের জায়গায় ত্রিশ হাজার টাকায় রফা করে মাসিকে ঢাকায় স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা গেল।
পরবর্তী বছর দেড়েকের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ না দিলেও চলবে। করোনাকালে অনেকেই চাকরি হারালেও মাসি তুলনামূলকভাবে একটা ভালো চাকরি পেয়ে ঢাকায় শহরে থিতু হয়েছেন। সিতারাও চাকরিতে পদোন্নতি পেয়েছে, তবে তাকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছে। কুড়িগ্রামে একই এনজিওর বড় একটা প্রজেক্টের প্রধান নির্বাহীকর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পাবার ফলে ঢাকা ছাড়তে সে কোনো আপত্তি করেনি। আমার সাথে মাঝে-মধ্যে সিতুর কথা হয়, তবে অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। আমি যেমন ছিলাম তেমনি আছি বলা যায়। তবে অন্যসব দিক থেকে একই রকম থাকলেও সম্প্রতি আমার জীবনে একটা নতুন উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। নিলুফার বিনতে মুহাইমেন অর্থাৎ আমাদের অফিসের হিসাব বিভাগের শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা নীলার সাথে সম্প্রতি আমার একটু ভাবের আদান-প্রদান চলছে। বিয়ের জন্যে বাড়ি থেকে চাপ ছিল বলে আমি নিজেই কিছুদিন থেকে মেয়েদেও ব্যাপাওে আমার কট্টরাপন্থী স্বভাবে কিছু ছাড় দিয়ে রেখেছিলাম এবং এই সুযোগে জনৈক মুহাইমেন সাহেবের কন্যা নিলুফার আমার অন্তরের অন্দর মহলে ঢুকে পড়েছেন। মাসি এই ঘটনার সংক্ষিপ্ত সার শুনে আপাতত দৃষ্টিতে বেশ খুশি হলেন বলে মনে হলো। বললেন, ‘তোরা একদিন আয়, আমি তোদের রান্না কওে খাওয়াবো।’
মাসি রান্না করে খাওয়াবার আগেই শিক্ষানবীশ কর্মকর্তার পোস্টিং হয়ে গেল কুষ্টিয়ায়। আসলে নীলা নিজে ইচ্ছে করেই কুষ্টিয়ায় পোস্টিং নিয়েছিল। ঢাকায় স্থায়ী কোনো থাকার জায়গা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে সিট ছেড়ে দেবার চাপ এবং আমার দিক থেকে বিবাহ বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা, সব মিলিয়ে মা-বাবার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়াটাই তার কাছে যথোপোযুক্ত মনে হয়েছিল। সত্যি বলতে কী, সম্ভাব্য স্ত্রীর সাথে একই অফিসে কাজ করাটাও আমার কাছে কোনো সুখকর বিষয় মনে হচ্ছিলনা। কুষ্টিয়ায় জয়েন করে নীলা কল করে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে খুশি হয়েছে কে বলোতো?’
আমি অনেকক্ষণ ইতিউতি চিন্তা করে বললাম, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না!’
‘তুমি’ নীলার তাৎক্ষণিক উত্তর। নীলা এইমুহূর্তে তার বাবা-মার কাছে চলে যাওয়ায় সত্যিই আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচে ছিলাম বলা যায়। কিন্তু এই কথাটা সে বুঝতে পারলো কেমন করে তা আমি বুঝতে পারলাম না।
মাসি আগের মতোই প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করেন, আর তা না হলে তিনবার কল করলেও ধরেন না আর কলব্যাক করার তো প্রশ্নই ওঠে না। গত বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একটা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্সে যোগদিতে দুই সপ্তাহের জন্যে থাইল্যান্ডে যেতে হলো। মাসি জানতেন আমি দেশের বাইরে, তারপরেও দ্বিতীয় দিনেই প্রথমে ম্যাসেজ, তারপরে ম্যসেঞ্জারে কল।
‘চৌধুরি সাহেব আপনি তো দিব্যি ব্যাংকক পাতায়ায় নাইটক্লাবে ফূর্তি করে বেড়াচ্ছেন। এদিকে মাসির যে কী অবস্থা তার কোনো খবর রাখেন?’
‘তোমার আবার কী হলো?’ আমি অনেকটাই নিরুত্তাপ, নিরুদ্বিগ্ন। আমার কণ্ঠস্বরে উদ্বেগের অভাব মাসি বোধহয় ধরে ফেলেছিলেন। বললেন, ‘আমার সেই পেইনটা আবার বেড়েছে। মেডিসিন না নিলে কাল হয়তো বিছানা থেকে উঠতেই পারবো না।’
মাসি রান্না ঘরে থাকলে বলেন কিচেনে আছি, স্নান অথবা গোসল করার পরিবর্তে বলেন শাওয়ার নিচ্ছি অষুধ খেতে হবে না বলে বলেন মেডিসিন নিতে হবে। আমি বললাম, ‘তুমি তো জানোই আমি দেশের বাইরে। সিতারা বা আমার অফিসের সাব্বিরকে বলা যেতো। কিন্তু এদের কারো সাথেই তো তুমি সম্পর্ক ভালো রাখোনি। এখন কী করবো বলো?’
‘তোর সেই বান্ধবী কী যেনো নাম নীলা না ঠিলা, ওকে বললেও তো কিছুটাকা বিকাশে পাঠিয়ে দিতে পারে।’ মানুষের নাম বিকৃত করার আশ্চর্য দক্ষতা ছিল মাসির। এতোদিন রসিকতা হিসাবে নিলেও নীলার নাম বিকৃত করাটা আমার পছন্দ হলো না। তারপরেও বললাম, ‘নীলা কী অবস্থায় আছে, টাকা পাঠাতে পারবে কিনা জানি না। বলে দেখতে পারি।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত টাকা লাগবে?’
‘তিন হাজার হলেই চলবে। তবে সাড়ে তিন হাজার হলে ভালো হয়।’
‘একটু তাড়াতাড়ি পাঠাতে বলিস বিপুল। বুঝতেই পারছিস, মেডিসিনের ব্যাপার।’
মাসি ফোন ছাড়ার পওে নীলাকে কল করলাম। নীলা মনে হয় কিছুটা গম্ভীর হয়ে শুনলো তারপর বললো, ‘মাসির বিকাশ নম্বরটা দাও। আজ বিকেলের মধ্যেই টাকাপ াঠিয়ে দেবো।’
আমি দেশে ফিরে আসারও মাসখানেক পরে একদিন মাসির সাথে দেখা হলে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নীলার টাকাটা ফেরৎ পাঠিয়েছিলে?’ ‘একেবারে ভুলে গেছিরে বিপুল। তুই টাকাটা পাঠিয়ে দে। আমি পরে কোনো এক সময় তোকে দিয়ে দেবো।’ মাসির নির্বিকার উত্তর। আমি সাড়ে তিন হাজার টাকা নীলাকে পাঠিয়ে দিয়ে বললাম, ‘মাসি অনেক আগেই টাকাটা দিয়েছিল, তোমাকে. পাঠাতে ভুলে গেছি।’
মাসি মোটামুটি ভালো বেতনে তাঁর স্থায়ীচাকরিতে যোগ দেবার পরে আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তিনি ফোন করেন না, সাধারণত ফোন ধরেনও না। তাতে আমি অবশ্য খুশিই হয়েছি বলা যায়। কারণ সময়ে অসময়ে ছোট-খাটো প্রয়োজনে তিনি আর টাকার জন্যে ফোন করেন না। তবে কখনো বিদেশে যাওয়া, চিকিৎসা বা পারিবারিক কোনো সমস্যায় বেশি টাকার প্রয়োজন হলে ‘চৌধুরি সাহেব’ সম্বোধন করে ম্যাসেজ পাঠান। আমাদের দেখা সাক্ষাতও কমে এসেছিল। যেহেতু প্রয়োজন কমে এসেছে সেই কারণে তিনি মাঝেমধ্যে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবার কথাও ভুলে গেছেন।
এভাবে ভালোই চলছিল, সমস্যা করলো নিলুফার বিনতে মুহাইমেন। একদিন রাতে নীলা ফোন করে জানালো তিন দিনের জন্যে ঢাকায় আসতে হবে। আমাদের অফিসেই একটা ইন হাউজ ট্রেনিং আছে জানতাম, কিন্তু সেখানে নীলাকে যোগ দিতে বলা হয়েছে জানতাম না। নীলা কেন যে আগে থেকে জানায়নি বুঝলাম না, কিন্তু কোথায় এসে উঠবে এবং দুইটা রাত কোথায় থাকবে তার ব্যবস্থা না করতে পারায় শেষ মুহূর্তে আমাকে ফোন করেছে। আমি মনে মনে খুশি হলেও একটু বিরক্তি দেখিয়ে বললাম, ‘তুমি যে আসবে তা আগে থেকে জানাওনি কেন?’
‘ভেবেছিলাম হঠাৎ করে হাজির হয়ে তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবো।’
‘এখন তো নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছো। তোমাকে কোথায় থাকতে দেয়া যায় বুঝতে পারছিনা।’
‘থাক। খুব বেশি সমস্যা হলে আমি সাভারে বোনের বাসায় চলে যাবো।’
‘বোনের বাসা থেকে ঢাকায় এসে তো ট্রেনিং করতে পারবে না। দেখি ব্যবস্থা একটা হবে নিশ্চয়ই।’
যার কথা ভেবে নীলাকে বলেছিলাম ব্যবস্থা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই, তিনি শুনে বললেন, ‘তোর বান্ধবী নীলু না ঘিলু ওর জন্যে বরং অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে দে। আমার শরীরটা বেশি ভালো নয়, তাছাড়া বুঝিস তো, সব মানুষেরই প্রাইভেসি বলে একটা ব্যাপার আছে।’