চন্দ্রাগিরি

By Published On: March 28, 2025Views: 8

চন্দ্রাগিরি
সুমন্ত গুপ্ত

ঘড়ির কাঁটায় নেপাল সময় সকাল সাতটা। মোবাইলের এর অ্যালার্ম জানান দিচ্ছে এবার ঘুম থেকে উঠতে হবে। কিন্তু এতো ঠাণ্ডা রুমে হিটার চালানো সাথে দুটো লেপ গায়ে দেবার পরেও ঠাণ্ডা কমছিলো না। আড় চোখে মোবাইলে নেপাল এর বর্তমান তাপমাত্রা দেখে চোখ মাথায় ওঠার জোগাড়। বর্তমান সময়ে থামেলের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও লেপের নিচ থেকে উঠতে মন চাইছিলো না। কিছু সময় পর আবার অভিনব দাদার ফোন। আর ঘুমিয়ো না এবার উঠে তৈরি হয়ে নাও । আজ আমার আর সানন্দার নেপাল ভ্রমণের তৃতীয় দিন। হিমালয়কন্যা নেপালের সৌন্দর্যে মুগ্ধ বিশ্ববাসী। এজন্যই দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা নেপাল ভ্রমণে গিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও মাউন্ট এভারেস্ট, শত বছরের পুরনো মন্দির, আকাশচুম্বী পর্বতমালা, জলপ্রপাত, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, বিভিন্ন উৎসব রয়েছে দেশটিতে। পৃথিবীর যেসব দেশে সহজেই একা ভ্রমণ করা যায়, তার মধ্যে নেপাল অন্যতম। বিশ্বের পর্বতারোহীদের পছন্দের স্থান নেপাল। অন্নপূর্র্ণা কিংবা এভারেস্ট জয়ের জন্য সারা বছরই তারা এখানে ভিড় করেন। নেপাল পর্বতারোহীদের পছন্দের দেশ হলেও সাধারণ পর্যটরাও এখানে যান হিমালয়ের পাশ থেকে সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে। অন্নপূর্ণা পর্বতের শুভ্র চূড়া দেখতেও কেউ কেউ ভিড় করেন সেখানে। প্রত্যেক বছর হাজারো পর্যটক ভ্রমণ করেন এই পাহাড়ি কন্যার দেশে। সার্কের সদস্যদের মধ্যে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর একটি হলো নেপাল, যার কোন সমুদ্র নেই, সমুদ্র পথে যবার কোন সুযোগও নেই। নেপাল বিখ্যাত হিমালয়ের সৌন্দর্যের দরজা হিসাবে কিন্তু শুধু হিমালয় াদেও নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতেও আছে আরও নানারকম দেখার মতো স্থান নিয়ে। কাঠমান্ডু নেপালের রাজধানী ও বৃহত্তম মহানগর যেখানে বাস করছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। নেপালে ঘুরতে হলে কাঠমান্ডুতে আসাই ভালো। অনেকেই পাহাড় দেখবার আসায় কাঠমান্ডুর মতো শহরকে ঘুরবার তালিকায় প্রাধান্য প্রথমে দিতে চান না কিন্তু ঐতিহ্য, বাণিজ্য, নানাবিধ আরকিটেকচারাল নিদর্শন নিয়ে কাঠমান্ডু কিন্তু তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। নিজের সাথে যুদ্ধ করে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নিলাম নতুন গন্তব্যে যাবার জন্য। আমাদের আজকের ভ্রমণ গন্তব্য চন্দ্রগিরি হিল। ঢাকার মতো যানজট আছে, রাস্তার হাল আরও খারাপ কাঠমান্ডুর। দিনভর বেশ তাপ। তবে শেষরাতে গা কিছুটা শিন শিন করে। সূর্যদেবের ছোঁয়ায় উঁচু নিচু পথ পেড়িয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। দূরের পাহাড় চুড়ায় সাদা বরফের আনাগোনা আমাদের মুগ্ধ করছিলো। চলতি পথে আমাদের ঢাকা শহরের মত যানজটে মন অতিষ্ঠ হবার জোগাড়। সকালের ঠাণ্ডার প্রকোপ দেখে এর মোকাবেলার লক্ষে কয়েকটি ঠাণ্ডার কাপড় পরেছি বৈকি। কিন্তু এবার ঘেমে উঠছি বারবার। তখনই অভিনব দাদা বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করো। ঠান্ডায় কাঁপবে।’ কাঠমান্ডু শহর থেকে দেড় ঘণ্টার পথ চন্দ্রগিরি। সেখানেই এত শীত হবে! ঠিক বিশ্বাস হলো না। মেঘেদের দেশে এসে অনেকরই আবদার ছিল মেঘ ছোঁয়ার। স্বল্প সময়ে এভারেস্টের কাছে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।তাই সেই মেঘের ছোঁয়া পেতে অভিনব দার আমাদের নিয়ে চন্দ্রগিরি যাবার প্রয়াস। আমার ভ্রমণ সঙ্গী সানন্দা আগের থেকেই চন্দ্রগিরি হিল এর ট্র্যাভেল ব্লগ দেখিয়ে ছিলো কিন্তু উচ্চতাভীতি আছে আমার, তাই যাব না বলেছিলাম।

শেষ পর্যন্ত ভ্রমণ সঙ্গীর জোরাজুরি তে যেতেই হলো। সবাই মিলে চন্দ্রগিরির পথ ধরলাম। কাঠমান্ডু মূলত একটি উপত্যকা। এর চারপাশ ঘিরে আছে পাহাড়। প্রায় দুই ঘণ্টা মাইক্রোবাসে চেপে নামলাম থানকোট। সেখান থেকে শুরু হলো পাহাড়ি পথ। এরপর পাহাড় কেটে তৈরি শক্ত কংক্রিটের সুদৃশ্য পথ এঁকেবেঁকে গিয়ে থামল চন্দ্রগিরি কেব্‌ল কার স্টেশনে। বিশাল এই এলাকা থেকে নিচের থানকোট শহর স্পষ্ট। একটি পাহাড় ডিঙিয়ে কাঠমান্ডু। সেটা খুব একটা স্পষ্ট না। কিন্তু চন্দ্রগিরিতে এসে তো রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট। কাঁপুনি তো ধরবেই। এত উঁচু পাহাড়ে উঠে আসার পথটাও রোমাঞ্চকর। সময় দিবা দ্বিতীয় প্রহর আমরা এসে পৌঁছালাম চন্দ্রগিরির প্রবেশ পথে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে এগিয়ে যেতে লাগলাম। হিমশীতল বাতাসে একটু পর পর শরীর কেঁপে উঠছিলো। আমাদের মত অনেকেই এসেছেন চন্দ্রগিরি দর্শনে। দেখা পেলাম দর্শনীয় ফোয়ারার। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম কেবল কার এর পানে অনিচ্ছা স্বত্বে কারন আমার উচ্চতায় ভয়! সিঁড়ি বেয়ে উঁচু একটি ভবনে উঠে কেবল কারের মূল স্টেশনে পৌঁছালাম। এর আগে টিকিট কাটতে হলো। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মাথাপিছু টিকিট ১ হাজার ১০০ নেপালি রুপি। ভবনের ভেতরে প্রবেশের পর সহস্রাধিক মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখতে পেলাম। আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অভিনব দাদা বললেন সম্ভবত চন্দ্রগিরি হিলের পৌরাণিক তাৎপর্য বিবেচনা করে নেপাল সরকার চন্দ্রগিরি দর্শনে কেব্‌ল কার নির্মাণ করেন। চন্দ্রগিরির উচ্চতা ৮২৬৮ ফিট। পৌরাণিক যুগে এই উচ্চতা কীভাবে পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের মাথায় ভালেশ্বর মন্দির গড়ে উঠেছিল, সে তথ্য অজ্ঞাত। যেমন অজ্ঞাত মিশরের সুউচ্চ পিরামিডগুলোয় বিশাল বিশাল পাথর স্থাপন। সে যাই হোক, কেব্‌ল কারের যাত্রাটি মোটামুটি ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। পাহাড়ের উচ্চতায় যেতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট, সেটি আবার নির্ভর করে বাতাসের গতির ওপর। কেব্‌ল কার থেকে কাঠমান্ডু উপত্যকা, প্রকৃতিক দৃশ্য ও অন্নপূর্ণা থেকে এভারেস্ট পর্যন্ত হিমালয় পর্বতমালার চমৎকার দৃশ্য অবলোকন করা যায়। কেব্‌লওয়ে সিস্টেমে ৩৪টি গন্ডোলা রয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় ১০০০ জন যাত্রী বহনে সক্ষম। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর আমরা উঠে বসলাম কেবল কারে। কারের দুই পাশে মুখোমুখি আমরা মোট ছয়জন বসে আছি। যাঁরা নিচের দৃশ্য দেখতে চান না, তাঁরা উল্টো দিকে বসলেন। সরসর করে উঠছে কেব্‌ল কার। যত ওপরে উঠছি, নিচের শহর তত ছোট হয়ে যাচ্ছে। নিচে ঘন সবুজ বন কালচে হচ্ছে। খানিকটা উঠেছি, এরই মধ্যে কোত্থেকে এক দল মেঘ এসে লাগল কারে, গায়ে। ভিজিয়ে দিয়ে গেল গ্লাস। মেঘের ছোঁয়ায় বিন্দু বিন্দু জলকণা জমে আছে সেখানে। আমাদের গায়ে লাগল হিমেল পরশ। একটু ঠান্ডা লাগছে। আমি নিচের দিকে তাকাতেই পিলে চমকে উঠলো । আমার অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। অন্য দিকে কেব্‌ল কারের যাত্রীদের মধ্যে এখন শুধু ‘ওয়াহ’ ‘কী সুন্দর’ ‘বাহ’ ধনি। মাঝেমধ্যে একটি দুটি কারের চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কিছু দূর উঠে নিচে শুধু মেঘের খেলা চোখে পড়ল। এখন বনও অদৃশ্য। কালচে মেঘের চাদর ঢেকে দিয়েছে সবুজ। ঠান্ডা আরও বাড়ছে। মেঘের খেলা দেখতে দেখতে, ভয়মিশ্রিত তীব্র ।

5 1 vote
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments